লিখেছেনঃ রাবেয়া সুলতানা
ডেলিভারি এর পর প্রায় মনে হত চুপ করে বাসা থেকে বের হয়ে যাই। ইনায়ার বয়স যখন মাত্র ৪ দিন তখন আমি ওকে ফেলে দেশে চলে যেতে চেয়েছিলাম। এমন কোথাও যেখানে বাচ্চা সংগত কোনো দায়িত্ব থাকবেনা। ভয়াবহ মন খারাপ এক সময় রুপ নিল কান্নার। সন্ধার পর থেকে রাত ১০ টা অবধি আমার বাধভাঙ্গা সেই কান্নার সাক্ষী ছিল জামি। সে হয়ত খুব অসহায়বোধ করেছে ওই সময় টা, তা এখন আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু সে ধৈর্য্য সহকারে তাৎখনিক কিছু স্টেপ নিয়েছিল যা আমার ওই সময়ের রেমেডি হিসেবে কাজ করেছে।
আমার যা হয়েছিল সেটাকে মেডিকেল এর ভাষায় postpartum depression বলে।
আমেরিকায় প্রতি ৮ জন মহিলার মধ্যে ১ জন এই কন্ডিশন ফেইস করেন। ১000 জনে ১ জন এই কারনে নিজের অথবা সন্তানের ক্ষতি করার চেস্টা করেন। কতটা মারাত্মক এটা নিশ্চয় এখন আন্দাজ করা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা কয়জন এই বিষয় টা জানি? বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলাটা বেশীরভাগ মানুষ ই লজ্জার মনে করেন।
‘আয় হায়! এই মাইয়া দেহি হাগল অইয়া গেছে! হুদায় কান্দে কেন?’
‘শুনিচিন? ওই বাড়ীর পোয়াতিক বোলে বাতাস লাগিচে, সেই থেকে বেটিছল খালি মরবা চাচে’
‘কি বলছ এসব? চুপ কর! এত ফুটফুটে একটা বাচ্চা হয়েছে তোমার! এসব আজাইরা চিন্তা বাদ দিয়ে বাচ্চার ঠিকমত দেখাশুনা কর।’
অবশ্যয় এটা সামগ্রিক ভাবে কারও দোষের কিছু না। অনেক শিক্ষিত মানুষ ও এগুলোকে তেমন পাত্তা দেন না। সেখানে গ্রামের একজন মহিলা কি করে বুঝাবে যে তার কি হয়েছে? সে কি নিজে জানে যে সে কোনো অন্যায় করছে না?
Postpartum depression এর তিনটি বড় কারনের মধ্যে একটা হল হরমোনাল। estrogen & progesterone নামে দুইটি হরমোন গর্ভকালীন সময়ে বাড়তে থাকে কিন্তু প্রসবের পর তা এক ধাক্কায় নেমে আসে যা একজন মানুষের স্বাভাবিক আবেগের প্রকাশকে ব্যহত করতে পারে।
তারপর আসে সামাজিক ফ্যক্ট যেটা অনেকাংশে আমার সাথে মিলে যায়। সমাজ ও আশেপাশের প্রতিবেশী থেকে সাহায্য সহযোগিতার অভাব হলে একটা নবজাতক লালন পালন করা অনেকটা কস্টদায়ক হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে গ্রাম বা মফস্বল এলাকায় এই সুবিধা কতবড় আশীর্বাদ এটা কোনো দম্পতি শহরে একা বাস করলে আঁচ করতে পারবেন।
আমার জন্য আশীর্বাদ আমার হাজবেন্ড। আমার মা/ শাশুড়ির মত এক্সপেরিয়েঞ্চ ওর নাই কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে কোনো অংশে কম না। একজন ফুল টাইম PhD Student সাথে RA হয়েও রান্না করা, বাচ্চার কাপড় ধোয়া, বাজার করা আবার আমাদের কে নিয়মিত ডাক্তার ভিজিট এ নিয়ে যাওয়া..আবার যেকোনো দুই বেলা উঠানো খাবার খাওয়ানো আর ডায়পার চেঞ্জ, এক কথায় ৭৫% সাংসারিক কাজ সে করছে।
আমেরিকায় আমাদের মত অবস্থা বেশিরভাগ পরিবারে। হাজবেন্ড ওয়াইফ কাজ গুলোকে ভাগাভাগি করে নেন। কিন্তু প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে অনেকেই বিচলিত হয়ে পরেন। সারাদিনের শত ব্যস্ততা থাকে নবজাতক কে নিয়ে আবার রাত কেটে যায় নির্ঘূম চোখে। নিজেদের মধ্যেকার চিরাচরিত আলাপ বদলে যায় ফিডিং আর ডায়পার চেঞ্জে।
Mayo Clinic এর একটা আর্টিকেলে পড়লাম Paternal Postpartum Depression নিয়ে। ক্যজুয়াল ভাষায় এটাকে Sad Dad ও বলে। মেডিকেলি প্রমানিত যে, একজন নতুন বাবার ক্ষেত্রে সন্তান গর্ভে থাকাকালীন সময় এমনকি সন্তান জন্মের পর সেই পরিমান হরমোনাল চেঞ্জ হয় যেটা মায়ের হয়। কি অদ্ভুত তাই না!! ফলশ্রুতিতে কিছু বাবা নিজেকে পরিবার থেকে আলাদা রাখতে চান এবং নিজেক দোষী ভাবতে থাকেন। কিছুক্ষেত্রে তাদের পরিবারের সাথে সম্পর্কের অবনতি ও ঘটে।
আমি আসলেই ভাগ্যবতী কারন দেশ থেকে এত দূরে থেকেও কিছু মানুষের ভালোবাসা/সাহায্য পেয়েছি।Masuma Mustafiz SyedKazi Akhlakur Rahman Nusrat Jamila Kaji Atiqur Rahman হয়ত আমার রক্তের সম্পর্কিত কোনো আত্বীয় না কিন্তু এই বিদেশের মাটিতে আমাদের খারাপ/ ভালো থাকার সঙ্গী এখন উনারা। আলহামদুলিল্লাহ্ !
সম্ভবত ইনায়া জন্মের ৭ দিনের মাথায় New York থেকে ভাইয়া ভাবী স্বপরিবারে বাসায় আসেন আমাদের পাশে থাকার জন্য। আমরা অনেক ভাল সময় কাটিয়েছি সেই কটা দিন। সাথে আমার সমস্যার কথা ও খুলে বলেছি। উনারা কিছু সহজ কিন্তু ইফেক্টিভ টেকনিক বলে দিলেন যেমন: খারাপ লাগলে যেন ঘরে বসে না থাকা, একটু বাইরে হেঁটে আসা অথবা কফি খেতে বাইরে যাওয়া, কিছু কেনার না থাকলেও শপিং কম্পলেক্স গুলোতে ঘুরে বেরানো অথবা লং ট্যুর। আমরা সেগুলো মেনে চলছি এবং আলহামদুলিল্লাহ্ আগের চেয়ে কমপক্ষে ৭০ভাগ ভাল আছি।
সবশেষ কারন হল মানসিক যা কিনা নির্ভর করে মায়ের নতুন কিছু কে গ্রহন করতে পারার সক্ষমতার উপর। নতুন মায়েরা এই ব্যপারে বেশীরভাগ সময় উদ্বিগ্ন থাকেন। কম ঘুম আর সারাদিনের পরিশ্রম একসময় খিটমিটে মেজাজ এর কারন হয়ে দাড়ায়। প্রতিটি নতুন মা এই কথা টা ভেবে বিচলিত হন- ‘আমি কি একজন ভাল মা হতে পারব’?
বিশ্বাস করেন আপনারা দুজনেই অসাধারন বাবা-মা, কারন আপনারা চেস্টা করে যাচ্ছেন। আমেরিকায় একটা কথা প্রায় বলে- With the first baby you are always learning, and on your second you will be a pro😊
শুভকামনা রইল সকল নতুন ও হবু বাবা-মা এর জন্য❤️
বি:দ্র: আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতার সাথে আমেরিকান স্বাস্থ্য বিষয়ক কিছু অথেন্টিক ওয়েবসাইট এবং আমার OB-GYN এর দেয়া পরামর্শ এখানে তুলে ধরেছি। আমি কোনো প্রফেশনাল লেখিকা নই। ভূলত্রুটি থাকলে অবশ্যয় শুধরে দিবেন। আর ভালো লাগলে অথবা কারও বিন্দুমাত্র উপকারে আসলে মন্তব্যে জানাবেন।Pregnancy নিয়ে আরও ভাল কিছু লিখার ইচ্ছা আছে।