গর্ভাবস্থায় রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম | পায়ে অস্থিরতা

Spread the love

কখনো কি ভেবেছেন আপনার পা দুটো আপনার কথা না শুনলে কেমন লাগবে?  যদি  রাতে হঠাৎ ঘুম ভেংগে পা দুটো নাড়ানোর অদম্য ইচ্ছা হয়? শুনতে অবাক লাগলেও এমনটা হওয়া কাল্পনিক কিছু নয়।  এটি একটি রোগ যা রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম (Restless leg syndrome) বা আরএলএস নামে পরিচিত।

পুরুষের চাইতে মহিলারাই বেশি আক্রান্ত হন এই রোগে।  গর্ভাবস্থায় প্রায় এক তৃতীয়াংশ মহিলার ক্ষেত্রে রেস্টলেস লেগ সিনড্রোমের উপসর্গ  দেখা দেয় ।

বিজ্ঞাপণ
গর্ভাবস্থায় রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম

রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম কি?

এটি স্নায়ুতন্ত্রের সাথে জড়িত এমন একটি রোগ যাতে রোগীর অনবরত পায়ে অস্বস্তি ও যন্ত্রণা হয়। পায়ে শিরশিরে ভাব ও প্রদাহ থেকে মুক্তি  পেতে রোগী অনবরত পা নাড়াতে থাকেন বা পা নাড়ানোর তাড়না অনুভব করেন। গর্ভাবস্থায় তো বটেই, যেকোন মানুষের ক্ষেত্রে যেকোন সময়ে এই রোগ হতে পারে। 

গর্ভাবস্থায় কেন হয় রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম?

গবেষকরা আদৌ রেস্টলেস লেগ সিনড্রোমের সুনির্দিষ্ট কোন কারণ পাননি।  তবে, কিছু তত্ত্ব রয়েছে।  বলা হয়ে থাকে, শরীরে বিভিন্ন ক্যামিকেলের তারতম্য এই সিনড্রোমের জন্য দায়ী। আবার কিছু গবেষণা দাবী করে,  গর্ভাবস্থায় হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে এটি ঘটে।  কেউবা আবার বংশধারাকে দায়ী করেছেন।

  •  জিনগত কারণ: আমাদের চুলের রঙ থেকে শুরু করে আকার আকৃতি সবেতেই জিনের প্রভাব থাকে।  মানবশরীরে অনেক রোগই জীনবাহিত কারণে হয়ে থাকে।   যদি আপনার পরিবারে কারো  রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম পূর্বে হয়ে থাকে, তবে আপনারও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে।
  • ক্যামিকেলের তারতম্য: আমাদের মস্তিষ্কে বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক পদার্থ স্নায়ুর কাজকর্মে ভূমিকা রাখে। এই রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার খুবই পরিচিত এবং  ডোপামিনের শক্তিশালি ভূমিকা রয়েছে আমাদের চলাফেরায়। রেস্টলেস লেগ সিনড্রোমের একটি মূল কারণ হিসেবে ধরা হয় শরীরে ডোপামিনের অস্বাভাবিকতা।  এর প্রভাবে শরীরের পেশীর স্বাভাবিক নড়াচড়ার বদলে অনিয়ন্ত্রিত চালনা হতে পারে।
  • হরমোনাল পরিবর্তন : গর্ভাবস্থায় প্রোজেস্টেরন ও এস্ট্রোজেন হরমোনের নাটকীয় বৃদ্ধি যেমন জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তেমনই কিছু অস্বস্তিকর অবস্থাও তৈরী করে।  এর ফলে দেখা দিতে পারে রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম! এই নাটকীয় পরিবর্তন বৃদ্ধি পায় থার্ড ট্রাইমেস্টারে অর্থাৎ শেষ তিন মাসে, আবার প্রসবের পর স্বাভাবিক হয়ে আসে।
  • পুষ্টির অভাব: আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল আয়রন এবং ফলিক এসিড।  ফলিক এসিড হল এক ধরণের ভিটামিন। এদের অভাবে শরীরে রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম হতে পারে।  এর মধ্যে ফলিক এসিডে ও আয়রনের মাত্রা কমে যাওয়ায় পেশীতে দুর্বলতাও দেখা দেয়। 

এছাড়াও বিশ্রাম ও ঘুমের অভাব, হতাশা,  দুশ্চিন্তা থেকে রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম তৈরী হয় অনেক ক্ষেত্রে।

রেস্টলেস লেগ সিনড্রোমের লক্ষণ

রেস্টলেস লেগ সিনড্রোমে রোগীদের অভিজ্ঞতা হয় বিভিন্নরকম।  কেউ মাঝে মাঝে অনুভব করেন উপসর্গ,  কেউবা প্রতিদিনই।

পা টানা বা খোঁচার মত অনুভূতি,  কারো ব্যাথা বা জ্বলুনী হতে থাকে। অস্বস্তিকর অনূভুতির কারণে রোগীর পা নাড়াতে ইচ্ছে হয়।  এতে কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি মিললেও পা নাড়ানো বন্ধ করলেই আবার ফিরে আসে যন্ত্রণা।  রাতভর ঘুমুতে পারেন না রোগী।  দিনটা কাটে ঝিমুনি ও দুর্বলতায়। 

সন্ধ্যা বা রাতের দিকে প্রকট হতে থাকে উপসর্গগুলো।  অনেক্ষণ নিষ্ক্রিয় থাকলেও এমনটা হতে পারে। যেমন, যানবাহনে অনেক্ষণ ভ্রমণের সময়ে বা রাতে ঘুমাতে গেলে উপসর্গ বৃদ্ধি পায়।  এমনকি শুধু পায়ে সীমাবদ্ধ না থেকে হাতেও ছড়িয়ে পড়ে ব্যাথা অনেকসময়।

একনজরে উপসর্গসমূহ :

  • পায়ে অস্বস্তিকর অনুভূতি,  পা নাড়ালে খানিক্ষণ ভালো লাগলেও পা নাড়ানো বন্ধ করলেই আবার সমস্যা দেখা দেয়।
  • পায়ে জ্বালাপোড়া অনুভুত হয়।
  • রোগীর মনে হতে থাকে পা বেয়ে কিছু একটা উঠে আসছে।
  • রাতে বা বিশ্রাম নেয়ার সময় উপসর্গ বেড়ে যায়।  ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে বারবার। সারাদিন রোগীকে ক্লান্ত দেখায়।  খিটখিটে আচরণ করতে থাকে। 

ঘরোয়া চিকিৎসায় সারান রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম

খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করুন 

১. কফি, ক্যাফেইন, সোডা খাওয়া থেকে পুরোপুরি বিরত থাকুন। সামান্যমাত্রার ক্যাফেইনও আপনার উপসর্গ অনেকগুণ বাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট।  

২. আয়রন যুক্ত খাবার খাওয়া : আরএলএস এর একটি অন্যতম কারণ হতে পারে আয়রণ ঘাটতির কারণে তৈরী হওয়া রক্তশূন্যতা।   এজন্য অধিক পরিমাণের আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া জরুরী.  মাছ, লাল মাংস, মটরশুটি, পালংশাক এগুলো আয়রণের অন্যতম উৎস। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় ডাক্তার যে আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দেন তা নিয়মিত খাওয়ার চেষ্টা করুন।

৩. ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি পূরণ : সবুজ শাকসব্জি, শিম বাদাম জাতীয় খাবার শরীরের ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি পূরণ করে।  প্রতিদিনের খাবার তালিকায় এসব খাবার যুক্ত করুন। তবে অতিরিক্ত ম্যাগনেসিয়াম ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে  পারে।

শারীরীক ব্যায়াম

প্রতিদিনের রুটিনে হাল্কা ব্যায়াম রাখুন।  সকালে উঠে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করা যেতে পারে।  সাঁতার কাটা বা যোগব্যায়াম ভালো ফল দিতে পারে। দীর্ঘক্ষণ একই স্থানে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকবেন না।

নিরুপদ্রব ঘুমের জন্য করণীয়

ঘুমের সময়টা নির্ধারিত রাখুন। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও একই সময়ে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস গড়ে তুলুন। রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে হালকা উষ্ণ পানিতে গোসল করে নিতে পারেন। এতে আপনার ঘুম গভীর ও আরামদায়ক হবে।

বিজ্ঞাপণ

ঘুমানোর আগে ৩০ মিনিট এমন কোন কাজ করুন যা আপনার চিন্তাভাবনাকে শিথিল করে ।  যেমন: মেডিটেশন বা বই পড়া।  ওই সময়ে যেকোন ধরণের ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যাবহার থেকে বিরত থাকুন। 

ঘুমের সময় হাঁটুর নিচে বালিশ দিতে পারেন।  গর্ভাবস্থায় বামদিক করে শোয়াই ভালো, এতে রক্তসরবরাহ বৃদ্ধি পায়। 

রাতে রেস্টলেস লেগ সিন্ড্রমের কারণে ঘুম ভেংগে গেলে করণীয় : 

  • পায়ে মালিশ করুন
  • গরম শেঁক দিন.
  • হাল্কা হাটাহাটি করুন.
  • পা নাড়াচাড়া করুন.
  • বই পড়ুন বা এমন কোন কাজ করুন যা আপনার উপসর্গ গুলোকে ভুলে থাকতে সহায়তা করবে।

বিভিন্ন ডিভাইসের সাহায্য গ্রহণ: 

ফুট র‍্যাপ: ফুট র‍্যাপের ব্যাবহারের ফলে আপনার আরএলএস এর যন্ত্রণা কমতে পারে।  তবে এটি প্যাঁচানোর সময় সাবধান থাকা জরুরী যাতে রক্তচলাচল বাধাগ্রস্থ না হয়।

ভাইব্রটিং প্যাড : ঘুমানোর সময় ভাইব্রেটিং প্যাড ব্যাবহার করলে সুফল পেতে পারেন।  উপসর্গ না কমালেও এটি আপনার নিদ্রাকে আরামদায়ক ও গভীর করতে সহায়তা করবে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এটি ব্যাবহার করা উচিত নয়।

কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে

ঘরোয়া চিকিৎসায় কোন সমাধান না হলে বা খুব বেশি অসুবিধা হলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। আরএলএস সাধারণত সন্তান প্রসবের পরপরই ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু ব্যাতিক্রম কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা প্রসবের পরেও রয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনার উপসর্গ ধীরে ধীরে কমে আসছে কিনা খেয়াল রাখুন।   যদি উপসর্গ এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যে আপনার প্রতিদিনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে থাকে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়াটা আপনার জন্য জরুরী। 

রোগ নির্ণয় :

রেস্টলেস লেগ সিন্ড্রমের উপসর্গ আরো বিভিন্ন রোগের সাথে মিলে যায়।  এজন্য চিকিৎসকরা আগে বিভিন্ন পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হতে চান।  এক্ষেত্রে সবার আগে শরীরে আয়রণের মাত্রা নিশ্চিত করার জন্য পরীক্ষা করা হয়।

বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে তাঁরা নিশ্চিত হন যে রোগী আরএলএস এর সমস্যায় ভুগছে,  যেমন: 

  • কি কি উপসর্গ অনুভব করছেন রোগী? 
  • উপসর্গ কখন বৃদ্ধি পায়?  বসে থাকা অবস্থায় নাকি শুয়ে থাকলে?  
  • ব্যাথা কি হাটাহাটি করলে কমে যায় কিনা?
  • রাতে  উপসর্গ বেড়ে যায় কিনা? 

চিকিৎসকরা সাধারণত যেসব ওষুধ দিয়ে থাকেন

আয়রন সাপ্লিমেন্ট: যেহেতু আরএলএস এর একটি প্রধান কারণ হল আয়রণের ঘাটতি জনিত রক্তশূন্যতা। তাই চিকিৎসকেরা প্রধানত আয়রণ সাপ্লিমেন্ট দিয়ে থাকেন। 

রেস্টলেস লেগ সিনড্রোমে ব্যাবহৃত বেশিরভাগ ওষুধই গর্ভাবস্থায় নিরাপদ নয়। তাই ডাক্তাররাও এসব ক্ষেত্রে ঘরোয়া পদ্ধিতিতেই এই সমস্যা প্রতিকারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে যদি সমস্যা গুরুতর হয়ে ওঠে তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু ওষুধ দেয়া হতে পারে। 

যেহেতু ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, তাই অনেক রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা ঘুমের ঔষধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। 

ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া যেকোন ওষুধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন।

প্রসবের পরও কি রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম থাকতে পারে?

বাচ্চা জন্মানোর পর আপনার শরীরের অবস্থা পূর্বের মত স্বাভাবিক হয়ে গেলেই রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম দূর হয়ে যায়।  একেবারেই দূর্লভ কিছু ঘটনা রয়েছে যেখানে মায়েরা প্রসবের পরেও সমস্যাগুলো অনুভব করেন। এক্ষেত্রে কি কারণে আরএলএস হচ্ছে আগে তা জানা জরুরী। বিভিন্ন রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও আরএলএস দেখা দেয়। অতএব,  ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন এবং কারণ অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা নিন।

রেস্টলেস লেগ সিনড্রোমে আক্রান্ত মায়েদের জন্য রাতগুলো হয়ে দাঁড়ায় দুর্বিসহ। দিনভর ক্লান্তি তাদের প্রাত্যহিক জীবনকে করে তুলে খিটখিটে। সাধারণ ও সহজ কিছু চিকিৎসায় তারা মুক্তি পেতে পারেন যন্ত্রণা থেকে। তাই যেকোন মায়েরই রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম সম্পর্কে জানা জরুরী। 

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment