গর্ভাবস্থার ১৪ তম সপ্তাহকে প্রেগন্যান্সির দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারের প্রথম সপ্তাহ হিসেবে ধরা হয়। এটাই বেশীর ভাগ মায়ের জন্য বাকি দুই ট্রাইমেস্টারের চাইতে অপেক্ষাকৃত সহজ সময়। সাধারণত এ সময়টিতে বেশিরভাগ মায়ের গর্ভকালীন বিভিন্ন অস্বস্তিকর উপসর্গগুলো অনেকটা কমে আসে।
দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে গর্ভপাতের সম্ভাবনা অনেকটুকু কমে যায়। তাই এসময় চাইলে আপনি সুসংবাদটা সবাইকে জানাতে পারেন।
১৪ সপ্তাহের অবস্থান গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাসে।
গর্ভধারণের ১৪ সপ্তাহে গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি
ভ্রূণের শরীর এসময় তার মাথার তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার গলা আগের তুলনায় লম্বা হয়ে যায় যার কারণে ভ্রূণের ঝুঁকে থাকা মাথাটি অনেকটা সোজা হয়ে আসে। একই কারণে ভ্রূণের শরীরের গঠনও গুটিয়ে থাকা অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে লম্বাটে হতে শুরু করে।
ভ্রূণটির নড়াচড়াতেও এসময় অনেকটা পরিবর্তন আসে। এর আগে এর নড়াচড়া ছিল অনেকটা হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠার মত তবে এসময় থেকে সে বেশ হাত পা ছুঁড়ে বা শরীর বাঁকিয়ে নড়াচড়া শুরু করতে পারে।
গর্ভের শিশুটির আকার এই সপ্তাহে একটি কিউয়ি ফলের সাথে তুলনা করা যায়।এ সময় ভ্রূণের উচ্চতা থাকে প্রায় ৩.৪২ ইঞ্চি বা ৮.৭ সেমি এবং এর ওজন হয় আনুমানিক ১.৫২ আউন্স বা ৪৩ গ্রামের মত। গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত শিশুর পা তার পেটের সাথে গোটানো অবস্থায় থাকে।
১৪ তম সপ্তাহের দিকে এসে গর্ভের ভ্রূণের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক বিকাশের মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। সেগুলো নিম্নরূপঃ
মুখ
গর্ভের শিশুটি এ সময় বিভিন্ন মুখভঙ্গি করতে পারে। সে হয়তো কখনো ভ্রু কুঁচকে চিন্তিত ভঙ্গি করবে আবার হয়তো খুব রেগে যাওয়ার ভঙ্গি করবে। কখনো সে তার মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কাটার ভঙ্গিও করতে পারে। ভ্রূণের মস্তিষ্কের এ সময় বিকাশ হতে থাকেই বলেই তার মুখের পেশীগুলোর বিভিন্ন নড়াচড়ার কারণে এসব মুখভঙ্গির সৃষ্টি হয়। সেই সাথে মুখের পেশীগুলোরও বিকাশ হতে থাকে।
এসময় ভ্রূণটি চোষার এবং চাবানোর ভঙ্গিও করতে পারে এমনকি মাঝে মাঝে সে তার বৃদ্ধাঙ্গুল মুখে নিয়ে চুষতেও পারে।
ত্বক
ভ্রূণের মাথায় হালকা ধূসর বর্ণের কিছু চুল গজাতে শুরু করতে পারে। তবে জন্মের আগ পর্যন্ত তার চুলের রং পরিবর্তিত হতে পারে। চোখের ভ্রুও এসময় থেকে গজাতে শুরু করতে পারে।
ভ্রূণের চুল শুধু তার মাথাতেই নয় বরং পুরো শরীর জুড়েই থাকবে। এগুলোকে লানুগো বলে। লানুগো মূলত ভ্রূণকে অ্যাম্নিওটিক ফ্লুয়িড থেকে রক্ষা করে এবং তাকে উষ্ণ রাখে। গর্ভধারণের পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে যখন ভ্রূণের দেহে চর্বি জমা হতে শুরু করে তখন থেকে এই লানুগো ঝড়ে যেতে থাকে কারণ সে সময় ভ্রূণকে উষ্ণ রাখার কাজ তার শরীরের চর্বি করতে শুরু করে। তবে অনেক বাচ্চার জন্মের সময়ও এই লানুগো নিয়ে জন্মাতে পারে। জন্মের কিছুদিনের মধ্যে এগুলো ঝড়ে পড়ে।
হৃদপিণ্ড
ভ্রূণের হৃদপিণ্ড এ সময় প্রতিদিন প্রায় ২৩.৬৫ লিটার রক্ত পাম্প করে এবং তার হৃদস্পন্দন থাকতে পারে ১৫০ বিপিএম এর কাছাকাছি
জননাঙ্গ
ভ্রূণের জননাঙ্গের বাহ্যিক অংশ এখন পরপুরি দৃশ্যমান তবে তা আকারে ছোট থাকার কারণে এখনি আলট্রাসাউন্ডে দেখা নাও যেতে পারে।
হাত এবং পা
ভ্রূণের হাত পা এখন পুরোপুরি বিকশিত এবং পায়ের নখের গঠন এখনো চলমান।সামনের কিছু সপ্তাহের মাঝে হাতগুলো আরও লম্বা হয়ে তার শরীরের সমানুপাতিক হয়ে যাবে।
১৪ সপ্তাহে ভ্রূণের কিডনি মূত্র উৎপাদন করতে শুরু করে দেয় যা ভ্রূণের শরীর থেকে নির্গত হয়ে অ্যাম্নিওতিক ফ্লুয়িডের সাথে মিশে। এসময় তার যকৃত থেকে পিত্ত উৎপন্ন হতে থাকে। এই দুটো বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে গর্ভের ভ্রূণ বাইরের পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছে।
এসময়ের মধ্যেই ভ্রূণের স্প্লীন বা প্লীহা থেকে লোহিত রক্ত কণিকার উৎপাদন শুরু হতে পারে। ভ্রূণের থাইরয়েড গ্রন্থিগুলোও হরমোনের উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট পরিপক্ব হয়ে ওঠে এবং ভ্রূণের অন্ত্র তার প্রথম মল বা মিকোনিয়াম তৈরি করতে শুরু করে।
ভ্রূণের পেশী এবং হাড়ের গঠনের সাথে সাথে ভ্রূণটি গুটিয়ে থাকা ভঙ্গি থেকে ধীরে ধীরে সোজা হতে থাকে।
১৪ তম সপ্তাহে মায়ের শারীরিক পরিবর্তন
১৪ তম সপ্তাহের মধ্যে মায়ের জরায়ু পেলভিসের উপরের দিকে এবং বাইরের দিকে বাড়তে শুরু করে। তাই এই সময় থেকে গর্ভবতী মায়ের পেটের আকার কিছুটা বাড়তে শুরু করতে পারে।
তবে মনে রাখতে হবে প্রত্যেকটি মায়ের শারীরিক গঠন আলাদা। কারো যদি মনে হয় পেটের আকার কোন পরিবর্তন আসেনি তবে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। মায়ের পেটের আকার কেমন হবে তা অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যেমন- হরমোন, গর্ভাবস্থার আগের ওজন, কততম গর্ভাবস্থা এবং মায়ের পেটের পেশীর ধরণ ইত্যাদি।
এ সময় থেকেই মায়ের মর্নিং সিকনেস বা বমি বমি ভাবের উপসর্গও অনেকাংশে কমে যেতে পারে।এসময় সাধারণত বেশিরভাগ মায়েরা আরও সতেজ বোধ করবেন ।এই কারণেই দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারকে গর্ভকালীন সময়ের সবচাইতে সহজ ও কিছুটা আরামের সময় বলা হয়।
এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে কারো কারো ক্ষেত্রে এসব সমস্যা এখনো থাকতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে কিছু মায়েদের মর্নিং সিকনেস এবং ক্লান্ত লাগার সমস্যা চতুর্থ বা পঞ্চম মাস পর্যন্ত থাকতে পারে আবার খুব অল্প কিছু মায়েদের ক্ষেত্রে তা পুরো গর্ভাবস্থা জুড়েই চলতে পারে।
গর্ভাবস্থার ১৪ সপ্তাহ থেকে মায়ের ওজন বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। গর্ভধারণের আগে যদি মায়ের বিএমআই স্বাভাবিক থাকে তবে ডাক্তারদের মতে এর পরবর্তীতে প্রতি সপ্তাহে ১ পাউন্ড করে ওজন বৃদ্ধি পেলে তা স্বাভাবিক। তবে যদি গর্ভধারণের আগে বিএমআই কম বা বেশি থাকে অথবা যদি প্রথম ট্রাইমেস্টারে মায়ের ওজন খুব বেশি কমে বা বেড়ে যায় তবে তার উপর নির্ভর করে ওজন বেশি বা কম বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হবে।
এ সময় নতুন যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে তা হল –
চুলকানি
গর্ভাবস্থায় হালকা চুলকানি হওয়া নিয়ে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই চিন্তার কিছু নেই। এটা খুবই স্বাভাবিক। প্রায় ২০ ভাগ গর্ভবতী মহিলার চুলকানির সমস্যা থাকে। এ সময় মায়েদের পেট এবং ব্রেস্টের আশেপাশে চুলকানি বেশী হতে পারে, কারণ দুটো স্থানের চামড়াই এ সময় প্রসারিত হয়। শুষ্ক ত্বক ও হরমোনের পরিবর্তনের কারণেও এ সময় চুলকানি দেখা দিতে পারে।
পেট শক্ত হয়ে যাওয়া বা টান টান অনুভূতি
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় তিনমাসের মধ্যে, জরায়ুর আকার বাড়ার সাথে সাথে তা পেটের দেয়ালে চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে , মায়ের পেট শক্ত হয়ে যাওয়া বা টান টান হয়ে যাওয়া অনুভূতি হয়। তবে সময়ের সাথে সাথে এই অনুভূতি বেশ স্বাভাবিক হয়ে যায়।
গর্ভাবস্থায় পেট শক্ত হয়ে যাওয়া, মায়ের দেহের ধরনের উপরেও অনেকটা নির্ভর করে। গর্ভাবস্থায় রোগা এবং স্থূল মহিলাদের পেট শক্ত হয়ে যাওয়া অনুভূতি বিভিন্ন হতে পারে। প্রধানত, রোগা মহিলারা গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে এটি অনুভব করেন এবং স্থূল মহিলারা তৃতীয় তিনমাসের মধ্যে তা অনুভব করে থাকেন।
ভেরিকোস ভেইন
ভেরিকোস ভেইন হল অস্বাভাবিকভাবে স্ফীত হয়ে যাওয়া শিরা যা চামড়ার উপর দিয়ে দেখা যায়। নীল বা বেগুনি রঙের আঁকাবাঁকা শিরাগুল সাধারণত পায়ে দেখা যায়। তবে গর্ভাবস্থায় ভেরিকোস ভেইন নিতম্বে বা ভ্যাজিনাল এরিয়াতেও দেখা যেতে পারে।
ভেরিকোস ভেইনের কারণে চুলকানি বা ব্যাথা হতে পারে কিন্তু এগুলো সাধারণত তেমন ঝুঁকির কারণ নয়। এর যদি কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তবে তার জন্য সন্তান জন্মদান পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায়।
তবে অল্প কিছু ক্ষেত্রে ভেরিকোস ভেইনের কারণে শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে (superficial venous thrombosis)। এমনটা হলে শিরা শক্ত হয়ে যায় এবং দড়ির মত দেখায় এবং এর আশপাশের জায়গা লাল ও গরম হয়ে যায় এবং ব্যাথা অনুভুত হয়।যদি এ ধরনের লক্ষন দেখা দেয় তবে দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
মাড়ি থেকে রক্তপাত
গর্ভাবস্থায় মাড়ি থেকে রক্ত পড়া খুব বেশি লক্ষণীয়। কারণ এই সময় মায়েদের শরীরের হরমোন পরিবর্তন হয় ফলে মাড়ি সংবেদনশীল হয়ে যায়। এই সময় সামান্য আঘাতে বা খোঁচাতেই মাড়ি থেকে রক্ত বের হয়। সুতরাং গর্ভবতী মায়েদের গর্ভাবস্থায় নিয়মিত মুখের যত্ন নিতে হবে।
এসব ছাড়াও গর্ভকালীন সময়ে মায়েরা আরও অনেক ধরণের উপসর্গ অনুভব করতে পারেন। গর্ভকালীন সব ধরণের উপসর্গ নিয়ে জানতে আমাদের আর্টিকেলটি পড়ুন।
এ সপ্তাহে করণীয়
আপনার গর্ভস্থ শিশুটি আপনার শরীরের জন্য একটি বাইরের বস্তু। শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার (immune system) স্বাভাবিক প্রবনতা হচ্ছে বাইরের কোন বস্তু শরীরে ঢুকলে তাকে প্রত্যাখ্যান করা।
শরীর যেন বাইরের বস্তু হিসাবে গর্ভস্থ শিশুটিকে প্রত্যাখ্যান না করে তাই শরীর নিজস্ব নিয়মে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে তখন দুর্বল করে রাখে। ফলে রোগ-জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হবার সম্ভবনা তখন বেড়ে যায়। এ কারনে এ সময় আপনার ঠাণ্ডা লাগা বা জ্বরের প্রবণতা বাড়তে পারে।
ভ্রমণের জন্য এ সময়টিকে গর্ভাবস্থায় কম ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়। কারণ এ সময় গর্ভপাতের ঝুঁকিও অনেক কমে যায় এবং গর্ভবতী মাও অপেক্ষাকৃত সতেজ বোধ করেন।
নিজের শরীরের প্রতি বাড়তি একটুই যত্ন নিন। খেয়াল করুন কাজের সময় যেন পেটের উপর তেমন কোনও চাপ না পরে। মেরুদন্ড সোজা রেখে হাঁটা এবং বসার চেষ্টা করতে হবে। এছাড়াও খেয়াল করুন আপনি যে খাদ্য গ্রহন করছেন তা যেন স্বাস্থ্য সম্মত হয়। তাতেই আপনার বেশিরভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে অনায়াসে।
দিনের বিভিন্ন সময়ে কাজের ফাঁকে পায়ের বিশ্রাম দিন। কিছুক্ষন পর পর পায়ের উপর চাপ কমাতে, পা ঝুলিয়ে বসুন। তবে কখনোই একটানা দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা যাবে না, এতে করে পায়ে পানি চলে আসতে পারে।
যেহেতু এখন ক্রমাগত বাড়তে থাকা জরায়ুকে জায়গা করে দেয়ার জন্য মায়ের পেটের পেশী এবং লিগামেন্টগুলোতে টান বাড়বে, ফলে আপনি সামান্য ব্যথা অনুভব করতে পারেন। যদি আপনি এখনো ব্যায়াম শুরু না করেন, তাহলে এ পর্যায়ে এসে এক-আধটু গর্ভাবস্থার জন্য উপযোগী ব্যায়াম শুরু করতে পারেন। এতে করে আপনার পেশী সবল থাকবে।
তবে হ্যাঁ, সক্রিয় থাকতে পারা যেমন ভালো, তেমনি আপনাকে এটাও জানতে হবে যে কতটুকু পর্যন্ত আপনি শরীরকে পরিশ্রম করাতে পারবেন। জেনে নিন, কোন ব্যয়ামগুলো আপনাকে সবল রাখবে, আর কোন ব্যয়ামগুলো গর্ভাবস্থায় বাদ দিতে হবে।
সবশেষে মনে রাখা উচিত, গর্ভবতী মাকে সব সময় হাসিখুশি ও দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে হবে। কারণ গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক অবস্থা পরবর্তী কালে শিশুর বিকাশে প্রভাব ফেলে, যা গবেষণায় প্রমাণিত।