বাচ্চা প্রি-ম্যাচিওর বলতে কি বোঝায়?
যদিও অধিকাংশ গর্ভাবস্থা ৩৭ থেকে ৪২ সপ্তাহ পর্যন্ত চলে, কোন কোন শিশুর তাড়াতাড়ি জন্ম নেয়া অস্বাভাবিক কিছু না। ৩৭ সপ্তাহের পূর্বে শিশু জন্মগ্রহণ করলে তাকে অকাল বা অপরিপক্ক বাচ্চা (Premature Baby) বলে ধরা হয়।অকালে শিশুর আগমন ঘটতে পারে কারণ:
- গর্ভফুল বা যোনীমুখে সমস্যার কারণে
- গর্ভে একের অধিক সন্তান থাকলে
- পানি ভেঙ্গে গেলে
- মায়ের উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের কারণে
- মায়ের কোন একটি সংক্রমন থাকলে, বিশেষ করে মুত্রথলিতে।
- অল্প বয়সে মাতৃত্ব
- কম সময়ের ব্যবধানে গর্ভধারণ
- মায়ের পুষ্টিহীনতা
- গর্ভাবস্থায় মায়ের ইনফেকশন
যে সকল মহিলারা প্রসবপূর্ব সেবা নেননি তাদের অপরিপক্ক প্রসবের ঝুঁকি বেশী থাকে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারণ অজানা থাকে। ৩৭ সপ্তাহের পূর্বে আপনার যদি প্রসবের কোন উপসর্গ দেখা দেয় তবে তৎক্ষনাত আপনার ধাত্রী, ডাক্তার বা হাসপাতালে যোগাযোগ করুন।
অপরিপক্ক শিশুদের একটি বড়, আধুনিক সরঞ্জামাদিসহ ছোট শিশুর সেবাদানে পারদর্শী লোকবল সম্পন্ন হাসপাতালে জন্ম নেয়া নিরাপদজনক (বিশেষ করে যাদের জন্ম ৩৩ সপ্তাহের পূর্বে হয়)। আপনি যদি গ্রামের দিকে থাকেন তবে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে তারা আপনাকে অপরিপক্ক বাচ্চার সেবার জন্য ভাল সরঞ্জামাদি সম্পন্ন হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে পারবে।
বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নির্ভর করে বাচ্চা কত দ্রুত হাসপাতালে পৌছালো এবং বিশেষায়িত সেবা পেলো তার উপর। ২৬ সপ্তাহের পূর্বে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৬০ জন বাচ্চা বেঁচে থাকতে পারে। ২৮-৩০ সপ্তাহের মধ্যে জন্মানো প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৯৮ জন বাচ্চা বেঁচে থাকে।
বিকলাঙ্গতার ঝুঁকি নির্ভর করে শিশুটি কতটা অপরিপক্ক তার উপর । ২৪ সপ্তাহে জন্মানো শিশুর মধ্যে ৪০ শতাংশ শিশুর মাঝারী থেকে মারাত্মক বিকলাঙ্গতার ঝুঁকি থাকে যেমন সেরেব্রাল পালসী, অন্ধত্ব, বধিরতা বা বুদ্ধিগত বিকলাঙ্গতা। গর্ভ শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে জন্মানো শিশুদের সাধারণত সুদুরপ্রসারী অসুবিধা থাকে না।
প্রি-ম্যাচিওর বা অপরিপক্ক বাচ্চার যেসব ঝুঁকি থাকে
যেহেতু অপরিপক্ক বাচ্চাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুরোপুরি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না তাই তারা নিম্নের অসুবিধাগুলো অনুভব করতে পারে:
ফুসফুসের সমস্যা
অপরিপক্ক শিশুদের প্রায়ই শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য সাহায্যের দরকার হয় কারণ তাদের ফুসফুস সম্পূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়না। অকালে জন্মের ক্ষেত্রে ফুসফুসের এবং অন্যান্য সমস্যার ঝুঁকি কমানোর জন্য প্রসবের পূর্বে মহিলাদের স্টেরয়েড ইনজেকশান দেয়া হয়।
শ্বাস বন্ধ হওয়া
এর মানে শিশু শ্বাস:প্রশ্বাস বন্ধ করে দেয়। মস্তিষ্কের যে অংশ শ্বাস:প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রন করে সে অংশ সম্পূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত না হওয়ার কারণে এটা হয়ে থাকে। অপরিপক্ক বাচ্চাদের নিবিড় পর্যবেক্ষনে রাখতে হবে যেন তার শ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে তা পুনরায় চালু করার জন্য সাহায্য করা যায়।
প্রি-ম্যাচিউর বাচ্চাদের ফুসফুসের গঠন ঠিকঠাক মত না হবার ফলে জন্মের পর এদের শ্বাস কষ্ট দেখা দিতে পারে। তাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় এমন হয় যে, বাচ্চা ঠিক মত শ্বাস নেবার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। তখন এদের কৃত্রিম শ্বাস যন্ত্র অর্থাৎ ভেন্টিলেটরের সাহায্যে সাময়িক ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখা হয়।
খাওয়াতে অসুবিধা
শিশু যদি চুষতে না পারে তবে তাকে নলের সাহায্যে খাওয়ানোর প্রয়োজন হতে পারে যতক্ষণ না সে চোষা এবং গেলার জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করতে না পারা
অপরিপক্ক বাচ্চার প্রাকৃতিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন যথাযথ বেড়ে উঠে না তাই তারা নিজ শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা। তাদের বিশেষ হিউমিডিক্রিব বা মাথার উপর বিশেষ হিটারের নিচে যত্নের প্রয়োজন হতে পারে যতক্ষণ না তারা নিজের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনের মতো পরিপক্ক হয়।
জন্ডিস
শিশুর চামড়া হলুদ হতে পারে কারণ যকৃত তখনো যথাযথ কাজ শুরু করেনি। জন্মের পর বেশির ভাগ শিশুর বিলিরুবিন বেশি থাকে এবং এই বিলিরুবিনের মাত্রা আরও বেশী থাকে প্রি-ম্যাচিউর ও লো বার্থ ওয়েট বেবীর ক্ষেত্রে। এই বিলিরুবিনের মাত্রাই জন্ডিসের নির্দেশক।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
প্রি-ম্যাচিউর বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় অনেক কম থাকে।তাই তারা ঘন ঘন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ কারণে বাবা মায়েদের অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
আমার শিশু কি বাঁচবে?
সাধারণত, গর্ভাশয়ে বেড়ে উঠার জন্য অতিবাহিত প্রতিটি অতিরিক্ত সপ্তাহ বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দেয়। শিশু যত দ্রুত জন্মাবে বেঁচে থাকা ততটা ঝুঁকিপূর্ণ হবে। ৩২ সপ্তাহের পূর্বে জন্মানো বাচ্চাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি যদি তারা নবজাতকের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে বিশেষায়িত চিকিৎসা এবং সেবা পায়।
আপনার বাচ্চা যদি আগে জন্মায়, তবে তাকে আপনার এবং আপনার সঙ্গীর অতি নিকটে, চামড়ার সাথে চামড়া লেগে থাকে এমনভাবে কোলে নিয়ে যত দীর্ঘ সময় জুরে পারা যায় তত ভালো। এটাকে বলে “ক্যাঙ্গারু কেয়ার”।
আপনার স্থিতিশীল শরীরের তাপমাত্রা একটি ইনকিউবেটরের চেয়ে মসৃণভাবে বাচ্চার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে, তারা দ্রুত বেড়ে উঠে এবং বিকশিত হয়।
ক্যাঙ্গারু কেয়ার আপনার সাথে আপনার বাচ্চার সম্পর্ক তৈরীতে সাহায্য করে এবং আপনাকে তাদের কাছে থাকার অনুভূতি জানাতে সাহায্য করে। এটা আপনার বুকের দুধ উৎপাদন ও বজায় রাখতেও সাহায্য করতে পারে। অপরিপক্ক বাচ্চারা বুকের দুধে ভাল বেড়ে উঠে।
২৪ সপ্তাহের পূর্বে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ সেবা তখন নিয়মিতভাবে দেয়া হয়না। যদি এমন মনে হয় যে আপনার বাচ্চা ২৪ সপ্তাহের পূর্বে জন্মাবে, আপনার ডাক্তার তখন এই বিষয়ে আলাপ করবেন। আপনার পরিবারের জন্য কোনটা সবচেয়ে ভালো তা সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে আপনার ডাক্তার যতটা সম্ভব তথ্য দিবেন।
২৪ সপ্তাহে, যদিও বেঁচে থাকার হার এখনও কম, কিন্তু সেই সময়ের পর থেকে বেঁচে থাকার হার নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। ২৮ সপ্তাহের মধ্যে, প্রতি ১০০ জন শিশুর মধ্যে ৯০ জনের বেশি শিশু বেঁচে থাকবে যদি কোন বিশেষায়িত হাসপাতালে নবজাতকের নিবিড় পর্যবেক্ষণ সেবায় থাকে।
প্রি-ম্যাচিউর বেবির বিভিন্ন রকমের অবস্থা
শিশুর জন্ম যখন ২৮ তম সপ্তাহেরও আগে
শিশুর জন্মের সময় তার বয়স ২৮ সপ্তাহের কম হওয়াটা খুব কম ক্ষেত্রেই হয়। এই ধরণের শিশুরা সাধারনত খুব কম ওজন (দুই পাউন্ডের কম) নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য এদের আলাদা অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। এমনকি এই সময় শিশুরা চোখ খোলাও শেখে না এবং চোখের পাতাও তৈরি হয় না। কান্না করতেও এই সময়ের শিশুরা শেখে না।
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটেই এ ধরণের শিশুদের রাখা হয় যতদিন না তারা ঠিক হয়ে উঠে। খাওয়ানোর ব্যপারে সাহায্য নিতে হয় টিউবের। তবে দুঃখের বিষয় হলো এসব শিশুরা অনেক সময়ই কিছুটা শারীরিক বা মানসিক অপ্রাপ্তি নিয়ে বেড়ে উঠে।
শিশুর জন্ম যখন ২৮ থেকে ৩১ তম সপ্তাহের মধ্যে
আগের চেয়ে কিছুটা বেশি ওজন নিয়ে এই সময়ের মধ্যের শিশুরা জন্মগ্রহণ করে তবে সমস্যাগুলো সাধারণত একই রকম থাকে। এদেরও আলাদা অক্সিজেন প্রয়োজন হয় এবং বেশিরভাগ শিশুরই মায়ের দুধ টেনে খাওয়ার শক্তি থাকে না বলে টিউবের মাধ্যমে খাওয়াতে হয়। কিছু কিছু শিশু এই সময় কান্না করতে শেখে। জন্মের পর অনেক সময় নিয়ে এই শিশুরা নড়া চড়া ও অন্যান্য কাজ শিখে থাকে।
শিশুর জন্ম যখন ৩২ থেকে ৩৬ তম সপ্তাহের মধ্যে
এই সময়ের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী শিশুরা বেশিরভাগ সময়েই স্বাভাবিক শিশুদের মতই থাকে যদিও তাদের ওজন অনেকটাই কম থাকে। খাওয়ানো ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা এদের মাঝেও দেখা যায় তবে কিছুটা কম পরিমাণে। এবং এসব শিশুরা খুব দ্রুতই স্বাভাবিক হতে পারে।
তারা খুব দ্রুতই নিজে খেতে পারে এবং ওজনও বেশ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তবে তাদেরও আলাদা বিশেষ যত্নের প্রয়োজন এবং উপযুক্ত যত্নের ফলে এসব শিশুরা ভালোভাবেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
প্রি-টার্ম বার্থ সম্পর্কে জেনে নিন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শতকার ৭৫ ভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ সেবা নিশ্চিত করা গেলেই অপরিণত নবজাতক শিশুকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব । একজন প্রিম্যাচিওর বাচ্চার ফুসফুস, পরিপাকতন্ত্র ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিণত না হ্ওয়ার পূর্বেই জন্মলাভ করে, কাজেই এই পৃথিবীর আলো বাতাসের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য ওকে একজন পরিণত নবজাতকের চেয়েও বেশী সংগ্রাম করতে হয়। এজন্য তার বিশেষ যত্ন প্রয়োজন ।
আরও পড়ুনঃ প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চার যত্ন
সবার জন্য শুভকামনা।