শিশুর আয়রনের ঘাটতি জনিত এনিমিয়া (Iron-deficiency anemia)

Spread the love

আপনার শিশুকে অনেক ফ্যাঁকাসে এবং ক্লান্ত দেখাচ্ছে, এটা কি রক্তশূন্যতার কারণে হতে পারে?

হ্যাঁ! ফ্যাঁকাসে দেখানো এবং ক্লান্ত লাগা রক্ত শূন্যতার প্রাথমিক কিছু লক্ষণের মধ্যে অন্যতম। অন্যান্য কিছু লক্ষণ হল দ্রুত হৃৎস্পন্দন, বিরক্ত লাগা, ক্ষুধা মন্দা, ভঙ্গুর নখ এবং কালশিটে পড়া অথবা ফুলে যাওয়া জিহ্বা। কিন্তু এই ধরনের কোন লক্ষণ দেখা যাওয়া ছাড়াও শিশুদের রক্ত শূন্যতায় ভুগতে প্রায়শই দেখা যায়।

রক্ত শূন্যতা বা এনিমিয়া কি এবং এর কারণ কি?

যখন লোহিত রক্ত কণিকা শরীরের কোষগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে না তখনই মানুষ রক্তশূন্যতায় ভুগে। অনেক কারণেই এই রক্তশূন্যতা হতে পারে, তার মধ্যে জন্মগত রোগ Sickle cell anemia অন্যতম। কিন্তু আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্তশুন্যতা বেশি পরিলক্ষিত বিষয়।

বিজ্ঞাপণ

হিমোগ্লোবিন (যে রক্ত কণিকা অক্সিজেন বহন করে) তৈরি করতে আমাদের শরীরে আয়রনের প্রয়োজন পড়ে। আর তাই আপনার শিশু যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন গ্রহণ না করে তাহলে তার অক্সিজেন বহন করা লোহিত রক্ত কণিকার পরিমাণও কম হবে। এছাড়া শরীরে বিদ্যমান কণিকাগুলো ছোট হয়ে যাবে এবং ফলাফল স্বরূপ শরীরের কোষগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় অক্সিজেন সরবরাহ কম হবে।

শিশুরা যখন হুট করেই বড় হতে থাকে ঠিক তখনই তাদের মধ্যে রক্ত শূন্যতা বেশি পরিলক্ষিত করা হয়। কেননা এই সময়ে তাদের শরীরে প্রচুর পরিমাণে আয়রনের চাহিদা থাকে এবং খাবার মাধ্যমে তাদের সেই আয়রনের চাহিদা খুব কম সময়েই পরিপূর্ণ হয়।

তবে এটা জেনে রাখবেন, রাতারাতি দুই একদিনের কারণেই কেউ রক্ত শূন্যতায় ভুগে না বরং সময়ের সাথে দীর্ঘদিনের আয়রন শূন্যতার কারণেই শরীরে রক্ত শূন্যতা তৈরি হয়।

আয়রনের ঘাটতি অনেক কারণেই হতে পারে, তার মধ্যে খাদ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন না থাকা, রক্তক্ষরণ এবং খাদ্য থেকে আয়রন গ্রহণ করতে না পারা অন্যতম।

রক্তশূন্যতা কি অনেক ক্ষতিকর?

হ্যাঁ এটা শরীরের জন্য বেশ ক্ষতিকর হতে পারে।

উপরের লক্ষণগুলো ছাড়াও রক্ত শূন্যতায় ভোগা শিশুর যে কোন ধরনের স্থায়ী শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতি হতে পারে। আরেকটা ব্যাপার মনে রাখবেন, রক্ত শূন্যতা হয়ত পরবর্তীতে ঠিক করে ফেলা যায়, তবে রক্তশূন্যতার কারণে হয়ে যাওয়া শারীরিক এবং মানসিক সমস্যাগুলো সবসময় ঠিক করা হয়ত সম্ভব নাও হতে পারে।

এছাড়া আয়রনের ঘাটতির কারণে শিশুর শরীরে যে কোন ধরনের বিষক্রিয়া এবং ইনফেকশন হতে পারে।   

আপনার শিশু কি রক্তশূন্যতার ঝুঁকিতে আছে?

৯ থেকে ২৪ মাস বয়সী সকল শিশুই রক্ত শূন্যতার ঝুঁকিতে থাকে তবে নিম্ন বর্ণীত শিশুরা একটু বেশিই রক্ত শূন্যতার ঝুঁকিতে থাকেঃ

প্রিম্যাচিউর শিশু এবং জন্মের সময় কম ওজনের শিশুরা দুই মাস অথবা তার পরে আয়রনের ঘাটতির ঝুঁকিতে থাকেঃ গর্ভাবস্থায় পূর্ণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর জন্ম নেয়া শিশুরা জন্মের আগের এক মাস মায়ের গর্ভ থেকে আয়রন সংরক্ষণ করে শরীরে মজুদ রাখে। আর সেই পরিমাণ আয়রন তাদের পরবর্তী ছয় মাস পর্যন্ত আয়রনের চাহিদা পূরণ করে থাকে।

আর প্রিম্যাচিউর শিশুরা মায়ের গর্ভকালীন সময়ে যে পরিমাণ আয়রন সংরক্ষণ করে, সেটা তাদের কেবল এক থেকে দুই মাস পর্যন্ত আয়রনের ঘাটতি পূরণ করে।

এক বছর হওয়ার আগেই যে শিশুরা গরুর দুধ খাওয়া শুরু করেঃ কেননা, গরুর দুধে আয়রনের পরিমাণ খুবই অল্প থাকে।  এছাড়া শরীরের আয়রন গ্রহণ করা থেকেও গরুর দুধ কিছুটা বাঁধা প্রদান করে আর এমনিতে অন্য কোন আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের বদলে শিশুর খাদ্য তালিকায় যদি গরুর দুধ চলে আসে তাহলে তো আয়রনের ঘাটতি হবেই সেটা স্বাভাবিক ভাবেই বুঝা যায়।

অপরদিকে গরুর দুধ শিশুর অন্ত্রে নিয়ে আসতে পারে কিছু ক্ষতিকারক প্রভাব, এমনকি মলত্যাগের সাথে রক্তপাতের কারণ হিসেবেও গরুর দুধের নাম তালিকায় চলে আসে। এই রক্তপাতের সাথে শরীরের আয়রনও বের হয়ে যায় আর ফলাফল স্বরূপ শিশু ভোগে রক্তশূন্যতায়।

বুকের দুধ পান করা শিশু যদি চার মাস বয়সের পর আয়রন সমৃদ্ধ খাবার না খায়ঃ বুকের দুধ থেকে শিশু অন্যান্য খাবারে ও ফরমুলা দুধের তুলনায় তিনগুণ বেশি আয়রন গ্রহণ করতে পারে। আর এই চার মাস বয়সের সময় শিশু হালকা শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করে আর তাই এই সময় শিশুর প্রয়োজন আয়রন ফরটিফাইড সিরিয়াল এবং অন্যান্য আয়রন সমৃদ্ধ খাবার।

যে সব শিশুরা প্রথম থেকেই ফরমুলা দুধ খায়, যদি তাদেরকে আয়রন ফরটিফাইড ফরমুলা দুধ না দেয়া হয় তাহলে শিশুর মধ্যে রক্ত শুন্যতা অথবা আয়রনের ঘাটতি দেখা যেতে পারে। তবে আশানুরূপ কথা হল এই যে, বর্তমান সময়ের বেশীরভাগ ফরমুলা দুধই এখন আয়রন ফরটিফাইড দুধ।

বিজ্ঞাপণ

আপনার কি ডাক্তারের সাথে কথা বলা প্রয়োজন?

আমেরিকান একাডেমী অফ পেডিয়াট্রিক্স এর মতে শিশুর বয়স ১২ মাস পূর্ণ হবে তখন রক্ত শুন্যতা আছে কি না পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তবে শিশুটি যদি প্রিম্যাচিউর শিশু হয়ে থাকে তাহলে এর আগেই রক্ত শুন্যতার বিষয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এছাড়া এমনিতে আপনি যদি শিশুর মধ্যে রক্ত শুন্যতার কোন ধরনের লক্ষণ দেখতে পান তাহলে শিশু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন।

শিশুর কি রক্ত শুন্যতা আছে কি না এবং শিশুর রক্তে হিমোগ্লোবিন এর পরিমাণ এবং রক্তে কি পরিমাণ লোহিত কণিকা আছে (hemoglobin and hematocrit)  সেটা জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করতে বলবেন। 

আপনি কি শিশুর রক্তশূন্যতা রোধ করতে পারবেন?

হ্যাঁ! আপনি চাইলেই আপনার শিশুকে নিম্ন বর্ণীত উপায়ে রক্ত শুন্যতায় ভোগা থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেনঃ

আপনার শিশু যদি প্রিম্যাচিউর অবস্থায় জন্ম নেয় এবং ওজন কম থাকে তাহলে তাকে কি আয়রন সাপলিমেন্ট দেয়ার প্রয়োজন আছে কি না সেটা জানার জন্য ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।

শিশুর বয়স এক বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান অথবা আয়রন ফরটিফাইড ফরমুলা দুধ খাওয়ান। এক বছরের আগে শিশুকে কখনো গরুর দুধ খাওয়াবেন না।

আপনার শিশু যদি চার মাস বয়স পার করার পরেও শক্ত কোন খাবার না খেয়ে শুধুমাত্র বুকের দুধ পান করে তাহলে আমেরিকান একাডেমী অফ পেডিয়াট্রিক্স এর মতে শিশুকে দৈনিক ১১ মিলিগ্রাম আয়রন সাপলিমেন্ট দেয়া প্রয়োজন যতক্ষণ পর্যন্ত না সে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া শুরু করে।

বাচ্চা যখন সলিড খাবার শুরু করে তখন তাকে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ান।

শিশুকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল এবং  শাক-সবজি খাওয়ানোর অভ্যাস করুন, যেমনঃ কিউই, এভোকাডো, ক্যান্টালোপ ইত্যাদি। ভিটামিন সি শরীরকে অন্যান্য খাবার থেকে আয়রন গ্রহণ করতে সাহায্য করে।

শিশুর রক্তশূন্যতার প্রতীকার এবং চিকিৎসা কি?

শিশু যখন থেকেই শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করে তখন থেকেই শিশুকে প্রচুর পরিমাণে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে। তবে শরীরের রক্ত শুন্যতার প্রতীকার হিসেবে সবসময় খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন কাজে দেয় না। আপনার শিশুর হয়ত ড্রপারের মাধ্যমে দেয়া হয় এমন আয়রন সাপলিমেন্টের প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিন।

পেট খালি থাকা অবস্থায় শরীর সবচাইতে বেশি আয়রন গ্রহণ করতে পারে। তবে শুধুমাত্র আয়রন আপনার শিশুর পাকস্থলীতে কিছু অস্বস্তি তৈরি করতে পারে (এমনকি এই সাপলিমেন্ট খেতেও তেমন সুস্বাদু নয়) তাই ডাক্তাররা আপনাকে পরামর্শ দিতে পারেন যে আপনি যাতে করে খাবার, বুকের দুধ অথবা ফরমুলা দুধের সাথে আয়রন সাপলিমেন্ট মিশিয়ে খাওয়ান।

বিজ্ঞাপণ

এছাড়া সাপলিমেন্ট কাজ করছে কি না এটা জানার জন্য, সাপলিমেন্ট খাওয়ানো শুরু করার দুই এক মাস পরেই ডাক্তার হয়ত হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ আবার চেক করে নিতে পারেন।

সাধারণত রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ঠিক হতে সাপলিমেন্ট খাওয়ানো শুরু করার পরেও প্রায় মাস দুই এক সময় নেয় এবং শরীরের আয়রনের সংরক্ষণ সঠিক পরিমাণে নিয়ে আসতে প্রায় ছয় থেকে বারো মাসের মত সময় লাগতে পারে। এরপরে সাপলিমেন্ট বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খেলেই হবে।

শুধুমাত্র সতর্ক থাকার জন্য কি শিশুকে আয়রন সাপলিমেন্ট খাওয়ানো যাবে?

হ্যাঁ এটা সত্য যে শরীরের জন্য আয়রন সাপলিমেন্ট খুবই উপকারী, তবে অতিরিক্ত আয়রনের কারণে শরীরে বিষক্রিয়াও হতে পারে। তাই শিশুকে অতিরিক্ত আয়রন সাপলিমেন্ট দেয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিবেন। ডাক্তাররা সাধারণত বুকের দুধ পান করা শিশুকে চার মাস বয়সের পর আয়রন সাপলিমেন্ট খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

আপনার বাসায় যদি আয়রন সাপলিমেন্ট অথবা অন্য যে কোন ধরনের ওষুধ থেকে থাকে, তাহলে অবশ্যই সেগুলো নিরাপদ স্থানে শিশুর নাগালের বাইরে রেখে দিন।  

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment