গর্ভধারণের এই সপ্তাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারন এই সময়ে আপনার গর্ভের সন্তানের অনেক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। গর্ভস্থ ভ্রূণ এই সময়ে ৫-৬ মিলিমিটার বা .২৫ ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে। বাচ্চার নাক, মুখ, কান ধীরে ধীরে আকার নিতে শুরু করে।
ষষ্ঠ সপ্তাহের অবস্থান গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় মাসে বা নির্দিষ্ট করে বললে এক মাস এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়েছে।
গর্ভাবস্থার ষষ্ঠ সপ্তাহে গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি
গর্ভাবস্থার ষষ্ঠ সপ্তাহে ভ্রূণের মাথার আকার অপেক্ষাকৃত বড় থাকে এবং তাতে কালো স্পট দেখা যায়, যেখানে বাচ্চার চোখ ও নাকের গঠন শুরু হয়। মাথার দুপাশে একটু চাপা থাকে যেখানে বাচ্চার কান আকার নিতে শুরু করে।
ভ্রূণের দু পাশে কুঁড়ির মত দেখতে মাংসপিণ্ড দেখা যায়, যা আস্তে আস্তে হাত এবং পা এ পরিনত হয়। ভ্রূণের ছোট্ট মুখের ভেতর তার জিহ্বা ও ভোকাল কর্ডের গঠন এসময় শুরু হয়ে যায়।
এ সময় হৃদস্পন্দন থাকে মিনিটে প্রায় ১৬০ বার যা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রায় দ্বিগুণ। গর্ভাবস্থার অষ্টম সপ্তাহে আলট্রাসাউন্ড করলে বাচ্চার হার্টবিট শোনা যেতে পারে। তবে ভ্যাজাইনাল আলট্রা সাউন্ডে পঞ্চম সপ্তাহেও বাচ্চার হার্টবিট শোনা যেতে পারে।
হৃদপিণ্ড গঠিত হওয়ার পর এটি বাচ্চার সারা শরীরে রক্ত প্রবাহ শুরু করে। বাচ্চার আভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গঠনের প্রক্রিয়াও এসময় শুরু হয়ে যায়। এই ছোট্ট শরীরেই নির্দিষ্ট স্থানে যকৃত, কিডনি ও শ্বাসতন্ত্রের গঠন শুরু হয়।
ভ্রূণের দেহ এসময় এখনো কুন্ডলী পাকিয়ে থাকে এবং মাথার আকৃতি এখনো দেহের তুলনায় বড় থাকে। তার মেরুদণ্ড শরীরের বাইরে বিস্তৃত হয়ে লেজের মত কুন্ডুলি পাকিয়ে থাকে যা পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুরপুরি মিলিয়ে যাবে।
ষষ্ঠ সপ্তাহে মায়ের শারীরিক পরিবর্তন
গর্ভাবস্থার এ সময়ে মায়েদের কিছু কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে-
ক্লান্তিবোধ – গর্ভধারণের এ সপ্তাহে অনেক ক্লান্তিবোধ হতে পারে কারন আপনার অনেকটুকু শক্তি বাচ্চার বিকাশে খরচ হয়।যদিও হরমোনের পরিবর্তনের কারণেই মূলত গর্ভকালীন সময়ে অবসাদ ও ক্লান্তি আসে তবু এর অন্যান্য আরো বেশ কিছু কারণও রয়েছে।
যেমন, ঘুমের অনিয়ম। গর্ভাবস্থার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘুমের অনিয়ম হতে পারে। বিশেষ করে এ সময় কোমরে এবং মেরুদণ্ডে হালকা ব্যথা অনুভূত হওয়ার কারণে অথবা বারবার প্রস্রাব করতে উঠতে হওয়ার কারণে আপনার হয়ত তেমন একটা ভালো ঘুম হবে না। আর রাতের বেলায় ভালো ঘুম না হওয়াও দিনভর অবসাদ কিংবা ক্লান্ত লাগার একটি অন্যতম কারণ।
মুড সুইং– এই সপ্তাহে গর্ভবতী মায়ের আচরণগত কিছু পরির্বতন আসতে পারে। মা কখনো হয়ত আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতে পারেন আবার কখনো উৎফুল্ল হয়ে উঠতে পারেন।কিংবা গর্ভধারণের লক্ষনগুলো নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগতে পারেন।
এই ধরনের পরিবর্তনের সময়ে একেকজনের মধ্যে একেক ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। অনেক মা এসময় অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হতে পারেন এবং গর্ভধারণের কারণে হওয়া বিভিন্ন পরিবর্তনের প্রতি ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত আবেগ প্রকাশ করতে পারেন।
আবার কিছু মায়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত উদ্বেগ বা anxiety কিংবা গর্ভকালীন হতাশা লক্ষ্য করা যায়।
ঘন ঘন পস্রাবের বেগ পাওয়া – গর্ভাবস্থার একটা স্বাভাবিক ঘটনা হচ্ছে বার বার টয়লেটে যাওয়া। প্রথম ও শেষ তিন মাসে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসা খুব সাধারণ ঘটনা। সত্যি কথা বলতে, এটি গর্ভাবস্থার প্রথমদিকের লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং এই সময়ে শরীরে হরমোনের যাবতীয় পরিবর্তনের একটি অংশ।
বমি বমি ভাব বা মর্নিং সিকনেস – গর্ভধারণের ৬ সপ্তাহ সময় থেকে সাধারণত মর্নিং সিকনেস বা বমি বমি ভাব দেখা দেয়। কিন্তু এটা কখনো কখানো ৪ সপ্তাহ থেকেও শুরু হতে দেখা যায়। পরবর্তী এক মাস ধরে সমস্যাটা আরো বেশী প্রকট হতে পারে।
স্তনে নরম ভাব এবং সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে – গর্ভাবস্থায় প্রাকৃতিক কারনেই মায়ের স্তনের আকৃতিগত পরিবর্তন দেখা দেয়। এটিই প্রকৃতির নিয়ম। ৬-৮ সপ্তাহের দিকে স্তন এর আকার বৃদ্ধি পাওয়া শুরু হতে পারে যা পুরো গর্ভকালীন সময় ধরে চলে।
স্পটিং বা ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ – স্পটিং বা ভ্যাজিনাল ডিসচার্জ এ সময়টাতে স্বাভাবিক যা প্রায় চার ভাগের একভাগ মায়েদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। তবে তা যদি বেশী হয় এবং সাথে ব্যাথা অনুভব করেন তাহলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। কারণ এটা মিসক্যারেজ বা এক্টপিক প্রেগনান্সির লক্ষন ও হতে পারে।
মাথা ব্যাথা – কিছু কিছু মায়েদের মাথা ব্যাথা থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে হুটহাট ওষুধ না খেয়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া উচিত। প্রচুর পরিমানে পানি খাওয়া, গরম পানিতে গোসল বা মাথা ম্যাসাজ এ ক্ষেত্রে উপাকারি। এব্যাপারে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে নিন।
তবে মনে রাখা দরকার এ সময় মা যদি তার মধ্যে কোন পরিবর্তন লক্ষণ না করে তাহলে খুব ঘাবড়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই। সবাই যে গর্ভাবস্থায় সবধরনের লক্ষণ অনুভব করবেন ব্যাপারটা এমন না। কেউ কেউ গর্ভাবস্থায় খুব বেশি শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন অনুভব নাও করতে পারেন।
এ সপ্তাহে করনীয়
এ সময় যেহেতু গর্ভের সন্তানের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় তাই এখন থেকেই অস্বাস্থ্যকর সব খাবার পরিহার করুন। যেকোনো ধরনের ওষুধের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করুন এবং যেকোনো ওষুধ সেবনের আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন যে সেটি গর্ভাবস্থায় সেবন নিরাপদ কিনা।
National Women’s Health Information Center (NWHIC) এর মতে একজন গর্ভবতী মায়ের দৈনিক .৪ মিলিগ্রাম ফলিক এসিড গ্রহন করা উচিত। অনেক খাবারেই ফলিক এসিড পাওয়া যায়। যেমন – শাকসবজি, ব্রকলি, লেটুস, সাইট্রাস ফল, কলিজা, ডাল, মটরশুঁটি ইত্যাদি।
গর্ভাবস্থায় দৈনিক কমপক্ষে ২-৩ লিটার পানি খাওয়া উচিত। ফ্রেশ জুসও খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মনে রাখা উচিত চিনি সমৃদ্ধ জুসে অনেক ক্যালরি থাকে। কফি, চা বা সোডা জাতীয় পানীয় কম বা একেবারে না খাওয়াই উচিত।
আপনার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অন্য সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণে প্রোটিন, ফলিক এসিড ও অয়রন সমৃদ্ধ খাবার যোগ করুন। মায়ের গর্ভে বেড়ে উঠা শিশুর বৃদ্ধির জন্য এই উপাদানগুলো অনেক বেশি প্রয়োজন।এসময় জাঙ্ক ফুড খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। জাঙ্ক ফুডের চাইতে ফল-মুলের প্রতি আকৃষ্ট হন।অনেক গর্ভবতী মহিলা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে। শাকসব্জি ও ফল-মুল খাবারের মাধ্যমে কোষ্ঠ কাঠিন্য থেকে দুরে থাকার চেষ্টা করুন।
একবেলায় বা একবারে ভরপেট খাবার না খেয়ে ছোট ছোট বিরতিতে অল্প করে খাবার খেতে শুরু করুন, এতে আপনার রুচিও নষ্ট হবে না আর খেতে কিছুটা স্বস্তি পাবেন। দিনে তিন বেলা না খেয়ে ছোট ছোট বিরতিতে ছয়বার বা তাঁর বেশি খাবার খেতে চেষ্টা করুন। এটি গ্যাস, এসিডিটি এবং বমিভাব কমতে সাহায্য করে।
গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শরীরে ভিটামিন ও মিনারেল এর অভাব থাকলে তা শিশুর শরীরেও প্রভাব ফেলবে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে গ্রহণ করতে পারেন অতিরিক্ত মিনারেল এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ ওষুধপত্র। এছাড়া নিশ্চিত হোন আপনি যে ভিটামিন ওষুধ গ্রহণ করছেন সেগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমান ফলিক এসিড রয়েছে।
গর্ভবতী মায়েদের মন সব সময় ভালো থাকলে গর্ভস্থ শিশুর মানসিক বিকাশ সুষ্ঠু হয়। এ সময় পরিবারের সবাইকে গর্ভবতী মাকে মানসিক চাপ থেকে দূরে রাখতে সহায়তা করা উচিত।
এ সময় স্বামীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্ত্রীর সাথে মধুর সম্পর্ক রেখে যথাযথ সহযোগিতা করা তার মূল কাজ।
এসময় যথাসম্ভব আরামদায়ক পোশাক পরুন এবং অতিরিক্ত গরমে যাওয়া ও লম্বা ভ্রমণ পরিহার করুন যথাসম্ভব।
সবার জন্য শুভকামনা।
<<গর্ভাবস্থা সপ্তাহ ৫
গর্ভাবস্থা সপ্তাহ ৭ >>