কলিক কি
সব নবজাতকই কান্না করে, এটাই বাস্তবতা। কান্নাই পৃথিবীতে তাদের প্রয়োজন জানান দেয়ার একমাত্র উপায়। কিন্তু কিছু কিছু নবজাতক (প্রায় ১৫ থেকে ২০ ভাগ) অন্যদের তুলনায় অনেক বেশী কান্না করে।
যখন এসব সুস্থ বাচ্চা কোন কারণ ছাড়াই, যেমন অসুস্থ লাগা, খিদে লাগা, মায়ের সংস্পর্শের ইচ্ছা, ন্যাপীর ভিজে ভাব, ক্লান্ত লাগা, কিংবা গরম বা ঠাণ্ডা লাগা ছাড়াই বেশ অনেকটা সময় জুড়ে কান্না করতে থাকে তখন এধরনের শিশুদের বিশেষজ্ঞরা কলিক বেবি বলে থাকেন।
অনেক মা বাবাই বুঝে উঠতে পারেন না, নবজাতক কেন কান্না করছে। যখন তারা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান এবং শিশুর শারিরিক কোন সমস্যা পাওয়া যায় না, কিংবা যখন, যেসব কারণে বাচ্চা কাঁদতে পারে তার সবগুলোই ঠিক-ঠাকই থাকে, তখন স্বাভাবিক কারণেই মা বাবা অনেকটা আতঙ্কিত ও অসহায় বোধ করেন।
এই অজানা কারণে শিশুর কান্না করা ব্যাপারটি একজন নতুন মায়ের জন্য ভীষণ মানসিক চাপের তো বটেই, অনেক সময় এই মানসিক চাপ মায়ের মনে অপরাধবোধ এবং ডিপ্রেশান তৈরী করে। কারণ মা যখন এ সমস্যার সমাধান খুঁজে পান না, তখন তিনি নিজেকে অযোগ্য মা ভাবতে শুরু করতে পারেন। অনেকে এই চাপ সহ্য করতে না পেরে বাচ্চাকে জোরে ঝাঁকানো, কান্নারত বাচ্চাকে একা রেখে চলে যাওয়া কিংবা অন্যান্য কিছু ঝুঁকিপুর্ন কাজও করে ফেলেন। তাই এই সম্পর্কে জেনে নেয়া খুবই জরুরী।
শিশু কলিক কিনা কিভাবে বুঝবেন?
শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে বাচ্চা যদি সাধারানত দিনে তিন ঘণ্টা বা তার বেশী, সপ্তাহে তিন বা চার দিনের বেশী এবং একটানা তিন চার সপ্তাহের বেশী কান্না করতে থাকে এবং সেই কান্নার যদি কোন ব্যাখ্যা না থাকে, ধরে নিতে পারেন শিশু হয়ত কলিক। শিশুর কয়েক সপ্তাহ বয়স থেকেই কলিকের সমস্যা শুরু হতে পারে।
কলিকের কারনে শিশু দিন বা রাতের যে কোনো সময় কান্না করতে পারে। তবে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত কান্না বেশী থাকে। এতে ভয়ের কোন কারণ নেই কারণ ৬০ ভাগ শিশুর ক্ষেত্রে এটি ৩ মাসের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায়। ৯০ ভাগ শিশু ৪ মাস এর মধ্যে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠে।
তবে স্বল্প সংখ্যক কিছু বাবা-মায়ের মতে তাদের সন্তান ৮ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত কম-বেশি এই সমস্যা বোধ করেছে। মনে রাখতে হবে কলিকের কারনে পরবর্তীতে শিশুর তেমন শারীরিক বা মানসিক সমস্যা হওয়ার কথা প্রমাণিত হয়নি।
কলিক কি কারনে হয় তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে হজমের সমস্যা, রিফ্লাক্স (reflux), বা পরিবেশগত কারনে কলিক হতে পারে মনে করা হয়। “কলিক” আপনার শিশুর কোন অসুস্থতার লক্ষন নয়। সে যে ভঙ্গিতে কান্না করতে থাকে তা দেখে মনে হতে পারে তার পেট ব্যাথা করছে কিন্তু এটা তার পেট ব্যাথার লক্ষনও নয়।
ধারণা করা হয় পেটে গ্যাস এর কারণে শিশু কলিক হতে পারে।কিন্তু গবেষকরা এখন মনে করছেন শিশুর কান্নার কারনেই পেটে গ্যাসের সৃষ্টি হয়। কারণ সে যতক্ষণ কান্না করতে থাকে ততক্ষনই সে বাতাস গিলতে থাকে।
কলিকের আরো কিছু লক্ষণ থাকতে পারে, যেমন-
- কান্নার সময় কোনভাবেই শিশুকে শান্ত করা যায় না।
- কান্নার সময় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখে।
- মুখ লালচে বর্ণের হয়ে যায়।
- পিঠ বাঁকিয়ে হাঁটু পেটের কাছে নিয়ে আসে।
- গ্যাসের কারণে পেট শক্ত হয়ে থাকে
কিছু বাচ্চা “কলিক” কেন হয়?
কলিক কেন হয় বা সব শিশুর ক্ষেত্রে এটা কেন হয়না তা আজ ও অনাবিষ্কৃত। বিশেষজ্ঞদের কাছে এটি এখনও রহস্য। তবে কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন “কলিক” বাচ্চারা সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে তাদের ইন্দ্রিয়ের উপর কোনো ধরণের চাপ (যেমন কিছু দেখা, শোনা বা অনুভব করা) সহ্য করতে পারেনা। ফলে তারা বিরক্ত হয়ে উঠে এবং কান্না জুড়ে দেয়। তবে, সেই সাথে এটিও ঠিক যে বেশীরভাগ কলিক বাচ্চার সচরাচর স্বাস্থ্যগত অন্যান্য সমস্যা কম থাকে।
অনেকে মনে করেন শিশুর অন্ত্রে সুস্থ ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্যহীনতার কারণেও “কলিক” হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে কলিক শিশুদের অন্ত্রে অন্য শিশুদের চাইতে অন্যরকম মাইক্রোফ্লোরা থাকে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে খাবারে এলার্জির কারণে কলিক হতে পারে। ফর্মুলা খাওয়া বাচ্চারা ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্ট হলে বা বুকের দুধ খাওয়া বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মায়ের খাদ্যাভ্যাসের কারণে কলিক হতে পারে। শিশুর কলিক হওয়ার সাথে ছেলে শিশু না মেয়ে শিশু, বুকের দুধ খায় নাকি ফর্মুলা খায় কিংবা জেনেটিক কারণের কোন সম্পর্ক এ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ যেকোনো শিশুর ক্ষেত্রেই ব্যাপারটি ঘটতে পারে।
তবে, কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মায়েরা গর্ভাবস্থায় বা পরে ধূমপান করেন তাদের বাচ্চারা সাধারণত কলিক হয়। বাচ্চার আশেপাশে ধূমপান করলেও তা হতে পারে।
কলিক বেবি শান্ত করার কিছু পরামর্শ
কলিক শিশুর ক্ষেত্রে নিজে শান্ত থাকাটা সবচাইতে জরুরী। যদিও তা বলার চাইতে করাটা অনেক বেশী কঠিন। আমাদের ছোট্ট সোনা একটু কাঁদলেই অস্থির হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। তবু, সন্তানের স্বার্থেই আমাদের কিছু জিনিস মাথা ঠাণ্ডা রেখে চেষ্টা করে যেতে হবে।
নিচের টিপসগুলো শিশুকে হয়তো বা কিছুটা শান্ত করতে পারবে কিন্তু উপায়গুলো সুবিধামতো একটি একটি করে চেষ্টা করুন, সবগুলো একসাথে করবেন না। এতে বাচ্চা আরও বিরক্ত হয়ে আরো বেশী কান্না জুড়ে দিতে পারে।
শিশু কান্না শুরু করলেই সাড়া দিন। গবেষণায় দেখা গেছে বাচ্চার কান্নায় সাড়া দিলে পরবর্তীতে তা তার কান্না কমাতে সাহায্য করে, এসময় শিশুর জন্য স্নেহের পরশ ও নিরাপদ আশ্রয় সবচেয়ে বেশি কাম্য।
শিশু যদি কোন কিছুতে বিরক্ত হয় তবে তা থেকে তাকে দূরে রাখুন। বিশেষ করে বিকেলে এবং সন্ধ্যার দিকে। যদি মনে হয় শিশু কোলাহল পছন্দ করছে না, তখন এ সময় বেশী মানুষজন তার কাছে কাছে না আসাই ভালো। খেয়াল করুন সে কিসে বিরক্ত হচ্ছে এবং তা থেকে যথাসম্ভব তাকে দূরে রাখুন।
পারিবারিক কলহ, মানসিক চাপ, মনোমালিন্য যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নবজাতকের চারপাশের পরিবেশ শান্ত ও সুন্দর রাখুন। কলিকের কান্নার সময় উপস্থিত হলে, আলো কমিয়ে দিন, যথাসম্ভব মৃদু স্বরে কথা বলুন বা একবারেই কথা বলবেন না। অন্য শব্দ যতটুকু সম্ভব কম করুন। আবার কিছু শিশুর ক্ষেত্রে হালকা ও মৃদু একঘেয়ে শব্দ কখনো কখনো শিশুকে শান্ত করতে পারে, যেমন টিভি বা রেডিওর মৃদু শব্দ।
অনেক কলিক বেবি পেটে সামান্য চাপ দিলে আরাম অনুভব করে। বাচ্চাকে আপনার কোলে উপুড় করে শুইয়ে বা সোজা করে কোলে নিয়ে (যাতে তার পেট আপনার কাঁধের উপর থাকে), অথবা তাকে আপনার হাতের উপর উপুড় করে শুইয়ে আস্তে আস্তে তার পিঠে ঘষে বা চাপড়ে দিতে পারেন। এতে সে কিছুটা আরাম বোধ করতে পারে। ।
যেহেতু শিশু দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ই বেশি কাঁদে, তাই ওই সময়ের কিছুক্ষণ আগে এন্টি কলিক সিরাপ খাওয়াতে পারেন (যদিও তা প্রমানিত নয়) তবে অবশ্যই তা করবেন চিকিৎসকের পরামর্শে ।
কলিকের কারণ যদি গ্যাস বলে মনে হয় আর আপনার বাচ্চা যদি বুকের দুধ খায়- তবে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে আপনার ডায়েট থেকে এলার্জি বা গ্যাস উদ্রেককারী কিছু কিছু খাবার খাওয়া বাদ রেখে দেখতে পারেন। আর শিশু ফর্মুলা খেলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ফর্মুলা পরিবর্তন করে দেখতে পারেন।
শিশুকে প্যাসিফায়ার দিয়ে দেখতে পারেন। অনেক সময় চুষনি মুখে থাকলে বাচ্চার কান্না বন্ধ থাকে। অনেক সময় যখন কোন কিছুই কাজ করেনা একমাত্র চুষনি বাচ্চা কে শান্ত করতে পারে। American Academy of Pediatrics এর গবেষণায় দেখা গেছে ঘুমানোর সময় চুষনির ব্যাবহার SIDS এর আশঙ্কাও কম করে।
মাঝে মাঝে শিশুকে নিয়ে ঘরের বাইরে ঘুরে আসতে পারেন। বাইরের পরিবেশ শিশুর মন শান্ত করতে পারে।
মনে রাখবেন, সব শিশুর ক্ষেত্রে এই টিপসগুলো কাজ করবে, এমন কোনো কথা নেই। এসময় ধৈর্য ধরে আপনার চেষ্টা অব্যহত রাখুন, এবং ঠিক কোন পযিশানে থাকলে কিংবা কি করলে সে একটু ভালো বোধ করে সেটি নিয়ে মা হিসেবে আপনার ইন্দ্রিয় এবং নিজস্ব রিসার্চকেও গুরুত্ব দিন। অন্যদের উপদেশ অযাচিত মনে হলে তা নিয়ে আপাতত বেশি ভাবার কারণ নেই।
মা–বাবার করনীয়
যেহেতু কলিক কোন রোগ না এবং নির্দিষ্ট একটি সময় পর এই সমস্যা কেটে যায় তাই- এই বিষয়টি আমরা বিস্তারিত জেনে নিলে কিছুটা রিলাক্সড থেকে শিশুকে শান্ত হতে সাহায্য করতে পারবো। সদ্য পৃথিবীতে আসা প্রাণটির এখন নিরাপত্তা ও মমতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। বিষয়টি একটু কঠিন হলেও মা, বাবা ও পরিবারের সদস্যরা একে অন্যকে সহযোগীতা করলে এই চ্যালঞ্জের সময়টি পার করে যেতে পারবেন। তাই বাবা-মা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যরা ভাগ করে বাচ্চার যত্নের কাজটি পালন করুন। দুজনে একসাথে ক্লান্ত হয়ে পরবেন না। সময় ভাগ করে একজন একজন করে বিশ্রাম নিন।
নবজাতকের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানই বাবা-মায়ের প্রধান কাজ। বিষয়টি মায়েদের জন্য একটু ক্লান্তিকর হয়ে যায় অনেক সময়, তাই যথাসম্ভব পরিবারের অন্যদের সাহায্য নিতে কেউ কার্পণ্য করবেন না। এসময় মায়ের নিজের শারীরিক এবং মানসিকভাবে উজ্জিবিত এবং সুস্থ থাকার চেষ্টা করা প্রয়োজন।
বাচ্চার সমস্যার ব্যাপারে অন্যদের সাথে আলাপ করুন। প্রয়োজনে অন্যদের সাহায্য নিন। সবসময় মনে রাখবেন এটা একসময় কেটে যাবে।
চিকিৎসক এর পরামর্শ
বাচ্চা কলিক বলে মনে হলেও, চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং চেক আপ করাতে হবে। কারণ বাচ্চার কান্নার কারণ আসলেই কি, তা আমরা নাও বুঝতে পারি। তাই পরীক্ষা করে দেখতে হয় তার আর কোন সমস্যা আছে কিনা। কান্না ছাড়া আর কোন অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখলেও দেরি না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সবার জন্য শুভকামনা।