শিশুর নিয়মানুবর্তিতা (Discipline) শিক্ষা

Spread the love

লিখেছেন Sharmin Shamon

আদর-ভালোবাসার পরেই সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ যে উপহারটি আপনি আপনার বাচ্চাকে দিতে পারেন তা হলো ডিসিপ্লিন বা শৃঙ্খলা। কিন্তু একই সাথে এটা অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ বা কঠিন কাজ মা-বাবাদের জন্য।

বিজ্ঞাপণ

ডিসিপ্লিন হলো শেখানোর বিষয়, শাস্তি দেয়া নয়। ধরুন আপনার বাচ্চা এমন কিছু করছে যা করা ঠিক না, আপনি তাকে বার বার সেটা করা থেকে থামাচ্ছেন যতোক্ষন না বাচ্চা নিজেই সেটা থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা শিখছে। এটাও একধরনের ডিসিপ্লিন শেখানো।

তবে এই থামানোর কাজটি করতে হবে অত্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আর ভালোবাসা দিয়ে যেন বাচ্চাটি বুঝতে পারে সে ঠিক করছে না এবং তাতে করে সে নিজেই নিজকে নিয়ন্ত্রন করতে শিখে যায়। আপনি কিছু বেসিক কাজের মাধ্যমে বাচ্চাকে ডিসিপ্লিন শেখানো শুরু করতে পারেন।

বাচ্চাকে একটি নির্দিষ্ট রুটিন দিয়ে শুরু করতে পারেন ডিসিপ্লিন শেখানোর প্রথম পাঠ। মনে রাখবেন মা হচ্ছে বাচ্চার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ ব্যক্তি যার প্রভাব বাচ্চার জীবনে অন্য সবার থেকে বেশি পড়ে৷ একটা বাচ্চা খুবই নড়বড়ে, প্রতিরোধহীন (অনেকটা কাঁদামাটির মতো, যেমনটা বলা হয়ে থাকে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে), আর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে থাকে তার ভালোবাসা, খাবার, নিরাপত্তার জন্য।

একটি বাচ্চা জন্মের কিছুদিন পরেই শিখে যায় যে তার ক্ষুধা লাগলে কেউ একজন তাকে খাওয়াবে, তার ডায়পার বদলে দেবে, ক্লান্ত হলে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে, তাকে নিরাপদ অনুভব করাবে। আর এই সবই যখন সুন্দর আর ধারাবাহিকভাবে হয় বা হতে থাকে তখন বাচ্চাও মনে করতে থাকে বা তার ব্রেইন এটা ধরে নেয় যে তার জীবন, তার পৃথিবীটা একটা নির্দিষ্ট নিয়মে চলছে৷ আর এভাবেই শুরু হয় ডিসিপ্লিন শেখা এবং শেখানো।

আমাদের দেশে এমন মা হয়তো কম আছে যাকে শুনতে হয়নি যে ‘বাচ্চাকে এতো কোলে নিয়ে রেখো না, বদভ্যাস হয়ে যাবে, বা কাঁদছে কাঁদুক’ কিন্তু আপনার ছোট বাচ্চাটি যখন কাঁদে সে আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্য কাঁদেনা। হয়তো সে ক্ষুধার্ত, বা তার ডায়পার চেইঞ্জ করতে হবে, বা তার কোথাও ব্যথা, হয়তো অনিরাপদ বোধ করছে৷

আর যেহেতু কান্না ভিন্ন অন্যকোন ভাষা তার জানা নেই তাই সে কান্নার মাধ্যমেই তার প্রয়োজন প্রকাশ করছে। বাচ্চার কান্নাকে বুঝে সে অনুযায়ী দ্রুত সাড়া দেয়া উচিত যেন বাচ্চা নিরাপদ বোধ করে। আর একজন নিউবর্ণ বেবি যখন তার জীবনের প্রথম ৬ মাস ধারাবাহিক ভালোবাসা আর সঠিক যত্ন পায় সে বাচ্চাটি অন্য অনেক বাচ্চার থেকে ইজি আর ম্যানেজেবল বাচ্চা হয়ে থাকে।

কার্যকরী ডিসিপ্লিনের তৈরির ক্ষেত্রে কিছু টিপসঃ

টিপস ১

বয়স অনুযায়ী খুবই উপযোগী আর বাস্তবসম্মত একটি রুটিন সেট করা, যেটা আপনার বাচ্চার জন্য যৌক্তিক আর উপকারী হবে। সেই রুটিনে তার জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের সময় রাখা, খাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় রাখা, খেলার, পড়ার সময় রাখা। তবে রুটিনে যত বেশি দৃড় থাকা যায় ততো ভালো। ঘন ঘন রুটিন পরিবর্তন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

টিপস ২

বাচ্চাকে আগে থেকেই পরবর্তী কাজের ব্যাপারে বলা। এতে করে বাচ্চার ব্রেইন প্রস্তুত হতে পারে এবং বাচ্চার নেগেটিভ রিয়েকশন কম হয়। যেমনঃ বাচ্চাকে যদি আজ কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান থাকে তাহলে আপনি আগে থেকেই বলে রাখতে পারেন যে আজ বিকেলে আমরা অমুক জায়গায় বেড়াতে যাবো, কে কে যাবে আর যেখানে যাচ্ছেন সে জায়গা সম্পর্কে একটু বলতে পারেন অল্প কথায়।

ধরুন বাসায় গেস্ট আসবে, কারা আসবে এই ধারনা আগে থেকে দিতে পারেন তাহলে বাচ্চার জন্য এডজাস্ট করা তুলনামূলকভাবে সহজ হয়। আবার ধরুন, বাচ্চাকে রাতের খাবার খাওয়াচ্ছেন, আপনি বলতে পারেন যে আমরা খাওয়া শেষ করে ব্রাশ করে ঘুমাতে যাবো। তবে বয়স অনুযায়ী করা ভালো কাজটি। কারন একেক বয়সী বাচ্চার বুঝার ক্ষমতা একেক রকম।

টিপস ৩

বাচ্চাকে বুঝার চেষ্টা করবেন, আর প্রতিটি বাচ্চা আলাদা এটা একদম সহজ সত্য হিসেবে মেনে নিতে হবে। অন্যের বাচ্চার সাথে তুলনা করে বাচ্চাকে কোন চাপে ফেলবেন না। তাতে ক্ষতিই বেশি হতে পারে। আপনার যদি মনে হয় আপনার বাচ্চা পিছিয়ে আছে তার বয়সী অন্য বাচ্চার থেকে তাহলে আপনি আরো সময় দিন, বুঝার চেষ্টা করুন কোথায় সমস্যা হচ্ছে। দরকার হলে প্রফেশনাল কারো সাহায্য নিন।

টিপস ৪

বিজ্ঞাপণ

আপনার বাচ্চা সারাদিন এটা সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে, এক্সপ্লোর করতে পছন্দ করে, এতে বিরক্ত না হয়ে তার আগ্রহ আর কৌতুহলকে গুরুত্ব দিন, সম্মান করুন। আর অবশ্যই বাচ্চার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন যেহেতু বাচ্চা নিজেকে নিজে নিরাপদ রাখতে জানেনা৷ বাচ্চার আগ্রহকে নেতিবাচক মনোভাব দিয়ে দেখবেন না, তাতে বাচ্চার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যেতে পারে৷ যদি আপত্তিকর বা অনিরাপদ কিছু হয়, সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে পারেন।

টিপস ৫

বাচ্চা আর কি বুঝে বা বুঝবে না- এই ধারনা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে হবে৷ একটা বাচ্চা হয়তো তার বেসিক নিডের জন্য আপনার উপর নির্ভর করতে পারে কিন্তু সেও একজন মানুষ, স্বতন্ত্র মানুষ। তাই বাচ্চাকে সেভাবে সম্মান করুন। আর বাচ্চারা যতোটা প্রকাশ করতে পারে, তার থেকে অনেক বেশি বুঝে৷ আপনি যখন বাচ্চাকে গুরুত্ব দিবেন বা সম্মান করবেন তখন সে নিজেকে সম্মান করতে শিখে আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে৷

টিপস ৬

বাচ্চা যদি এমন কিছু করে যা করা ক্ষতিকর তা থেকে তার মনোযোগ অন্যকিছুতে সরিয়ে দিন৷ আপনি চাইলেই তার সাথে খারাপ ব্যবহার না করে তাকে অন্যকিছুতে ব্যস্ত করে দিতে পারেন। ছোট বাচ্চাদের মনোযোগ সরানো যায় সহজেই।

টিপস ৭

বাচ্চাকে অযথা ট্যাগ দেয়া যেমনঃ তুমি পঁচা বেবি, তুমি দুষ্ট, তুমি বেয়াদব, তোমাকে আর আদর করবোনা, তোমাকে কেউ ভালোবাসবে না, এসব না বলার চেষ্টা করতে হবে। একই মেসেজ ভিন্নভাবে বা একটু ইতিবাচকভাবে দেয়া যেতে পারে। যেমনঃ ধরুন আপনার বাচ্চা খাবার ছুঁড়ে ফেলছে, আপনি বলতে পারেন, আমি তোমাকে ভালোবাসি বেবি কিন্তু এই কাজটাকে ভালোবাসিনা, আবার এভাবেও বলতে পারেন -তুমি একটা ভালো বেবি কিন্তু খাবার ফেলা পঁচা কাজ।

এতে বাচ্চাটি নিজেকে খারাপ না ভেবে তার করা কাজটাকে খারাপ ভেবে নিজেকে শুধরাতে পারে৷ নয়তো বাচ্চাকে আপনি খারাপ বললে সে হীনমন্যতায় ভুগতে পারে বা হতাশ হয়ে একই কাজ বার বার করতে পারে।

টিপস ৮

ভালোকাজের প্রশংসা করুন। ডিসিপ্লিন মানে শুধু অপ্রত্যাশিত বা খারাপ কাজগুলোকে বাচ্চার ডেইলি লাইফ থেকে কমিয়ে ফেলা শেখানোই নয়, বরং ভালো কাজগুলোরও পুনরাবৃত্তি করানো। আপনার বাচ্চা যখন সঠিক কিছু বা ভালো কিছু করে তখন তাকে প্রশংসার মাধ্যমে সেটা আপনি জানাতে পারেন তাতে করে এই কাজ সে বার বার করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

টিপস ৯

বিজ্ঞাপণ

বাচ্চাকে মারবেন না, পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক, তবুও না। কারন আপনি যখন আপনার বাচ্চাকে মারবেন সেও শিখে যায় বা এই মেসেজটা পায় যে মারধর করা ভ্যালিড এবং সেও এটা করতে পারে। এমনকি একদিন হঠাৎ দেখবেন হয়তো আপনার বাচ্চা আপনাকেই আঘাত করে বসেছে।

টিপস ১০

আপনার বাচ্চার জন্য সেট করা নিয়ম-কানূন সম্পর্কে পরিবারের অন্য সদস্যদের জানিয়ে রাখুন এবং বলে রাখুন তারাও যেন এভাবেই সবকিছু পালন করে। নয়তো বাচ্চা একেকজনের কাছ থেকে একেক আচরন পেলে কনফিউজড হতে পারে বা মিসগাইডেড হতে পারে।

একটি ছোট্ট শিশু যখন পৃথিবীতে আসে তখন সে কিছুই জানেনা, কিছুই বুঝেনা, কিছুই পারেনা। মা-বাবার চোখই তার চোখ, মা-বাবার ভাষাই তার ভাষা, মা-বাবার চিন্তা-চেতনাই হয় তার চিন্তা-চেতনা। ধীরে ধীরে মা-বাবা, পরিবার, পরিবেশ থেকে সে সব শিখে শিখে হয়ে উঠে পুরোদস্তুর মানুষ।

কাজেই আমাদের বড়দেরকে অবশ্যই আগে থেকেই নিজেদেরকে সেভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে যে কোন চোখে আমরা আমাদের সন্তানকে পৃথিবী দেখাবো, কোন ভাষায়, কোন মানসিকতায় তাকে বড় করবো।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment