এমনিওটিক ফ্লুইড বেড়ে যাওয়া বা পলিহাইড্রামনিওস (পানি বেড়ে যাওয়া)

Spread the love

অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড কি?

আমরা কমবেশি সবাই জানি যে, মানব শিশুর ভ্রূণ মাতৃগর্ভে পানির মত একধরনের তরলে ভেসে থাকে। এই তরলকেই বলা হয় অ্যাম্নিওটিক ফ্লুইড। গর্ভের এই তরল বা  ফ্লুইড গর্ভের ভ্রূণের সুরক্ষা ব্যবস্থা বা লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের একটি অংশ। গর্ভধারণের সাধারণত ১২ দিনের মধ্যেই অ্যাম্নিওটিক স্যাক অর্থাৎ ভ্রূণের ধারক থলিটি গঠিত হওয়ার সাথে সাথেই অ্যাম্নিওটিক ফ্লুইড উৎপন্ন হওয়া শুরু হয়।

প্রাথমিকভাবে এই ফ্লুয়িড মায়ের শরীর থেকে সরবরাহকৃত পানি দ্বারা তৈরি হয়।আমরা জানি, গর্ভের ভ্রূণটি মায়ের পেটে যে থলিতে থাকে তা অ্যাম্নিওটিক ফ্লুইড দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে আর এই ফ্লুইড ভ্রূণের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।

বিজ্ঞাপণ
  • এই তরল গর্ভের ভ্রূণকে বাইরের আঘাত (যদি কোন কারণে মায়ের ঝাঁকুনি লাগে) থেকে রক্ষা করে।
  • আম্বিলিকাল কর্ড বা নাভিরজ্জুকে সংকুচিত হতে বাধা দেয় যাতে ভ্রূণের অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতি না হয়।
  • মায়ের জরায়ুর তাপমাত্রা স্থির রাখতে সাহায্য করে।
  • বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন থেকে ভ্রূণকে রক্ষা করে।
  • গর্ভের ভ্রূণের নড়াচড়ায় সাহায্য করে যাতে তার পেশী ও হাঁড়ের গঠন ত্বরান্বিত হয়।
  • এটি ভ্রূণের পরিপাকতন্ত্র ও শ্বাসতন্ত্রের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।

অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া, দুটোই গর্ভাবস্থায় জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।

অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড বেড়ে যাওয়া বা পলিহাইড্রামনিওস কি?

গর্ভধারণের প্রথম ১৪ সপ্তাহ পর্যন্ত অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড মায়ের শরীর থেকে অ্যাম্নিওটিক স্যাকে জমা হয়। দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারের শুরুর দিক থেকে গর্ভের ভ্রূণ এই অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড গ্রহন করা শুরু করে যা তার কিডনির মাধ্যমে পরিশোধিত হয়ে মূত্র হিসেবে নির্গত হয় । নির্গত তরলটি  ভ্রূণ আবার গ্রহন করে।

এভাবে প্রতি কয়েক ঘণ্টা অন্তর গর্ভের শিশুটি সম্পূর্ণ অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইডগুলো রিসাইকেল করে। গর্ভস্থ ভ্রূণের এই কাজটি অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইডের সঠিক পরিমান বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।

যদি কোন কারণে এই প্রক্রিয়ার ব্যাতিক্রম হয় অর্থাৎ অ্যাম্নিওটিক স্যাকে ফ্লুইডের পরিমান বেড়ে বা কমে গেলে ফ্লুয়িডের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং এতে গর্ভের শিশুর সুরক্ষা ব্যবস্থা ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।

স্বাভাবিক অবস্থায় তৃতীয় ট্রাইমেস্টারের আগ পর্যন্ত জরায়ুতে অ্যাম্নিওটিক   ফ্লুইডের পরিমান বাড়তে থাকে। ৩৪-৩৬ সপ্তাহের মধ্যে  অ্যাম্নিওটিক   ফ্লুইডের পরিমান হতে পারে প্রায় ১ লিটার। ৩৬ সপ্তাহের পর থেকে থেকে প্রসবের আগ পর্যন্ত ধীরে ধীরে এ ফ্লুইডের পরিমান কমতে থাকে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে, অ্যাম্নিওটিক স্যাকে  ফ্লুইডের পরিমান অস্বাভাবিক বেশী থাকে তখন তাকে বলে পলিহাইড্রামনিওস। আবার, অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড কমে গেলে সে অবস্থাকে বলে অলিগোহাইড্রামনিওস।

অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড বেড়ে যাওয়া বা পলিহাইড্রামনিওসের লক্ষন

বেশীরভাগ মায়েদের ক্ষেত্রেই পানি বেড়ে যাওয়া বা পলিহাইড্রামনিওসের লক্ষন বোঝা কষ্টকর। তবে এ ক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়েদের পেটের আকার স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশী বড় হয়ে যায় এবং পেটের চামড়া খুব টান টান ও চকচকে হয়ে উঠতে পারে।

পলিহাইড্রামনিওসের ক্ষেত্রে মায়েদের পেটে ব্যাথা এবং শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা হতে পারে। কারণ এক্ষেত্রে মায়েদের জরায়ু শরীরের অন্যান্য অঙ্গের উপর এবং ফুসফুসের উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে।

অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড সাধারণত সময়ের সাথে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই সাধারণত ৩০ সপ্তাহের দিকে যখন এটি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায় তখন বৃদ্ধির পরিমাণ নির্ণয় করা সহজ হয়। তবে খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রে এটি খুব দ্রুত কয়েকদিনের মধ্যে বেড়ে যেতে পারে। গর্ভে একের অধিক সন্তান থাকলে এটি বেশী দেখা যায়।

পলিহাইড্রামনিওসের ক্ষেত্রে নীচের গর্ভকালীন সমস্যাগুলো প্রকট হয়ে উঠতে পারে-

এমন কোন লক্ষণ দেখা দিলে আপনার চিকিৎসক আপনাকে আলট্রাসাউন্ডের পরামর্শ দিবেন। আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে মায়ের জরায়ুর বিভিন্ন পকেটে অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইডের পরিমান কেমন তা দেখা হয়।

এর পরিমান মাপার জন্য সাধারণত জরায়ুর বিভিন্ন পকেটের লম্বালম্বি দৈর্ঘ্য নেয়া হয় এবং তা থেকে অ্যাম্নিওটিক ফ্লুইডের পরিমান বের করা হয়। আলট্রাসাউন্ড রিপোর্টে এটি সাধারণত সেন্টিমিটার বা মিলিমিটারে দেয়া থাকে।

তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে  সাধারণত অ্যাম্নিওটিক   ফ্লুইডের পরিমান থাকে ৫ থেকে ২৫ সে.মি। ২৫ সেন্টিমিটারের বেশী থাকলে অ্যাম্নিওটিক ফ্লুইড অতিরিক্ত বলে ধরা হয়।

অ্যাম্নিওটিক ফ্লুইড কি কারণে বেড়ে যেতে পারে?

বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যাম্নিওটিক ফ্লুইড প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কারণ নির্ণয় করা কঠিন বিশেষ করে যদি বৃদ্ধির  মাত্রা কম থাকে। এ বেড়ে যাওয়া গর্ভের বাচ্চার, প্লাসেন্টার বা মায়ের নিজের শারীরিক কোন সমস্যার কারণে হতে পারে।

বিজ্ঞাপণ

ডায়াবেটিস

যদি মায়ের ডায়াবেটিস থাকে এবং সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে না থাকে তবে গর্ভের শিশু অতিরিক্ত ইউরিন উৎপন্ন করে। এর ফলে অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড বেড়ে যায়।

যদি মায়ের ব্লাড সুগার বেশী থাকে এবং ডায়াবেটিসের  চিকিৎসা নেয়া না হয়ে থাকে তবে ডাক্তার মাকে কোন ডায়াবেটিস স্পেশালিষ্ট এর সাথে সাক্ষাতের পরামর্শ দেবেন। মায়ের সুগার লেভেল কমানো গেলে অ্যাম্নিওটিক ফ্লুইডের পরিমানও কমে যায়।

টুইন টু টুইন ট্রান্সফিউশন সিনড্রোম (TTTS)

গর্ভে যদি আইডেন্টিকাল টুইন থাকে অর্থাৎ যখন দুটি ভ্রূণ একটিই প্লাসেন্টা শেয়ার করে, তবে সেক্ষেত্রে অনেকসময় যেকোনো একটি ভ্রূণ প্লাসেন্টা থেকে অতিরিক্ত রক্ত গ্রহন করে এবং ফলশ্রুতিতে তার শরীরে তরলের পরিমান বেড়ে যায়। তখন ভ্রূণটি এই অতিরিক্ত তরল বের করে দেয়ার জন্য প্রচুর ইউরিন উৎপন্ন করে যার ফলে অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড বেড়ে যায়। এ সমস্যাটিকে টুইন টু টুইন ট্রান্সফিউশন সিনড্রোম বলা হয়।

গর্ভের বাচ্চার জটিলতা

কখনও কখনও গর্ভের ভ্রূণের বৃদ্ধিজনিত কোন জটিলতার কারণে ভ্রূণ অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড গ্রহন করতে পারেনা কিন্তু তার কিডনি ইউরিন উৎপন্ন করতে থাকে। এধরনের জটিলতা দেখা দিলেও অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড বেড়ে যেতে পারে।

ক্রোমোসোমে অস্বাভাবিকতা

ডাউন সিনড্রোমের মত কোন অস্বাভাবিকতা থাকলেও কোন কোন ক্ষেত্রে অ্যাম্নিওটিক ফ্লুইড বেড়ে যেতে পারে।

ভ্রুনের এনিমিয়া

কিছু কিছু ক্ষেত্রে Rh ফ্যাক্টরের কারণে গর্ভের বাচ্চার এনেমিয়া বা ইনফেকশন হতে পারে যার কারণেও অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড বেড়ে যেতে পারে।

অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড বেড়ে যাওয়া বা পলিহাইড্রামনিওসের চিকিৎসা

যদি আলট্রাসাউন্ডে পলিহাইড্রামনিওস সনাক্ত হয়,  তবে ডাক্তার আরও ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখবেন ভ্রূণের কোন জন্মগত ত্রুটি বা টুইন টু টুইন ট্রান্সফিউশন সিনড্রোম আছে কিনা। এছাড়াও ডায়াবেটিসের  জন্য রক্ত পরীক্ষা এবং জন্মগত ত্রুটি নির্ণয়ের জন্য এমনিওসেনটেসিস করা হতে পারে।

বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মৃদু পলিহাইড্রামনিওস নিজ থেকেই ঠিক হয়ে যায়। আবার এর কারণ যদি নির্ণয় করা যায় তবে তা প্রতিরোধ করেও এ সমস্যার সমাধান করা যায়। যেমন যদি বাচ্চার হার্টবিটের কারণে অ্যাম্নিওটিক ফ্লুইড বেড়ে যায় তবে ডাক্তার তার জন্য ওষুধ দিতে পারেন যেটা বাচ্চার হার্ট বিট সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি পলিহাইড্রামনিওসের সমস্যারও সমাধান করে।

যদি অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড বেড়ে যায় তবে ডাক্তার আপনাকে বিশ্রামের পরামর্শ দেবেন। অনেক সময় এক ধরনের ওষুধ দেয়া হয় যাতে গর্ভের বাচ্চা ইউরিন কম উৎপন্ন করে। এছাড়াও এমনিওসেনটেসিসের মাধ্যমে অতিরিক্ত ফ্লুইড বের করাও হতে পারে।

যদি গর্ভাবস্থার শেষের দিকে মৃদু পলিহাইড্রামনিওস দেখা যায় কিন্তু মা এবং বাচ্চা যদি সুস্থ থাকে তবে সেসব ক্ষেত্রে কোন চিকিৎসার সাধারণত প্রয়োজন হয়না।

পলিহাইড্রামনিওসের কারণে কি কি ঝুঁকি থাকে?

পলিহাইড্রামনিওস বা অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড বেড়ে যাওয়ার ফলে কিছু কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন, অতিরিক্ত তরলের কারণে বাচ্চা সময়ের আগেই প্রসব হতে পারে। আবার কোনো কোনো সময় আম্বিলিকাল কর্ড মায়ের যোনিপথে, বাচ্চার মাথার সামনে চলে আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে জরুরীভিত্তিতে সিজারিয়ান বা সি-সেকশন করার প্রয়োজন হতে পারে।

অতিরিক্ত অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইডের কারণে, প্রসবের জন্য বাচ্চার মাথা মায়ের পেলভিসে ঠিক মত সেট হতে পারেনা। এ ধরণের পরিস্থিতিতে, প্রসবের সময় প্লাসেন্টা সঠিক সময়ের আগেই বের হয়ে যেতে পারে। যার ফলে, মায়ের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে।

এছাড়াও অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড বেড়ে যাওয়া বা পলিহাইড্রামনিওসের ক্ষেত্রে মৃত সন্তান প্রসবের সম্ভাবনাও থাকতে পারে।

তবে মনে রাখবেন বেশীরভাগ মায়েরাই অ্যাম্নিওটিক  ফ্লুইড বেড়ে যাওয়া বা পলিহাইড্রামনিওস থাকা সত্ত্বেও সুস্থ বাচ্চার জন্ম দেন যদি সমস্যাটি বেশি প্রকট না হয়ে থাকে।বেশিরভাগ সময় এ ধরনের সমস্যাগুলো মায়েদের পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তাই গর্ভাবস্থায় সবসময় নিয়মিত ডাক্তারের কাছে গিয়ে চেক আপ করাতে হবে এবং তার নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে হবে।

সবাই ভাল থাকবেন। সুস্থ থাকবেন। সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment