গর্ভধারণের সময় গণনা সাধারণত শুরু হয় মাসিকের প্রথম দিন হতেই। এই সময়ের এক দুই সপ্তাহের মধ্যেই সাধারণত গর্ভসঞ্চার হয়ে থাকে। যেহেতু কন্সেপশন বা গর্ভসঞ্চারের নির্দিষ্ট সময় নির্ণয় করা সম্ভব নয়, তাই বিশেষজ্ঞরা শেষ পিরিয়ডের প্রথম দিন থেকে পরবর্তী ৪০ সপ্তাহকে গর্ভধারণের সময় হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এই হিসেবেই প্রসবের দিন (Due Date) গণনা করা হয়।
গর্ভধারণের প্রথম সপ্তাহে মায়ের শারীরিক পরিবর্তন
প্রথম সপ্তাহের এ সময়টিতে কেউ কন্সিভ করেছেন এটি ঠিক বলা যায় না – কারন গর্ভসঞ্চারের ব্যাপারটি সাধারণত পিরিয়ড শুরুর দুই সপ্তাহ পর ঘটে থাকে। গর্ভসঞ্চার না হলেও একজন নারীর শরীর এসময় গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
পিরিয়ড শুরু হলে পূর্বের পিরিয়ড সাইকেলে গঠিত হওয়া জরায়ুর পুরু আবরণ এবং অনিষিক্ত ডিম্বাণু শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। সেই সাথে নতুন একটি সাইকেল শুরু হয় যাকে প্রেগন্যান্সির শুরু হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রতিবার পিরিয়ডের পরে মায়ের শরীর অনেক জটিল হরমোনাল পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যায়। এ ব্যাপারটি ঘটে মূলত শরীরকে গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত করতে। পিরিয়ডের শুরুতে প্রথমেই যে হরমোনটি কাজ শুরু করে সেটি হলো follicle stimulating hormone বা FSH। এই হরমোন মায়ের ফলিকলগুলোকে পরিপক্ব করতে থাকে। ফলিকল হলো মায়ের ডিম্বাশয়ে থাকা ছোট ছোট তরলভর্তি ব্যাগ যেগুলোতে একটি করে ডিম্বাণু গঠিত হয়।
দ্বিতীয় হরমোনটি, যাকে luteinizing hormone (LH) বলে, সেটি পিরিয়ড শুরুর ৫ দিনের মাথায় বাড়তে থাকে এবং FSH হরমোনের সাথে সাথে ফলিকলগুলোকে আরও পরিপক্ব করতে সাহায্য করে। অনেকগুলো ফলিকলের মধ্যে প্রতি মাসে একটি মাত্র ফলিকল অভুলেশন বা ডিম্বস্ফুটনের জন্য প্রস্তুত হয়।
ফলিকলগুলো যখন পরিপক্ব হয়ে ওঠে তখন মায়ের শরীরে এস্ট্রজেন হরমোন উৎপন্ন হতে শুরু করে। এই হরমোন দু-ধরণের কাজ করে থাকে। প্রথমত এটি জরায়ুর ভেতরের আবরণ পুরু করতে শুরু করে যাতে নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর দেয়ালে ভালোভাবে প্রতিস্থাপিত হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, এস্ট্রজেন হরমোনের পরিমাণ যখন বেড়ে যায় তখন তা luteinizing hormone (LH) এর উৎপাদনও বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে সবচাইতে পরিপক্ব ফলিকল থেকে একটি (খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রে দুটি) ডিম্বাণু অবমুক্ত হয়ে ডিম্বাশয় থেকে বেরিয়ে ফেলোপিয়ান টিউবে অবস্থান করে এবং নিষিক্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। এই সময়টিকেই অভুলেশন বলে।
পরবর্তীতে ডিম্বাণুটি ক্রমশঃ গর্ভাশয়ের দিকে অগ্রসর হয়। তার এই যাত্রাপথে যদি কোন শুক্রানু দ্বারা ডিম্বানুটি নিষিক্ত হয় তবে তা গর্ভাশয়ে গিয়ে অবস্থান নেয়, যাকে আমরা নারীর গর্ভধারন বা কন্সেপশন বলি।
আর যদি ডিম্বানুটি কোন শুক্রানু দ্বারা নিষিক্ত না হয়, তবে তা বিচূর্ন হয়ে কিছু রক্তকনিকা সহ পরের মাসিকের সময় বেরিয়ে যাবে। যদি গর্ভধারণ না ঘটে তবে জরায়ুর দেয়ালের বাড়তি অংশও পরবর্তী পিরিয়ডের সময় বেরিয়ে আসে।
শুক্রাণু মায়ের শরীরে প্রায় ৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে আর ডিম্বাণু সাধারণত ১২-২৪ ঘণ্টা জীবিত থাকে। তাই অভুলেশন বা ডিম্বোস্ফোটনের পাঁচ দিন আগে থেকে অভুলেশনের দিন পর্যন্ত সময়কে সবচাইতে বেশী উর্বর সময় ধরা হয়ে থাকে যদিও এর শেষ তিন দিনে গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশী।
বেশীরভাগ মায়েদের ক্ষেত্রেই পরবর্তী পিরিয়ড শুরুর ১২-১৪ দিন আগে অভুলেশন হয়। অর্থাৎ আপনার পিরিয়ড সাইকেল যদি ২৮ দিনের হয় তবে পিরিয়ড শুরু হওয়ার ১৪ দিন পর আপনার অভুলেশন হতে পারে। যদি পিরিয়ড সাইকেল এর বেশি বা কম হয় তবে পরবর্তী পিরিয়ড শুরুর ১৪ দিন আগে অভুলেশন হতে পারে।
অভুলেশন নির্ণয়ের কোন অব্যর্থ পদ্ধতি নেই। তাই আপনার যদি গর্ভধারণের পরিকল্পনা থাকে তবে এই সময়ে বা এসময়ের কিছু আগে থেকেই চেষ্টা শুরু করার পরামর্শ দেয়া হয়।
গর্ভবতী হওয়ার প্রথম সপ্তাহের লক্ষণ
প্রথম সপ্তাহে গর্ভধারণের কোনও পরিস্কার লক্ষণ দেখা যায় না। কারণ এখনো গর্ভধারণের প্রক্রিয়াই শুরু হয়নি। তবে কারও কারও দূর্বল লাগতে পারে; ঘনঘন মূত্রত্যাগের প্রবণতা দেখা দিতে পারে। মেজাজের ওঠানামাও (Mood Swing) শুরু হতে পারে। এ লক্ষণগুলো অনেকটা স্বাভাবিক সময়ে মাসিক হওয়ার আগে এবং মাসিকের সময়ে হরমোনগত ওঠানামার কারনে ঘটে থাকে।
এই সপ্তাহে আপনার করনীয়
- আপনার যদি গর্ভধারণের পরিকল্পনা থাকে তবে এখন থেকেই সুস্থ ও নিয়মানুবর্তী লাইফস্টাইল মেনটেইন করার চেষ্টা করুন। ধূমপান ও মাদক থেকে দূরে থাকুন।
- প্রেগন্যান্সির সময় কোন ডাক্তারের পরামর্শে থাকবেন সে ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিন। এমন নয় যে আপনি প্রথমবার যার কাছে যাবেন তার কাছেই সবসময় যেতে হবে। আপনি যে কোন সময় আপনার পছন্দের ডাক্তারের কাছে শিফট করতে পারেন।
- গর্ভবতী হওয়ার পূর্বেই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন এবং যদি সম্ভব হয় গর্ভপূর্ববর্তী চেকআপ করিয়ে ফেলুন যার মাধ্যমে আপনার শরীর এখনই গর্ভধারণের জন্যে প্রস্তুত আছে কি না তা জেনে নিতে পারবেন।
- আপনি যদি কোনো ওষুধ ব্যাবহার করে থাকেন তাহলে বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিন তা গর্ভধারণের জন্য নিরাপদ কিনা। আপনার নিয়মিত ওষুধের মধ্যে এমন কিছু ওষুধ থাকতে পারে যা গর্ভাবস্থার উপযোগী নয়। তাই কন্সেপশনের পূর্বেই ডাক্তারের পরামর্শে সেগুলো বন্ধ কিংবা বিকল্প ঔষধের ব্যাবস্থা করে ফেলতে হবে।
- বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলে Pre-Natal multivitamin খাওয়া শুরু করুন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড খাওয়ার চেষ্টা করুন। এতে শিশুর অনেকধরনের জন্মগত ত্রুটি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ফলিক এসিড গর্ভধারণের অন্তত ৩ মাস আগে থেকে খাওয়া শুরু করা ভাল।
- অ্যাক্টিভ থাকার চেষ্টা করুন। প্রতিদিন হালকা শরীরচর্চার অভ্যাস করুন।
- ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা (ব্লাড প্রেসার, শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস ইত্যাদি) থাকলে, তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে যত্নবান হোন এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিন। নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন। গবেষণামতে যেসব মহিলা বিষণ্ণতায় ভোগেন তাদের অন্যদের তুলনায় গর্ভধারণে বেশী সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রত্যেকটি গর্ভধারণে ইচ্ছুক মায়ের বিশেষ করে যাদের নিজস্ব বা পারিবারিকভাবে বিষণ্ণতার হিস্ট্রি আছে তাদের গর্ভধারণের আগে অন্তত একবার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিৎ।
- যদি আপনার বিষণ্ণতার কোন লক্ষন থাকে, যেমন- কোন কিছুতে উৎসাহ বোধ না করা বা আনন্দ না পাওয়া, খাবারে অরুচি, ঘুমের সমস্যা, সারাক্ষণ নিরাশ থাকা বা নিজেকে অযোগ্য মনে হওয়া ইত্যাদি, তবে আপানার ডাক্তারের সাথে আলাপ করুন। তিনি কোনো থেরাপিস্ট বা সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে আপনাকে রেফার করবেন।
বাবাদের জন্য পরামর্শ
প্রেগন্যান্সির পুরো জার্নিটা স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই। তাই দুজনেরই শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে। এই সময় স্বামীর উচিৎ তার কোন যৌনবাহিত রোগ আছে কিনা তা পরীক্ষা করে নেয়া। সেই সাথে ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করা উচিৎ। গবেষণায় দেখা গেছে ধূমপান বা মদ্যপানের কারণে পুরুষের শুক্রাণুতে সমস্যা হতে পারে যাতে কন্সিভ করা কঠিন হতে পারে।
এছাড়াও দুজনেরই উচিৎ প্রেগন্যান্সি নিয়ে খোলাখুলিভাবে আলোচনা করা। প্রেগন্যান্সির শুরুতেই এ সম্পর্কে দুজনের বোঝাপড়া থাকলে পুরো প্রেগন্যান্সির সময় জুড়ে মানিয়ে নেয়া সহজ হয় যা পরবর্তীতে পিতৃত্ব এবং মাতৃত্বের সময়টাকে অনেক সহজ করে তোলে। সবার জন্য শুভকামনা।
সবার জন্য শুভকামনা।