গর্ভাবস্থার ১৫তম সপ্তাহে গর্ভের ভ্রূণ অনেক ছোট থাকে, কিন্তু তার শারীরিক বিকাশ হতে থাকে খুব দ্রুত। এই সপ্তাহ প্রেগন্যান্সির দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারের দ্বিতীয় সপ্তাহ এবং এ সপ্তাহের অবস্থান গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাসে।
গর্ভধারণের ১৫ সপ্তাহে গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি
এরই মধ্যে ভ্রূণের হাত তার শরীরের প্রায় সমানুপাতিক। তবে এতদিন তার পা তুলনামূলকভাবে শরীরের তুলনায় অনেকটা ছোট থাকলেও এ সপ্তাহ থেকে পাগুলো ভ্রূণের হাতের তুলনায় দ্রুত বাড়তে থাকে।
গর্ভের শিশুটির আকার এই সপ্তাহে একটি আপেলের সাথে তুলনা করা যায়।এ সময় ভ্রূণের উচ্চতা থাকে প্রায় ৩.৯৮ ইঞ্চি বা ১০.১ সেমি এবং এর ওজন হয় আনুমানিক ২.৪৭ আউন্স বা ৭০ গ্রামের মত।
যেহেতু এই সময়ের পর মায়েরা আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে বাচ্চার ওজন ও উচ্চতা জানতে পারেন তাই আমাদের পরামর্শ থাকবে যাতে অন্যের রিপোর্টের সাথে নিজের তুলনা না করেন। গর্ভাবস্থার শুরু দিকে সব ভ্রূণের বৃদ্ধি প্রায় একই রকম থাকে কিন্তু এসময় থেকে প্রতিটি ভ্রূণ তাদের নিজস্ব গতিতে বাড়তে থাকবে। কারও বৃদ্ধি দ্রুত হবে আবার কারোটা একটু ধীরগতির। তবে সব ভ্রূণই একটি নির্দিষ্ট ধারা মেনে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং গর্ভাবস্থার শেষ দিকে গিয়ে বেশিরভাগ ভ্রূণই প্রয়োজনীয় ওজন ও উচ্চতা লাভ করে।
১৫তম সপ্তাহের দিকে এসে গর্ভের ভ্রূণের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক বিকাশের মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। সেগুলো নিম্নরূপঃ
মুখ
এ সময়ের মধ্যে ভ্রূণের টেস্ট বাড বা স্বাদ গ্রন্থি গঠিত হয়ে যায় এবং টেস্ট বাডগুলো স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত হতে থাকে। মস্তিষ্কের সাথে এই সংযোগের মাধ্যমেই আর কিছুদিন পর থেকে ভ্রূণ বিভিন্ন ধরণের স্বাদ বুঝতে শুরু করবে।
মা যে খাবার এবং পানীয় গ্রহণ করে থাকেন সেগুলোর স্বাদ মায়ের রক্তের মাধ্যমে এম্নিওটিক ফ্লুয়িডে প্রবেশ করে। আর ভ্রূণ যখন এই তরল গ্রহন করে তখন সে প্রথমবারের মত স্বাদ অনুভব করা শুরু করে।
কান
ভ্রূণের কানের বাহ্যিক গঠন এখন অনেকটাই বিকশিত এবং তার শ্রবণ যন্ত্রের ছোট ছোট হাঁড়গুলো এসময় গঠিত হতে শুরু করে। এর ফলে সে এসময় থেকেই হালকা শব্দ শুনতে শুরু করে। কিছুদিন পর থেকেই সে মায়ের গলার স্বর, হৃদস্পন্দন এবং পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন শব্দ শুনতে পাবে।
চোখ
ভ্রূণের চোখের পাতা বন্ধ থাকলেও তার চোখগুলো এখন আলোর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠবে। যদি ভ্রূণের অবস্থান অনুযায়ী পেটের ওপর আলো ফেলা হয়, তাহলে সে আলোর উৎস থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে সক্রিয় হবে।
কঙ্কাল
এ সময় পর্যন্ত ভ্রূণের কঙ্কাল ছিল নরম তরুণাস্থি দিয়ে গঠিত। তরুণাস্থি একধরনের নরম হাঁড় যা দিয়ে আমাদের কান এবং নাক গঠিত হয়। গর্ভাবস্থার ১৫ সপ্তাহ থেকে তরুণাস্থিগুলো শক্ত হাঁড়ে পরিণত হতে শুরু করবে। এসময় যদি ভ্রূণের এক্স-রে করা সম্ভব হত তবে তাতে তার কঙ্কালের অবয়ব দেখা যেত।
হাত এবং পা
ভ্রূণটি এ সময় তার হাত পা এবং শরীরের সব জয়েন্ট নাড়াতে পারে। আর কয়েক সপ্তাহ পর থেকে মা ভ্রূণের নড়াচড়া বুঝতে শুরু করতে পারেন। এসময় ভ্রূণটি তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করতে শুরু করতে পারে।
ত্বক
ভ্রূণটির ত্বক এখনো খুবই পাতলা যার উপর দিয়ে তার রক্তনালী এবং ভেতরের হাঁড় স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
আরও আগে থেকেই ভ্রূণের পুরো শরীর জুড়ে ধূসর বর্ণের চুল গজাতে থাকে। এগুলোকে লানুগো বলে। লানুগো মূলত ভ্রূণকে অ্যাম্নিওটিক ফ্লুয়িড থেকে রক্ষা করে এবং তাকে উষ্ণ রাখে। গর্ভধারণের পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে যখন ভ্রূণের দেহে চর্বি জমা হতে শুরু করে তখন থেকে এই লানুগো ঝরে যেতে থাকে কারণ সে সময় ভ্রূণকে উষ্ণ রাখার কাজ তার শরীরের চর্বি করতে শুরু করে। তবে অনেক বাচ্চার জন্মের সময়ও এই লানুগো নিয়ে জন্মাতে পারে। জন্মের কিছুদিনের মধ্যে এগুলো ঝরে পড়ে।
১৫ তম সপ্তাহে মায়ের শারীরিক পরিবর্তন
১৫ তম সপ্তাহের মধ্যে মায়ের জরায়ু পেলভিসের বাইরে উপরের দিকে বাড়তে শুরু করে। আর এই সময় থেকে গর্ভবতী মায়ের পেটের আকার কিছুটা বাড়তে শুরু করতে পারে।
তবে মনে রাখতে হবে প্রত্যেকটি মায়ের শারীরিক গঠন আলাদা। কারো যদি মনে হয় পেটের আকারে কোন পরিবর্তন আসেনি তবে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। মায়ের পেটের আকার কেমন হবে তা অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যেমন- হরমোন, গর্ভাবস্থার আগের ওজন, কততম গর্ভাবস্থা এবং মায়ের পেটের পেশীর ধরণ ইত্যাদি।
গর্ভাবস্থার ১৫ সপ্তাহ থেকে ভ্রূণের ওজন দ্রুত বাড়তে থাকে। তাই এসময় থেকে মায়ের ওজন বৃদ্ধি পাওয়াও স্বাভাবিক । ডাক্তারদের মতে গর্ভধারণের আগে যদি মায়ের বিএমআই বা বডি ম্যাস ইনডেক্স স্বাভাবিক থাকে তবে এর পরবর্তীতে প্রতি সপ্তাহে ১ পাউন্ড করে ওজন বৃদ্ধি পেলে তা স্বাভাবিক। আবার, যদি গর্ভধারণের আগে বিএমআই কম বা বেশি থাকে অথবা যদি প্রথম ট্রাইমেস্টারে মায়ের ওজন খুব বেশি কমে যায় বা বেড়ে যায় তবে তার উপর নির্ভর করে মায়ের ওজন বাড়ানো বা কম বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হবে।
তবে মনে রাখবেন এই ১ পাউন্ড করে ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার হিসেবটা একটি গড়পড়তা হিসেব। মায়ের ওজন যদি কোন সপ্তাহে আধ পাউন্ড বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তী সপ্তাহ দেড় পাউন্ড বাড়ে তবে সেটাও খুব স্বাভাবিক।
গর্ভাবস্থার এ সময় যেসব উপসর্গ বেশি দেখা দিতে পারে তা হল –
চুলকানি
গর্ভাবস্থায় হালকা চুলকানি হওয়া নিয়ে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই চিন্তার কিছু নেই। এটা খুবই স্বাভাবিক। প্রায় ২০ ভাগ গর্ভবতী মহিলার চুলকানির সমস্যা থাকে। এ সময় মায়েদের পেট এবং ব্রেস্টের আশেপাশে চুলকানি বেশী হতে পারে, কারণ দুটো স্থানের চামড়াই এ সময় প্রসারিত হয়। শুষ্ক ত্বক ও হরমোনের পরিবর্তনের কারণেও এ সময় চুলকানি দেখা দিতে পারে।
ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ
এই সময়ে সাদা স্রাব বা লিউকোরিয়া নির্গত হওয়ার পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। গর্ভাবস্থায় এস্ট্রজেন হরমোন এর পরিমান বেড়ে যায় এবং যোনীর আশপাশে এসময় রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি পায় বলেই এমনটা হয়। এই বিষয়টি অস্বস্তিকর হলেও এর বিশেষ উপকারী দিক আছে। এই ডিসচার্জ জরায়ুমুখ এবং জন্মনালীকে বিভিন্ন ধরণের ইনফেকশন থেকে রক্ষা করে এবং যৌনাঙ্গের বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য বজায় রাখে।
তবে দুর্গন্ধযুক্ত, হলুদাভ, বাদামী কিংবা লাল স্রাব দেখা দিলে দ্রুত আপনার গাইনীকে জানান।
নাক বন্ধ লাগা বা প্রেগন্যান্সি রাইনাইটিস
ঠাণ্ডা লাগার কারণে যখন আমাদের নাক বন্ধ থাকে, এই ব্যাপারটা কিছুটা ঠিক তেমনই। তবে এমন অবস্থা গর্ভকালীন সময়ে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকে।
শতকরা ত্রিশ শতাংশ নারীর ক্ষেত্রে এই নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া সমস্যাটি দেখা যায়। এই সমস্যা গর্ভধারণের দ্বিতীয় মাস থেকে শুরু হলেও এটা প্রায় সময়ই পরবর্তীতে আরো তীব্র আকার ধারণ করে। সন্তান প্রসবের পরপরই এই সমস্যা কিছুটা প্রশমিত হয় এবং প্রসবের পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যেই একেবারে ঠিক হয়ে যায়।
নাক থেকে রক্ত পড়া
গর্ভাবস্থায় শরীরে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়। এসময় নাকের ভেতরের রক্তনালীগুলো প্রসারিত হয়ে যায় এবং বর্ধিত রক্তপ্রবাহ নাকের সংবেদনশীল রক্তনালীগুলোর উপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে যার ফলে নালীগুলো সহজে ফেটে যেতে পারে। এই কারণে গর্ভাবস্থায় অনেকে নাক থেকে রক্ত পড়ার সমস্যায় ভুগতে পারেন। প্রায় ২০ ভাগ মহিলাদের এমনটা হতে পারে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত কিছু না হলে এতে ভয়ের কারণ থাকেনা।
অতিরিক্ত বমি বা হাইপারমেসিস গ্রাভিডেরাম
অনেক মহিলাই গর্ভাবস্থায় মর্নিং সিকনেসে ভোগেন। মর্নিং সিকনেস গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক একটি বিষয় এবং এতে সাধারণত তেমন ভয়ের কোন কারণ থাকেনা। মর্নিং সিকনেসে সাধারনত বমি বমি ভাব হয় এবং মাঝে মাঝে বমি হয়। এ সমস্যা সাধারনত ১২-১৪ সপ্তাহের ভেতর ঠিক হয়ে যায়। মর্নিং সিকনেসের কারণে মারাত্মক ধরনের পানিশূন্যতা হয়না।
তবে হাইপারমেসিস গ্রাভিডেরাম হলো মর্নিং সিকনেসের তীব্র রুপ যার ফলে প্রচণ্ড বমি ভাব ও বমি হতে পারে।হাইপারমেসিস গ্রাভিডেরাম হলে বমি ভাব এবং বমি হতেই থাকে এবং পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এর কারণে কোন খাবার বা তরল পেটে রাখাটা দুষ্কর হয়ে ওঠে।
হাইপারমেসিস গ্রাভিডেরামের ক্ষেত্রে পানিশূন্যতার পাশাপাশি মায়েদের গর্ভাবস্থার আগের ওজনের চাইতে অন্তত ৫ ভাগ ওজন কমে যায়।যদি অনবরত বমি হতে থাকে এবং পানিশূন্যতা ও ওজন কমে যাওয়ার লক্ষন দেখা দেয় তবে অবশ্যই ডাক্তারকে জানানো উচিত।
এসব ছাড়াও গর্ভকালীন সময়ে মায়েরা আরও অনেক ধরণের উপসর্গ অনুভব করতে পারেন। গর্ভকালীন সব ধরণের উপসর্গ নিয়ে জানতে আমাদের আর্টিকেলটি পড়ুন।
এ সপ্তাহে করনীয়
এ সময় থেকে সাধারণত বেশিরভাগ মায়ের খাওয়া-দাওয়ার সমস্যা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তাই এখন থেকেই বিভিন্ন রকম পুষ্টিকর খাবার খেতে শুরু করুন। এতে করে বুকের দুধ ছাড়িয়ে যখন শিশুকে শক্ত খাবার খাওয়াতে শুরু করবেন, সে সহজেই সেগুলো গ্রহণ করবে।কারণ গর্ভাবস্থাতেই শিশু মায়ের গ্রহন করা বিভিন্ন খাবারের স্বাদ পেতে শুরু করে।
স্বাভাবিক অবস্থায় দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে ডায়েটে ৩৪০ ক্যালোরি এবং তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে ৪৫০ ক্যালোরি অতিরিক্ত গ্রহণ করতে বলা হয়। তবে মায়ের ওজন যদি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি অথবা কম হয় তাহলে শরীরের অবস্থা অনুযায়ী কম অথবা বেশি পরিমাণে ক্যালোরি গ্রহণ করতে হতে পারে। এছাড়াও গর্ভে যদি একের অধিক সন্তান থাকে তাহলে একটু বেশি পরিমাণে ক্যালোরি গ্রহণ করতে হবে। তাই গৎবাঁধা কোন ডায়েট ফলো না করে আপনার কি প্রয়োজন তা নিয়ে একজন পুষ্টিবিদের সাথে কথা বলুন।
হাঁটা চলা অব্যাহত রাখুন। একটানা বেশিক্ষণ বসে কাজ করবেন না। এই সময় থেকে পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজ শুরু করতে পারেন। এসব ব্যায়ামগুলো প্রসবের সময় বেশ সাহায্য করে। সেই সাথে প্রসবের পর দ্রুত সেরে উঠতে এবং প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার মত সমস্যা রোধে বেশ কার্যকর।
গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের নিরাপত্তার জন্য স্বাভাবিকভাবেই মায়ের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একটু কমে যায়। তাই এই সময় বিভিন্ন জীবাণু সংক্রমণ এড়াতে একটু সাবধানতা প্রয়োজন। ঘন ঘন হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন, বাইরে গেলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার সাথে রাখুন। খাবার, পানীয়, টুথব্রাশ কারো সাথে শেয়ার করবেন না এবং অসুস্থ মানুষজনের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্ন নেয়া খুবই প্রয়োজন৷ এসময় দাঁত পরিষ্কার রাখতে হবে৷ গর্ভাবস্থায় অনেক সময় মাড়ি ফুলে রক্তপাত হয়৷ তাই এ সময়ে প্রথম থেকেই মাড়ির যত্ন নেওয়া উচিত৷ প্রতিদিন সকালে ও রাতে শোয়ার আগে দাঁত ব্রাশ করা প্রয়োজন৷ দাঁত বা মাড়ির কোনও সমস্যা থাকলে দন্ত চিকিত্সকের পরামর্শ নিন৷
সুস্থ পরিবেশই শুধু একটা সুস্থ বাচ্চার জন্ম দিতে পারে । এটা বর্তমানে বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমানিত যে মায়ের সাথে সন্তানের আত্তিক সম্পর্ক থাকে । কাজেই গর্ভবতী মাকে সর্বদা হাসিখুশি ও চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। সেই সাথে পরিবারের অন্যান্য সদ্যসদ্যেরও মাকে যথাযথ মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে।
সবার জন্য শুভকামনা।