গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু : ঝুঁকি ও করনীয়

Spread the love

বর্ষাকালে এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় অন্যান্য পোকার সাথে মশার উপদ্রবটাও কিঞ্চিৎ বেড়ে যায়। যার ফলে মশা বাহিত বিভিন্ন ধরনের রোগ জীবাণু এই ধরনের সময়গুলোতে আমাদেরকে আক্রমণ করে থাকে। মশা-বাহিত বিভিন্ন রোগের মধ্যে ডেঙ্গু অন্যতম একটি ভয়াবহ রোগ যার ফলে আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় এই রোগ মা এবং গর্ভের শিশুর জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

ডেঙ্গু কি?

ডেঙ্গু হল মশা বাহিত একটি রোগ। সময়মত সুচিকিৎসা প্রদান করা না হলে প্রাণঘাতী ইনফেকশন ডেঙ্গু জ্বর আমাদের শরীরের উপরে প্রচুর প্রভাব বিস্তার করে। ডাক্তারি ভাষায় প্রাণঘাতী এই ইনফেকশনকে Dengue haemorrhagic fever বলা হয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপণ

ডেঙ্গু সাধারণত বিশ্বের গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলগুলোর শহর এলাকায় বেশি দেখা যায়, এছাড়া উপক্রান্তিয় অর্থাৎ বাংলাদেশের মত নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেও এই রোগটি প্রায়শই পরিলক্ষিত করা যায়।

এডিস নামক মশাই হল এই রোগের বাহক, এই ধরনের মশা সাধারণত বদ্ধ পানিতে ডিম পারে। ডেঙ্গু রোগ মূলত এই এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমেই ছড়ায়। এই ধরনের মশা প্রায় ৪০ দিনের মত বেঁচে থাকে এবং পুরোটা সময় জুড়েই তার এই ভাইরাস বহন করে চলে।   

এডিস মশার জন্য ডিম পারার সবচাইতে ভালো সময় হল বর্ষাকাল, আর তাই বর্ষার পরবর্তী সময়টা আমাদের খুব সতর্ক হয়ে চলতে হবে। এছাড়া এই ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা সাধারণত একদম সকালে এবং বিকেলের দিকে খুব বেশি কামড়ায়।

ডেঙ্গু রোগের কারণ

নিম্নে ডেঙ্গু রোগের কিছু সাধারণ কারণ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলঃ

  • গ্রীষ্মপ্রধান এবং নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে হওয়া এই এডিস নামক মশাই হল ডেঙ্গু রোগের প্রধান ও অন্যতম কারণ।
  • যেহেতু এই ডেঙ্গু মশা সাধারণত বদ্ধ পানি, খোলা ড্রেন, কৌটা, ফুলদানী এবং পানি সংরক্ষণের কৌটার মধ্যেই সাধারণত ডিম পাড়ে, তাই এই ধরনের পানি পরিষ্কার না রাখলেও সেটা এডিস মশার বংশ বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
  • এই ডেঙ্গু ভাইরাসটি চার ধরনের হয়ে থাকে আর তাই যদিও আপনি এক ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েন তবুও আপনার জন্য আরো তিনটি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
  • একদম সকালে এবং বিকেলের দিকে ডেঙ্গু মশা প্রচুর কামড়ায় তাই সে সময়ে অসতর্ক থাকাও ডেঙ্গু রোগের একটা কারণ হয়ে পড়ে।

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ

নিম্নে ডেঙ্গু রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে বর্ণনা করা হল। সাধারণত ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার চার থেকে সাত দিনের মাথায় আপনার মধ্যে এই লক্ষণগুলো ফুটে ওঠে।

ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির অনেক উচ্চ তাপমাত্রায় জ্বর হয়ে থাকে, যার কারণে সহজেই ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত বলে চিহ্নিত করা যায়। এছাড়া এই জ্বরের সাথে আরো কিছু লক্ষণ থাকে যেমন মাথা ব্যথা, হাতে পায়ের জয়েন্টে ব্যথা, বমি বমি ভাব, শরীরে র‍্যাশ হওয়া, শরীরের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া অথবা চোখের পিছনে ব্যথা করা।

ডেঙ্গু রোগ অনেক বিপদজনক আকার ধারণ করলে নিম্নের লক্ষণগুলো দেখা যেতে পারেঃ

  • নাক এবং দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত ক্ষরণ
  • তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা
  • শরীরের ত্বকে ক্ষত
  • কিছুক্ষণ পরপরই বমি হতে থাকা
  • শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্ট হওয়া
  • শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে যাওয়া

গর্ভকালীন সময়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে তার ঝুঁকি কতটুকু?

গর্ভকালীন সময়ে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হলে গর্ভের শিশুর জন্য সেটা মোটেও ভালো কিছু নয়। আপনার গর্ভে বেড়ে ওঠা শিশুর উপর এই ডেঙ্গু রোগ যে প্রভাবগুলো বিস্তার করতে পারে সেগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলঃ

  • শিশু জন্মের সময় ওজন কম থাকা
  • যদি গর্ভ ধারণ করার প্রাথমিক পর্যায়ে ডেঙ্গু আক্রমণ করে তাহলে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • গর্ভকালীন সময়ে ডেঙ্গু রগে আক্রান্ত হলে তার প্রাথমিক প্রভাব হল প্রিম্যাচিউর শিশু অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শিশুর জন্ম গ্রহণ করা যার ফলে শিশু আপনার গর্ভে পরিপূর্ণ ভাবে বেড়ে ওঠার সময় পায় না।
  • এছাড়া ডেঙ্গু রোগের কারণে বড় ধরনের আরো কিছু জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে এমনকি ডেঙ্গু জ্বরের কারণে আক্রান্ত মায়ের গর্ভের শিশু মারাও যেতে পারে।

ডেঙ্গু হলে জ্বর অত্যন্ত বেড়ে যায়। মায়ের শরীরে যখন জ্বর বেশি হয়, এর ফলে মায়ের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। সেই সাথে শিশুটিরও হৃদপিণ্ডের গতি অনেক বেড়ে যায়। আর জ্বরের কারণে মায়ের শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এতে মায়ের শরীর থেকে বাচ্চার শরীরে যে রক্ত চলাচলা হয় সেটি ব্যহত হয়।

বিজ্ঞাপণ

আমাদের শরীরে যখন তাপমাত্রা বাড়ে তখন শরীরে শিরা উপশিরাগুলো প্রসারিত হয়। প্রসারিত হওয়ার কারণে শিশুর দেহে মায়ের শরীর থেকে রক্ত চলাচল ব্যহত হয়ে যায়। এতে মায়ের গর্ভে বাচ্চার মৃত্যু হতে পারে। এরপর সঠিক পুষ্টি না পাওয়ার কারণে বাচ্চার কম ওজন হতে পারে। সময়ের আগেই প্রসব বেদনা হতে পারে। জন্মের পরও বাচ্চা মারা যেতে পারে।

যদি ডেঙ্গু জ্বর কোনো মাকে আক্রমণ করে, তাহলে তাঁর যেকোনো জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ার মধ্যে যে অনুচক্রিকা বা প্লাটিলেট জড়িত সেটি কমে যেতে পারে। তখন সেই মায়ের যদি কোনো কারণে প্রসবকালীন ডেঙ্গু ধরা পড়ে কিংবা অস্ত্রোপচার পরবর্তী সময়ে ধরা পড়ে তাহলে তাঁর প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং সেই মাও মারা যেতে পারেন। তা ছাড়া এ সময় যে মায়ের শরীরে রক্ত সঞ্চালন হবে, সেটিও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। (সূত্র)

গর্ভের শিশুও কি ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হতে পারে?

ডেঙ্গু রোগের কারণে গর্ভের শিশুর কোন ধরনের অঙ্গ বিকৃতি হয় না এবং এই রোগ গর্ভের শিশুকে আক্রান্ত করতে পারে না। তারপরেও যথেষ্ট পরিমাণে সাবধান থাকতে হবে যাতে করে শিশুর জন্মের পর তাকেও ডেঙ্গু রোগ আক্রমণ না করে।

তাই আপনি যদি গর্ভকালীন সময়ে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন তাহলে শিশুর জন্মের পর ডাক্তার ভালো করে পরীক্ষা করে দেখবেন যে শিশু কি জ্বর আছে কি না অথবা শরীরে র‍্যাশ হয়েছে কি না। তার প্লাটিলেট কাউন্ট ও করা হতে পারে।  

গর্ভাবস্থায় কীভাবে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা করা হতে পারে?

গর্ভকালীন সময়ে ডেঙ্গু রোগের সার্বিক চিকিৎসা গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বেশ স্পর্শকাতর একটা বিষয়। এই সময়ে আক্রান্ত হলে যে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে সেটা অন্য সময় থেকে মোটেও ব্যতিক্রম কিছু নয়। অন্য সময়ের মতই ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত কি না এবং আক্রান্ত হলেও সেটা কতটা গুরুতর এগুলো পরীক্ষা করার জন্য আপনার রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। গর্ভকালীন সময়ে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা সম্পর্কিত কিছু সাধারণ নির্দেশনা নিম্নে বর্ণনা করা হলঃ

  • এই সময়ে আপনাকে প্রচুর পরিমাণে তরল গ্রহন করতে হবে। আপনি চাইলে পানির সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের ফলের জুস অথবা স্যালাইন খেতে পারেন কেননা এই সময়ে গর্ভে এম্ব্রয়নিক ফ্লুইড এবং শরীরের পানির পরিমাণ ঠিক রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
  • শরীরের জয়েন্টের ব্যথা এবং অন্যান্য ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আপনাকে ব্যথা নাশক ওষুধ এবং অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হতে পারে।
  • যে সমস্ত ওষুধ পেসক্রিপশন ছাড়াই কিনতে পাওয়া যায়, গর্ভকালীন সময়ে সেগুলো সেবন থেকে একদম বিরত থাকবেন। কেননা এই ধরনের ওষুধ গর্ভকালীন সময়ের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়।
  • আপনার রক্তে উচ্চচাপ আছে কিনা এবং রক্তের প্লাটিলেট নিয়মিত পরীক্ষা করা হবে।
  • ডেঙ্গু রোগ যদি অতিরিক্ত আকার ধারণ করে তাহলে হয়ত প্লাটিলেট ইনফিউশনের পরামর্শ দেয়া হবে।
  • এছাড়া এই সময়ে আপনাকে ইনজেকশনের মাধ্যমে স্যালাইন এবং সার্বক্ষণিক অক্সিজেন বজায় রাখার জন্য অক্সিজেন দেয়া হতে পারে।
  • যদি অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে হয়ত রক্ত গ্রহণ করতে হতে পারে।

গর্ভকালীন সময়ে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা নারীদের জন্য কতটা নিরাপদ?

যেহেতু ডেঙ্গু ভাইরাসের জন্য বিশেষ ধরনের কোন ভ্যাকসিন অথবা অ্যান্টিবায়োটিক নেই তাই এর চিকিৎসার সবচাইতে প্রচলিত উপায় হল এই রোগের লক্ষণগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা।

মা এবং গর্ভের শিশুর নিরাপত্তাই হল সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাই এই গর্ভকালীন সময়ে শুধুমাত্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিহীন প্যারাসিটামল সেবন করার জন্য ডাক্তার পরামর্শ দিবেন। এছাড়াও ডাক্তার আপনাকে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে বলবেন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিতে উপদেশ দিয়ে থাকবেন।

বিজ্ঞাপণ

ডেঙ্গু জ্বর যদি অতিরিক্ত আকার ধারণ করে ফেলে তাহলে আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা প্রদান করা হবে যেখানে আপনাকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা সম্ভব। এভাবেই হাসপাতালে আপনার উচ্চ রক্তচাপ এবং পানিশূন্যতার ব্যাপারে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। যদি রক্তে আপনার প্লাটিলেটের পরিমাণ অনেক কম থাকে তাহলে রক্ত প্রদানের মাধ্যমে আপনার রক্তের প্লাটিলেটের পরিমাণ ঠিক রাখা হবে।

ডেঙ্গু ইনফেকশন কিভাবে প্রতিরোধ করা যেতে পারে?

গর্ভকালীন সময়ে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত না হওয়ার জন্য এবং পরবর্তীতে আরো জটিলতা যাতে তৈরি না হয় এজন্য নিজেকে ডেঙ্গু রোগ থেকে নিরাপদ রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া যেহেতু গর্ভের শিশুর সুস্বাস্থ্য রক্ষা করা আপনার দায়িত্ব তাই নিজেকে অবশ্যই ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। নিম্ন বর্ণীত উপায়গুলো আপনাকে ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবেঃ

  • যেহেতু ডেঙ্গু মশা একটু গরম আবহাওয়া পছন্দ করে তাই দিনের বেলাতে যখন বিশ্রাম নিবেন তখন অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা রুমে থাকার চেষ্টা করবেন।
  • যতটুকু সম্ভব হয় মশারি ব্যবহার করবেন এবং নিরাপদ মশার স্প্রে ব্যবহার করতে পারেন।
  • এসি, টব এবং ফুলদানী সহ সকল ধরনের বদ্ধ পানি পরিষ্কার রাখুন যাতে করে ডেঙ্গু মশা বংশ বিস্তার করতে না পারে।
  • ফুলহাতা এবং হালকা বর্ণের জামা পরিধান করার মাধ্যমে মশার কামড় থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব।
  • নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করান এবং যখনই সন্দেহ হবে সাথে সাথে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করুন।
  • এছাড়া জানালা দিয়ে যাতে করে মশা না ঢুকতে পারে এজন্য সেখানে নেট বসাতে পারলে খুবই ভালো।
  • যদি মশা নিরোধক কোন ক্রিম ব্যবহার করেন তাহলে একসাথে অনেক বেশি ব্যবহার না করে বরং অল্প অল্প করে বারবার ব্যবহার করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।

পরিশেষে

যেহেতু আপনি অচিরেই একজন মা হতে চলেছেন তাই এই গর্ভকালীন সময়ে আপনাকে একটু অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে এবং ডেঙ্গুর মত রোগ থেকে নিরাপদ থাকার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে। ডেঙ্গু রোগের প্রতিরোধের  ব্যবস্থা এবং যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করাই হল এই রোগ থেকে নিজেকে এবং গর্ভের শিশুকে নিরাপদে রাখার একমাত্র উপায়।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment