আজকাল আমাদের মধ্যে যে ব্যাধিটি ক্যান্সারের চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তা হোল নিজের প্রতি আস্থা এবং আত্মমর্যাদাবোধের অভাব। সমস্যাটি মানসিক হলেও শারীরিক গঠন এর সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। সবচেয়ে আতঙ্কের কথা হোল আমাদের সন্তানেরা তাদের কৈশোরের সারল্য আর বাধাহীন আনন্দের বদলে টিকে থাকার মন্ত্র হিসেবে শারীরিক সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এমনকি সুস্থতাও এখন সৌন্দর্যের তথাকথিত সংজ্ঞার কাছে পর্যুদস্ত।
.
হতাশার সাথে আজকাল লক্ষ্য করলাম যেকোনো গেট টুগেদারে (বিশেষভাবে নারী মহলে) আজকাল বিষয় থাকে-‘কে মোটা হয়ে গেছে?’ ‘কে অনেক স্লিম হয়ে গেছে?’ ‘কে এই বয়সেও অনেক কম বয়সী দেখায় ?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সবচেয়ে কুৎসিত যে মন্তব্য হয় তা হোল, শারীরিক গঠন , মুখশ্রী , বয়স কিংবা গায়ের রঙ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তুলনামুলক আলোচনায়, বলা প্রয়োজন এই বিশেষ তুলনামুলক আলোচনায় পুরুষরাও কম যান না। এমনকি সেই স্বামী-স্ত্রীর সন্তানের বাবা-মায়ের জীনগত বৈশিষ্ট কতখানি সেই আলোচনাও বাদ যায় না।
.
এখনকার নতুন মায়েদের ডিপ্রেশান এবং অস্থিরতার বেশ কয়েকটি মূল কারণের মধ্যে একটি নিজের পরিবর্তিত শারীরিক গঠনের প্রতি বিদ্বেষ যা তার মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে। মাতৃত্বের মতো আসধারন গৌরবের একটি বিষয়ও অনেকের কাছে অনেক সময় ম্লান হয়ে পড়ে গর্ভকালীন এবং প্রসব-পরবর্তী কিছু শারীরিক পরিবর্তনের কারণে।
.
আজকাল শারীরিক গঠনের বিষয়টি প্রচারমাধ্যম এবং সমাজে এত গভীর এবং বিস্তির্নভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে , এমনকি শিশুরা এবং বিশেষভাবে কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের শরীরকে একটি বিশেষ মাপকাঠিতে রাখার চেষ্টা করছে – এবং তা অনেকক্ষেত্রেই বাবা মায়ের অলক্ষ্যে। স্কুলে অসংখ্য বাচ্চা প্রকাশ্যে কিংবা নীরবে মানসিক হয়রানীর (bullying ) শিকার হচ্ছে এই শারীরিক গঠনের তুলনা দিয়ে। হয়তো সবার অগোচরেই ধ্বংস কিংবা বিঘ্নিত হয়ে পড়ছে অনেক শিশু-কিশোরের আত্ম-মর্যাদাবোধ (self esteem)- নিজেদের নিয়ে গ্লানি গ্রাস করছে তাদের, যে বিষয়ে প্রকৃতপক্ষে তাদের কোন দায় নেই। Bully যারা করছে কিংবা যারা এর শিকার হচ্ছে অনেক সময়ই উভয় পক্ষের বাবা-মা কিংবা স্কুলের শিক্ষকেরা অবগত কিংবা সচেতন থাকছেন না। শিশুদের সহবত এবং নৈতিক শিক্ষার মধ্যে আমরা এসব রাখছি তো? নাকি নিজেরাই বাচ্চাদের সামনে অন্যদের নিয়ে তুলনা, বিদ্রূপ কিংবা কটূক্তি করছি ? বেশ কিছু দেশের গবেষণাধর্মী লেখা পড়ে জানলাম, হাইস্কুলের বাচ্চাদের ডিপ্রেশান এবং আত্মহত্যা প্রবণতার একটি কারণ চেহারা কিংবা শারীরিক গঠন এবং তার মধ্যে ‘স্থুলতা’ নিয়ে হতাশা অন্যতম।
.
খুব দুঃখজনকভাবে, টিভির বিভিন্ন বিজ্ঞাপনেও বিরুপ কিংবা বোকা চরিত্রগুলোয় অতিরিক্ত ওজনের গোলগাল বাচ্চা ব্যাবহার করা হয়। ‘কি রে বান্টি, তোর সাবান স্লো নাকি ?’– বিজ্ঞাপনটি দেখে মনে হয় , হাত ধোওয়ার সাবানের বিজ্ঞাপন না, বরং একটা বাচ্চা শুধু মায়ের কথা শুনে চলার কারনে স্কুলের ‘অতি স্মার্ট’ বন্ধুদের কাছে কিভাবে অপদস্থ হয়-তারই প্রতিচ্ছবি। আবার হরহামেশা এমনটাও দেখা যায়, একজন স্ত্রী বিশেষ একটি ক্রিম ব্যাবহার করে টানটান ত্বকের অধিকারী হলে, আর্টিফিশিয়াল সুয়েটনার খেয়ে স্লিম হলে কিংবা তেল মেখে দীঘল চুলের অধিকারী হয়েই কেবল স্বামীর মনোযোগ পাচ্ছেন। এসব বিজ্ঞাপনে পারিবারিক মূল্যবোধের কথা, মানুষের স্বাতন্ত্র্য কিংবা আত্মমর্যাদাকে ধুলিস্যাত করে এটাই আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে যে একটি মেয়ের সৌন্দর্যই হোলো পৃথিবীতে তার সকল অর্জনের মূলমন্ত্র, সে তার কর্মক্ষেত্রে হোক, সমাজ কিংবা পরিবারে।
.
পাশ্চাত্যে সভ্যতার যত প্রসার ঘটেছে বলেই দাবি করা হোক , এসব সমস্যা সেসব দেশে আরো প্রকট । যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে শুধু কিশোর-কিশোরী নয়, চার থেকে আট বছর বয়সী শিশুদের ভেতর মানুষের শারীরিক গঠন, চেহারার আদল সর্বোপরি বাহ্যিক সৌন্দর্য্য নিয়ে কিছু গৎবাঁধা ‘মানদণ্ড’ তৈরি হয়ে গেছে, এবং নিজেকে সেই মানদণ্ডে বিচার করে তারা রীতিমত মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। কেউ নিজেকে প্রয়োজনের চেয়ে মোটা ভাবছে- কেউবা রোগা, কেউ নিজেকে কালো ভাবছে, কেউ ভাবছে তার চোখ ছোট , কেউ বা ভাবছে তার কেন ঝরঝরে চুল না হয়ে কোঁকড়ানো হোল। তাদের মনে এই ভাবনাগুলো আসছে কারণ আমরা অনেকটাই ‘বিউটি ইন্ডাস্ট্রি’র ঠিক করে দেয়া ছকে বাঁধা পরে গেছি। আজকাল বিজ্ঞাপন প্রচারে তেমন কোন নীতিমালাও চোখে পরে না। সবখানে যেন একটাই বার্তা ‘সৌন্দর্য সফলতার মূলমন্ত্র এবং এই বার্তা বিশেষ ভাবে নারীদের জন্য প্রযোজ্য’।
এই মুলমন্ত্র আমাদের আরো শেখায়ঃ
বয়স, ভৌগলিক কিংবা জীনগত বৈশিষ্ট্য কোনভাবেই যেন সেই সৌন্দর্যের ছককে ভাঙতে না পারে, তার জন্য যেকোনো মুল্য দিতেও রাজী হওয়া উচিৎ। বয়সের সাথে সাথে মুখের বলিরেখা পরে যাওয়া, কিংবা চুল ধুসর হওয়া যেন ভয়ঙ্কর কোন দুঃস্বপ্নের চেয়েও অপ্রিয়। টান টান চামড়া , জিরো ফিগার, ডায়েট , ফর্সা ত্বক এগুলোর সাথে যুক্ত হয়েছে টোল পড়া গাল, সুচালো নাক কিংবা আকর্ষণীয় বুকের গঠনের জন্য প্লাস্টিক সার্জারি।
.
মূল লক্ষ্য এটাই- যেন নিজেকে নিয়ে সবসময় আমরা হীনমন্যতায় ভুগি। আমরা যতটাই নিজেদের চেহারা আর শারীরিক গঠনকে ঘৃণা করব, বিউটি ইন্ডাস্ট্রির চাকা ততোই চালু থাকবে। মুখে বলিরেখা ? অ্যাণ্টি-এজিং প্রোডাক্ট আছে , দাঁত বাকা কিংবা খানিকটা উঁচু ? সার্জারি আছে। চূল সোজা? কার্লি করে নিন। নাকি কার্লি? –তাহলে সোজা করে নিন। এসব করতে গিয়ে স্কিন কিংবা চুলের বারোটা বেজেছে? পার্লার এ যান , অনেক রকম থেরাপী আছে। পেট মোটা হয়ে যাচ্ছে ? ওজন বেড়ে যাচ্ছে ? আছে সমাধান ! হাজার হাজার সমাধান! শুধু যে বিজ্ঞাপনের বাহার তা নয়, সমাজের এমনকি পরিবারের লোকজনও কম যায় না, মাদক, ধূমপান, ক্যামিক্যাল যুক্ত খাবার, দূষণ এসব নিয়েও এত উপদেশ শোনা যায় না, ওজন বাড়লে যেটুকু শুনতে হয়। কি করলে কি হবে? কি খেলে বা না খেলে মেদ ঝড়বে, টেকো মাথায় চুল গজাবে, রঙ ফর্সা হবে বলিরেখা দূর হবে, এসব উপদেশ আজকাল রাস্তায় থেকে কিছু কুড়িয়েও নেয়া যাবে।
.
এত যে সমাধান, তাহলে সমস্যা টা কি?
সমস্যা একটাই, আপনি বিশেষ একরকম নন। আপনি বিশেষ একরকম হবার জন্য আপনার জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করুন এসবের পিছনে ছুটতে ছুটতে , বিষণ্ণ থেকে কিংবা হীনমন্যতায় ভুগে। এখানেই শেষ না। আমাদের সন্তানরা আমাদের দেখছে, টিভিতে আকর্ষনীয় সব বিজ্ঞাপন দেখছে, আর ভাবছে আমাদের কি নেই? আমি কেনো নির্দিষ্ট একরকম দেখতে নই?
.
ক্রমাগত এই ‘নেই’ এর ভিড়ে আমরা আজকাল জীবনের মানেই হারিয়ে ফেলছি। সারাক্ষণ ছুটছি কি নেই তার পিছনে। হয়ে পড়ছি অবসাদগ্রস্ত , সারাক্ষণ তুলনায় মগ্ন হয়ে নিজেদের ভালবাসতেই ভুলে যাচ্ছি।
.
আজকাল সিরিয়াল নিয়ে অনেক লেখালেখি হলেও, নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণহীন বিজ্ঞাপন প্রচার এবং সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের নতুন প্রজন্মকে অনেক বেশী বিভ্রান্ত করছে। তাদের কাছে জগতটা রঙিন প্যাকেটে মোড়া মনে হচ্ছে, ঠিক যেমনটি বিজ্ঞাপনে দেখায়। মানবিক মুল্যবোধ, আত্মবিশ্বাস, জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সব ধরণের মানুষের প্রতি সম্মান আর ভালবাসা পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের মনে হয় এই বিষয়গুলো নিয়ে একটু গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। সৌন্দর্যের তথাকথিত এই চক্র ভেঙ্গে বরং আমরা কথা বলি কিভাবে নিজেকে পরিবার এবং সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় করা যায়, কিভাবে নিজেকে একজন সৎ কর্মনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায় , সুস্থভাবে বাঁচার জন্য কিভাবে অস্বাস্থ্যকর এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করা যায়, নিজের প্রাপ্তি এবং অর্জন নিয়ে কিভাবে সবচেয়ে বেশী সন্তুষ্ট এবং সুখী থাকা যায়, সর্বোপরি কিভাবে হীনমন্যতা আর বর্ণবাদ-মুক্ত একটি সুস্থ প্রজন্ম তৈরি করার জন্য ব্যাক্তিগত এবং সামগ্রিকভাবে ভুমিকা রাখা যায়।
.
সবার জন্য শুভকামনা ।