পিতৃত্ব- মাতৃত্বকালীন সময়ের শুরুতে আপনার অনুভূতি: যা সব বাবা মায়ের জানা জরুরী

Spread the love

আমার মধ্যে কি হচ্ছে?

বাসায় নবজাতক শিশুর সাথে থাকার সময়টা চমৎকার, কিন্তু একই সাথে শোরগলপূর্ণ এবং ক্লান্তিকর। নতুন বাচ্চার সাথে জীবনটা চাহিদাপূর্ণ ও অনিশ্চিত। নিজের প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো এমনকি গোসল ও খাবার তৈরী করার সময়টুকু নিজের জন্য বের করে নেয়াও এই সময়ে কঠিন হয়ে যায়।

আপনি ক্লান্ত ও মাঝে মাঝে আবিষ্ট হয়ে যাবেন। এটা মনে হতে পারে যে, আপনার নিজের উপরই নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই। এটি স্বাভাবিক। এটা সবসময় থাকবে না। ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যেই আপনি অনেক বেশী গোছানো হয়ে যাবেন। তিন থেকে চার মাসে সবকিছু আরো বেশী সহজ হয়ে যাবে।

বিজ্ঞাপণ

কিভাবে প্রথম দিকের সপ্তাহগুলোতে টিকে থাকা যাবে? 

  • দিনের বেলায় যখন বাচ্চা বিশ্রামে বা ঘুমিয়ে থাকবে তখন বিশ্রাম বা ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
  • যতো কম কাজ করা যায় ততটুকুই করুন। বাড়ীর কাজ কমিয়ে দিন (আপনি এবং আপনার বাচ্চা অনেক মূল্যবান)।
  • আপনার সঙ্গীকে বাচ্চার গোসল ও পোশাক পরিবর্তনের দায়িত্ব দিন – এতে আপনার বিশ্রাম মিলবে এবং বাচ্চারও পিতামাতা উভয়কে চেনার সুযোগ হবে।
  • আপনার বিশ্রামের পদ্ধতিগুলো মনে করুন। পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করুন যদি আপনি খিটখিটে অনুভব করেন বা বিশ্রাম নিতে চান। পদ্ধতিগুলো জানতে পড়ুন। 
  • কোন কাজ বসে করার মাধ্যমে আপনার শক্তি সঞ্চয় করুন। মেঝে বা সোফায় বসে বাচ্চার ন্যাপী বদলান এবং বসে কাপড় ভাজ করুন।
  • খাবার সাধারণ রাখুন, কারণ আপনার অধিক রান্না করার সময় বা শক্তি কোনটিই থাকবে না। সহজ খাবার প্রায়ই স্বাস্থ্যকর হয়, যেমন সালাদের সাথে চর্বিহীন গ্রিল করা মাংস বা মাছ, হোলগ্রেইন পাউরুটির সাথে টিনজাত মাছ অথবা রান্না করা ঠান্ডা মুরগী। হাল্কা নাস্তা হিসাবে তাজা ফল বা দই খেতে পারেন।
  • বাসার বিভিন্ন কাজে অন্যদের সাহায্য চান।
  • বিশুদ্ধ বাতাস এবং হালকা ব্যায়াম যেমন বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে থেকে হেটে আসা আপনাকে ঘরের ‘বন্দিত্ব’ থেকে মুক্ত করবে।
  • মনে রাখবেন আপনি যদি আপনার নিজের যত্ন করতে না পারেন তবে অন্য কাউকেই ঠিকমতো যত্ন করতে পারবেন না।

সকল নতুন পিতামাতারই সাহায্যের প্রয়োজন হয়, বিশেষভাবে যদি আপনার পরিবার আপনার কাছকাছি না থাকে অথবা আপনি যদি একক পিতা বা মাতা হোন। অন্যের সাহায্য চাইতে ভয় পাবেন না, সাহায্য গ্রহণ করুন।

আপনার বাচ্চার দেখাশুনা করা

অনেক নতুন পিতামাতা পারিবারিক জীবনের প্রথম কিছু সপ্তাহ দিশেহারা বোধ করে, এমনকি অনেক বাচ্চারাও। আপনার বাচ্চা আপনার ভিতরের অন্ধকার জায়গা ছেড়ে একটি অদ্ভুত, মাঝে মাঝে ভয়ের, অপরিচিত জায়গা ও শব্দের মধ্যে প্রবেশ করেছে। নতুন বাচ্চার বিষয়ে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষ মনে রাখা দরকার:

নতুন জন্মানো বাচ্চাকে আপনি খারাপ করতে পারেন না। কান্নাই আপনার বাচ্চার একমাত্র উপায় যা দ্বারা সে আপনাকে বুঝাতে পারে যে, তার আপনাকে দরকার। বাচ্চারা এখনও দুষ্টামি করার জন্য বা নিজেদের সুবিধা আদায় করার জন্য এত বড় হয় নি।

সকল বাচ্চাই কান্না করে। কিছু বাচ্চা অন্যদের থেকে বেশী কাঁদে। কিছু বাচ্চা আপনার চিন্তার চেয়েও বেশী কাঁদে। বিকাল এবং সন্ধ্যা প্রায়ই সবচেয়ে কষ্টকর হয়। যখনই আপনার বাচ্চা কাঁদবে তার কাছে যান যাতে সে নিরাপদ বোধ করে।

বাচ্চা যখন হতাশ থাকে বা যখন তাড়াতাড়ি কিছু দরকার যেমন – খাওয়ানো, শুকনো ন্যাপী, আলিঙ্গন তখনই যদি তারা তা পায় – তাহলে তারা কম কান্না করে।

মনে রাখবেন যদিও সে আপনার সন্তান, তারপরও তার সাথে আপনার সম্পর্ক একেবারেই নতুন। যখন আমরা নতুন কারো সাথে সাক্ষাত করি, তখন তারা কেমন ব্যবহার করে, কোনটা তাদেরকে হতাশ করে, এবং কিভাবে তাদেরকে আরাম দেয়া যায়, তা জানতে সময় প্রয়োজন। এটা বাচ্চার জন্যও প্রযোজ্য… এমনকি আপনার পূর্বে আরেকটি বাচ্চা থাকলেও।

প্রথম কিছু সপ্তাহের শোরগোল বেশী দিন থাকে না। আপনার বাচ্চা ধীরে ধীরে একটি নিয়মে ঘুমানো বা খাওয়া শুরু করবে।এটা খুবই প্রয়োজনীয় যে, আপনার বাচ্চা যাতে একটি সম্পূর্ণ ধোঁয়ামুক্ত পরিবেশে বড় হয়। বাচ্চা যদি সিগারেটের ধোঁয়া গ্রহণ করে তবে তার ফুসফুসের এবং এস আই ডি এস (SIDS)-এর সমস্যা হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

বাচ্চা কান্না বন্ধ না করলে কি করবেন?

যখন আপনি আপনার বাচ্চার জন্য কোন কিছুই আরামদায়ক না করতে পারেন তখন এটি খুবই চিন্তাদায়ক। বাচ্চা শান্ত করার জন্য নিচের বিষয়গুলো চেষ্টা করতে পারেন-

প্রথমে দেখে নিন, আপনার বাচ্চা ক্ষুধার্ত কিনা, অতিরিক্ত গরম বা অতিরিক্ত ঠান্ডা কিনা এবং শুকনো ও পরিষ্কার ন্যাপী পরে আছে কিনা।মনে রাখবেন বাচ্চারাও অন্যদের মতো – যখন আপনি হতাশ থাকেন তখন তা চলে যেতে যেমন সময় লাগে বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও তাই।

যদি আপনার বাচ্চা দিনের বেলায় শান্ত না হয় তবে তাকে কারও তত্ত্বাবধানে প্র্যাম-এ রাখুন এবং আপনারা উভয়ই শান্ত হওয়ার জন্য বাইরের সতেজ বাতাসে কিছুক্ষণ হেঁটে আসুন। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে জড়িয়ে ধরলে প্রায়ই শান্ত হয়।

যদি এটাও কাজ না করে তবে বাচ্চাকে একটি নিরাপদ স্থানে রাখুন (যেমন তাদের বেসিনেট অথবা খাট) এবং আপনাকে সাহায্য করার জন্য কাউকে ডাকুন। প্রায়ই, বিশেষ করে বাচ্চারা যখন অশান্ত থাকে তথন মায়ের চেয়ে অন্য কেউ চেষ্টা করলে সাড়া দেয়।

যদি বাসায় কেউ না থাকে তাহলে আপনাকে আপনার বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের ফোন করার দরকার হতে পারে এবং তাদেরকে আসার জন্য বলতে পারেন। যদি কেউ কাছাকাছি না থাকে তাহলে বাচ্চাকে গাড়ীতে নিয়ে কারো বাসা থেকে ঘুরে আসুন, এটি অনেক সময় সাহায্য করবে।

বিজ্ঞাপণ

আপনার অনুভূতি: যা সকল পিতামাতার জন্য জানা জরুরী

একটি ম্যাগাজিনের পাতা উল্টান বা টিভি ছাড়ুন এবং আপনি অবাক হবেন এটা দেখে যে:

  • সকল গর্ভবতী মহিলা আনন্দে উদ্ভাসিত হয়
  • একজন নতুন জন্মানো বাচ্চার মা কখনও জরাজীর্ণ বা আবিষ্ট হয় না
  • প্রতিটি নতুন জন্মানো বাচ্চার দুজন অনুগত মা-বাবা থাকেন যারা কাজের চাপ ভাগ করে নেয় এবং কোন বিষয়ে কখনও ঝগড়া করে না
  • পিতৃত্ব-মাতৃত্ব আসে স্বাভাবিক ভাবেই।

যখন আপনি গর্ভবতী থাকেন বা পিতৃত্ব-মাতৃত্ব কালের শুরুর দিক মানাতে ব্যস্ত, জীবনকে ম্যাগাজিন এবং টিভির আশাব্যাঞ্জক ভাবমূর্তির চেয়ে ভিন্ন মনে হবে। তার মানে এই না আপনার সাথে কিছু ভুল হচ্ছে – শুধুমাত্র গর্ভাবস্থার এবং শৈশবকালের জনপ্রিয় ভাবমূতি আপনাকে বাস্তব জিনিসের জন্য প্রস্তুত করে না। বাস্তব এই যে, গর্ভাবস্থা এবং পিতৃত্ব-মাতৃত্বকালের শুরুর দিকে অনেক উত্থান এবং পতন আছে।

আপনার জীবনের কোন বড় ঘটনা (এমনকি ভাল ঘটনাও) অনেক মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। যেমন বিবাহ, নতুন চাকুরী, বাড়ি পরিবর্তন, লটারি জেতা বা বাচ্চা হওয়ার মত ঘটনা হতে পারে। মানসিক চাপের কারনে আপনি খারাপ অনুভব করতে পারেন।

ক্লান্তি অনুভব – মহিলাদের জন্য গর্ভাবস্থায় এবং পিতৃত্ব- মাতৃত্বকালীন সময়ের শুরুর দিকে বাবা-মা উভয়ের জন্য হওয়াটা স্বাভাবিক। বাস্তবিকভাবে, ক্লান্তি, বোঝা আরও বাড়িয়ে দেয়। অনেক মা বাবার জন্য, প্রথম কয়েক সপ্তাহের অবসাদ অনেকটা দিশেহারার মত হয়ে পড়ে।

তার উপরে আরও আছে যেমন বাচ্চা জন্মানোর পর মহিলারা তাদের শরীরের পরিবর্তন এবং হরমোন মাত্রার পরিবর্তনের সাথে মানাতে চেষ্টা করে। এছাড়াও তারা স্তন্যদান শিখে এবং স্তন্যপান শিখতে সময় লাগে যদিও এটি মা এবং বাচ্চার জন্য ভাল। অন্যদিকে বাচ্চাদের জন্য নতুন পৃথিবীর সাথে মানিয়ে নেয়া সহজ নয়। এবং যদি আপনার বাচ্চাকে খাওয়াতে এবং সামলাতে সমস্যা হয় তা আপনার উপরও প্রভাবে ফেলবে।

গর্ভাবস্থায় এবং বাচ্চা জন্মানোর পরে আপনি খারাপ বোধ করলে অবাক হবেন না। এক্ষেত্রে যা আপনাকে সাহায্য করতে পারে তা হল:

  • কারও সাথে কথা বলা – আপনার সঙ্গী, একজন বন্ধু, আপনার ধাত্রী
  • নিজের জন্য বেশি সময় বের করা- আপনি আনন্দ পান এমন কিছু করুন
  • অতিরিক্ত ক্লান্ত না হওয়ার চেষ্টা করুন
  • হাঁটতে যাওয়া
  • বিশ্বাসযোগ্য এমন কাউকে ব্যবস্থা করা যে আপনার বাচ্চাকে কয়েক ঘন্টা দেখভাল করবে যাতে করে আপনি নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ঘুমের সুযোগ পান।

আপনার বাচ্চার সাথে বন্ধন

“মা ও সন্তানের মাঝে ভালবাসার বন্ধন” এই ধরনের গল্প অনেক মহিলার জন্য খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। অন্যান্য মহিলা, তাদের পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব এবং মিডিয়া যেভাবে মা-সন্তানের বন্ধনের ব্যাপারে কথা বলে তারা ঠিক সেইভাবে বাচ্চার সাথে বন্ধন অনুভব করতে পারে না।

তাদের জন্য, বাচ্চার সাথে দৃঢ় বন্ধনের অনুভূতি না থাকার চাপ এবং অন্যান্যদের শোনানো গল্পের মত না চলার কারনে, প্রথম কয়েক সপ্তাহ এবং মাস মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা এমনকি আরও কঠিন করতে পারে।

এই অনুভূতি স্বাভাবিক, কিন্তু যদি তা তীব্র বা অপ্রতিরোধ্য হয়, তাহলে আপনার অনুভূতি কি তা বুঝার জন্য সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে। আপনি একজন ভাল মা হতে পারেন এবং আপনার বাচ্চার সাথে সঠিক বন্ধন হয়ত অনুভব করবেন না।

বিজ্ঞাপণ

যদি আপনার এই অনুভূতির সাথে লড়াই করেন, যেমন বাচ্চার সাথে বন্ধন তৈরী করছেন না অথবা যতটুকু উচিত ততোটুকু বাচ্চাকে ভালবাসেন না, তাহলে আপনার ধাত্রী, ডাক্তার অথবা শিশু ও পরিবার স্বাস্থ্য সেবিকার সাথে এই বিষয়ে কথা বলুন।

বাচ্চা জন্মের পর দুর্দশাগ্রস্থ বা দুশ্চিন্তায় থাকা

যখন আপনি নতুন বাচ্চার সাথে বাড়িতে থাকবেন তখন খারাপ অনুভব করা, দিশেহারা বোধ করা অথবা নতুন এবং ভয়ার্ত চিন্তা-ভাবনা করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আপনি সম্ভবত জরাজীর্ণ অবস্থায় আছেন, আপনার শরীর প্রসবের পর পুনরুদ্ধার হচ্ছে এবং শিশু লালন-পালনের মত আপনি নতুন এবং চ্যালেঞ্জিং কাজ শিখছেন।

কিন্তু যদি আপনি এখনও বিষণ্ণ, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হন, আপনার বা আপনার বাচ্চার সম্পর্কে উদ্বিগ্ন থাকেন অথবা বাচ্চা জন্মের পর ২ সপ্তাহ পর্যন্ত যদি বিষণ্ণ বোধ করেন, তাহলে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি আপনার জিপি বা আপনার শিশু এবং পরিবার স্বাস্থ্য সেবিকার সাথে কথা বলুন। আপনার প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা বা এর সাথে সম্পর্কিত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থাকতে পারে।

মনে রাখবেন, যদি আপনার অতীতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার অভিজ্ঞতা থাকে তাহলে গর্ভাবস্থায় বা পিতৃত্ব-মাতৃ ত্বকালের শুরুর দিকে এই সমস্যার পুনরাবৃত্তি হওয়া বা একটি ভিন্ন রকম সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক, তাই যথা সম্ভব তাড়াতাড়ি কারও সাথে কথা বলুন যে আপনাকে সাহায্য করতে পারে।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment