যেদিন প্রথম জানতে পারি, আমি মা হচ্ছি, তার ঠিক দুদিন পর, সকাল বেলায় অল্প একটু ব্লিডিং হয়। ডাক্তার দেখাই। উনি USG করাতে বলেন। করাই। রেজাল্ট আসে Incomplete abortion. যেহেতু ইনকমপ্লিট, ডাক্তার তাই কিছু ঔষধ দেন। এগুলো খেলে যেটুকুন অংশ রয়ে গেছে ভিতরে তা বের হয়ে আসবে। এটা নাকি আমার জন্য খুব জরুরি। আমি তখন আরো একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। উনিও একই কথা বলেন।
আমি ঔষধ কিনে বাসায় আসি। বেস্ট ফ্রেন্ডকে কল দিই। সে একজন ডাক্তার হিসেবে আমাকে সাজেস্ট করে যা করার ময়মনসিংহ এসে করতে। কারণ এই ওষুধগুলো খেলে নাকি প্রচন্ড ব্লিডিং হবে। আমি তখন আমার কর্মস্থল মৌলভীবাজারে একা থাকি। পরিবার থেকে অনেক দূরে। হাজবেন্ডের কর্মস্থল দিনাজপুর। তাই ওর পরামর্শ ছিলো আগে বাড়ি আসার।
পরদিন ময়মনসিংহে এসে প্রথমে একজন গাইনোকোলজিস্টের কাছে যাই। ম্যাডাম আলট্রাসনোগ্রাম করতে বলেন। USG করার সময় আমি সনোলজিস্টকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমার বেবিটা নেই, না? উনি অবাক হয়ে বলেছিলেন, থাকবে না কেন! আমি হতবাক উনার কথা শুনে।
দুরুদুরু বুকে ম্যাডামের রুমে গেলাম। ম্যাডাম রিপোর্ট দেখে বললেন, বেবি আছে, তবে হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকসময় ৮/৯ সপ্তাহ লাগে হার্টবিট বুঝতে। আমার তখন ৭ সপ্তাহ চলছিলো। তাই ১৫ দিন পর আবার আলট্রাসনোগ্রাম করাতে বললেন। উনি শিওরিটি দিতে পারছেন না। তবে ৫০% চান্স আছে বেবি সারভাইভ করার।
এই ১৫ টা দিন যে কিভাবে কেটেছে আমার! জীবনের কোনো অনিশ্চয়তা এতোটা প্রভাব ফেলেনি আমার শরীর মনের উপর। ১৫ দিন পর যখন আলট্রাসনোগ্রাম করাতে যাই, ওই রুম থেকেই শুনি হার্টবিট পাওয়া গেছে আমার বেবির। তারপর রিপোর্ট হাতে আসা, ডক্টরকে দেখানো, এম্বুলেন্সে করে বাড়ি আসা সবকিছু কেমন ঘোরের মধ্যে। খুব সাবধান থাকতাম সবসময়। তবুও কেমন যেন ভয় কাজ করতো। এই ঘটনার জন্য কিনা জানিনা, পুরো প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে আমি রাতে ঘুমাতে পারিনি। ২৪ ঘন্টায় ৩/৪ ঘন্টা ঘুমাতাম। তাও ছাড়াছাড়া। কি যে ভয়াবহ অস্থিরতা! অথচ বেবির ঠিকঠাক বিকাশের জন্য সব সময় চেষ্টা করতাম মন শান্ত, সুস্থির রাখতে।
বাবুটাকে যখন পাই, আমার কেবল মনে হচ্ছিলো, সেদিন যদি মিসক্যারেজের ওষুধগুলো খেয়ে ফেলতাম, আমার বেবিটা কোথায় থাকতো আজ! এখনো প্রায়ই ওর দিকে তাকালে সেদিনগুলো চোখে ভাসে। সৃষ্টিকর্তা যেন এমনি করে সবসময় আমার সন্তানের পাশে থাকেন, তাকে নেক হায়াত দান করেন। আমিন।
মা হওয়ার পর গল্পটা মোড় নিলো অন্য দিকে। একটা মেয়ে থেকে যে মুহূর্তে আমি একজন মায়ে রুপান্তরিত হলাম ঠিক তখনই সন্তানের সাথে সাথে আমারও নতুন করে জন্ম হলো। ওটিতে ঢুকার আগ মুহূর্তের আমি আর সি সেকশন শেষে পোস্ট অপারেটিভ রুমের আমি দুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি সত্ত্বা।
আমি একজন মানুষ। আমার নিজস্ব একটা জগত আছে, আছে একান্ত নিজস্ব একটা সত্ত্বা। আমি আকাশ দেখতে ভালোবাসি, বৃষ্টি ভালোবাসি, বই পড়তে, গান শুনতে ভালোবাসি, ঠিকঠাক বানানো এককাপ চা কিংবা ধোঁয়া উঠা এক মগ কফি একটু সময় নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খেতে ভালোবাসি। মানুষের হাসিমুখ দেখতে ভীষণ ভালোবাসি।
আমার ছোট্ট পুতুলটাকে পাওয়ার পর থেকে খেয়াল করে দেখা হয়না শরতের আকাশ কতখানি নীল হলো, কিংবা গোধূলির ক্যানভাসে কতগুলি রংয়ের আঁচড়। বৃষ্টি আসলে সবার আগে মনে আসে কাঁথা ন্যাকড়া কিভাবে শুকাবো এই চিন্তা। চা কিংবা কফি লাস্ট কবে বারান্দায় বসে গরম থাকতে থাকতে এক বসায় খেয়ে শেষ করতে পেরেছি মনে পড়ে না। সাহস করে বই হাতে নিলে কিছুক্ষণের মধ্যে বইয়ের পাতারা হওয়ায় ভাসে। তাকে স্ক্রিনটাইম দিতে চাইনা, তাই নিজের স্ক্রিনটাইম ও শুন্যের কাছাকাছি। মি টাইম নির্ভেজাল জিরো। সেই সাথে আর সবার জন্য বরাদ্দ সময়ও।
কর্মজীবী মা আমি। বাইরে থাকা সময়টুকু বাদে বাকি সবটুকুন সময় তাকে ঘিরে। ভাবনার সবটুকু জুড়ে সে। তার সেফটি, তার কমফোর্ট, নিউট্রিশান, ডায়াপার, তার ঠিকঠাক বেড়ে উঠা, ভালো থাকা আরো অনেক কিছু।
যা কিছু ছিলো ভীষণ প্রিয়, সবই আজ লক্ষ যোজন আলোকবর্ষ দূরে। মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, তবু কি ভীষণ পরিপূর্ণ! ছোট্ট একরত্তিটা কি অদ্ভুত জাদুমন্ত্রে আমার পুরো পৃৃথিবীটা ভরিয়ে রেখেছে!!
সব চাইতে, প্রিয় আর সবকিছুর চাইতে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি আমার ছোট্ট মিষ্টি সোনাটাকে। সে আছে বলে আমার আকাশ জুড়ে ফুটে তারা রাতে, প্রাতে ফুল ফুটে রয় বনে আমার বনে।
এতক্ষণ যে কথাগুলো বললাম, এটা আমার জীবনের গল্প। প্রতিটি মায়ের জীবনেই এমন গল্প আছে। মেয়ে থেকে মা হয়ে উঠার গল্পটা খুব সহজ নয়। এই গল্পের প্রত্যেকটা শব্দ লেখা হয় অস্তিত্বের আঁচড়ে, প্রতিটি অক্ষরে জড়িয়ে থাকে অপার্থিব মায়া। প্রতিটি মা ই সফল, প্রতিটি মা ই সেরা। প্রত্যেক মা ই নিজের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটা করে তার সন্তানের জন্য।
পৃৃথিবীর সব সোনামণি বেড়ে উঠুক বাবা মায়ের ভালোবাসায়। ভালো থাকুক আমাদের সোনাবাচ্চাগুলো। মেধা, মনন, মানবিকতায় আলোকিত মানুষ হয়ে উঠুক তারা। তাদের হাত ধরে ঝলমলে হাসুক পৃৃথিবী আবারও।