গত ১১ মার্চ কোভিড–১৯ কে প্যানডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। তবে প্যানডেমিক ঘোষণা করে ভাইরাসটি কতটা ভয়াবহ তা বোঝানো হয়নি, বোঝানো হয়েছে বিশ্বের ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে তা ছড়িয়ে পড়া পরিস্থিতিকে।
কোভিড–১৯ বা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং এই প্রাদুর্ভাবের কারনে গর্ভবতী নারী এবং গর্ভের শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা নিয়ে মায়েদের দুশ্চিন্তাও বেড়েই চলছে। যেহেতু করোনা ভাইরাসের লক্ষন অনেকটাই সাধারণ ফ্লু এর মত তাই প্রথমেই এই রোগীকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বলে সনাক্ত করা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ যুক্তরাজ্যের রয়্যাল কলেজ, গর্ভবতী নারীদের জন্য করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি সম্পৃক্ত কিছু দিক নির্দেশনা প্রকাশ করেছে। এছাড়াও কীভাবে গর্ভবতী নারীরা করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি এড়িয়ে থাকতে পারবেন সে সম্পর্কেও বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। আসুন জেনে নেই করোনা ভাইরাস সম্পর্কে গর্ভবতী মায়েদের কিছু প্রশ্নের উত্তর ও করনীয় সম্পর্কেঃ
গর্ভবতী নারীদের কি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি?
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল কলেজ অফ অবস্টেট্রিশিয়ান এন্ড গায়নোকোলোজিস্ট (RCOG) এই সম্পর্কে বলে, সাধারণ মানুষ ঠিক যতটুকু ঝুঁকিতে থাকে গর্ভবতী নারীরাও ঠিক ততটুকু ঝুঁকিতে থাকে। আলাদা ভাবে গর্ভবতী নারীরা কি বেশি ঝুঁকিতে থাকে, এমন কোন তথ্য এখন পর্যন্ত সুনিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
RCOG এর প্রেসিডেন্ট এডওয়ার্ড মরিসের মতে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত থেকে এটুকু বলা যায় যে অন্য যে কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের চাইতে গর্ভবতী নারীদের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি নয়।
এদিকে সিডিসি’র ওয়েবসাইটেও একই কথা বলা আছে যে, গর্ভবতী নারীরা কি করোনাতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে তুলনামূলক ভাবে বেশি থাকে কি না সে সম্পর্কে এখন পর্যন্ত সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে যেহেতু গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একটু কমে যায় তাই এসময় কিছু কিছু ইনফেকশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই এসময় একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
করোনা ভাইরাস কি গর্ভের শিশুর মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে?
রয়্যাল কলেজ অফ অবস্টেট্রিশিয়ান এন্ড গায়নোকোলোজিস্ট এর প্রেসিডেন্ট ডঃ এডওয়ার্ড মরিস বলেন, “মায়ের করোনা ভাইরাস হলে সেটা গর্ভের শিশুর মধ্যেও সংক্রমণ হতে পারে, এমন কোন তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।” তিনি আরো বলেন, “আর ঠিক তাই এই মুহূর্তে এটুকু বলা যায় যে গর্ভবতী নারীর করোনা হলে গর্ভের শিশুর জন্মগত ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনাও বেশ কম।”
তবে প্রতিনিয়ত যেহেতু নতুন নতুন তথ্য আসছে তাই এসব নির্দেশনা পরিবর্তিত হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে চায়নাতে করোনা ভাইরাসের লক্ষণ দেখা দেয়া কিছু গর্ভবতী নারীর সঠিক সময়ের আগেই প্রসব হয়ে যেতে দেখা যায়। তবে এটা কি ঠিক করোনা ভাইরাসের কারনেই হয়েছে নাকি গর্ভবতী নারীর শারীরিক অসুস্থতার কারনে ডাক্তাররা সময়ের আগের প্রসবের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি।
১৮ই মার্চে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দুটি ক্ষেত্রে মা থেকে সন্তানের করোনা ভাইরাসের সম্ভাব্য সংক্রমের কথা বলা হয়েছে। তবে দুটি কেসের ক্ষেত্রেই এই সংক্রমণ গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় হয়েছে না জন্মের ঠিক পর পর হয়েছে সে সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে কিছু বলা হয়নি।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কিছু মায়েদের আম্নিওটিক ফ্লুয়িড, কর্ড ব্লাড এবং নবজাতকের গলা থেকে নমুনা নিয়ে করা পরীক্ষায় করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অন্য আরেকটি গবেষণায় তিনজন আক্রান্ত মায়ের প্লাসেন্টার নমুনা থেকেও নেগেটিভ ফলাফল পাওয়া গিয়েছে।
এইসব গবেষণার ফলাফল থেকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের থেকে গর্ভের শিশুর মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণের সম্ভাবনা কম।
গর্ভাবস্থায় করোনার প্রভাব কেমন হতে পারে?
গর্ভবতী নারীরা এই সময়ে করোনা আক্রান্ত হলে তাদের মধ্যে সাধারণ ফ্লু এর লক্ষন দেখা যেতে পারে। তবে লক্ষণগুলো তীব্র আকার ধারন করার সম্ভাবনা কম এবং এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের কারনে কোন গর্ভবতী নারীর মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়নি।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে গর্ভপাত হতে পারে এমন কোন উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এছাড়াও যেহেতু গর্ভের বাচ্চার মধ্যে এই ভাইরাস সংক্রমণের কোন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি তাই ধরে নেয়া যায় এই ভাইরাসের কারণে ভ্রূণের কোন অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়ার সম্ভাবনাও কম।
সংক্রমণের ঝুঁকি আমি কীভাবে এড়াতে পারি?
সংক্রমণ এড়াতে আপনি এবং আপনার পরিবার নিচের চার ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেন:
- ঘন ঘন সাবান ও পানি দিয়ে বা অ্যালকোহলযু্ক্ত হাত-ধোয়ার সামগ্রী ব্যবহার করে আপনার হাত ধূয়ে নিন
- কাশি বা হাঁচি দেবার সময় মুখ এবং নাক কনুই দিয়ে বা টিস্যু দিয়ে ঢেকে রাখুন। ব্যবহূত টিস্যুটি তাৎক্ষণিকভাবে নির্দিষ্ট স্থানে (মুখ বন্ধ ডাস্টবিন) ফেলে দিন
- ঠান্ডা লেগেছে বা জ্বরের লক্ষণ আছে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন
- জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত চিকিৎসা সেবা নিন।
কিছু কিছু বিশেষজ্ঞের মতে এসময় গর্ভবতী মায়েদের বয়স্ক মানুষদের মতই আলাদা থাকার চেষ্টা করা উচিৎ।
করোনা আক্রান্ত নারী কি তার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবে?
এখন পর্যন্ত এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি যার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত বলা যেতে পারে যে, মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে শিশুর মধ্যেও করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হয়। আর তাই মায়ের বুকের দুধের অন্যান্য গুণগত মানের কথা বিবেচনা করে শিশুকে এমন অবস্থায় বুকের দুধ খাওয়ানই ভালো।
এ সম্পর্কে সিডিসি’র ওয়েবসাইটে বলা আছে, নবজাতক শিশুর পুষ্টির সবচাইতে সেরা উৎস হল মায়ের বুকের দুধ। তবে এই সংক্রমনের ক্ষেত্রে কীভাবে সঠিক উপায়ে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো যেতে পারে এ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোন নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।
যদিও বুকের দুধের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা তেমন নেই বললেই চলে, তবু অন্যান্য মাধ্যমে মায়ের থেকে শিশুর মধ্যে করোনার সংক্রমণ হতেই পারে। তাই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো সময় মায়েদের সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। যেমন, যখন সন্তানের কাছে থাকবেন এবং দুধ খাওয়াবেন তখন মাস্ক পরবেন, সন্তানের সংস্পর্শে আসার আগে ও পরে (দুধ খাওয়ানোর সময়) ভালো করে হাত ধুয়ে নিবেন, এবং জীবানু রয়েছে এমন জায়গা ভালভাবে পরিস্কার করবেন। কোভিড-১৯ এ নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত বা এই ভাইরাসে আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে এমন যে কোন মানুষ শিশুসহ অন্যদের সংস্পর্শে আসার সময় সকল ক্ষেত্রে উপরোক্ত সতর্কতাগুলো অবলম্বন করবেন।
আবার যদি বুকের দুধ পাম্প করে শিশুকে খাওয়ানো হয় তাহলে সেই পাম্প স্পর্শ করার আগেও ভালো করে হাত ধুয়ে জীবাণু মুক্ত করে নিতে হবে। সর্বচ্চো সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য সম্ভব হলে অন্য কারো মাধ্যমে পাম্প করা দুধ শিশুকে খাওয়ানো ভালো।
যেহেতু মায়ের বুকের দুধের কারনে শিশু অনেক ধরনের রোগ থেকে বেঁচে থাকতে পারে তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া বুকের দুধ কোনভাবেই বন্ধ না রাখাই ভালো।
মা যদি খুবই অসুস্থ হয়, তখনও বুকের দুধ সংরক্ষন করে তার সন্তানকে দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করা উচিত। এই দুধ কোন পরিস্কার কাপ বা চামুচে করে দেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে একই ধরনের সংক্রমন প্রতিরোধ সতর্কতা অনুসরণ করতে হবে।
উল্যেখ্য যে মায়ের বুকের দুধ এবং গর্ভে থাকা এমনিওটিক ফ্লুইডের উপাদান পরীক্ষা করে এখন পর্যন্ত সেখানে করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়নি। তবে যেহেতু এই গবেষণাটি খুব কম সংখ্যক মায়েদের উপর করা হয়েছে তাই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের থেকে কি নবজাতক শিশুকে আলাদা রাখতে হবে?
এই সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলেন, যেহেতু এখন পর্যন্ত এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি যে নবজাতক শিশুকে তার মায়ের কাছ থেকে আলাদা রাখতে হবে তাই শিশুকে মায়ের কাছ থেকে আলাদা না করাই ভালো। কেননা এর কারনে শিশু এবং মা উভয়ের উপরেই প্রচুর মানসিক চাপও পড়তে পারে।
তবে রয়্যাল কলেজের প্রসুতি মা এবং শিশুর স্বাস্থ্য বিভাগের প্রেসিডেন্ট ডঃ রাসেল ভাইনার এ সম্পর্কে বলেন, পুরো বিষয়টি আমাদের জন্য খুব দ্রুত আর তাই যে কোন সিদ্ধান্তে চলে যাওয়াটা বেশ কঠিন। তবুও বর্তমান পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করা বলা যেতে পারে, নবজাতক শিশু এবং মা’কে আলাদা না রাখাই ভালো। তবে এক্ষেত্রে যাবতীয় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ।
তবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মা ও শিশুকে অন্য নবজাতকদের কাছ থেকে ১৪ দিন আলাদা রাখার পরামর্শ দেয়া হয় যাতে অন্যদের ভেতর এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
গর্ভবতী নারীরা যদি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে সন্দেহ করেন তাহলে করনীয় কি?
রয়্যাল কলেজ এই সম্পর্কে বলেছে, এই ধরনের মুহুর্তে সরকার প্রদত্ত জরুরী নাম্বারে কল করাই শ্রেয়। এছাড়া ফোন করার সময় এটা তাদের অবশ্যই বলে দিতে হবে যে আপনি গর্ভবতী।
করোনা ভাইরাসে যদি আক্রান্ত হন অথবা করোনা ভাইরাসের কোন লক্ষন প্রকাশ পেলে সাথে সাথে নিম্নের হটলাইনে যোগাযোগ করুন। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট(IEDCR), আপনার বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে আসবে।
ফোন নাম্বার:
- ০১৯২৭৭১১৭৮৪
- ০১৯২৭৭১১৭৮৫
- ০১৯৩৭০০০০১১
- ০১৯৩৭১১০০১১
উল্যেখ্য যে করোনা ভাইরাসের লক্ষন অন্যান্য সাধারণ ফ্লু এর মতই। তাই করোনা ভাইরাসের কোন ধরনের লক্ষন প্রকাশ পেলে আতংকিত না হয়ে উপরোল্লিখিত জরুরী নাম্বারে যোগাযোগ করুন।
এছাড়া যদি করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় তাহলে আপনাকে আইসোলেশন অর্থাৎ সবার থেকে আলাদা হয়ে থাকার ব্যাপারে পরামর্শ প্রদান করা হবে। পরবর্তীতে অন্যান্য সবাইকে যেভাবে করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা করা হয় গর্ভবতী নারীকেও ঠিক একই ভাবে পরীক্ষা করা হবে। যে সমস্ত গর্ভবতী নারীদের আইসোলেশনের ব্যাপারে পরামর্শ দেয়া হবে তাদের পরবর্তী চৌদ্দদিন পর্যন্ত বাসায় আবদ্ধ থেকে কারো সংস্পর্শে না যাওয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তবে এই সময়েও তাদের নিয়মিত মাতৃকালীন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যেতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে জানিয়ে দিতে হবে যে তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত অথবা আক্রান্ত হওয়ার সন্দেহে আইসোলেশনে আছেন।
যদি গর্ভবতী নারীর কোন ধরনের জরুরী চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তাহলে অবশ্যই ডাক্তারকে জানিয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে গর্ভবতী নারীকে আলাদা রেখে সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করে ডাক্তার চিকিৎসা প্রদান করবেন।
সবশেষে বলবো, আতঙ্কিত হবেন না। কারণ মানসিক অবস্থা আমাদের শারীরিক কর্মক্ষমতাকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। তাই এ সময় আতঙ্কিত হলে তা শরীরকে দুর্বল করে ফেলতে পারে এবং গর্ভকালীন বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
সবার জন্য শুভকামনা।