গর্ভধারণের সপ্তম সপ্তাহ : ভ্রূণের বৃদ্ধি, মায়ের শরীর এবং কিছু টিপস

Spread the love

গর্ভাবস্থার সপ্তম সপ্তাহে গর্ভস্থ শিশু এখনো ভ্রুণ অবস্থায় আছে। আকারে তা একটি কালজামের সমান। তবে এখন এর আকার আগের সপ্তাহের দ্বিগুণ। এর মাথার কাছে নতুন একটি স্ফীতি দেখতে পাবেন যেখানে মিনিটে শত শত কোষ বেড়ে চলেছে যা মস্তিষ্কে পরিণত হবে।

সপ্তম সপ্তাহের অবস্থান গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় মাসে কিংবা নির্দিষ্টভাবে বললে ১ মাস দুই সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়েছে।

বিজ্ঞাপণ

গর্ভাবস্থার সপ্তম সপ্তাহে গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি

এই সময় ভ্রূণের মস্তিষ্ক খুব দ্রুত বিকশিত হয় তাই ভ্রূণের মাথার আকার শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় বড় হয়। এই সময় প্রতি মিনিটে প্রায় ১০০টি নূতন ব্রেইন সেল তৈরি হয়।

আপনার গর্ভের ভ্রুনটি আস্তে আস্তে ছোট্ট একজন মানুষে পরিনত হচ্ছে। এ সময়ে হাড়ের গঠন শুরু হয়।

লম্বায় আপনার গর্ভের ভ্রূণটি এখন প্রায় ১ সেন্টিমিটার বা ১০ মিলিমিটার। গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত শিশুর পা তার পেটের সাথে গুটানো অবস্থায় থাকে। তাই এ সময় পর্যন্ত ভ্রুনের উচ্চতা পরিমাপের জন্য ভ্রুনের উপরের অংশ থেকে নিচ পর্যন্ত উচ্চতা নেয়া হয়। এটিকে ক্রাউন রাম্প লেংথ (crown-rump length) বলে।

চোখের যে অংশগুলো তাকে দেখতে সাহায্য করবে, যেমন- কর্নিয়া, আইরিস, পিউপিল, লেন্স এবং রেটিনার গঠন সপ্তম সপ্তাহেই শুরু হয়ে যায়। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেগুলো প্রায় পুরোপুরি গঠিত হয়ে যাবে।

ভ্রূণের পাকস্থলী এবং অন্ননালীর (esophagus) গঠন শুরু হয়ে যায়। অন্ননালীর মাধ্যমে খাবার আমাদের মুখ থেকে পাকস্থলী পর্যন্ত পৌঁছায়। ভ্রূণের যকৃত এবং অগ্নাশয়ের গঠন এই সপ্তাহে শুরু হয়।

বাচ্চার কিডনির গঠন শুরু হয়েছে কিন্তু তা এখন কর্মক্ষম নয়। যৌনাঙ্গও আস্তে আস্তে বিকশিত হতে থাকে কিন্তু এখনই আলট্রাসাউন্ড এ তা ধরা পরবেনা।

মাথার পাশে টোলের মত দেখতে ছোট গর্তমত অংশগুলোতে কান, আর পুরু স্থানগুলোতে চোখ হবে। এছাড়া শরীরের নানা স্থানে আরো যে স্ফীতি গুলো দেখতে পাচ্ছেন সেগুলো মাংশপেশী ও হাড় হয়ে বেড়ে উঠবে।

এছাড়া আরো কয়েকটি ফোলা অংশ দেখা যাবে, যেগুলোকে বলা হয় মুকুলিত অঙ্গ (limb buds) – এগুলোতে ধীরে ধীরে তরনাস্থির গঠন শুরু হবে যা পরবর্তীতে হাত ও পায়ের হাড়ে পরিণত হয়। শরীরে অন্যান্য অঙ্গ দ্রুত বেড়ে ওঠার সাথে সাথে পেছনের লেজের মত অংশটি আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকবে।

এই সময় থেকেই ভ্রূণের আম্বিলিকার কর্ডের গঠন শুরু হতে পারে। এটি ভ্রূণকে প্লাসেন্টার সাথে সংযুক্ত করে যার মাধ্যমে অক্সিজেন ও পুষ্টি শিশুর শরীরে যায় এবং বর্জ্য পদার্থ শিশুর শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।

সপ্তম সপ্তাহে মায়ের শারীরিক পরিবর্তন

গর্ভাবস্থার সপ্তম সপ্তাহে যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে তা হল-

বমি বমি ভাব বা মর্নিং সিকনেস – সাধারনত দিনের শুরুতে বমি বমি ভাব অনুভব করতে পারেন। এটি গর্ভ ধারনের প্রাথমিক লক্ষন হিসেবে বলা যেতে পারে। গর্ভ ধারন কালে দিনের যে কোন সময়ে এই ধরনের অনুভূতি হতে পারে। গর্ভধারণের ৬ সপ্তাহ সময় থেকে সাধারণত মর্নিং সিকনেস বা বমি বমি ভাব দেখা দেয়। কিন্তু এটা কখনো কখানো ৪ সপ্তাহ থেকেও শুরু হতে দেখা যায়।

গন্ধপ্রবনতা – গর্ভবতী মায়েরা এই সময়ে কিছু খেতে পারেন না। এমন কি তারা কোন খাবারের গন্ধ ও সহ্য করতে পারেন না। আগে যেসব গন্ধ ভালো লাগতোনা তা হয়তো এ সময় আরও প্রকট হয়ে ওঠে কিন্তু যেসব গন্ধ আগে পছন্দ করতেন তাতেও হয়তো আপনার নাক কুঁচকে যাবে। সব চাইতে অবাক করা বিষয় হলো আপনি হয়তো আপনার সঙ্গীর গায়ের গন্ধও হয়তো সহ্য করতে পারবেন না।

ঘন ঘন পস্রাবের বেগ পাওয়া – গর্ভকালীন সময়ে জরায়ু আকারে বৃদ্ধি পায়। আকারে বৃদ্ধি প্রাপ্ত এই জরায়ু মুত্র থলির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। যে কারনে মুত্র থলি পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই বার বার প্রস্রাব পেতে থাকে প্রথম ও শেষ তিন মাসে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসা খুব সাধারণ ঘটনা।

সাদা স্রাব – গর্ভাবস্থায় হরমোন ইস্ট্রোজেন ও রক্ত সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার জন্য কোন কোন সময় সাদা স্রাব যেতে পারে। ঢিলেঢালা পোষাক ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। সাদা শ্রাবের সাথে যদি দুর্গন্ধ থাকে বা চুলকানি হয় তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

মুড সুইং এই সপ্তাহে গর্ভবতী মায়ের আচরণগত কিছু পরির্বতন আসতে পারে। মা কখনো হয়ত আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতে পারেন আবার কখনো উৎফুল্ল হয়ে উঠতে পারেন।কিংবা গর্ভধারণের লক্ষনগুলো নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগতে পারেন।

এই ধরনের পরিবর্তনের সময়ে একেকজনের মধ্যে একেক ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। অনেক মা এসময় অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হতে পারেন এবং গর্ভধারণের কারণে হওয়া বিভিন্ন পরিবর্তনের প্রতি ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত আবেগ প্রকাশ করতে পারেন।

বিজ্ঞাপণ

স্পটিং স্পটিং এ সময়টাতে স্বাভাবিক যা প্রায় চার ভাগের একভাগ মায়েদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। তবে তা যদি বেশী হয় এবং সাথে ব্যাথা অনুভব করেন তাহলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। কারণ এটা মিসক্যারেজ বা এক্টপিক প্রেগনান্সির লক্ষন ও হতে পারে।

এছাড়াও স্তন আগের চাইতে বেশী sensitive হয়ে উঠতে পারে। এবং আকার বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রজেস্টেরন হরমোন এর অতিরিক্ত নিঃসরণের কারনে এই সময় গর্ভবতী মায়েরা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগতে পারেন অথবা বুকে জ্বালা পোড়া ভাব হতে পারে।

হরমোনের মাত্রা এবং গর্ভকালীন উদ্বেগ বেড়ে যাবার ফলে এ সময়ে আপনি নিদ্রাহীনতায় ভুগতে পারেন এবং আপনার স্বপ্নগুলোকেও জীবন্ত মনে হতে পারে। এভাবে ঘুমের অভাব এবং বাড়তি মানসিক চাপ আপনাকে ক্লান্ত করে দিতে পারে, তবে গর্ভকালীন সময়ের প্রথম তিন মাস পেরিয়ে গেলে আপনার অবস্থার উন্নতি হতে পারে।

তবে মনে রাখা দরকার এ সময় মা যদি তার মধ্যে কোন পরিবর্তন লক্ষণ না করে তাহলে খুব ঘাবড়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই। সবাই যে গর্ভাবস্থায় সবধরনের লক্ষণ অনুভব করবেন ব্যাপারটা এমন না। কেউ কেউ গর্ভাবস্থায় খুব বেশি শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন অনুভব নাও করতে পারেন।

গর্ভাবস্থার এ সপ্তাহে করনীয়

আপনার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অন্য সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণে প্রোটিন, ফলিক এসিড ও অয়রন সমৃদ্ধ খাবার যোগ করুন। আপনার উদরে বেড়ে উঠা শিশুর বৃদ্ধির জন্য এই উপাদানগুলো অনেক বেশি প্রয়োজন।

কোষ্ঠকাঠিন্য যেন না হয় সে জন্য প্রচুর পানি পান করতে হবে। দিনে অন্তত আট গ্লাস পানি পান করতে হবে। আঁশ আছে এ রকম খাবার, যেমন- শাকসবজি, ফলমূল, বিচিজাতীয় খাবার, ডাল, আটা ইত্যাদি খেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দূর করার জন্য কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না।

এসিডিটি বা বুকজ্বলা হলেও অল্প অল্প করে ঘন ঘন খাবার খেতে হবে। তৈলাক্ত খাবার, ভাজাপোড়া ও বেশি মসলাযুক্ত খাবার কম খান। একসঙ্গে বেশি খাবার না খেলেও উপকার পাওয়া যায়। খাওয়ার সময় পানি কম খান। দুইবেলা খাবারের মধ্যবর্তী সময়ে বেশি বেশি পানি পান করতে হবে। খাওয়ার পরপরই উপুড় হওয়া বা বিছানায় শোয়া উচিত নয়।

বিজ্ঞাপণ

গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্ন নেয়া খুবই প্রয়োজন৷ এসময় দঁাত পরিষ্কার রাখতে হবে৷ গর্ভাবস্থায় অনেক সময় মাড়ি ফুলে রক্তপাত হয়৷ তাই এ সময়ে মাড়ির যত্ন প্রথম থেকেই নেওয়া উচিত৷ প্রতিদিন সকালে ও রাতে শোয়ার আগে দঁাত ব্রাশ করা প্রয়োজন৷ দাঁত বা মাড়ির কোনও সমস্যা থাকলে দন্ত চিকিত্‌সকের পরামর্শ নিন৷

শরীর সুস্থ রাখা এবং সহজ প্রসবের জন্য গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম করা একান্ত প্রয়োজন৷ নিয়মিত সকল-সন্ধায় এক ঘণ্টা করে হাঁটলে ঠিকমতো রক্ত চলাচলে সহায়তা করে এবং পেশিগুলোও সুস্থ ও সবল অবস্থায় থাকে৷

এ সপ্তাহে গর্ভপাতের সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। পরিসংখান বলে প্রতি পাঁচটি গর্ভধারণের দু’টি এ সপ্তাহে গর্ভপাত হয়ে যায়। গর্ভপাতের লক্ষণগুলোর বিষয়ে সতর্ক হোন এবং কী কী কারণে এমন হতে পারে জেনে নিন। আপনি যখন গর্ভাবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন তখন এমন কিছু হলে তা ভয়াবহ মানসিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।

এর মধ্যে হয়ত ডাক্তারের সাথে প্রথম সাক্ষাতের সময় ঠিক করে ফেলেছেন। ডাক্তারকে কী কী প্রশ্ন করবেন তার একটি তালিকা করে ফেলুন।

সবার জন্য শুভকামনা।

<<গর্ভাবস্থা সপ্তাহ ৬
গর্ভাবস্থা সপ্তাহ ৮>>


Spread the love

Related posts

Leave a Comment