নবম সপ্তাহ থেকে আপনার শরীরের ভ্রুনটি ধীরে ধীরে মানবশিশুর রুপ নিতে থাকে কারণ এই সময় তার চেহারা ধীরে ধীরে গঠিত হতে থাকে। ভ্রুন এর লেজটি এসময় মিলিয়ে যায়।
নবম সপ্তাহের অবস্থান গর্ভাবস্থার তৃতীয় মাসে কিংবা নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ২ মাস শেষ হয়েছে।
গর্ভাবস্থার নবম সপ্তাহে গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি
এখন ভ্রূণের আকার একটি ছোট জলপাইয়ের সমান এবং মাথা থেকে তলা পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২.৩ সে.মি এবং ওজন প্রায় ২ গ্রাম (.০৭ আউন্স) ।
এসময় মুখমণ্ডল তৈরি হতে শুরু করে এবং খুব ছোট আকারে জিহ্বাটি আকৃতি লাভ করতে থাকে।ভ্রূণের জিহ্বাতে এই সময় থেকেই কিছু ছোট স্বাদগ্রন্থি বা টেস্ট বাড তৈরি হয়।
ভ্রূণের কানগুলোর ভেতর এবং বাইরের আলাদা কাঠামো দেখা যেতে পারে এবং অন্তঃকর্ণে যে বিশেষ তরল থাকে তা জমা হতে শুরু করেছে। এই বিশেষ তরলটিই শারীরিক ভারসাম্যের বোধ তৈরি করে।
এরমধ্যে চোখগুলো কিছুটা বড় এবং স্পষ্ট হয়ে উঠে এবং নিজস্ব বর্ণ ধারণ করে।
ভ্রূণের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক, ফুসফুস, কিডনি এবং পরিপাকতন্ত্রের গঠন এখনো চলমান। ভ্রূণের হৃদপিণ্ডের চারটি প্রকোষ্ঠ এ সময়ের মধ্যে তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা।
গর্ভাবস্থার ৯ সপ্তাহ নাগাদ যদি আলট্রাসাউন্ড করা হয়ে থাকে তবে এ সময় বাচ্চার হার্টবিট বোঝা যেতে পারে। ডপলার মেশিনে ১০ সপ্তাহ নাগাদ বাচ্চার হার্টবিট বোঝা যেতে পারে তবে সাধারণত ১২ সপ্তাহে তা ঠিকমতো বোঝা যায়।
যদিও ১৫ সপ্তাহের আগে আলট্রাসাউন্ড এ শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ সম্ভব নয় কিন্তু এ সপ্তাহ থেকেই তার যৌনাঙ্গ রূপ নিতে থাকে।
শিশুর গোড়ালি ও কব্জি এখন অনেকটাই বিকশিত হয়ে যায়। তার হাত ও পায়ের আঙ্গুল অনেকটাই পরিপূর্ণ থাকে কিন্তু এগুলো এখনো হাসের পায়ের মত একটির সাথে আরেকটি লাগানো থাকে।
এতদিন আপনার ডিম্বাশয় থেকেই শিশুর বেড়ে উঠার প্রয়োজনীয় প্রজেস্টেরন হরমোন উৎপন্ন হতো। কিন্তু এ সপ্তাহে আপনার প্লাসেন্টা (placenta) মোটামুটি কর্মক্ষম এবং এখন প্লাসেন্টাই হরমোন উৎপন্ন করে।
সবকিছু ঠিক থাকলে এ সময় আপনার শিশুটিকে একটি ছোট মানবশিশু বলে চেনা যাবে এবং এর পর থেকে শিশুর ওজনও দ্রুত বাড়তে থাকবে।
নবম সপ্তাহে মায়ের শারীরিক পরিবর্তন
প্রত্যেকটি মা ই আলাদা। অনেক মায়েদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারেও পেট তেমন একটা বাড়ে না আবার কারো কারো প্রথম ট্রাইমেস্টারেই পেট বোঝা যেতে পারে।
আবার কিছু কিছু মায়দের পজিটিভ প্রেগন্যান্সি টেস্ট পাওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পেট ফোলা ভাব থাকতে পারে। তবে এর কারণ ভিন্ন হতে পারে। যদি অনেক আগেই পেট বাড়তে থাকে তবে এর কারণ হতে পারে নিম্নরূপ-
- পেট ফোলা ভাব
- পেটে গ্যাস
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- অল্প কিছু ক্ষেত্রে যমজ সন্তান থাকলে আগেই পেট বড় হতে পারে।
প্রথমবার মা হতে যাওয়া মহিলাদের ক্ষেত্রে সাধারণত ১২-১৬ সপ্তাহের মাঝে পেট বাড়তে পারে। তবে আগে গর্ভধারণ করা মহিলাদের ক্ষেত্রে তা আরও আগে শুরু হতে পারে। কারণ তাদের জরায়ু এবং পেটের পেশী আগের গর্ভধারণের কারণে প্রসারিত থাকে।
নবম সপ্তাহে মায়েরা গর্ভধারণের যেসব উপসর্গের মুখোমুখি হতে পারে তা হল-
ক্লান্ত লাগা – আপনার খুব ক্লান্ত এবং দুর্বল লাগতে পারে। গর্ভাবস্থার মাঝামাঝি সময়ে এই উপসর্গ একটু কমে আসলেও আবার শেষের দিকে এই অবসাদ ও ক্লান্তি ফিরে আসতে পারে। হরমোনের পরিবর্তন, বিশেষ করে প্রজেস্টরন বৃদ্ধি পাওয়া এর অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
যৌনাঙ্গে প্রদাহ এবং স্রাব – গর্ভকালীন হরমোন গুলো যে অবস্থা সৃষ্টি করে তাতে বিশেষ ধরনের ছত্রাকের আক্রমণে যোনি প্রদাহ (vaginal thrush) হতে পারে। আপনার যোনি পথে তরল নির্গত হবার মাত্রা (vaginal discharge) বেড়ে যেতে পারে, কিন্তু হলুদ বর্ণের অথবা দুর্গন্ধযুক্ত না হলে এতে উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। তবে যে কোন ধরনের নির্গমন প্রসঙ্গে আপনার ডাক্তারকে অবহিত করুন।
স্তনে পরিবর্তন – Nipple আকৃতি বাড়তে পারে এবং গাঁড় বর্ণ ধারন করতে পারে। nipple এর আশেপাশে (areola) ছোট ছোট ব্রন হতে পারে। এগুল Montgomery’s Tubercles নামে পরিচিত এবং স্তনকে breast feeding এর জন্য প্রস্তুত করতে সাহায্য করে। এগুলোকে চাপবেন না বা দূর করার চেষ্টা করবেন না। মুখের ব্রন এর মত এগুলো অপ্রয়োজনীয় নয়।
ব্রণ – হরমোনের কারনে মুখেও ব্রন এর উপস্থিতি বাড়তে পারে। কিন্তু ব্রণে কিছু মাখার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করবেন। কিছু কিছু ক্রীম গর্ভধারণের সময় ব্যাবহার না করায় ভাল।
নাক বন্ধ লাগা বা প্রেগন্যান্সি রাইনাইটিস – ঠাণ্ডা লাগার কারণে যখন আমাদের নাক বন্ধ থাকে, এই ব্যাপারটা কিছুটা ঠিক তেমনই। তবে এমন অবস্থা গর্ভকালীন সময়ে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকে।
শতকরা ত্রিশ শতাংশ নারীর ক্ষেত্রে এই নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া সমস্যাটি দেখা যায় এবং এই সমস্যা গর্ভধারণের দ্বিতীয় মাস থেকে শুরু হলেও এটা প্রায় সময়েই পরবর্তীতে আরো তীব্র আকার ধারণ করে। সন্তান প্রসবের পরপরই এই সমস্যা কিছুটা প্রশমিত হয় এবং প্রসবের পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যেই একেবারে ঠিক হয়ে যায়।
পাইকা বা অখাদ্য খাওয়ার ইচ্ছা – গর্ভবতী নারীদের আচারসহ নানা জাতীয় খাদ্য খাওয়ার আকাঙ্খা জাগে। আবার কারো কারো শোনা যায় বরফ, মাটি, ছাই ইত্যাদি অখাদ্য খাওয়ারও তীব্র ইচ্ছা তৈরি হয়। এই প্রবণতাকে পাইকা (Pica) বলে।
যদি পাইকা চরম আকার ধারণ করে, তাহলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। তিনি প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকলে তা খুঁজে বের করবেন এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেবেন। আপনার আয়রন বা অন্য কিছুর ঘাটতি আছে কিনা তা জেনে নিন। এসবের ঘাটতি পূরণ হলে অনেক সময় এসব ইচ্ছা ঠিক হয়ে যায়।
খাবারে অনীহা –এটা অস্বাভাবিক নয় যে কিছু কিছু খাবারের প্রতি আপনি অনীহা বোধ করবেন কিংবা আপনার রুচি কমে যাবে। যদিও এর কারণ নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি, এটা হয়ত আপনার দেহে দ্রুত এস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণ বৃদ্ধির একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এছাড়াও আপনি হয়ত দেখতে পাবেন যে কিছু বিশেষ খাদ্য যা আপনি মজা করে খেতেন তা হঠাৎ করে আপনার কাছে একেবারেই অসহ্য লাগছে।
গর্ভকালীন হরমোন আরো অনেক ভাবেই আপনাকে সমস্যায় ফেলতে পারে। অনেক মহিলাই কষ্টকর মাথাব্যথা এবং পিঠের সমস্যায় ভোগেন ।
আপনার শরীরের শিরা গুলা অপেক্ষাকৃত বেশী দৃশ্যমান হতে পারে বিশেষ করে স্তন এর আশেপাশে এবং পায়ে। বেশিক্ষন দাড়িয়ে থাকলে পায়ে ব্যাথা হতে পারে। বিস্রামের সময় পা উপরে তুলে রাখার চেষ্টা করুন।
সকালবেলা বা রাতে বমি ভাব ও মাথাব্যথার প্রকোপ বেড়ে যেতে পারে।এই সময় মুড সুইং খুবই সাধারন ঘটনা।অল্প কিছুতেই উদ্বিগ্ন বা রেগে যেতে পারেন অথবা বিষন্নতায় ভুগতে পারেন।
অনেক মা এসময় কিছুটা অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন এই ভেবে যে তার হয়ত গর্ভের শিশুর জন্য সঠিক ভাবে মাতৃত্ব জাগছে না। অনেকেই ভাবেন এটা হয়ত শিশু বুঝতে পারবে। ভয় পাবেন না, এটা স্বাভাবিক। গর্ভের শিশু কিছুই বুঝতে পারবেনা।
এসব ছাড়াও গর্ভকালীন সময়ে মায়েরা আরও অনেক ধরণের উপসর্গ অনুভব করতে পারেন। গর্ভকালীন সব ধরণের উপসর্গ নিয়ে জানতে আমাদের আর্টিকেলটি পড়ুন।
এ সপ্তাহে করনীয়
শারীরিক ভাবে কর্মব্যস্ত থাকলে গর্ভাবস্থায় সুস্থ থাকবেন এবং শিশু জন্মের পরও তা আপনাকে দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করবে। তবে তা যেন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে না হয় সে দিকে খেয়াল রাখবেন এবং এ সময় শরীর চর্চার ক্ষেত্রে কোনটা করবেন আর কোনটা করবেন না তা জেনে নিন ।
যদিও এখনো শুরুর দিকের সময়, তবু আপনি কীভাবে বসছেন বা কী ধরনের কাজ করছেন তার উপর নির্ভর করবে আপনার শিশু সহজ প্রসবের উপযোগী অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে কি না।
এখন থেকেই এ নিয়ে ভাবতে থাকুন যাতে করে আপনি ভাল অভ্যাস রপ্ত করতে পারেন। শরীরচর্চার জন্য কিছু ভাল অভ্যাস রপ্ত করুন।শান্ত থাকার চেষ্টা করুন ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন।এমন কিছু করুন যাতে আপনরে মন ভালো থাকবে এবং হাসি খুশী থাকুন।
আপনার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অন্য সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণে প্রোটিন, ফলিক এসিড ও অয়রন সমৃদ্ধ খাবার যোগ করুন। আপনার উদরে বেড়ে উঠা শিশুর বৃদ্ধির জন্য এই উপাদানগুলো অনেক বেশি প্রয়োজন। গর্ভকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় খাবার ও পুষ্টি সম্পর্কে জেনে নিন।
গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্ন নেয়া খুবই প্রয়োজন৷ এসময় দাঁত পরিষ্কার রাখতে হবে৷ গর্ভাবস্থায় অনেক সময় মাড়ি ফুলে রক্তপাত হয়৷ তাই এ সময়ে মাড়ির যত্ন প্রথম থেকেই নেওয়া উচিত৷ প্রতিদিন সকালে ও রাতে শোয়ার আগে দাঁত ব্রাশ করা প্রয়োজন৷ দাঁত বা মাড়ির কোনও সমস্যা থাকলে দন্ত চিকিত্সকের পরামর্শ নিন৷
প্রথম দিককার সপ্তাহগুলোতে যেহেতু গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে, অধিক রক্তপাত, অস্বাভাবিক ডিসচার্জ, তলপেটে মাত্রাতিরিক্ত ব্যাথা- এই ধরনের যে কোন শারীরিক সমস্যার জন্য তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
গবেষণার দেখা গেছে প্রায় ২০ ভাগ গর্ভধারণের ক্ষেত্রে গর্ভপাত ঘটে। ভ্রুণের ক্রোমসোমের যেকোন অস্বাভাবিকতা থাকলে, সেটা মিসক্যারেজ হতে পারে। এখানে মায়ের কিছু করার নেই। এই সব দিকগুলো মাথায় রাখুন।
একটোপিক প্রেগনেন্সি সম্পর্কে জেনে নিন।