শিশু কখন থেকে ভালোভাবে দেখতে পায়

Spread the love

শিশুর জন্মের পর থেকেই তার শারীরিক, মানসিক এবং আবেগ জনিত সব ধরনের বিকাশ হয়ে থাকে তার দৃষ্টি শক্তির সাহায্যে। কারণ একটি শিশু তার দৃষ্টি শক্তি দিয়েই চারপাশের পরিবেশ থেকে সব ধরনের তথ্যগুলো সংগ্রহ করে থাকে।

জন্মের ঠিক পর পর দৃষ্টি শক্তি দিয়ে এই ধরনের তথ্য সংগ্রহের পরিমাণ কম থাকলেও শিশুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই তথ্য সংগ্রহের পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে থাকে।

বিজ্ঞাপণ

নবজাতকের দৃষ্টিশক্তি কখন পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়?

শিশুর দেখতে পাওয়া এবং শুনতে পাওয়ার অনুভূতির বিকাশ একইভাবে হয়না।শিশুর জন্মের প্রথম মাসের শেষের দিকেই তার শ্রবণ শক্তি পুরপুরি বিকশিত হয়ে যায়। তবে দৃষ্টি শক্তির ব্যাপারটি বেশ আলাদা, কেননা শিশুর এই ইন্দ্রিয় পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে ছয় থেকে আট মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

আর এই ছয় অথবা আট মাস পর থেকেই শিশু অন্যদের মত করেই স্বাভাবিক ভাবে তার আশেপাশের চমৎকার পৃথিবীটাকে দেখা শুরু করে।

এক্ষেত্রে মজার তথ্যটি হল জন্মের পর থেকেই শিশুর চোখ এবং দৃষ্টি পরিপূর্ণভাবে গঠিত হয়ে যায়। অর্থাৎ তার চোখ সবকিছু দেখতে পায়। কিন্তু তার চোখ ঠিকঠাক মত কাজ করলেও সে যা দেখছে সেই তথ্যগুলো অনুধাবন কিংবা প্রসেস করার জন্য তার মস্তিষ্ক ততটা পরিণত থাকেনা।

তাই জন্মের বেশ কিছু সপ্তাহ পর পর্যন্ত শিশুর সবকিছু ঝাপসা মনে হয়। শিশুর মস্তিষ্ক যত পরিণত হতে থাকে সেই সাথে দৃষ্টিশক্তিও তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা অর্জন করতে থাকে।

শিশুর দৃষ্টি শক্তি কীভাবে বিকশিত হয়?

সাধারণত নবজাতককে যখন কোলে নেয়া হয় অথবা আপনি যদি তার খুব কাছে যান তখন সে আপনাকে দেখতে পায়।জন্মের পর পর শিশু সাধারণত ৮ থেকে ১২ ইঞ্চি বেশি দূরের কিছু স্পষ্টভাবে দেখতে পায়না। শিশুর এই দৃষ্টিশক্তির সীমা বয়স বাড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

এই দৃষ্টিসীমার বাইরেও শিশু আলোর গতিবিধি, কোনকিছু নড়াচড়ার আভাস এবং আকার আকৃতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেতে পারে। কিন্তু এসময় সবকিছুই তার জন্য ঝাপসা অবস্থায় থাকে।

আর তাই একটি ছোট শিশুর কাছে আপনার চেহারাটাই সবচাইতে আকর্ষণীয় দৃশ্য। এসময় বেশি বেশি করে শিশুর কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করবেন যাতে করে সে আপনাকে ভালো করে দেখতে পায়।

প্রথম মাসে

জন্মের ঠিক পর পর একটি শিশু চোখ নাড়িয়ে কিভাবে চারপাশ দেখতে হয় তার কিছুই জানে না। তাই সে নিয়ন্ত্রিনহীন ভাবে চোখ নাড়ায় বা কখনো কখনো চোখ ট্যারাও দেখাতে পারে।  

প্রথম মাসের শেষের দিকে অথবা দ্বিতীয় মাসে শিশুর দৃষ্টি তার দুটো চোখই ফোকাস করে কোন চলমান বস্তুকে অনুসরণ করতে পারে। তার সামনে কোন ঝুনিঝুনি নাড়ালে সে কিছুক্ষণের জন্য স্থম্ভিত হয়ে যেতে পারে।

এই সময়ে শিশুর খুব কাছাকাছি গিয়ে আপনি যদি নিজের মুখ খুব ধীরে ধীরে এক পাশ থেকে অন্য পাশে নাড়াতে থাকেন, তাহলে দেখবেন শিশুও আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে এবং আপনার সাথে সাথে সেও চোখ নাড়িয়ে আপনার মুভমেন্ট অনুসরণ করছে।

দ্বিতীয় মাসে

শিশু জন্মের পর থেকেই সব ধরনের রঙ দেখতে পায় তবে তখন বিভিন্ন ধরনের রঙের মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য করতে পারেনা। যেমন, দুমাস বয়সী শিশু লাল এবং কমলা রঙ আলাদা করতে পারেনা। কেননা দুটো রঙই প্রায় কাছাকাছি।

ঠিক এই কারণেই ২ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুর কাছে গাঢ় সাদাকালো রঙের প্যাটার্ন অনেক পছন্দ। অন্যান্য রঙের পার্থক্য বুঝতে বুঝতে তার আরো মাস দুয়েক লেগে যেতে পারে।

তাই দেখবেন খুব উজ্জ্বল আর রংচঙে কোন কিছুর প্রতি শিশুর আগ্রহের কোন সীমা নেই। এই সময়ে শিশুর দৃষ্টিশক্তি এবং রঙের পার্থক্য শেখানোর জন্য তাকে বিভিন্ন ধরনের ছবির বই, ছবি এবং রঙ্গিন খেলনা দিয়ে উৎসাহ দেয়া যেতে পারে।

চতুর্থ মাসে

এই বয়সে শিশুর মধ্যে দূরত্বের ধারণা তৈরি হতে থাকে। এর আগ পর্যন্ত শিশু কোন বস্তুর অবস্থান এবং আকার-আকৃতি সঠিক ভাবে বুঝতে পারে না এবং সেটা কিভাবে হাত বাড়িয়ে ধরবে সে ব্যাপারে মস্তিষ্ক থেকে সঠিক সিগন্যালটি পায় না।

চার মাস বয়সে বাচ্চার হাত বাড়ানোর মত পেশী সঞ্চালনের ক্ষমতা বা মোটর ডেভেলপমেন্ট স্কীল গঠিত হতে থাকে এবং হাত বাড়িয়ে কোনো জিনিস ধরার কাজটি সুষ্ঠুভাবে কিভাবে সম্পন্ন করতে হবে তার মস্তিষ্ক সেটা বুঝে ওঠার মত পরিপক্ব হয়ে যায়।  

এই সময়ে খুব সহজেই ধরা যায় এমন কোন নিরাপদ খেলনা শিশুর হাতে দিয়ে তার ক্রমবিকাশে সাহায্য করতে পারেন। সাধারণত এ বয়স থেকেই শিশুরা তার যেসব ধরতে সুবিধা যেমন- মায়ের চুল, কানের দুল ইত্যাদি ধরে টান দিতে চেষ্টা করে ।

পঞ্চম মাসে

এই বয়সে শিশু বস্তুর আকার বুঝতে শুরু করে এবং বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। সেইসাথে যেকোন বস্তুকে তার চোখ দিয়ে অনুসরণ করতে শুরু করে। এমনকি এই বয়সে অনেক বাচ্চা যে কোন কিছুর ছোট্ট একটি অংশ দেখেই সে বস্তুটিকে চিনে ফেলতে পারে।

তার এই উপলব্ধির মাধ্যমেই বোঝা যায় যে, সে বুঝতে শিখেছে এবং সে জানে যে পুরো জিনিসটি তার সামনে না থাকলেও সেই জিনিসটির অস্তিত্ব আছে।

এইজন্য এই বয়সী শিশুর সাথে যখন আপনি লুকোচুরি খেলেন সেটা শিশু খুবই পছন্দ করে। এ বয়সে শিশুরা বিভিন্ন ধরনের রঙের পার্থক্য আলাদা করে বুঝতে শিখে যায়।

অষ্টম মাসে

শিশুর জন্মের পরপর দৃষ্টিশক্তির উপর তার নিজের ততটা দক্ষতা না থাকলেও, ৮ম মাসের দিকে এসে সে দৃষ্টিশক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারে।

বিজ্ঞাপণ

যদিও কাছে থাকা জিনিসের প্রতিই তার আকর্ষণ একটু বেশি থাকে তবু সে রুমের অন্য প্রান্তে থাকা কোনো মানুষ এবং জিনিসপত্রের অবস্থান বুঝতে পারে।

জন্মের সময় বাচ্চার চোখের রং যদি অন্য ধরনের হয় তবে এসময়ে এসে তা স্থায়ী রঙে পরিবর্তিত হয়ে যায়। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেক সময় হালকা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় ।  

আপনার ভূমিকা

নিয়মিত ডাক্তারের কাছে চেক-আপে গেলে একটু খেয়াল রাখবেন যাতে করে ডাক্তার শিশুর চোখের দিকেও একটু বিশেষ ভাবে মনোযোগ দেন।

ডাক্তার এই সময়ে শিশুর চোখের গঠন এবং চোখের নড়াচড়ার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা সহ অন্যান্য আরো সমস্যা আছে কি না সেগুলোও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখবেন।

এছাড়া আপনার পরিবারে যদি কারো কোন বড় ধরনের চোখের সমস্যা থেকে থাকে আর বিশেষ করে সেটা যদি তাদের ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়ে থাকে তাহলে সেটা ডাক্তারকে জানিয়ে দিতে ভুলবেন না।

শিশুর বয়স যখন তিন অথবা চার বছর হয় তখন ডাক্তার বিভিন্ন চার্ট এবং অক্ষরের মাধ্যমে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে শিশুর দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি ঠিক আছে কি না।

আপনার শিশুর চোখে যদি কোন ধরণের সমস্যা দেখা যায় অথবা আপনার পরিবারে যদি জটিল ধরনের চোখের সমস্যা থেকে থাকে তাহলে আপনার শিশু বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন মনে করলে শিশুকে অন্য একজন চক্ষু ডাক্তারের কাছে পাঠানোর ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারেন।

শিশুর চোখের যে কোন সমস্যারই সঠিক চিকিৎসা জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুরু করা প্রয়োজন, কেননা কোন কোন সমস্যা শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে আরো প্রকট হয়ে যায়। ।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে অন্যান্য যেকোনো কিছুর চেয়ে শিশুরা মানুষের মুখের অবয়ব দেখতেই বেশি পছন্দ করে। তাই যতটা সম্ভব শিশুর কাছাকাছি থেকে শিশুকে আপনার চেহারা দেখার সুযোগ করে দিন এবং আই কন্টাক্ট করুন।

শিশুর বয়স যখন প্রায় এক মাসের মত হয়ে যায় তখন শিশুর চোখের সামনে আপনি যাই আনুন না কেন, সেটিই শিশু খুব উৎসাহ নিয়ে দেখবে। তাই এই সময় গৃহস্থালির সাধারণ জিনিসপত্র অথবা খেলনা শিশুর কাছে নিয়ে তাকে দেখার সুযোগ করে দিন।

বিজ্ঞাপণ

কোন ঝুনঝুনি অথবা উজ্জ্বল কোন বস্তু শিশুর চোখের সামনে ধরে একপাশ থেকে অন্য পাশে নিন তারপর তা উপর থেকে নিচের দিকে এবং পুনরায় আবার নিচ থেকে উপরের দিকে নিয়ে আসুন। এই নড়াচড়া তাকে আকৃষ্ট করবে যদিও ৩-৪ মাসের আগে বেশিরভাগ শিশুই উপর থেকে নীচের দিকের নড়াচড়া ঠিকভাবে অনুসরণ করতে পারেনা।

এছারাও আশেপাশের কোন কোন বস্তু তাকে আকৃষ্ট করে সেটা খেয়াল করুন, যেমন- ফ্যান, পাখি বা বাগানে পাতার নড়াচড়া ইত্যাদি।

শিশু যখন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকবে তখন তার সামনে প্রাথমিক যে রঙগুলো আছে সেগুলো নিয়ে আসুন। এছাড়াও প্রাইমারি রঙের খেলনা, রঙিন পোস্টার অথবা যে সব বইয়ে প্রচুর ছবি আছে সেগুলোও শিশুকে দেখতে দিন।

শিশুর দৃষ্টি শক্তির ব্যাপারে কখন উদ্বিগ্ন হবেন?

নিয়মিত চেকআপের সময় ডাক্তার শিশুর দৃষ্টিশক্তিও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখবেন, তবুও কোন কিছু নিয়ে যদি আপনার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় তাহলে সেটা ডাক্তারকে জানিয়ে দিন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারেঃ

  • তিন থেকে চার মাস বয়স হওয়ার পরেও শিশু দুই চোখ দিয়েই কোন বস্তুকে অনুসরণ করতে না পারলে।
  • শিশু যদি দুই চোখই সমান ভাবে সব দিকে নাড়াতে না পারে।
  • শিশুর চোখ সবসময় নড়তে থাকে এবং কখনো স্থির না হয়।
  • যদি শিশুর চোখ বেশিরভাগ সময় ট্যাঁরা থাকে (যদিও জন্মের প্রথম কয়েকদিন এটা স্বাভাবিক) অথবা তার একটি বা উভয় চোখের মনি যদি ভেতরের দিকে বা বাইরে দিকে থাকে।
  • শিশুর চোখের পিউপিল  অর্থাৎ মনির মধ্যে যদি সাদাটে ভাব থাকে।
  • শিশুর চোখ যদি আলোর প্রতি একটু বেশি সংবেদনশীল হয় অথবা প্রায় সময়েই চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে।

আপনার শিশু যদি প্রিম্যাচিউর অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে অথবা সঠিক সময়ের একটু বেশি আগেই জন্ম নিয়ে নেয় এবং তার মধ্যে যদি কোন ধরনের সংক্রমণ থেকে থাকে অথবা অক্সিজেনের মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান করা হয় সেসব ক্ষেত্রে শিশুর ঝাপসা দেখা (astigmatism) , দূরের জিনিস কম দেখা (myopia) সহ আরো বেশ কিছু দৃষ্টি শক্তি জনিত সমস্যা দেখা যাওয়ার ঝুঁকি একটু বেশি থাকে।

এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চাদের চোখের মধ্যে অস্বাভাবিক রক্তনালী বৃদ্ধি পেয়ে চিরতরে অন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা দুই চোখ একই সমান্তরাল না হওয়ার (ট্যারা হওয়া)  সম্ভাবনা থাকে। শিশু যদি প্রিম্যাচিউর অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে তাহলে আপনার শিশু বিশেষজ্ঞ চোখ পরীক্ষার সময় সেটা বিবেচনায় রাখবেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে থাকবেন।

সবার জন্য শুভকামনা।

শিশুর ইন্দ্রিয়ের বিকাশ | দৃষ্টিশক্তি | Audio Article

Spread the love

Related posts

Leave a Comment