সিকেল সেল ডিজিজ (Sickle cell disease) ও গর্ভাবস্থা

আর্টিকেলটিতে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে -
Spread the love

সিকেল সেল ডিজিজ কি ধরনের রোগ?

সিকেল সেল ডিজিজ হল এক ধরনের বংশগত রোগ যার কারণে রক্তে কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। সিকেল সেল শুধুমাত্র রক্তের লোহিত কণিকাগুলোর উপর প্রভাব বিস্তার করে। উল্লেখ্য যে লোহিত কণিকা আমাদের রক্তে অক্সিজেন বহন করে থাকে।

রক্তের স্বাস্থ্যকর লোহিত কণিকাগুলো আকারে কিছুটা গোল এবং নমনীয় হয় যার ফলে এগুলো একদম ছোট রক্তনালী দিয়েও খুব সহজেই চলাচল করতে পারে। আপনি যদি সিকেল সেল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন তাহলে আপনার রক্তের লোহিত কণিকাগুলো শক্ত, আঠালো এবং ইংরেজি বর্ণ “সি” এর মত আকৃতি ধারণ করে।

বিজ্ঞাপণ

লোহিত কণিকার এই আকৃতির কারণে আক্রান্ত লোহিত কণিকাগুলো শরীরের যে কোন অংশে আটকে যেতে পারে এবং যার ফলে শরীরের সেই অঙ্গে অক্সিজেন স্বাভাবিক ভাবে পৌঁছাতে পারে না। আর এই ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যথা করতে পারে, এমনকি শরীরের কোষ এবং অঙ্গের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।

সিকেল সেলে আক্রান্ত রক্ত কণিকা স্বাভাবিকের তুলনায় স্বল্পস্থায়ী হয়ে থাকে। অপরদিকে যদিও আপনার শরীর নিয়মিত রক্ত কণিকা উৎপাদন করতে থাকে, তবু সিকেল সেলে আক্রান্ত হওয়ার কারণ যে পরিমাণে রক্ত কণিকা নষ্ট হয়ে যায় সে তুলনায় শরীর নতুন রক্ত কণিকা উৎপাদন করে সেগুলোকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না।

এর মানে হল সিকেলসেলে আক্রান্ত রোগীদের শুধুমাত্র অস্বাভাবিক লোহিত রক্ত কণিকাই থাকে না বরং সুস্থ মানুষের তুলনায় তাদের শরীরের রক্ত কণিকাও বেশ খানিকটা কম থাকে। আর এই ধরনের শারীরিক অবস্থার কারণে অচিরেই আপনি রক্তশূন্যতায় ভুগতে পারেন। (তবে সিকেলসেলে আক্রান্ত হওয়ার কারণে রক্তশূন্যতা অন্যান্য রক্ত শূন্যতা যেমন আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্তশূন্যতা থেকে বেশ খানিকটা ভিন্ন রকম হয়ে থাকে।)

বিগত কয়েক যুগ ধরে সিকেলসেল রোগের চিকিৎসার বেশ উন্নতি হয়েছে, আর তাই বর্তমানে সিকেলসেলে আক্রান্ত রোগীরাও দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে থাকে এবং সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করে। আর এই উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে বর্তমানে গর্ভকালীন সময়ে সিকেলসেল রোগে আক্রান্ত হলেও নিরাপদ গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভবপর হয়ে উঠেছে।

সঠিক যত্ন এবং চিকিৎসার মাধ্যমে সফলতার সাথে এই রোগকে প্রতিহত করে একটি সুস্থ স্বাভাবিক গর্ভাবস্থা পরিচালনা করা সম্ভব।

কারা এই সিকেল সেল ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন?

