শিশুকে শৃঙ্খলা শেখাতে বা শাসন করতে প্রায় সব বাবা-মা শাস্তির সাহায্য নেয়। আমরা মনে করি শাস্তির ভয় দেখিয়ে শিশুকে সঠিক পথে পরিচালিত করা সম্ভব। যে ব্যাপারটি আমরা খেয়াল করিনা বা করতে চাইনা তা হলো শাস্তির ফলে শিশুর মনে যে নেতিবাচক প্রভাব পরে এবং তা তার বিকাশকে কতোখানি বিঘ্নিত করে।
শাস্তি ও শৃঙ্খলার মধ্যে পার্থক্য কি?
শৃঙ্খলা হচ্ছে শিশুকে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, আত্মবিশ্বাস ও দায়িত্ব শেখানোর এক উপযুক্ত কৌশল। কোনটা ভাল, কোনটা ভুল, কোনটা করা যাবে, কোনটা করা যাবেনা এই সব কিছু শিশুকে সুন্দর করে রপ্ত করানোর পন্থাই হচ্ছে শৃঙ্খলা।
কোনধরনের আক্রমনাত্নক আচরণের প্রকাশ না করে কাওকে কোন নিয়মের ছকে বেঁধে ফেলাই হচ্ছে শৃঙ্খলা। শিশুদের জন্য শৃঙ্খলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন আচরণটি সঠিক আর কোন আচরণ বর্জনীয় এই শিক্ষা দিতে শৃঙ্খলার কোন বিকল্প নেই।
শিশুদের জন্য বাঞ্ছনীয় আচরণ কি হবে, কিভাবে শিশুর রাগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কিভাবে কোন উত্তেজিত বাচ্চাকে শান্ত করা যায়, এসবই হচ্ছে শৃঙ্খলার অন্তর্ভুক্ত বিষয়।
শাস্তি একটি নেতিবাচক শব্দ এবং শিশুদের জন্য অনেকাংশেই ক্ষতিকর। শিশুদের কোন ভুল বা অপ্রত্যাশিত আচরণের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া মনে করা হয় শাস্তিকে। আদতে শাস্তি একটি বর্জনীয় আচরণ যা শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাঁধার সৃষ্টি করে।
শাস্তির উদ্দেশ্য হল-
- ক্ষমতা ও শক্তি প্রয়োগ করে আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা
- শিশুর মনে স্থায়ী ভয় গেঁথে দেয়া
- শুধুমাত্র শিশুর ভুলগুলোকেই গুরুত্ব দিয়ে তাদের সংশোধন করা
শাস্তি মা-বাবা ও সন্তান উভয়ের জন্যই হানি-কারক। শাস্তি পেলে শিশু যেমন ক্ষুব্ধ হয় তেমনি শিশুকে আঘাত করে বাবা-মাও মানসিকভাবে অস্থির হয়ে পড়েন।
শাস্তি ও শৃঙ্খলার প্রধান বৈসাদৃশ্য ধরা পরে এদের কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে। শাস্তি হচ্ছে শিশুকে ভয় দেখিয়ে বা বল প্রয়োগ করে শৃঙ্খলা শেখানোর এক ধরনের চেষ্টা। শৃঙ্খলা হচ্ছে শিশুকে ভাল-খারাপের পার্থক্য শিখিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল।
কেন শিশুকে শৃঙ্খলা শেখাতে শাস্তির উপর নির্ভর করা উচিত নয়?
শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশে শাস্তির কিছু উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর দিক রয়েছে। শাস্তির এই নেতিবাচক প্রভাবের কারণেই শাস্তির উপর নির্ভর করা উচিত নয়।
নিউরোলজিস্টদের মতে আমাদের ব্রেইনের তিনটি অংশ আছে। সহজ ভাষায় বললে এগুলো হলো –
রেপটিলিয়ান ব্রেইন (Reptilian brain) – মস্তিষ্কের এই অংশটি আমাদের শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন- শ্বাস প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন, পরিপাক এবং আমাদের টিকে থাকার বিভিন্ন কাজ যেগুলো আমাদের শরীর অচেতনভাবেই করে থাকে।
মামালিয়ান ব্রেইন (Mammalian Brain) – এই অংশটিকে ইমোশনাল ব্রেইনও বলে যেটি আমাদের আবেগ অনুভূতি, ভয়, উদ্বেগ, মায়া, ভালোবাসা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে।
হিউম্যান ব্রেইন (Human Brain)– এটি আমাদের থিঙ্কিং ব্রেইন যা আমাদের শেখা, সমস্যার সমাধান করা, ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ জটিল সব চিন্তাভাবনা মস্তিষ্কের এই অংশেই হয়।
শৃঙ্খলা ও শাস্তির পার্থক্য হলো শৃঙ্খলা আমাদের থিঙ্কিং ব্রেইন বা হিউম্যান ব্রেইনকে প্রভাবিত করে আর শাস্তি আমাদের ইমোশনাল ব্রেইনকে।
অনেকেই মনে করেন শাস্তির মাধ্যমে ভয় দেখানো হলে শিশু তার আচরণ শুধরে নেবে। তবে সত্যিটা হলো নিয়মিত ভয় দেখানো হলে তা শিশুর মস্তিষ্কে অনেকভাবেই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
মানসিক সমস্যা
যখন আমরা হঠাৎ ভয়ের কিছু দেখি তখন কোনকিছু না ভেবেই লাফিয়ে পেছনে সরে আসি। সে সময় আমাদের থিঙ্কিং ব্রেইন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং ইমোশনাল ব্রেইন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। যদি এটি খুব ভয়ের কিছু হয় তা আমাদের মনে দাগ কাটে এবং আলাদা স্মৃতি হিসেবে ব্রেইনে রয়ে যায়। এবং ভবিষ্যতে এই ধরণের পরিস্থিতিতে যাতে পড়তে না হয় সে বিষয়ে আমরা সচেতন হয়ে যায়।
এই ধরণের অতিরিক্ত ভয় প্রসূত স্মৃতি থেকে পরবর্তীতে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, যেমন- বিষণ্ণতা, উদ্বেগজনিত সমস্যা, posttraumatic stress disorder (PTSD) ইত্যাদি।
এখন অনেকেই বলতে পারেন বাচ্চাকে শাস্তি দেয়া মানে খুব ভয়ের কিছু বা জীবন মরণ কোন সমস্যা তো না। হ্যাঁ, আমাদের মত প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য হয়তো এটা খুব বড় বিষয় নয় কিন্তু শিশুদের জন্য এটা অনেক বিশাল।
ধরুন কেউ আমাদের আঘাত করলো বা মনে খুব কষ্ট দিলো। এই বিষয়গুলো থেকে বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্কই খুব সহজে বেরিয়ে আসতে পারে। কেউ বন্ধুবাধবের সাথে কথা বলে, কেউ অন্য কাজে মন দিয়ে আবার কেউ বা সেই ব্যাক্তির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। মোট কথা আমাদের অনেক ধরণের অপশন থাকে।
কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাবা মাই তাদের কাছে সবকিছু, পুরো পৃথিবী। তাদের প্রতিটি বিষয়ের জন্য তারা বাবা মায়ের উপরই নির্ভরশীল। তাদের আর কোন অপশন থাকেনা। তাই বাবা মায়ের খারাপ ব্যবহার তাদের কাছে জীবন মরণ সমস্যার মতই।
এই জাতীয় আচরণ তার ইমোশনাল ব্রেইনকে অনবরত নাড়া দিতে থাকে এবং তার থিঙ্কিং ব্রেইন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে এর প্রভাব স্বরূপ বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সূত্রপাত হতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে বেড়ে ওঠা শিশুদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা হয়। তাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণেও সমস্যা দেখা দেয় এবং আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এতে শিশুরা মনে করে হিংসা ও প্রতিশোধই সমস্যা সমাধানের এক মাত্র পথ। বড়রা যা করে শিশুরা তা অনুকরণ করে। শিশুরা এটা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে হিংসার প্রয়োগে কোনও ভুল নেই। তারা তাদের বাবা মা বা শিক্ষককেও অসম্মান করে। শারীরিক অত্যাচারে ভুক্তভোগী শিশু বড় হয়ে নিজের শিশু, স্ত্রী/স্বামী বা বন্ধুদের ওপর অত্যাচার করতে পারে।
শারীরিক সমস্যা
নিয়মিত ভয় দেখানো হলে স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে যা পরবর্তীতে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যারও সূচনা করতে পারে, যেমন- শিশুর মনে রাখা ও কিছু শেখার ক্ষেত্রে দুর্বলতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি।
পারস্পরিক সম্পর্কে ক্ষত সৃষ্টি
শিশুর কাছে বাবা-মা হচ্ছে সবচেয়ে নির্ভরতার জায়গা। শিশুর কোন ভুলের ফলস্বরূপ যখন তাকে শাস্তি দেয়া হয় বিশেষ করে যদি তা হয় শারীরিক তখন সে তার বাবা-মার উপর রেগে যায় এবং তাদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। এতে করে সন্তান ও পিতা-মাতার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।
শিশুকে বিদ্রোহী করে তোলে
অনেকসময় শাস্তি বাচ্চাদের মধ্যে তীব্র রাগের সঞ্চার করে। আপনি হয়ত তাকে ভুল পথ থেকে সরাতে শাস্তি দেয়াটাই উত্তম মনে করেন কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এর বিপরীত ঘটে। শিশুকে শাস্তি দেয়া হলে সে মনে মনে ক্ষোভ পুষে রাখতে পারে। এভাবে ধীরে ধীরে বাচ্চা বিদ্রোহী আচরণ করা শুরু করে।
শিশুর আত্নমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়
যেসব বাচ্চারা ক্রমাগত শাস্তির সম্মুখীন হয় তারা সাধারণত এক ধরনের আত্মগ্লানিতে ভোগে। তাদের কাছে মনে হয় যে তাদের কেউ ভালবাসেনা এবং তারা হয়ত কোন খারাপ মানুষ। এভাবে নিজের সম্পর্কে তাদের মনে খারাপ ধারণা তৈরি হয়।
শাস্তির নামে যে কাজগুলো কখনোই করা যাবেনা
বাচ্চাকে শাস্তি দিতে গিয়ে অথবা শৃঙ্খলা শেখাতে গিয়ে আমরা অনেকসময় অনেক ভুল পদক্ষেপ নেই যা নিতান্তই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে বাচ্চার জীবনে। আসুন দেখে নেই কোন কাজগুলো অবশ্য বর্জনীয় শিশুর বেড়ে ওঠার স্বার্থে।
গায়ে হাত তোলা
বাচ্চাকে শাসন করতে গিয়ে কখনোই তার গায়ে হাত তোলা যাবেনা। মারধোর করলে বাচ্চার মনে স্থায়ী ক্ষোভ, ভয় ও হতাশার জন্ম হয় যা তার বিকাশে বাঁধার সৃষ্টি করে। আমরা মনে করি যে বাচ্চাকে মেরে তাকে শাস্তি দেয়া হলে সে আর সেই ভুলটি করবেনা কিন্তু এই ধারনা সঠিক নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর উল্টা ঘটে।
তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা
বাচ্চাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা মোটেও ঠিক নয়। অনেকেই সন্তানকে শাস্তি দিতে গিয়ে তাকে ছোট করে কথা বলে যা নিতান্তই একটি ভুল অভ্যাস। সবার সামনে শিশুকে অপমান করলে তার আত্ন-সম্মানে লাগে বিষয়টি এবং নিজেকে সে ক্ষুদ্র ভাবতে শুরু করে।
অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করা
শব্দ চয়নে খুব সতর্ক হতে হবে। তুমি কিছু পারো না, তোমাকে দিয়ে কিছু হবেনা, তুমি একটা অপদার্থ, তুমি বোকা, ইত্যাদি কথাগুলো আমরা হরহামেশাই ব্যবহার করি। এই অপমানজনক কথাগুলো শিশুকে আঘাত করে। সে নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। তাকে শাসন অবশ্যই করতে হবে তবে গঠনমূলক উপায়ে।
আরও পড়ুন– চাইল্ড শেইমিং এর ক্ষতিকর দিক এবং কিভাবে তা এড়িয়ে চলবেন
ভয় দেখানো
শাস্তির অংশ হিসেবে তাকে ভয় দেখানো যাবেনা। আমরা বাচ্চাদের অনেকসময় ভয় দেখাই এভাবে যে ভাত না খেলে রাক্ষস আসবে কিংবা ঘুমিয়ে পরো নয়ত ভুত ধরে নিয়ে যাবে। এরকম কাজ করা একদমই অনুচিত।
শিশুর বাবা/মা কে সংযুক্ত করে তাকে বকা দেয়া
অনেকসময় শিশুকে তার বাবা অথবা মার সাথে যুক্ত করে অপমান করা হয়। তুমি একদম তোমার মার রাগ পেয়েছ কিংবা তোমার অবস্থা তোমার বাবার মতই খারাপ, এরকম কথা বাচ্চাকে বলবেন না।
কথা বলা বন্ধ করা
বাচ্চাকে শাস্তি দিতে গিয়ে তার সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা ঠিক নয়। তাকে বুঝাতে হবে আদর ও ভালোবাসা দিয়ে।
শাস্তির ক্ষতিকর দিকগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে শিশুকে শাস্তি দিলে তার মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পক্ষান্তরে, শিশুকে যদি ইতিবাচক উপায়ে শাস্তি ছাড়াই নিয়ম-শৃঙ্খলা শেখানো যায় তা তার স্বাভাবিক ও সুন্দর বিকাশে সাহায্য করবে।
শাস্তি দিতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা সীমা ছাড়িয়ে যাই। বাবা-মা উত্তেজিত হয়ে প্রচণ্ড বকাঝকা কিংবা মারধোর করে যা শিশুকে তীব্রভাবে আহত করে। এরকম পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে পরিবারে শাস্তিবিহিন শৃঙ্খলার চর্চা করা।
আরও পড়ুনঃ শাস্তি ছাড়াই কিভাবে শিশুকে শৃঙ্খলা শেখানো যায়
সবার জন্য শুভকামনা।