অভিনন্দন!! আপনি যদি চতুর্থ সপ্তাহ নাগাদ জানতে পারেন যে আপনি গর্ভবতী তাহলে আপনি অনেকের চাইতে ভাগ্যবতী।কারণ অনেকেই মাত্র ৪ সপ্তাহে গর্ভবতী হওয়ার ব্যাপারটি আঁচ করতে পারেনা।
গর্ভাবস্থার চতুর্থ সপ্তাহে গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি
চতুর্থ সপ্তাহে ভ্রুনের সাইজ একটি পপি বীজের সমান থাকে। এ সময় গর্ভের ভ্রূণের দুটো স্তর থাকে। এগুলোকে হাইপোব্লাস্ট (hypoblast) এবং এপিব্লাস্ট (epiblast) বলা হয়। এই দুটো স্তর থেকে তার সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিকশিত হতে শুরু করে।
গর্ভাবস্থার চতুর্থ সপ্তাহ নাগাদ ভ্রূণটি জরায়ুর দেয়ালে লেগে থেকে বাড়তে থাকে। ভ্রূণের বাহ্যিক কোষগুলো মায়ের রক্তপ্রবাহের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে যাতে মায়ের শরীর থেকে পুষ্টি উপাদান এবং অক্সিজেন গ্রহন করতে পারে।
ভ্রূণের অভ্যন্তরীণ কোষগুলো প্রথমে দু স্তরে এবং পরবর্তীতে তিন স্তরে ভাগ হয়ে যায়। এই প্রত্যেকটি স্তর থেকে ভ্রূণের বিভিন্ন অঙ্গের বিকাশ শুরু হয়।
একেবারে ভেতরের স্তরটি থেকে বাচ্চার শ্বাসতন্ত্র এবং পরিপাকতন্ত্রের গঠন হবে, যেমন- ফুসফুস, পাকস্থলী, ব্লাডার ইত্যাদি।
মধ্যের স্তরটি থেকে গঠিত হবে ভ্রূণের হৃদপিণ্ড, রক্তনালী, পেশী এবং হাড়।
উপরের স্তরটি পরিণত হবে বাচ্চার বাচ্চার মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র, চোখের মনি, দাঁতের এনামেল, চামড়া এবং নখে।
গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে ভ্রূণটি একটি ছোট ইয়ক স্যাকের (Yolk Sack) সাথে লাগানো থাকে যা বাচ্চার পুষ্টি সরবরাহ করে। কয়েক সপ্তাহ পর মায়ের প্লাসেন্টার (Placenta) পুরোপুরি গঠন হয়ে যাবে। তখন ভ্রূণকে পুষ্টি এবং অক্সিজেন সরবরাহের কাজটি প্লাসেন্টাই করবে।
এ সময় ভ্রূণটি অ্যাম্নিওটিক স্যাকের (Amniotic Sac) ভেতরে অ্যাম্নিওটিক ফ্লুয়িড (Amniotic Fluid) দিয়ে ঘেরা থাকে যা ভ্রূণকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে। এই অ্যাম্নিওটিক স্যাকের বাইরের স্তর থেকে প্লাসেন্টা গঠিত হয়।
পরবর্তী পাঁচ সপ্তাহ গর্ভবতীর জন্য সংকটপূর্ন কারন এসময় ভ্রূণের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। এ সময় প্লাসেন্টা এবং আম্বিলিক্যাল কর্ডের (Umbilical Cord) বৃদ্ধি ঘটে যা মায়ের শরীর থেকে অক্সিজেন এবং অন্যান্য পুষ্টি শিশুর শরীরে প্রেরন করে।
গর্ভবতী হওয়ার চতুর্থ সপ্তাহের লক্ষণ
প্রথমেই বলে রাখা দরকার এ সময় মা যদি তার মধ্যে কোন পরিবর্তন লক্ষণ না করে তাহলে খুব ঘাবড়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই। বেশিরভাগ মায়েরাই গর্ভধারণের ষষ্ঠ সপ্তাহের আগে গর্ভধারণের তেমন কোন উপসর্গ অনুভব করেন না।
কিছু কিছু মায়েরা গর্ভধারণের কিছু লক্ষণ এই সময় থেকেই টের পেতে পারেন-
বমি বমি ভাব বা মর্নিং সিকনেস – গর্ভধারণের ৬ সপ্তাহ সময় থেকে সাধারণত মর্নিং সিকনেস বা বমি বমি ভাব দেখা দেয়। কিন্তু এটা কখনো কখানো ৪ সপ্তাহ থেকেও শুরু হতে দেখা যায়। পরবর্তী এক মাস ধরে সমস্যাটা আরো বেশী খারাপের দিকে যেতে পারে।
স্তনে নরম ভাব এবং সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে – গর্ভাবস্থায় প্রাকৃতিক কারনেই মায়ের স্তনের আকৃতিগত পরিবর্তন দেখা দেয়। এটিই প্রকৃতির নিয়ম। ৬-৮ সপ্তাহের দিকে স্তন এর আকার বৃদ্ধি পাওয়া শুরু হতে পারে যা পুরো গর্ভকালীন সময় ধরে চলে।
ক্লান্তিবোধ হওয়া – গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে অবসাদ বা ক্লান্তি গর্ভবতীকে আংশিক বা পুরোপুরি ঘিরে ধরতে পারে। গর্ভাবস্থার মাঝামাঝি সময়ে এই উপসর্গ একটু কমে আসলেও আবার শেষের দিকে এই অবসাদ ও ক্লান্তি ফিরে আসতে পারে। হরমোনের (Pregnancy Hormone) পরিবর্তন বিশেষ করে প্রজেস্টরন বৃদ্ধি পাওয়া এর অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
শারীরিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া – গর্ভকালীন সময়ে অনেক ধরনের হরমোন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি নিঃসৃত হয়, শরীরে রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং ওজন বৃদ্ধি পায়। আর এসব কারণের শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে।
এ সপ্তাহে করনীয়
প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে নিন – আপনি যদি গর্ভধারনের জন্য চেষ্টা করেন তবে অপেক্ষা করাকিছুটা কঠিনই বটে। তবে সঠিক ফলাফল পেতে মাসিক মিস হওয়ার এক সপ্তাহ পরে পরীক্ষা করতে হয়। মাসিকের তারিখের আগে পরীক্ষা করলে সঠিক ফলাফল পাওয়া নাও যেতে পারে।
যাদের শরীরের হরমোনের পরিমান ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় তাদের ক্ষেত্রে সঠিক ফলাফল পেতে একটু বেশী অপেক্ষা করতে হয়।
যাদের মাসিক অনিয়মিত তাদের ক্ষেত্রে পরীক্ষার সঠিক সময় বোঝা একটু কষ্টকর কারন পরবর্তী মাসিকের তারিখ নির্দিষ্ট থাকেনা। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য মাসিকের তারিখের পর এ পরীক্ষা করা ভালো। অথবা সাত সপ্তাহ পর পরীক্ষা করলে সঠিক ফলাফল পাওয়া যায়।
প্রেগন্যান্সি টেস্ট দিনের যে কোন সময় করা যায়। যেদিন পরীক্ষা করতে চান সেদিন একটু কম পানি পান করুন কারন পানি প্রস্রাবে হরমোনের পরিমান কমিয়ে দেয়। কোন কোন টেস্ট কিট অবশ্য সকালের প্রথম প্রস্রাব থেকে করার পরামর্শ দেয়। কারন সারারাতের মূত্র জমা থাকে বলে সেখানে এইচ.সি.জি(human chorionic gonadotropin) এর ঘনত্ব বেশি থাকে।
[ আরও পড়ুন- গর্ভবতী না হয়েও প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ হওয়ার কারণ কি? ]
Gynecologist এর সাথে দেখা করুন এবং পরামর্শ নিন। যখনি আপনি জানতে পারবেন যে আপনি গর্ভবতী তখনি যত দ্রুত সম্ভব কোন গাইনী ডাক্তারের সাথে দেখা করুন। যদি আপনি এখনো ঠিক করে না থাকেন যে পুরো গর্ভকালীন সময় আপনি কোন ডাক্তারের সাথে থাকবেন বা ডেলিভারি কে করবে, তবুও যেকোন একজনের সাথে পরামর্শ করুন গর্ভধারণ এর ব্যাপারে।
অতিরিক্ত গরমে যাবেন না । শারীরিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি বাচ্চার গঠনে অন্তরায় হতে পারে।
ফলিক এসিড নিতে ভুলবেন না। আপনি যদি গর্ভধারণ করেন বা গর্ভধারণের পরিকল্পনা করেন সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পরিমানে ফলিক এসিড গ্রহন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় ফলিক এসিড নিউরাল টিউব ডিফেক্ট (NTD) যেমন- স্পাইনাল কর্ড (Spina Bifida) ও ব্রেইনের (anencephaly) জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধে সাহায্য করে।
নিউরাল টিউব ডিফক্ট এর ঝুঁকি কমাতে বিশেষজ্ঞরা সাধারনত গর্ভধারণের অন্তত একমাস আগে থেকে দৈনিক ৪০০ মাইক্রোগ্রাম (mcg) ফলিক এসিড গ্রহনের পরামর্শ দেন।
আপনি যদি নিয়মিত মাল্টিভিটামিন গ্রহন করেন তাহলে লেবেল চেক করে দেখুন তাতে পর্যাপ্ত পরিমানে ফলিক এসিড আছে কিনা। তবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া কখনোই দৈনিক ১০০০ মাইক্রোগ্রামের বেশী ফলিক এসিড গ্রহন করা উচিত নয়।
হাঁটাহাঁটি ও হালকা ব্যায়াম করুন – ব্যায়াম আপনার ভাল পেশী, শক্তি এবং সহনশীলতা বিকশিত করতে সাহায্য করবে। এটা আপনার অতিরিক্ত ওজন কমাতে সহায়তা করবে (যদি আপনার ওজন বেশী হয়ে থাকে) অথবা ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখতে সহায়তা করবে যা আপনার গর্ভকালীন সময়ে খুব জরুরী।
ব্যায়াম আপনার গর্ভকালীন সময়ের পর খুব তাড়াতাড়ি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে। আপনি আপনার সহনশীল ব্যায়াম পছন্দ করতে পারেন। সাঁতার বা হাঁটা চলা যাবে না এমনটা নয়। পরিমিতভাবে আপনি সাঁতার বা হাঁটাচলাও করতে পারেন।
এছাড়াও আপনি কিছু সহজ যোগব্যায়াম করতে পারেন, গর্ভাবস্থার জন্য বিশেষ যোগব্যায়াম আছে। গর্ভাবস্থায় শরীরচর্চা সম্পর্কে জেনে নিন।
গর্ভাবস্থায় পেটের দাগ বা স্ট্রেচ মার্কস কমানোর জন্য গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই পেটে অলিভওয়েল মাখতে পারেন।
মনে রাখবেন গর্ভধারণের ক্ষেত্রে মায়েদের সাথে সাথে বাবাদের ও ভূমিকা পালন জরুরী। এ সময়টাতে বাবাদের উচিত সবসময় মায়েদের mental support দেয়া।
- গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্ন সম্পর্কে জেনে নিন।
- গর্ভধারণের শুরুর দিকের সময়গুলোতে গর্ভপাতের আশঙ্কা বেশী থাকে। এ সম্পর্কে জেনে নিন।
- একটোপিক প্রেগনেন্সি সম্পর্কে জেনে নিন।
<<গর্ভাবস্থা সপ্তাহ ৩
গর্ভাবস্থা সপ্তাহ ৫>>