শিশুর মানবিক উন্নয়নের কৌশলঃ শাস্তি প্রদান না অন্য কিছু

Spread the love

লিখেছেন – Sharmin Shamon

হেলদি প্যরেন্টিং এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বাচ্চাকে না মেরে কৌশলে সুন্দর এবং কার্যকরী পদ্ধতিতে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ করতে শেখানো। মানুষ যখন নিজের উপর নিজে নিয়ন্ত্রন তৈরি করতে পারে তখন সে যেকোন খারাপ কিছু থেকেই নিজেকে দূরে রাখতে পারে। ভয়-ভীতি, মারধোর আর চাপিয়ে দেয়া শিক্ষা  মানুষকে সাময়িক ঠিক রাখলেও বেশিরভাগ সময়েই এর দীর্ঘমেয়াদি কোন সুফল থাকেনা।

বিজ্ঞাপণ

একটি অতি পরিচিত দৃশ্য কল্পনা করুন। আপনি আপনার বাচ্চাকে কিছু একটা করতে বলছেন সে করছে না, আবার কিছু একটা করতে না করছেন কিন্তু সে শুনছে না, আপনি উঠে এসে জোরে দিলেন এক থাপ্পড়! ব্যস, সাথে সাথে কাজ হয়ে গেলো! খুব সহজ মনে হচ্ছে না বাচ্চাকে দিয়ে প্রত্যাশিত কাজটি করিয়ে নেয়া?  আসলেই কি তাই? এটা কিন্তু অনেকটা ময়লা পরিষ্কারের জন্য ময়লা কাপড় ব্যবহার করার মতো বিষয় হয়ে গেলো! 

চলুন, আর একটু গভীরে তাকিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করি। আপাতদৃষ্টিতে আপনার মনে হতে পারে যে মারলে সে কথা শুনে, শুনবে। কিন্তু এই মারের কারনে তার যে মানসিক ক্ষতি এবং আচরনগত সমস্যা বা বিহেভরিয়াল ডিসঅর্ডার তৈরি হতে পারে তা হয়তো সে আজীবন বয়ে বেড়াবে, তার নিজের জীবনে এমনকি পরবর্তীতে তার সাথে জড়ানো অন্যদের জীবনেও এর প্রভাব পড়তে পারে।

বাচ্চাকে মারলে সে সাথে সাথে কথা শুনলেও একই কাজ ভবিষ্যতে বার বার করতে পারে। এমনকি অনেক সময়ই বাচ্চা এই গায়ে হাত তোলার বিষয়টার সাথে এডজাস্ট করে যায় এবং সে তার মতোই থেকে যায়।

কিছু কিছু বাচ্চারা তো একটু বড় হওয়ার পর উল্টো মা-বাবাকেও মেরে বসে। শুধু তাই নয়, খেলতে গিয়ে, স্কুলে গিয়ে অন্য বাচ্চাদের সাথে একটু মতের অমিল হলেই মেরে বসে কারন সে তো শিখেছেই পরিবার থেকে যে রেগে গেলে বা মনমতো কিছু না হলে মারতে হয়, মারা যায়।

আরেকটু সহজ করে যদি বলি, ধরুন আপনার ৫ বছরের বাচ্চাটি আপনার পার্স থেকে আপনাকে না বলে ১০ টাকা নিয়ে গেলো। এবার আপনি তাকে ধরে ফেললেন এবং চুরি করেছিস কেন এই বলেই মারতে শুরু করলেন, আর বললেন যে আর জীবনে চুরি করবি না। এর সাথে ধরেন পরিবারের অন্য কেউ যদি যোগ করে যে, আরেহ এই বয়সেই চুরি করে, বড় হলে তো ডাকাতি করবে! 

এই যে দৃশ্যপট বা ঘটনাটি এটা খুবই কমন আমাদের দেশের পরিবারগুলোতে৷ শিক্ষিত বা অশিক্ষিত প্রায় সব পরিবারেই এভাবেই রিয়েকশন দেখায় বাচ্চাদের এই ধরনের অপ্রত্যাশিত আচরণে। আপনি তো ভাবছেন মেরেছি, মারের ভয়েই আর জীবনে চুরি করবেনা৷ তো, আজ না হয় আপনার বাচ্চাটি ছোট,  আপনাকে ভয় পায় তাই সামনের দিনগুলিতে আর চুরি করলো না!! কিন্তু ধরুন সে যখন বড় হবে,  একটা অফিসে চাকরি করবে তখন যে চুরি করবে না, দূর্নীতি করবে না এটা কিন্তু আপনি নিশ্চিত করতে পারবেন না, এমনকি তখন আপনার মারের ভয়ও আর তার কাজ করতে নাও পারে।

কারন সে তখন বড় হবে, আপনিও  যে তাকে মারবেন না, মারতে পারবেন না এটা তো সে জানেই!! চুরি সম্পর্কে আপনি তাকে  যে শিক্ষা বা যেভাবে শিক্ষা দিয়েছেন এটা মোটেও সঠিক নয়, এটা একটা ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা। নিশ্চয়ই ভাবছেন  তাহলে সঠিক শিক্ষাটা কি হতো? অনেকভাবেই আপনি তাকে কৌশলে সঠিক শিক্ষাটা দিতে পারেন আপনি আপনার সন্তানকে সবচেয়ে ভালো জানেন তাই আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে সেটা কি এবং কিভাবে করবেন।

এবার বলি আমার সন্তান যদি আমার পার্স থেকে আমাকে না জানিয়ে ১০ টাকা নিয়ে যেত আমি কি করতাম। প্রথমেই আমি নিশ্চিত হয়ে নিতাম টাকাটা সে-ই নিয়েছে কিনা। নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে আমার কাছে ডেকে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করতাম যে সে কেন নিয়েছে, এবং টাকাটা দিয়ে কি করেছে৷ এবার তাকে বুঝাতাম শান্ত এবং দৃঢ় গলায় যে কাউকে না বলে তার কোন জিনিস নিতে হয় না, এটা খারাপ কাজ এবং তুমি আর এটা করবে না। সাথে এটাও বলতাম তোমার কোন প্রিয় জিনিস কেউ যদি তোমার কাছ থেকে না বলে নিয়ে নেয় তোমার কেমন লাগবে। প্রথমবারে এইটুকুই।

বিজ্ঞাপণ

আমি অবশ্যই এটা ঘর ভর্তি মানুষের সামনে বলতাম না, এমনকি ‘চুরি’  শব্দটি ব্যবহার করতাম না এতো সহজেই। কারন বাচ্চাকে ছোট করে, অপমান করে কখনো ভালো জিনিস শেখানো যায় না, আর শেখালেও সে শেখার স্থায়িত্ব কম হয়। মোট কথা, বাচ্চাকে মেরে, ভয় দেখিয়ে নয়, বুঝিয়ে তাকে অনুধাবন করিয়ে, তার মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণ তৈরি করে যদি তাকে কিছু শেখান বা সংশোধন করে দেন তা সারাজীবন স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

জোর করে, ভয় দেখিয়ে, মেরে ভালো কিছু না ঢুকিয়ে, ভালো কাজের বীজ বপন করুন শুরু থেকেই। তাতে করে বাচ্চার সাথে সাথে সেই বীজটা একদিন বড় গাছে রূপ নিবে এবং আপনার বাচ্চার জীবন জুড়ে সে  গাছ ছায়া এবং ফল দিয়ে যাবে।

পজিটিভ স্পিচ বা ইতিবাচক কথা বাচ্চাদের জন্য খুব দরকারী এবং খুব কাজেও দেয়। একই নির্দেশনা দিবেন কিন্তু ভাষাটা আলাদা হবে। যেমনঃ তুমি ওখানে যেও না, না বলে আমরা বলতে পারি এখানেই থাকো,  তাতে বাচ্চা একটি ‘না’ কম শুনলো। জানি একটু জটিল এবং হাস্যকর মনে হচ্ছে হয়তো যে এভাবে মেপে মেপে কথা বলা যায় নাকি? যদি বলি সবসময় না গেলেও অনেক সময়ই যায়। কিছুদিন নিজে চেষ্টা করলে দেখবেন আপনি এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।

বাচ্চার কাছ থেকে পজিটিভ কথা শুনতে হলে পজিটিভ কথা বলতেও হবে। আমার প্রায় দুই বছর বয়সী মেয়ে আমাদের মুখে যা শুনে সাথে সাথে বলে উঠে, এটা যেমন আমাকে আনন্দ দেয় আবার ভয়ও পাইয়ে দেয় যে কখন কি বলছি সে কোনটা শিখে নিজের মধ্যে রেখে দিচ্ছে কে জানে!!!

এবার একটি গল্প বলি,  এর থেকে বুঝে যাবেন বাচ্চাকে না মেরে,  অপমান না করেও কিভাবে বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে ভালোকিছু করানো যায়।

একজন মা তার ৪ বছরের বাচ্চার জন্য রান্নাঘরে দুইটি কৌটা রাখলেন। একটি কৌটা জেলি বিন দিয়ে পুরো ভর্তি,  আরেকটি  একদম খালি। জেলি বিন ভর্তি কৌটার গায়ে লিখে দিলেন ‘গুড বিহেভিয়ার’, আর অন্যটির গায়ে লিখলেন ‘নট গুড বিহেভিয়ার’। এবার বাচ্চাকে পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে দিলেন যে সে সারাদিনে যতবার খারাপ আচরন বা খারাপ কাজ করবে ততটি জেলি বিন খালি কৌটায় রাখা হবে। দিনে  যদি ৩ টির বেশি হয় তাহলে রাতে ঘুমের সময় একটি গল্প তাকে কম বলা হবে। আর যদি একটি জেলি বিনও কৌটাতে না পড়ে তাহলে তাকে একটি গল্প বেশি বলা হবে। এবার সে বাচ্চাটি  দিনে কয়েকবার করে নট গুড বিহেভিয়ার কৌটাটি দেখে যায়, আর চেষ্টা করতে থাকে যেন বেশি জেলি বিন ওই কৌটায় না পড়ে৷ এমনকি কোন কোন দিন একটি জেলি বিনও সেই কৌটায় পড়েনি!

কতো সুন্দর আর কার্যকরী একটা পদ্ধতি বাচ্চাকে ভালো ব্যবহারে আগ্রহী করার। খেয়াল করে দেখুন এটা আমরা করতে গেলে অনেকেই ‘ব্যাড বিহেভিয়ার’ নাম দিতাম হয়তো। কিন্তু এই নামটিও দিয়েছে পজিটিভলি, অর্থ কিন্তু একই।  এই যে বাচ্চাটি জেলি বিন খেয়াল করে করে নিজেকে ঠিক রাখছে, এটা বেশি কাজে আসবে,  থাপ্পড় আর গালাগালির চেয়ে। কারন সে নিজের চেষ্টায় নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ তৈরি করছে মা-বাবার সাহায্যে। আর এভাবে চর্চা করতে করতেই একদিন এই বিষয়গুলো  তার আচরনের, ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে যায়।

বাচ্চা যদি অপ্রত্যাশিত কিছু করে তা কখনোই অনুমোদন করার কথা বলছিনা, বলছি এটা যে ঠিক নয় এটা তাকে বুঝানোর কৌশলটা যেন সঠিক এবং সুন্দর হয়৷ ধরুন আপনার বাচ্চা কোন অপ্রত্যাশিত আচরণ করলো। আপনি তাকে শাস্তি হিসেবে তার টিভি দেখা বা কার্টুন দেখার টাইম কমিয়ে দিতে পারেন। ধরুন সে  প্রতিদিন ১ ঘন্টা দেখে আজকে ৩০ মিনিট কমিয়ে দিতে পারেন। আচরণের ধরন এবং মাত্রা অনুযায়ী কোন কোন দিন একদম বন্ধও করে দিতে পারেন। তাকে ১০ মিনিট একজায়গায় বসে থাকার মতো শাস্তিও দিতে পারেন। এমন আরো অনেক ধরনের শাস্তি দেয়া যেতে পারে বাচ্চাকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে আঘাত না করেই।

আপনার প্যারেন্টিং এর ছাপ, আপনার সন্তান, তার সন্তান, তার সন্তান….এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মে থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী হাতের জোরালো থাপ্পড়ের থেকে ভালোবাসার শক্তি অনেক বেশি। তাই সন্তানকে মেরে নয়, অপমান করে নয়, ভালোবেসে শেখান। সেটাই হবে সত্যিকারের শিক্ষা।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment