মা হওয়ার গল্প | নুসরাত জাহান ত্বিষা

Spread the love

খুব ছোটবেলা থেকেই জীবনের মানে না বুঝতে শিখলেও, জীবন কিছু একটা হতে হবে এইটা জানতাম।পড়ালেখায় ভালোই ছিলাম তাই খুব ভালো কোন পেশাগত পরিচয়ের শখ ছিল।কখনো ডাক্তার, তো কখনো ডক্টরেট করার স্বপ্ন দেখতাম।খুব ভালো রেজাল্ট ছিল স্কুল,কলেজে।কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়।

সবাই যখন ভার্সিটির উচ্ছল জীবনে ব্যস্ত আমি তখন পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারও সাজাচ্ছিলাম।না বিয়ের পর লেখাপড়া বন্ধ হয়নি আমার,সংসারের সাথে সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছিলাম লেখাপড়াও।

বিজ্ঞাপণ

তিনবছর সংসার করার পর একদিন বুঝতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি।সন্তান পেটে নিয়েও পড়াশোনা করেছি,এক্সামও দিয়েছি।পুরো প্রেগন্যান্সি একাহাতে সংসার সামলে ভালোই ছিলাম আলহামদুলিল্লাহ। ভয় ছিল মনে,কিন্তু কোন আশংকা ছিল না।

দীর্ঘ ৪০সপ্তাহ অপেক্ষার পর ইমারজেন্সি সি সেকশনে যখন মেয়েকে কোলে পেলাম,তারপর থেকেই শুরু হল আমার ভয় পাওয়া। সেই ভয় ভালো মা হওয়ার ভয়, মেয়েকে ভালো রাখতে পারবো কিনা তার ভয়!!এর কারণ আমাদের সমাজ!!

একজন নতুন মা যে বাচ্চা হওয়ার পর কতটা ভয়াবহ সময় পার করে তার খবর বোধ করি কেউই রাখে না। সবকিছুতেই সেই নতুন মা কে বিচারের আওতায় রাখে সমাজ।মেয়ে ছিল কলিক!এইটা যে কি, যে সহ্য করেছে সেই জানে!! কিন্তু সবাই আমাকে বলতে থাকল আমি বাচ্চার পেট ভরাতে পারি না আমার দুধ দিয়ে,তাই বাচ্চা কান্না করে।আমি ডায়াপার দেই তাই বাচ্চা কান্না করে!

প্রথম থেকেই মিল্ক সাপ্লাই কম থাকা আমার এগুলো শুনে স্ট্রেস থেকে আরো খারাপ লাগতে থাকে।আমি আরো বেশি করে খাই,আরো বেশি করে সাক করাই।দিনে ২০/২২ঘন্টাও বাচ্চার মুখে দুধ দিয়ে বসে থাকি আর কান্না করি।বাচ্চাও কাঁদে,আমিও কাঁদি।প্রথম ৪মাস গেল এভাবেই।

এর কিছুদিন পর থেকে শুরু হল বাড়তি খাবার দেয়ার পর্ব,শুরু হল আসল এক্সাম।যাই করি,মেয়ে খায় না।মানুষ বলে আমি খাওয়াতে পারি না।একবছর ধরে এগুলো করতে করতে কখন যে পড়াশোনা করেছি তাও বলতে পারিনা।কিন্তু তাও চালিয়ে গেলাম।হয়ত খুব ভালো রেজাল্ট না হলেও চলার মত হল।কিন্তু এরপর দেখা গেল মেয়ে মা ছাড়া কিছু বুঝে না,অন্য কারো কাছেই থাকে না।

সবাই বলে আমার জন্যেই এমন হয়েছে,কিন্তু আসল কথা হল মেয়ে দেখেছেই শুধু মা কে, আর বাবা কে।তাও বাবাতো ব্যস্ত নিজের ব্যাবসা নিয়ে!!মেয়ে রাখার মত কেউ নেই তাই ২টা জব অফার পাওয়ার পরো করতে পারলাম না।ভাবলাম থাক,মেয়ে একটু বড় হোক পরেই না হয় করবো ক্যারিয়ার।

দেখতে দেখতে মেয়ের ৩বছর হয়,স্কুলে দেই।ভাবলাম এইবার মেয়ে মনে হয় আঁচল ছাড়া হবে।কিন্তু সে আরো বেশি করে আমাকে আঁকড়ে ধরলো! এর মাঝেই আশেপাশে শুরু হল আর একটা বাচ্চা নাও।এমনকি মেয়েও কান্নাকাটি তার নিজের ভাই-বোন চাই!এরপর নিলাম জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত! ছেড়ে দিলাম নিজের ক্যারিয়ারের সকল আশা।ভাবলাম শুধু মা ই না হয় হলাম জীবনে! তবে নিজেকে বুঝালাম যে সিদ্ধান্ত নিলাম তার জন্য কখনো আফসোস যেন না করি!

এরপর নিলাম দ্বিতীয় বাচ্চা।আমাদের ঘর আলো করে বড় মেয়ের ৫ম জন্মদিনেই এল দ্বিতীয় মেয়ে।আলহামদুলিল্লাহ। শুরু হল ঠিক ৫বছর আগের ইতিহাস! এইজনও কলিক।সারাদিন তাকে কোলে নিয়ে হাটি,সারা রাতও হাটি।অন্য কারো কোলে দিলেও সে কাঁদতেই থাকে।এইবার ও আগের বারের মত সবাই নানাকিছু বলে কিন্তু এইবার আমি আর আগের মত ভয় পাই না।একা হাতেই দুই মেয়েকে নিয়ে নিজের মনমতো ওদের পালি।কারো কথা কানেই নেই না।ভালোই যাচ্ছিল জীবন।এরপরেই এল সবচেয়ে কঠিন সময়!

দুই মেয়ে হওয়ার পরে আমাদের হাসবেন্ড ওয়াইফের ইচ্ছা ছিল না আর কোন সন্তানের, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যকিছু। আমাদের অজান্তেই দ্বিতীয় কন্যার ১.৫বছর বয়সে পেটে এল আরেক সন্তান।

১২আগস্ট, ২০১৯ এখনো মনে আছে তারিখটা! সেইদিনই জানতে পেরেছিলাম আমি প্রেগন্যান্ট আবারও। কি করবো,না করবো কিছুই মাথায় আসছিল না।একবার ভাবলাম এবোরশান করিয়ে ফেলি।কিন্তু তারপর মনে হল এইটা করা পসিবল না আমার পক্ষে। কন্টিনিউ করলাম প্রেগ্ন্যাসি।কিন্তু সত্যি কথা হল এইটা মন থেকে মেনে নিতে আমার আরো অনেক মাস সময় লেগেছিল,আমার কেবলই মনে হত আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি।

বিজ্ঞাপণ

মেঝ বাচ্চাটা তখনও দুধ খায়,ওকে একরকম জুলুম করে দুধ ছাড়ালাম।সেসব দুঃসহ রাতের কথা ভাবলে এখনো কান্না পায় আমার।৯মাসের প্রেগন্যান্সির  এমন কোন রাত যায় নি আমি মেঝটাকে জরিয়ে ধরে কান্না করিনি।আমার কেবলই মনে হত ওর সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি আমরা। আর সেইসাথে মানুষের কথার তো শেষই নাই।ছেলের আশায় আবার বাচ্চা নিয়েছি!!নিজেদের উপর কন্ট্রোল নাই!!আরো যে কতকিছু শুনেছি তা আর নাই বলি।

নিজের শরীর খারাপ হতে থাকলো দিন দিন।আমি আর আমার হাসবেন্ড ছাড়া বাসায় মুরুব্বি কেউ ছিল না কখনোই।আর পারমানেন্ট হেল্পিং হ্যান্ড ও পেলাম না খুজে।আমার মা,ভাবি আসতো মাঝে মাঝে কিন্তু সবসময়ের জন্য না।হিমগ্লোবিন লেভেল কমে গেল অনেক।দুই বাচ্চা সামলে নিজের যত্ন নেয়ার কোন সময়ই থাকতো না।

এর মাঝেই চলে আসল করোনা! লকডাউনের ঠিক ২দিন আগে আমার কোলে আসলো আমার ৩য় কন্যা।সি সেকশানের জন্য যখন হাসপাতালে যাচ্ছিলাম মেঝ মেয়েটা এত কান্না করছিল!নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল। করোনার জন্য বাচ্চাদের হসপিটালে নেয়া গেল না,তাই বড় দুই মেয়ে আর ছোট মেয়ের দেখা হল আড়াই দিন পর।সেই মুহূর্তে একসাথে তিন মেয়েকে দেখে মনে হচ্ছিল আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ চেয়েছেন বলেই এত সুন্দর একটা দৃশ্য দেখার সুযোগ পেয়েছি আমরা।

একদিকে করোনা,আর একদিকে ৩মেয়ের যত্ন! বড়টা নিজের কাজ নিজে করতে পারলেও মেঝটা তো আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না তখনও। ঘরে আমার মা আর এক বোন ছিল।এছাড়া আর কোন মেইড তো তখন রাখার কথা কল্পনার বাইরে।হায়রে কষ্ট! ছোট টাকে শুধু দুধ খাওয়ার সময় ছাড়া শুইয়ে রাখতাম,মেঝ আর বড় কে সময় দিতাম।মেঝ মেয়ে আমার কোলে আর একজন কে দেখে আরো মেজাজি হয়ে যেতে থাকলো,বড়টা নিজের মত একা একা চলতে শিখে গেল।একসময় মা আর বোন চলে গেল।হয়ে গেলাম পুরো একা।

হাসবেন্ড আর আমি মিলে সারাদিন ৩মেয়ের পিছে থাকার পরেও মনে হচ্ছিল কিছুই মনমতো হচ্ছে না।বড় মেয়ের অনলাইন ক্লাস চলছে,কিন্তু ও কি পড়ছে আমি তার খবর রাখতে পারি না।মেয়ে একাই পড়ে,একাই এক্সাম দেয়। মেঝটা কোনদিন সকালে খায় তো সারাদিন আর কিছুই মুখে নেয় না।ছোটটা একটু ঘুমায় তো বড় দুইজন চিতকার করে উঠিয়ে দেয়।সকাল থেকে শুরু করে এই যুদ্ধ রাতেও চলতে থাকে।একটা ঘুমায় তো আর একটা ঘুমায় না।

শেষ পর্যন্ত আমি দেখা গেল একটা কে কোলে আর এক্টাকে পায়ে দোল দিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছি কারন কেউই বাবার কাছে ঘুমাবে না!মাঝে মাঝেই মনে হত আর মনে হয় চলতে পারছি না,আর মনে হয় এই যুদ্ধ করা সম্ভব না।কিন্তু মেয়েরা যখন মা ডেকে হেসে জড়িয়ে ধরতো আবার কোথা থেকে শক্তি পেতাম!

এই করতে করতে কখন যে ছোট মেয়েও একটা স্ট্যাবল বয়সে এসে গেল,নাকি আমরা ৫জনই নিজেদের কে চালিয়ে নেয়া শিখে গেলাম জানিনা।এখন আলহামদুলিল্লাহ আমরা আমাদের মাঝেই সকল আনন্দ খুজে নিয়েছি।তিন কন্যা পাশাপাশি বসে যখন খেলে,কথা বলে,হাসে তখন মনে হয় এই দুনিয়াতেই ছোট একটা জান্নাত আমাদের আছে আলহামদুলিল্লাহ।প্রচন্ড ঝড়ের মাঝেও নিজেদের মনে সাহস রাখা আর ভালোবাসার মানুষকে আঁকড়ে ধরে রাখাই আমাদের এই কঠিন সময়ে হাল ছাড়তে দেয় নি।

বিজ্ঞাপণ

মা হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে,মানুষের কথায় কান না দেয়া।ভয় না পাওয়া।মনে সাহস রাখা। আর হ্যা, আমি ৩বাচ্চার মা হয়ে অবশেষে বুঝতে পেরেছি যে সফল মা  আসলে সবাই।সফলতার মাপকাঠি একেকজন এর জন্য  একেক রকম।

দিন শেষে আমার হাসিতে আমার ৩মেয়ে হেসে উঠে, আমার বুকের মাঝে কেউ জান্নাত খুজে পায় আমার কাছে এটাই সফলতা! এই দুনিয়াতে মা -বাবা ছাড়াও আরো ৩জন মানুষ আমাকে নিস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে এই বা কম কিসে!

জীবন নিয়ে কোন আফসোস করি না কারণ অবশেষে আমিও কিছু হতে পেরেছি,হোক না আমার পরিচয় শুধুই একজন ‘মা’!

দুয়া করবেন আমাদের জন্য।আমার কন্যাদের জন্য যেন সারাজীবন ঢাল হয়ে দাড়াতে পারি,কন্যাদের যেন সঠিক,মানবিক শিক্ষা দিয়ে মানুষ করতে পারি।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment