গর্ভাবস্থার অষ্টম সপ্তাহ চললেও গর্ভের শিশু এখন তার বিকাশের প্রায় ষষ্ঠ সপ্তাহে। অর্থাৎ কন্সেপশনের (গর্ভসঞ্চার) পর ছয় সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে (সাধারণত পিরিয়ড শুরুর দুই সপ্তাহ পর গর্ভসঞ্চার হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়) । এই সপ্তাহ ভ্রূণের বৃদ্ধির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
অষ্টম সপ্তাহের অবস্থান গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় মাসে কিংবা নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ১ মাস তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়েছে।
গর্ভাবস্থার অষ্টম সপ্তাহে গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি
এসময় শিশুর আকার একটি কিডনি বীনের সমান হয় (১.৬ সে.মি. বা এক ইঞ্চির চারভাগের তিন ভাগ) এবং ভ্রূণের আকার প্রতিদিন প্রায় এক মি.মি. হারে এর আকার বাড়ছে। এসময় ভ্রূণের আনুমানিক ওজন থাকে .0৪ আউন্স বা ১ গ্রাম।
ভ্রূণের চোখের ও কানের গঠন এর মধ্যেই শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। হাত এবং পায়ের ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুলের বিকাশ হচ্ছে যেগুলো এখন অনেকটা হাঁসের পায়ের মতো দেখায়। ভ্রূণটি এ পর্যায়ে মায়ের গর্ভে ভেসে বেড়াতে শুরু করেছে ।
ভ্রূণের হাতদুটো কব্জির কাছ থেকে ভাঁজ হয়ে হৃদপিণ্ডের কাছে গুটিয়ে থাকে। ভ্রূণের পাও লম্বা হতে থাকে এবং শরীরের সামনের দিকে দুটো পা প্রসারিত অবস্থায় থাকে। পায়ের অন্যান্য অংশগুলো, যেমন- হাঁটু, উরু, গোড়ালি এবং আঙ্গুল পুরোপুরি বিকশিত হতে আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।
ভ্রূণের শ্বাসতন্ত্রের গঠন সাধারণত এই সময় শুরু হয়ে যায় এবং শ্বাসনালী গলা থেকে শুরু করে তার বিকশিত হতে থাকা লাংস পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।
এ সময় শিশুর নার্ভগুলো শাখা প্রশাখা বিস্তার করতে থাকে। এগুলো ভ্রূণের মাংসপেশি ও অন্যান্য টিস্যুর সাথে, বিভিন্ন অঙ্গ যেমন – চোখ, কান ইত্যাদির সাথে এবং একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত হতে থাকে।
এসময় ভ্রূণ অ্যাম্নিওটিক স্যাকের ভেতরে থাকে এবং প্লাসেন্টা গঠিত হতে থাকে। প্লাসেন্টা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে মায়ের জরায়ুর দেয়ালে আটকে যেতে থাকে।
এর মধ্যে ভ্রূণের পেছনের লেজের মত অংশটি প্রায় মিলিয়ে যাওয়ার কথা এবং এ সময় থেকেই ভ্রূণটি আস্তে আস্তে মানব শরীরের আকার নিতে শুরু করে।
ভ্রূণের হৃদপিণ্ড এ সময় দুটি চেম্বারে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে এবং হৃদস্পন্দন থাকে মিনিটে ১৫০ বার।
গর্ভাবস্থার ৮ সপ্তাহ নাগাদ যদি আলট্রাসাউন্ড করা হয়ে থাকে তবে এ সময় বাচ্চার হার্টবিট বোঝা যেতে পারে। ডপলার মেশিনে ১০ সপ্তাহ নাগাদ বাচ্চার হার্টবিট বোঝা যেতে পারে তবে সাধারণত ১২ সপ্তাহে তা ঠিকমতো বোঝা যায়।
কত তাড়াতাড়ি বাচ্চার হার্টবিট মেশিনে ধরা পড়বে তা নির্ভর করে মায়ের জরায়ুতে বাচ্চার অবস্থান, প্লাসেন্টার অবস্থান এবং মায়ের ওজনের উপর।
অষ্টম সপ্তাহে মায়ের শারীরিক পরিবর্তন
গর্ভাবস্থার অষ্টম সপ্তাহে মায়ের শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করে। স্বাভাবিক অবস্থায় আকারে ছোট থাকা জরায়ুটি বাড়ন্ত ভ্রুণটিকে জায়গা করে দিতে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। এ সপ্তাহে এটি প্রায় একটা লেবুর সমান হয়।
মায়েরা গর্ভধারণের যেসব উপসর্গ এই সময় থেকেই টের পেতে পারেন-
বমি বমি ভাব বা মর্নিং সিকনেস – গর্ভধারণের ৬ সপ্তাহ সময় থেকে সাধারণত মর্নিং সিকনেস বা বমি বমি ভাব দেখা দেয়। কিন্তু এটা কখনো কখানো ৪ সপ্তাহ থেকেও শুরু হতে দেখা যায়। পরবর্তী এক মাস ধরে সমস্যাটা আরো বেশী প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।
তবে যদি অতিরিক্ত বমি হতে থাকে এবং পানিশূন্যতা ও ওজন কমে যাওয়ার লক্ষন দেখা দেয় তবে ডাক্তারকে জানানো উচিত। এগুলো হাইপারমেসিস গ্রাভিডেরামের লক্ষণ হতে পারে। হাইপারমেসিস গ্রাভিডেরাম হলো মর্নিং সিকনেসের তীব্র রূপ যার ফলে প্রচুর বমি ও বমি ভাব হতে পারে।
স্তনে পরিবর্তন – গর্ভাবস্থায় প্রাকৃতিক কারনেই স্তনের আকৃতিগত পরিবর্তন দেখা দেয়। ৬-৮ সপ্তাহের দিকে স্তনের আকার বৃদ্ধি পাওয়া শুরু হতে পারে যা পুরো গর্ভকালীন সময় ধরে চলে।এসময় স্তনের স্নেহ গ্রন্থি গুলো ক্রমশ পুরু হতে থাকে এবং দুগ্ধ গ্রন্থিতেও অতিরিক্ত রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়। কিছুটা অস্বস্তিদায়ক হলেও এই পরিবর্তনগুলো তাৎপর্যপূর্ণ। এর ফলে শিশুকে স্তন্যপান করানোর জন্য মায়ের শরীর প্রস্তুত হয়ে ওঠে।
স্তনে রক্ত সঞ্চালণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ভেরিকোস (Varicose) নামের শিরা এর চারিদিকে গড়ে উঠতে থাকে। অনেকে ত্বকের উপর থেকে এটা অনুভব করতে পারেন। প্রথম কয়েক মাস পর স্তনবৃন্তের চারদিকের কালো অংশ অর্থাৎ এরিওলা তুলনামূলকভাবে বড় হতে থাকে ।
ক্লান্ত লাগা – গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে অবসাদ বা ক্লান্তি বোধ করা খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। গর্ভাবস্থার মাঝামাঝি সময়ে এই উপসর্গ একটু কমে আসলেও আবার শেষের দিকে এই অবসাদ ও ক্লান্তি ফিরে আসতে পারে। হরমোনের পরিবর্তন, বিশেষ করে প্রজেস্টরন বৃদ্ধি পাওয়া এর অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
ঘন ঘন পস্রাবের বেগ পাওয়া – গর্ভাবস্থার একটা স্বাভাবিক ঘটনা হচ্ছে বার বার টয়লেটে যাওয়া। প্রথম ও শেষ তিন মাসে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসা খুব সাধারণ ঘটনা। এটি গর্ভাবস্থার প্রথমদিকের লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং এটি হরমোনের পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকে।
মুড সুইং– এই সপ্তাহে গর্ভবতী মায়ের আচরণগত কিছু পরির্বতন আসতে পারে। মা কখনো হয়ত আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতে পারেন আবার কখনো উৎফুল্ল হয়ে উঠতে পারেন।কিংবা গর্ভধারণের লক্ষনগুলো নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগতে পারেন।
অবসাদ, মানসিক চাপ এবং শরীরের বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তনের কারণে গর্ভকালীন সময়ে মুড সুইং খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। আবার কিছু মায়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত উদ্বেগ বা anxiety কিংবা গর্ভকালীন হতাশা লক্ষ্য করা যায়।
স্পটিং বা ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ – স্পটিং বা ভ্যাজিনাল ডিসচার্জ এ সময়টাতে স্বাভাবিক যা প্রায় চার ভাগের একভাগ মায়েদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। তবে ডিসচার্জ অতিরিক্ত হলে কিংবা রক্তপাত বেশি হলে এবং সাথে ব্যাথা অনুভব করলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। কারণ এটা মিসক্যারেজ বা এক্টপিক প্রেগনান্সির লক্ষন ও হতে পারে।
মাথা ব্যাথা – কিছু কিছু মায়েদের মাথা ব্যাথা থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে হুটহাট ওষুধ না খেয়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া উচিত। প্রচুর পরিমানে পানি খাওয়া, গরম পানিতে গোসল বা মাথা ম্যাসাজ এ ক্ষেত্রে উপকারি। এব্যাপারে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে নিন।
এসব ছাড়াও গর্ভকালীন সময়ে মায়েরা আরও অনেক ধরণের উপসর্গ অনুভব করতে পারেন। গর্ভকালীন সব ধরণের উপসর্গ নিয়ে জানতে আমাদের আর্টিকেলটি পড়ুন।
এ সপ্তাহে করনীয়
এ সময় যেহেতু গর্ভের সন্তানের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় তাই এখন থেকেই অস্বাস্থ্যকর সব খাবার পরিহার করুন। যেকোনো ধরনের ওষুধের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করুন এবং যেকোনো ওষুধ সেবনের আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন যে সেটি গর্ভাবস্থায় সেবন নিরাপদ কিনা।
রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হলে দুপুরে ঘুমিয়ে তা পুষিয়ে নিন। এসময় ক্লান্ত বোধ করাই স্বাভাবিক এবং এটা মেনে নেয়াই ভাল৷ বিকেলে হঁাটা, শোবার আগে হালকা গরম দুধ খাওয়া বা বই পড়া ইত্যাদিতে উপকার হতে পারে৷ ঘুমের অসুবিধা বেশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন৷
গর্ভে সন্তানের আগমন নিশ্চিত হওয়া মাত্র গর্ভকালীন পরিচর্যা শুরু করতে হবে। গর্ভকালীন পুরো সময় থেকে প্রসবের পর কিছুদিন পর্যন্ত নিয়মিত চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে।
বেশীরভাগ ডাক্তারই আপনার প্রথম সাক্ষাতের দিন ঠিক করবেন আপনার গর্ভধারণের অষ্টম সপ্তাহে। অনেকে এর আগেও আপনাকে দেখতে পারেন যদি আপনার কোন মেডিকেল কন্ডিশন থাকে, পূর্বের গর্ভধারণে কোন সমস্যা থাকে, যোনিপথে রক্তক্ষরণ, পেট ব্যাথা বা অনেক বেশী বমি বমি ভাব বা বমির লক্ষন থাকে।
প্রথম সাক্ষাত অনেকটা দীর্ঘ হতে পারে। তাই লম্বা সময় থাকার প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন। সম্ভব হলে আপনার সঙ্গীকেও সাথে নেয়ার চেষ্টা করবেন। গর্ভধারণের ব্যাপারে যাই মনে আসুক, ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে দ্বিধা বোধ করবেন না। প্রয়োজনে আপনার প্রশ্ন গুলো একটি কাগজে লিখে রাখতে পারেন। যদি মনে করেন কোন বিষয় ডাক্তারকে জানানো জরুরী তবে অবশ্যই জানান।
গর্ভধারণ সম্পর্কিত পড়াশুনা করুন। আজকাল ইন্টারনেটের বদৌলতে সমস্ত কিছু হাতের নাগালের মধ্যে। যত বেশী এই বিষয়ে পড়বেন, তত বেশী নিজের সম্পর্কে আস্থা বাড়বে।
প্রথম দিককার সপ্তাহগুলোতে যেহেতু গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে, অধিক রক্তপাত, অস্বাভাবিক ডিসচার্জ, তলপেটে মাত্রাতিরিক্ত ব্যাথা- এই ধরনের যে কোন শারীরিক সমস্যার জন্য তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
গবেষণার দেখা গেছে প্রায় ২০ ভাগ গর্ভধারণের ক্ষেত্রে গর্ভপাত ঘটে। ভ্রুণের ক্রোমসোমের যেকোন অস্বাভাবিকতা থাকলে, সেটা মিসক্যারেজ হতে পারে। এখানে মায়ের কিছু করার নেই। এই সব দিকগুলো মাথায় রাখুন।
সবার জন্য শুভকামনা।