সিকেল সেল এক ধরনের বংশগত রোগ তাই এটা বলা যায় যে পরিবারের কেউ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকলে অন্যান্য সদস্যদেরও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে।

তবে এটা ধারনা করা হয় যে এই রোগের উৎপত্তি হয়েছে সাহারা-আফ্রিকা অঞ্চল এবং মধ্যপ্রাচ্য এবং সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া অঞ্চল থেকে। তাই এটা দেখা গেছে যে ঐ অঞ্চল থেকে আগত লোকদের মধ্যে এই ধরনের রোগ বেশি দেখা যায়। এছাড়া অন্যান্য আরো বেশ কিছু এলাকা যেমন দক্ষিণ এবং সেন্ট্রাল আমেরিকা, ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জ এবং দক্ষিণ ইউরোপের মানুষের মধ্যেও এই রোগ হতে দেখা গেছে।

বর্তমানে প্রায় লাখ খানেক আমেরিকান এই সিকেলসেল রোগে আক্রান্ত। আর আমেরিকার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে আফ্রিকান-আমেরিকানদের মধ্যেই এই ধরনের রোগ বেশি দেখা যায়।

প্রতি ৫০০ আফ্রিকান-আমেরিকান শিশুর মধ্যে একজনের এই সিকেলসেল রোগে আক্রান্ত হয়। এছাড়া প্রতি ১৩ আফ্রিকান-আমেরিকান নবজাতক শিশুর মধ্যে ১ জনকে সিকেল সেল রোগের বাহক দেখা যায় অর্থাৎ যদিও তারা সিকেল সেলে আক্রান্ত নয় তবু জেনেটিক ভাবে তারা সিকেল সেল রোগটি বহন করছে।

সিকেল সেল ডিজিজ কয় ধরনের হয়ে থাকে?

সিকেল সেল বেশ কয়েক ধরনের হয়ে থাকে এবং প্রত্যেক ধরনের রোগই রক্তের লোহিত কণিকার ভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিকতার কারণে হয়।

হিমোগ্লোবিন হল রক্তের এক ধরনের প্রোটিন যেগুলো আপনার ফুসফুস থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে শরীরের বাকি অংশগুলোতে পৌঁছে দেয়। এছাড়া এগুলো কার্বনডাইঅক্সাইড সংগ্রহ করে আপনার ফুসফুসে পৌঁছে দেয় যাতে করে আপনি নিঃশ্বাস ছাড়ার মাধ্যমে এগুলো শরীর থেকে বের করে দিতে পারেন।

বাবা ও মা দুইজনের থেকে হিমোগ্লোবিনের দুই ধরনের জিন আপনি বংশগত ভাবে পেয়ে থাকেন। আর জেনেটিক এই মিশ্রণটাই নির্ধারণ করে যে আপনি সিকেলসেল রোগ আছে কি না আর থাকলেও ঠিক কোন ধরনের সিকেলসেল রোগে আপনি আক্রান্ত।

রক্তের সাধারণ হিমোগ্লোবিনকে বলা হয় হিমোগ্লোবিন-এ অপরদিকে সিকেলসেলের হিমোগ্লোবিনকে বলা হয়ে থাকে হিমোগ্লোবিন-এস, তবে এটা ছাড়াও আর বেশ কয়েক ধরনের অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন রয়েছে।

কয়েক ধরনের সিকেল সেল রোগ অন্যান্য রোগগুলো থেকে শরীরের জন্য একটু বেশিই ক্ষতিকর। আর ঠিক কোন ধরনের সিকেলসেল রোগে আপনি আক্রান্ত হয়েছেন সেটার উপর নির্ভর করে গর্ভকালীন সময়ে সিকেল সেলের জন্য আপনি কোন জটিলতায় ভুগবেন কি না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে ধরনের সিকেলসেল রোগগুলো সচরাচর দেখা যায়, সেগুলো নিম্নরূপঃ 

Hemoglobin SS (Hb SS)

আপনি যদি বাবা এবং মা উভয়ের কাছ থেকে হিমোগ্লোবিন এস নামক জিনটি পেয়ে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে আপনি Hemoglobin SS (Hb SS) নামক রোগে আক্রান্ত।

সিকেল সেল রোগের এই ধরনটাই খুব বেশি দেখা যায় এবং এটাই তুলনামূলক ভাবে একটু গুরুতর আকার ধারণ করে। এই ধরনের সমস্যাকে ডাক্তারি ভাষায় প্রায়শই সিকেল সেল এনেমিয়া অথবা homozygous hemoglobin SS বলা হয়ে থাকে। 

Hemoglobin SC (Hb SC)

আপনি যদি উত্তরসরি ভাবে বাবা অথবা মায়ে মধ্যে যে কোন একজনের থেকে হিমোগ্লোবিন এস জিন এবং অন্যজনের কাছ থেকে হিমোগ্লোবিন সি জিন পেয়ে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে আপনি Hemoglobin SC (Hb SC) নামক রোগে আক্রান্ত।

হিমোগ্লোবিন সি হল আরেক ধরনের অস্বাভাবিক ধরনের হিমোগ্লোবিন। তবে হিমোগ্লোবিন এস এর মত এই হিমোগ্লোবিনটি অতটা সমস্যার সৃষ্টি করে না আর তাই স্বাভাবিক অবস্থায় এবং গর্ভকালীন সময়ে আপনি তুলনামূলক ভাবে একটু কম জটিলতায় ভুগবেন।

Sickle beta thalassemia disease

আপনি যদি হিমোগ্লোবিন এস জিনটি বংশগত ভাবে পেয়ে থাকেন এবং একই সাথে আপনার রক্তে থ্যালাসেমিয়া নামক আরেকটি জটিল ধরনের রোগ থেকে থাকে তখন বুঝতে হবে যে আপনি Sickle beta thalassemia disease নামক রোগে আক্রান্ত। উল্লেখ্য যে এই রোগটিও দুই ধরনের হয়ে থাকেঃ

Sickle beta zero thalassemia, এই রোগটির ধরন অনেকটাই Hb SS এর মত। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বেশ কয়েক ধরনের গুরুতর স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগে থাকেন এবং একইসাথে এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের গর্ভকালীন সময়েও বেশ গুরুতর জটিলতায় ভুগতে দেখা যায়।

Sickle beta plus thalassemia, এই রোগটি অনেক ধরনের সিকেলসেল রোগের মধ্যে বেশ হালকা এবং এর কারণে স্বাভাবিক অবস্থাতে ও গর্ভকালীন সময়ে জটিলটা তুলনামূলক ভাবে কম দেখা যায়।

Sickle cell trait

কেউ যদি বংশগত ভাবে স্বাভাবিক “হিমোগ্লোবিন এ” জিনের সাথে “হিমোগ্লোবিন এস” জিনটিও পেয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সে ব্যক্তি Sickle cell trait নামক রোগে আক্রান্ত। এমতাবস্থায় উক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সিকেলসেল জিন দেখা গেলেও তারা আদতে সিকেলসেল নামক ব্যাধির শিকার হন না।

তবে এই জিনটি গর্ভের সন্তানের মধ্যে প্রবেশ করার সম্ভাবনা রয়েছে এবং সন্তানের পিতাও যদি এই রোগ বহনকারী হয়ে থাকেন তাহলে গর্ভের শিশু সিকেল সেল রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ sickle cell trait নামক রোগে আক্রান্ত।

সিকেল সেল রোগের লক্ষণগুলো কি কি?

সিকেল সেল রোগের লক্ষণগুলো একেক জন ব্যক্তির মধ্যে একেক ভাবে হতে পারে। সিকেল সেলে আক্রান্ত রোগী প্রায় সময়েই সুস্থ অনুভব করতে পারে কিন্তু আবার কখনো এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন যে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন পড়ে। নিম্নে সিকেলসেল রোগের বেশ কিছু সাধারণ লক্ষণ সম্পর্কে বলা হলঃ

ব্যথা: সিকেলসেল রোগে আক্রান্ত হলে যে ব্যথা অনুভূত হতে পারে সেটা মাঝে মাঝে বেশ অসহনীয়। হুট করেই এই ব্যথা শুরু হয়ে যেতে পারে এবং সাধারণত এই ব্যথা বুক, পিঠ, হাত এবং পায়ের উপর প্রভাব বিস্তার করে। এই ব্যথা বেশ তীব্র আকারও ধারণ করতে পারে এবং কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে এই ব্যথা স্থায়ী হতে পারে।

সিকেলসেল রোগের কারণে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথাও হতে পারে। আর এই ব্যথা খুব তীক্ষ্ণ ধরনের (পিন অথবা সুচ ফুটানোর মত তীব্র) অথবা শক্ত ও ধরে রাখার মত ব্যথা অনুভূত হতে পারে। সাধারণত এই ব্যথা বুকে, পিঠে, তলপেটে, ঘাড়ে অথবা মাথায় হয়ে থাকে।

জ্বর: এই জ্বর ইনফেকশনের লক্ষণও হতে পারে। কেননা সিকেলসেল রোগ আপনার স্প্লিনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলতে পারে যার ফলে ফ্লু, মেনিনজাইটিস এবং নিউমোনিয়া ধরনের ইনফেকশনের ক্ষেত্রে আপনি বেশ স্পর্শকাতর হয়ে উঠতে পারেন।

বিজ্ঞাপণ

সিকেলসেলের কারণে ফুসফুসের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, একে acute chest syndrome (ASC) বলা হয়ে থাকে। এর কারণে জ্বর হওয়ার সাথে সাথে শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যার মত আরো কিছু জটিল লক্ষণ ফুটে উঠতে পারে।

ক্লান্তি বা অবসাদ: রক্তশূন্যতার কারণে লক্ষণ দেখা যাবে এমনটা সবসময় নাও হতে পারে তবে এই রক্তশূন্যতা যত তীব্র আকার ধারণ করতে থাকবে আপনি ততই ক্লান্ত হয়ে উঠতে পারেন।

সিকেলসেল রক্তশূন্যতা অথবা beta zero thalassemia যদি আপনাকে আক্রান্ত করে তাহলে এই রোগের লক্ষণগুলো জটিল এবং তীব্র আকার ধারণ করবে। কেননা এই দুই ধরনের সিকেলসেলের কারণেই খুব বেশি সমস্যার সৃষ্টি হয়।

তবে যদি আপনার হালকা ধরনের সিকেলসেল রোগ যেমন Hb SC অথবা sickle beta plus thalassemia হয়ে থাকে তাহলে আপনার মধ্যে তুলনামূলক ভাবে লক্ষণ কম দেখা যাবে।

সিকেল সেল ডিজিজের কারণে কি ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে?

সিকেলসেল রোগের কারণে বেশ অনেক ধরনের সমস্যাই সৃষ্টি হতে পারে। হতে পারে এগুলো সাময়িক আবার হতে পারে এগুলো বেশ দীর্ঘস্থায়ী। এছাড়া তীব্র এবং হালকা উভয় ধরনের সমস্যাতেই আপনি ভুগতে পারেন। নিম্নে সিকেলসেল রোগের কিছু লক্ষণ দেয়া হলঃ

  • বুকে তীব্র ব্যথা
  • রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া
  • দৃষ্টি শক্তি (রেটিনা) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া
  • ফুসফুস এবং হৃদপিণ্ডে উচ্চ রক্তচাপ দেখা যেতে পারে।
  • শরীরের জয়েন্টগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
  • কিডনিতে সমস্যা
  • স্ট্রোক

গর্ভাবস্থায় সিকেল সেল কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে?

মাতৃত্ব কালীন যত্ন এবং ডাক্তারের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আপনি সুস্থ গর্ভাবস্থা সুনিশ্চিত করতে পারেন। তবে সিকেল সেলে আক্রান্ত হলে আপনার গর্ভাবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ বলে গণ্য করা হবে। এর মানে অবশ্য এই না যে আপনার জটিলতা দেখা দিবেই কিন্তু আপনার জটিলতা দেখা দেয়ার ঝুঁকি অন্যান্য মহিলাদের চাইতে একটু বেশি থাকবে।

ঠিক এজন্যই গর্ভকালীন সময়ে একজন হেমাটোলোজিস্ট এবং অবস্টেট্রিশিয়ানের মাধ্যমে আপনি একটু বাড়তি যত্নের মধ্যে থাকতে হবে। গর্ভকালীন অবস্থায় অতিরিক্ত ঝুঁকি থাকলে সেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও দেখাতে পারেন অথবা আপনার গায়নোকোলোজিস্ট তেমন বিশেষজ্ঞ কারো কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে আপনার চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন। আর এই গর্ভাবস্থায় আপনার গর্ভের শিশুকেও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।

গর্ভকালীন সময়ে যে জটিলতাগুলো আপনার শিশুর উপর প্রভাব ফেলতে পারে, সেগুলো নিম্নে বর্ণীত হলঃ

  • এই সমস্যায় প্লাসেন্টা দিয়ে রক্তের প্রবাহ কমে আসে যার ফলে আপনার গর্ভের শিশু অক্সিজেন এবং পুষ্টির অভাবে ভুগতে পারে। এছাড়া preeclampsia এর অন্যান্য আরো ঝুঁকি রয়েছে।
  • Intrautine growth restriction (IUGR). এমতাবস্থায় গর্ভের শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এই জটিলতা সৃষ্টি হলে গর্ভের শিশু তুলনামূলক ভাবে একটু ছোট হয় ও গর্ভের শিশুর শতকরা দশভাগ কম বৃদ্ধি হয়।
  • নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই সন্তান জন্ম নেয়া এই ধরনের জটিলতায় গর্ভধারণের ৩৭ সপ্তাহ পার হওয়ার আগেই শিশুর জন্ম হয়ে যায়। কখনো অবস্থা এমন হয়ে আসে যে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শিশুকে জন্ম দিলে বরং শিশুর নিরাপদ থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে অন্যান্য আরো অনেক কারণেই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শিশুর জন্ম হয়ে যেতে পারে।
  • Fetal anemia. এমতাবস্থায় শিশুর জন্ম গ্রহণ করার আগে তার রক্তের লোহিত কণিকা কমে আসে। আর গর্ভাবস্থায় অথবা জন্ম নেয়ার সময় রক্ত প্রদান করলে তখন শিশুর শরীরের রক্ত তার মায়ের সাথে অসঙ্গত হয়ে পড়তে পারে এবং যার ফলে এই fetal anemia হতে পারে।
  • মৃত সন্তান প্রসব সিকেলসেল রোগে আক্রান্ত হলে মৃত সন্তান প্রসবের ব্যাপারটা প্রায়শই ঘটতে দেখা যায়। যদি গর্ভের শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে আপনার ডাক্তার শঙ্কায় ভুগেন তাহলে তিনি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই inducing labor এর ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারেন।

এছাড়া অন্যান্য আর যে জটিলতা আপনার স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে সেগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলঃ

শরীরের রগের মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। একে ডাক্তারি ভাষায় venous thromboembolism অথবা VTE বলা হয়ে থাকে। সঠিক চিকিৎসা না করলে এর কারণে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

মূত্রনালিতে ইনফেকশন, নিউমোনিয়া অথবা প্রসব পরবর্তী ইনফেকশন হতে পারে।

গর্ভকালীন সময়ে যে কোন নারীর মধ্যে এই ধরনের জটিলতা দেখা যেতে পারে তবে সিকেল সেল রোগ থাকলে এগুলোর ঝুঁকি তুলনামূলক ভাবে বেশি হয়। তবে বেশীরভাগ সমস্যার ক্ষেত্রেই, আপনার যদি Hb SS অথবা sickle beta zero thalassemia থাকে তাহলে ঝুঁকি অনেক তীব্র আকার ধারণ করে এবং আপনার যদি Hb SC হয় তাহলে ঝুঁকিও অনেক কমে আসে। তবে প্রিকাল্পসিয়ার ক্ষেত্রে অবস্থা একটু ভিন্ন ধরনের, কেননা সকল ধরনের সিকেলসেলে আক্রান্ত গর্ভবতী নারীর উপরেই এটা প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

গর্ভকালীন সময়ে কি সিকেলসেল রোগের ওষুধ খাওয়া যেতে পারে?

এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আপনি ঠিক কি ওষুধ খাচ্ছেন তার উপর। যদি সম্ভব হয় তাহলে গর্ভধারণের আগে অথবা প্রাথমিক পর্যায়ে ডাক্তারকে দিয়ে আপনার ওষুধগুলো চেক করিয়ে নিন যে এগুলো আপনার জন্য এখন নিরাপদ কি না। কেননা আপনাকে হয়ত ওষুধ অথবা ওষুধের পরিমাণ পরিবর্তন করে গ্রহণ করতে হতে পারে।

গর্ভকালীন সময়ে সব নারীকেই ব্যথার ওষুধ hydroxyurea গ্রহণ করা বন্ধ করে দিতে হবে। এর পরিবর্তে সাধারণত অন্য আরেকটি ব্যথার ওষুধ acetaminophen দেয়া হয়ে থাকে। এছাড়া গর্ভকালীন সময়ে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা নাশকের জন্য কিছু বিশেষ ধরনের চেতনা নাশক ঔষধ গ্রহণেরও পরামর্শ দেয়া হতে পারে।

আপনি যদি তীব্র ব্যথায় ভুগে থাকেন তাহলে ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভকালীন সময়ে বিশেষ ধরনের চেতনা নাশক ঔষধের সাথে শিশুর মধ্যে কোন ধরনের ক্রুটি দেখা যাওয়ার মধ্যে সংযুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি তবুও শিশুর মধ্যে জন্মের পর withdrawal symptoms দেখা যাওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা থেকেই যায়। একে বলা হয়ে থাকে neonatal abstinence syndrome অথবা NAS।

একটা গবেষণায় দেখা গেছে গর্ভাবস্থায় যে নারীরা চেতনা নাশক ঔষধ গ্রহণ করে থাকেন তাদের প্রায় ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ৬ জনের শিশুর মধ্যে NAS দেখা যায়। সুতরাং এই ধরনের ওষুধ সেবন করার ঝুঁকিটা বেশ কম। এমতাবস্থায় আপনি NAS থেকে নিরাপদে থাকার জন্য ওষুধের পরিমাণ কমিয়েও সেবন করতে পারেন তবে এক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্ষ করে নিন।

গর্ভাবস্থা সিকেলসেল অসুখের উপর কি ধরনের প্রভাব বিস্তার করে?

আপনি যখন গর্ভধারণ করে থাকেন তখন আপনার গর্ভে বেড়ে ওঠা শিশুর জন্য আপনার শরীরের মধ্যে অনেক ধরনেরই পরিবর্তন আসে। আর আপনার যদি সিকেলসেল রোগ থাকে সেই পরিবর্তনগুলো আপনার জন্য একটু কষ্টদায়ক হয়ে উঠতে পারে।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে গর্ভকালীন সময়ে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য প্রচুর পরিমাণ রক্তের প্রয়োজন হয় আর যেহেতু সিকেলসেল এক ধরনের রক্তের অস্বাভাবিকতা জনিত অসুখ তাই এই অবস্থায় গর্ভধারণ করা আপনার স্বাস্থ্যের উপর বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

গর্ভকালীন সময়ে গর্ভ-ফুল এবং আপনার শিশুকে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়ার জন্য স্বাভাবিকের তুলনায় আরো প্রায় ৫০ ভাগ  পরিমাণ রক্ত চলাচল বেশি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

সুস্থ থাকার জন্য আপনার শরীরকে আরো বেশি লোহিত রক্ত কণিকা উৎপন্ন করতে হয়, তবে সাধারণত এর পরিমাণ শতকরা পঁচিশ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। আর যদি আপনার রক্তে যথেষ্ট পরিমাণ লোহিত কণিকা না থাকে তাহলে ডাক্তারি ভাষায় এই অবস্থাকে রক্তশূন্যতা বলা হয়ে থাকে (গর্ভবতী নারীদের মধ্যে এমনটা প্রায়শই দেখা যায়)।

আপনার যখন সিকেলসেল রোগ হয়ে থাকে তখন আপনার রক্তের লোহিত কণিকাগুলো স্বাভাবিকের তুলনায় দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। সাধারণ রক্ত কণিকা প্রায় ৯০ থেকে ১২০ দিন বেঁচে থাকে কিন্তু সিকেলসেলে আক্রান্ত রক্ত কণিকা ২০ দিনের বেশি বেঁচে থাকে না। আর তাই গর্ভকালীন সময়ে রক্তের এত চাহিদা পূরণ করা শরীরের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না।

ফলাফল স্বরূপ গর্ভকালীন সময়ে রক্ত প্রদান করতে প্রায়শই দেখা গিয়ে থাকে। Hb SS অথবা Sickle beta zero thalassemia তে আক্রান্ত নারীদের প্রায় অর্ধেককেই সিকেলসেল অথবা অন্যান্য জটিলতা থেকে মুক্ত রাখার জন্য রক্ত প্রদান করা হয়ে থাকে। তবে Hb SC ক্ষেত্রে এর পরিমাণটা আরেকটু কম, শতকরা মাত্র পাঁচ ভাগ নারীদেরকে এমতাবস্থায় রক্ত প্রদান করতে হয়।

গর্ভাবস্থায় সিকেল সেল রোগের ব্যথা কি আরো অসহনীয় হয়ে উঠে?

সিকেলসেল রোগের ক্ষেত্রে সবচাইতে দুশ্চিন্তার বিষয়টি হল ব্যথা, বিশেষ করে আপনাকে যদি গর্ভকালীন অবস্থার কারণে ওষুধ পরিবর্তন করতে হয়। সিকেলসেলে আক্রান্ত নারীদের গর্ভাবস্থায় প্রায়শই তীব্র ও অসহনীয় ব্যথায় ভুগতে দেখা যায়, যদিও এটা একদমই পরিষ্কার নয় যে গর্ভধারণের কারণে নাকি ওষুধ পরিবর্তনের কারণে এমনটা হয়। 

Hb SC রোগে আক্রান্ত নারীদের চার ভাগের এক ভাগকেই তীব্র ব্যথায় ভুগতে দেখা যায়। এছাড়া Hb SS, sickle beta plus thalassemia এর ক্ষেত্রে প্রায় অর্ধেক নারীদের ক্ষেত্রেই এমনটা হয়ে থাকে।

উল্লেখ্য যে সিকেলসেল রোগের কারণে তীব্র ব্যথাকে পেইন ক্রাইসিস বলা হয়ে থাকে আর এটা গর্ভকালীন সময়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। এমনকি অনেকের ক্ষেত্রে সন্তান জন্ম গ্রহণ আগ পর্যন্ত ব্যথা অনুভূত হতে দেখা যায়।

গর্ভকালীন সময়ে এই পেইন ক্রাইসিসের ঝুঁকি কীভাবে কমানো যেতে পারে?

বেশ কিছু ব্যথানাশক ওষুধ আছে যেগুলো গর্ভকালীন অবস্থায় সেবন করা একদমই নিরাপদ। তবে পেইন ক্রাইসিসের ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে প্রতীকার করার চেয়ে বরং প্রতিহত করাটাই বেশ বুদ্ধিমানের কাজ। নিম্নে কিছু উপায় বর্ণীত হলঃ

  • আপনি যদি একদম সুস্থ অনুভবও করেন, তবুও সকল ধরনের মাতৃত্ব কালীন এপয়েনমেন্টে ডাক্তার দেখাতে যান।
  • প্রচুর পরিমাণ পানি পান করে শরীরে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হওয়া থেকে বিরত থাকুন।
  • উচ্চ তাপমাত্রা পরিহার করুন।
  • প্রচুর পরিমাণে বিশ্রাম গ্রহণ করুন

এছাড়া আপনার যদি মনে হতে থাকে যে আপনার মধ্যে পেইন ক্রাইসিস দেখা যাচ্ছে, তাহলে অতিসত্বর ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।

গর্ভের সন্তানেরও কি সিকেল সেল রোগ হবে?

এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে যে সন্তানের বাবাও কি কোন অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন জিন বহন করছে কি না যার কারণে সিকেলসেল রোগ হতে পারে।

আপনার সন্তানের বাবাকেও পরীক্ষা করা হবে এটা দেখার জন্য যে তিনি সিকেলসেলের জিন বহন করছেন কি না। যদি সন্তানের বাবাও সিকেলসেলের জিন বহন কারী হয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে একজন জেনেটিক বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়ার জন্য পরামর্শ প্রদান করা হবে। তখন আপনার কাউন্সিলর গর্ভের সন্তানের সিকেলসেলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে অবহিত করবেন এবং সকল ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনাকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সাহায্য করবেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম গ্রহণ করা সকল শিশুরই সিকেলসেল আছে কি না সেটা জন্মের পরপরই পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। তবে আপনি যদি সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই এই সম্পর্কে জানতে চান তাহলে এই পরীক্ষাগুলো আপনি গর্ভকালীন সময়েও করতে পারেন। গর্ভধারণের প্রাথমিক অবস্থায় আপনি ১০ থেকে ১৩ সপ্তাহের মধ্যে chorionic villus sampling (CVS) নামক পরীক্ষাটি করাতে পারেন। অথবা দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে আপনি amniocentesis নামক পরীক্ষা করাতে পারেন।

আপনার কাউন্সিলর আপনি ও আপনার সঙ্গীকে এই পরীক্ষাগুলো করানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে এবং পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার পর মানসিক ভাবে ভেঙে না পড়ার জন্য প্রচুর সাহায্য করবেন।  

সবার জন্য শুভকামনা।        


Spread the love

Related posts

Leave a Comment