শিশুর বেড়ে ওঠা | চতুর্থ মাস

Spread the love

চতুর্থ মাসে পদার্পণ অর্থাৎ তিন মাস অতিক্রম করার পর শিশুর মানসিক ও সামাজিক বিকাশ খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। শিশুর শ্রবণ ও দৃষশক্তিও পরিপক্কতা লাভ করে। সে শক্ত মুঠো করে কিছু ধরতে ও মুঠো ছেড়ে দিতে শেখে। রঙিন ও শব্দযুক্ত খেলনার প্রতি অনেক বেশী আকৃষ্ট হয়। পরিবারের সদস্যদের আলাদাভাবে চিনতে শেখে এবং তার বিশেষ প্রিয় ব্যাক্তিটির প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করে।

চতুর্থ মাসে শিশুর খাবার

৩ মাস পার হলে শিশুর  প্রতিবার খাবারের পরিমাণ আগের চাইতে বাড়তে থাকে কারণ তার পাকস্থলী এসময় আগের চাইতে আকারে কিছুটা বৃদ্ধি পায়। একই সাথে খাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধানও বাড়তে পারে। এসময় শিশু ভালোভাবে দুধ খেতে শিখে যায়, তাই প্রতিবার তার খাওয়ার সময়টুকুও কমে আসতে পারে। 

বিজ্ঞাপণ

চতুর্থ মাসে অনেক শিশুরই খাওয়ার একটি রুটিন তৈরি হয়ে যায় এবং রাতের বেলা তার খাওয়ার পরিমাণ কমে আসে। তবে মাঝে মাঝে এই রুটিনের পরিবর্তন হওয়াটাও স্বাভাবিক। এসময় বুকের দুধ পান করা শিশুরা সাধারণত প্রতি ৪-৫ ঘণ্টা পর পর খেতে চাইতে পারে।

যেসব শিশু ফর্মুলা খায় তারা এসময় প্রতি ৪-৫ ঘণ্টা পরপর ৪-৬ আউন্স বা ১২০-১৮০ মিলি দুধ খেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে সব শিশুর খাবার বিরতি একই হয়না। কোনো কোনো শিশু আরো  ঘন ঘন খেতে চাইতে পারে।  তাই সবসময় তার ক্ষুধার লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল রাখুন। শিশু দৈনিক ৬-৮ বার প্রস্রাব করলে আপনি ধরে নিতে পারেন সে প্রয়োজনমত দুধ পাচ্ছে।

স্বাভাবিক ওজনপ্রাপ্ত শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত এসময় ঘুম থেকে জাগিয়ে খাওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। তবে যদি শিশুর ওজন ঠিকভাবে না বাড়ে তবে ডাক্তার হয়তো নিয়মিত বিরতিতে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে খাওয়ানোর পরামর্শ দেবেন।  

কর্মজীবী মায়দের অনেকের পক্ষেই হয়তো শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব হয়না।এক্ষেত্রে বুকের দুধ সংরক্ষণ করে শিশুকে বোতলে খাওয়াতে পারেন অথবা বুকের দুধের পাশাপাশি ফর্মুলাও দিতে পারেন। এসময় কীভাবে বুকের দুধের ফ্লো ঠিক রাখবেন সে বিষয়ে একজন ল্যাক্টেশন কনসাল্টেন্টের পরামর্শ নিতে পারেন।

চতুর্থ মাসে শিশুর ঘুম

এখন থেকেই শিশুর ঘুমের স্বাভাবিক নিয়ম শুরু হতে পারে। কিছু কিছু শিশু এ সময় রাতে একটানা ছয় ঘণ্টার মতো ঘুমাতে পারে। মাঝে মাঝে হয়তো খাওয়ার জন্য জাগতে পারে। তবে বেশিরভাগ বাচ্চার ক্ষেত্রে ছয় মাস বা তারও  পর থেকে রাতে নিয়মিত  ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে উঠে। এসময় রাত-দিন মিলিয়ে শিশু  ১৫ ঘণ্টার মত ঘুমিয়ে কাটাতে পারে।

যদি সে রাতের বেলা জেগে যায় তবে তাকে কোলে নেয়ার আগে বা অন্তত ৩০ সেকেন্ড অপেক্ষা করুন। অনেক শিশু ঘুমের মধ্যে কয়েক সেকেন্ড কান্না করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। যদি আপনি সাথে সাথেই তাকে কোলে তুলে নেন তবে সে নিজে থেকে ঘুমিয়ে পড়া শিখবে না। যদি কান্না না থামে,  তবে তাকে কোলে তুলে নিন। এসময় রুমে বেশি আলো জ্বালাবেন না। শিশুকে খাওয়ানো এবং ন্যাপি পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে তা মৃদু আলোতে করুন। তার সাথে বেশি কথা বলবেন না। এতে সে বুঝতে শিখবে রাতের বেলা ঘুমানোর সময়।

শিশুর ক্লান্ত হয়ে পড়ার লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল রাখুন এবং যখনই তার মধ্যে ক্লান্তভাব দেখবেন তখনি তাকে শুইয়ে দিন। শিশু বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়লে খিটখিটে হয়ে ওঠে এবং ঘুমাতে চায়না।

তাকে ঘুম পাড়ানোর সময় যখনই তার মধ্যে ঘুম ঘুম ভাব দেখবেন তখনই তাকে বিছানায় শুইয়ে দিন। এতে সে আপনার সাহায্য ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়তে শিখবে।

বেশিরভাগ শিশুর দিনের বেলার ঘুম এখন অনেকটা রুটিন মাফিক হয়ে উঠতে পারে। দিনে সাধারণত দুবার ঘুমানো এখন স্বাভাবিক এবং প্রতিবার সে এক থেকে দুঘণ্টা ঘুমোতে পারে।

ঘুমাতে যাওয়ার আগে কিছু কিছু কাজ নিয়ম মেনে করুন, যেমন বাচ্চাকে গোসল দেয়া, কাপড় বদলে দেয়া, আদর করা, গল্প বলা বা ঘুম পাড়ানি গান শোনানো ইত্যাদি। ঘুমের আগে পরপর কয়েক দিন কাজগুলো করলে সে বুঝতে পারবে এখন ঘুমের সময় হয়েছে এবং তাকে ঘুম পাড়ানো সহজ হবে। যে কোনো বয়সের বাচ্চাদের ক্ষেত্রেই এই রুটিন প্রযোজ্য।

চতুর্থ মাসে শিশুর ওজন ও উচ্চতা

৩ মাস বা ৯০ দিনের মধ্যে কিছু কিছু শিশুর ওজন এসময় তার জন্ম-ওজনের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। তবে বেশিরাভাগ  শিশুর ক্ষেত্রে এটি চতুর্থ মাস অতিক্রম করার সময় হয়ে থাকে।

এসময় একটি ছেলে শিশুর গড় ওজন হতে পারে ১৪.১৩ পাউন্ড বা ৬.৪ কেজি এবং উচ্চতা হতে পারে ২৪ ইঞ্চির মত। একটি মেয়ে শিশুর এসময় গড় ওজন হতে পারে  ১২.৮ পাউন্ড বা ৫.৮ কেজি এবং উচ্চতা হতে পারে প্রায় ২৩.৫ ইঞ্চি।

তবে মনে রাখা দরকার,  প্রতিটি শিশুর শারীরিক গঠন ও বৃদ্ধির গতি কিছুটা ভিন্ন হয় । এক্ষেত্রে যেটি সবচাইতে জরুরী তা হলো শিশুর বৃদ্ধির দিকে নজর রাখা এবং নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শে থাকা। প্রত্যেকটি সাক্ষাতকারে ডাক্তার শিশুর ওজন, উচ্চতা ও মাথার পরিধি মেপে দেখেবন এবং কোন অস্বাভাবিকতা পেলে আপনাকে জানাবেন।

চতুর্থ মাসে শিশুর স্বাস্থ্য

কোষ্ঠকাঠিন্য

শিশু দুই-তিন দিন পর পর স্বাভাবিক মলত্যাগ করলে সেটি সাধারনভাবে কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ নয়। বুকের দুধ খাওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটা স্বাভাবিক। শিশু যদি পরপর কয়েকদিন শক্ত মলত্যাগ করে এবং মলত্যাগের সময় কান্নাকাটি করে তবে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়।

মল ও গ্যাসে দুর্গন্ধ হলে সেগুলোও  কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ হতে পারে ৷ কন্সটিপেশানের আরেকটি লক্ষণ হলো,   পেট শক্ত হয়ে ফুলে যাওয়া৷ কখনো কখনো খুব তরল মলও কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ হতে পারে৷ যে শক্ত মল পাচন তন্ত্রে বাধা সৃষ্টি করে তার চারপাশ দিয়ে তরল মল বেরিয়ে আসতে পারে৷ যদি আপনার মনে হয় শিশুর এরকম কিছু হয়েছে, তাহলে ডাক্তার দেখানো জরুরী৷

মায়ের দুধে শিশুর জন্য সঠিক পরিমান প্রোটিন ও ফ্যাট থাকে, যা বাচ্চাদের কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করতে ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে ফর্মুলায় কিছু প্রোটিন হজমে শিশুর সমস্যা হতে পারে যার ফলে শিশুর মল শক্ত ও আকারে বড় হয়ে যায়। এমন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ফর্মুলার ব্র্যান্ড পরিবর্তন করে দেখতে পারেন।

কিছু ক্ষেত্রে, শিশু যদি বুকের দুধ খায় তবে মায়ের ডায়েটে উপস্থিত কোনো  প্রোটিনের কারণেও শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। মায়ের খাবারের কারণে হচ্ছে মনে হলে মায়ের ডায়েট থেকে একবারে একধরনের খাবার বাদ দিয়ে দেখুন বাচ্চার সমস্যা কম হচ্ছে কিনা।

ডায়রিয়া

শিশুর ডায়রিয়া হলে মল অনেক পাতলা হয়ে যায় এবং এতে পানির পরিমান বেশী থাকে। মলের রং হলুদ, সবুজ বা বাদামী বর্ণের হতে পারে। ডায়রিয়া কিছু ক্ষেত্রে ইনফেকশনের বা অ্যালার্জির লক্ষন হতে পারে এবং যদি কয়েকদিন ধরে চলতে থাকে তবে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে।

শিশু যদি ৩ মাস বা তার চাইতে কম বয়সী হয় তবে দিনে দুই থেকে তিনবার পাতলা পায়খানা করলে বা পাতলা পায়খানা ২ থেকে ৩ দিন স্থায়ী হলে, দেরী না করে ডাক্তারকে জানান। যদি ডায়রিয়ার সাথে রক্ত বা মিউকাস দেখেন সে ক্ষেত্রেও দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

মনে রাখতে হবে শিশুর মল হঠাৎ নরম হওয়া মানেই কিন্তু ডায়রিয়া নয়, তা নিয়ে চিন্তিত হওয়ারও তেমন কিছু নেই। তবে শিশু যদি স্বাভাবিকের চাইতে বেশিবার এবং একেবারে তরল পানির মত মলত্যাগ করে তবে তা ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়াও জ্বর, অতিরিক্ত কান্নাকাটি কিংবা শরীরে র‍্যাশ (rash) ওঠা -এসবও ডায়রিয়ার লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুর জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো পানিশূন্যতা। ডায়রিয়াজনিত পানিশূন্যতা খুবই মারাত্মক, এমনকি জীবনঘাতি। তাই ডায়রিয়া হোক বা না হোক, সবসময় শিশুর পানিশুন্যতার লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল রাখুন।

ডায়াপার র‍্যাশ

ডায়াপার র‍্যাশের ফলে শিশুর কোমল ত্বক লালচে আঁশযুক্ত হয়ে পড়ে। যেসব স্থানে শিশুর র‍্যাশ হয় সেখানে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় জায়গাটি সামান্য গরম হয়ে থাকে। কখনো  কখনো  এই র‍্যাশ শিশুর উরু থেকে পেট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। স্পর্শ করলে হয়তো স্থানটি গরম ও ফোলা অনুভব করতে পারেন।

শিশুর ডায়াপার র‍্যাশ হলে ভয়ের কিছু নেই। সঠিকভাবে যত্ন নিলে দু-তিন দিনের ভেতরই তা ঠিক হয়ে যায়। সাধারনভাবে বলতে গেলে,  ডায়াপার র‍্যাশ হলেই শিশুকে ডাক্তারের কাছে নেয়া জরুরী নয়। সময়মত শিশুর ডায়াপার পরিবর্তন করা হলে ৩/৪ দিনের মাঝেই র‍্যাশ দূর হয়ে যায়। তবে এর সঙ্গে জ্বর, ফুসকুড়ি বা ফোসকা বা সাদা পুঁজ নির্গত হতে দেখলে সংক্রমণ নির্দেশ করে যার জরুরিভিত্তিতে চিকিৎসা দরকার।

একটি ডায়াপার দীর্ঘসময় ধরে পরিয়ে রাখা ঠিক নয়। যত দ্রুত সম্ভব ভেজা ডায়াপার বদলে ফেলা উচিত।শিশুর ডায়াপার যাতে খুব আঁটসাঁট না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। ডায়াপার পরিবর্তনের পর একটি নরম কাপড় বা টাওয়েল আলতো চেপে চেপে বা কিছুক্ষণ খোলা রেখে শিশুর ত্বককে শুকিয়ে নিন। প্রতিবার ডায়াপার পরিবর্তনের পর হালকা উষ্ণ পানি দিয়ে স্থানটি আলতো করে চেপে পরিষ্কার করুন, ঘষে পরিষ্কার করবেন না।

নতুন ডায়াপার পড়ানোর আগে ভালো মানের ডায়াপার বা ন্যাপি অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে নিন। এতে র‍্যাশ হবার সম্ভবনা কমে যায়।  ডায়াপার পরানোর অংশে কিংবা শিশুর মুখমণ্ডলে কখনো পাউডার দেবেন না। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।

দুধ তুলে দেয়া বা উগলে দেয়া

মায়ের বুকের দুধের ফ্লো কম বা বেশি হলে খাওয়ার সময় শিশুর পেটে বাতাস ঢুকতে পারে। আবার শিশু যদি বোতলে বা ফিডারে দুধ খায় সেক্ষেত্রে বোতল ভালো মানের না হলে বা দুধ খাওয়ানোর সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা না হলে,  সেক্ষেত্রেও শিশু প্রচুর বাতাস গিলে ফেলে। দুধ খাওয়ার শেষে এই বাতাস পাকস্থলি থেকে বেরিয়ে যেতে চায় এবং বের হবার সময় কিছু দুধ সাথে নিয়ে বের হয়। এ ব্যাপারটিকেই spitting up বা  ‘দুধ তুলে দেয়া’ বলা হয়। এই ‘তুলে দেয়া’ বা SPIT  UP করা দুধকে অনেকে বমি বলে ভুল করেন। আসলে এটি বমি নয়। এই দুধ আবার অনেক সময় শিশুরা গিলেও ফেলে। সাধারনত ৪-৫ মাসের দিকে শিশুর পাকস্থলী পুরোপুরি সুগঠিত হয়ে ওঠে। এরপর সাধারনত দুধ তোলা বন্ধ হয়ে যায়।

বমি এবং দুধ তুলে দেয়ার মধ্যে পার্থক্য করাটা একটু কঠিন যেহেতু দুটো দেখতে একই ধরনের এবং দুটোই সাধারনত খাওয়ার পরেই হয়। তাই দুধ ঊগলে দিলে কোনটি হয়েছে তা বোঝার জন্য কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমনঃ

বাচ্চা যখন দুধ তুলে দেয় তখন সে অনেকটা নির্বিকার থাকে এবং দুধ বা খাবার সাধারনত সজোরে বের না হয়ে মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। শিশুর হাবভাবে কষ্ট পাওয়ার তেমন কোন লক্ষণও দেখা যায়না। এটি বাচ্চাদের জন্য স্বাভাবিক এবং সাধারনত কোনো  ভয়ের কারণ নয়।

কিন্তু শিশু যখন বমি করে তখন তার পেটের খাবার সজোরে বেরিয়ে আসে। এতে তার কষ্ট হয় এবং কান্নাকাটিও  করতে পারে। বাচ্চার বমির পরিমানও দুধ তুলে দেওয়ার চাইতে বেশী থাকে। বমির হওয়ার সাথে আরো  কিছু উপসর্গ থাকতে পারে, যেমন- জ্বর বা বাচ্চার মেজাজ খারাপ থাকা ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপণ

লালা পড়া

প্রথম ৩ মাস পর্যন্ত শিশুর মুখ থেকে লালা পড়ার বিষয়টি সচরাচর তেমন একটা দেখা যায় না, কেননা এই সময়টাতে সে বেশিরভাগ সময় চিৎ হয়ে থাকে এবং শিশুর মুখ উপরের দিকে মুখ করা থাকে। তবে এই সময় যখন সে পেটের উপর ভর দিয়ে শুয়ে থাকবে তখন তার মুখ থেকে লালা ঝরতে পারে।

শিশুর মুখ দিয়ে অনিচ্ছা সত্যেও লালা বের হওয়াকে ডাক্তারি ভাষায় “ড্রুলিং” (Drooling) বলা হয়। আমাদের মুখে ছয়টি গ্রন্থি আছে যেগুলো লালা উৎপন্ন করে, আর এই লালার পরিমাণ যখন খুবই বেশি হয়ে যায়, তখনই সেটা মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ে। শিশুদের মুখের মাংশপেশীগুলো পরিপূর্ণ বিকশিত থাকেনা বলে অনেকসময় তাদের মুখ থেকে অতিরিক্ত লালা বের হয়।

কান্না

শিশুর যদি কলিকের সমস্যা থেকে থাকে তাহলে এই সময় এসে এই উপসর্গ অনেকটাই কমে যায়। তবে কিছু কিছু শিশুর ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরেকটু প্রলম্বিত হতে পারে।

তৃতীয় মাসে শিশুর টিকা

তৃতীয় ডোজ টিকা দেয়ার ২৮ দিন পর অর্থাৎ শিশুর বয়স ১৪ সপ্তাহ বা সাড়ে তিন মাস হলে চতুর্থ ডোজ টিকা দিতে হবে। এসময় তৃতীয় ডোজের টিকাগুলোই আবার দেয়া হয়।মনে রাখতে হবে একই টিকার দুই ডোজের মধ্যে কমপক্ষে ২৮ দিনের বিরতি থাকতে হবে।

এসময় শিশুকে ২ ফোঁটা পোলিও টিকা বা ওপিভি  মুখে খাওয়ানো হয়। এর সাথে সাথে ডান পায়ে নিউমোনিয়ার টিকা পিসিভি দেয়া হয়। আর বাম পায়ে দেয়া হয় আরেকটি  টিকা যা পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন নামে পরিচিত।এই টিকাটি একটি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দেয়া হলেও এটি পাঁচটি রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে।রোগ গুলো হচ্ছে- ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস-বি, হেমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা- বি। সেই সাথে পোলিও টিকার আরেকটি ডোজ ডান হাতের উপরের অংশে দেয়া হয়। এই টিকাটির নাম আইপিভি।

টিকার সাধারণ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসাবে সামান্য জ্বর হতে পারে, টিকা দেয়ার স্থানে সামান্য লাল হওয়া, ফুলে যাওয়া ও অল্প ব্যথা হতে পারে, যা ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে সাধারণত সেরে যায়। এসময় ডাক্তারের পরামর্শে শিশুদের উপযোগী প্যারাসিটামল খাওয়ানো যেতে পারে।

তৃতীয় মাসে রোটা ভাইরাসের টিকা দেয়া না হয়ে থাকলে এই মাসে টিকার প্রথম ডোজ নিতে হবে।

বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে রোটা-রিক্স ও রোটা-টেক নামে দুই ধরনের রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিন দেয়া হয়। রোটা টেক- তিন ডোজ নিতে হয়। রোটা- রিক্স নিতে হয় দুই ডোজ ।

রোটা-টেক সাধারণত শিশুর ২ মাস, ৪ মাস এবং ৬ মাস বয়সে দেয়া হয়। রোটা-রিক্সের দুই ডোজ দেয়া হয় ২ মাস এবং ৪ মাস বয়সে। তবে দুটো টিকারই প্রথম ডোজ দিতে হবে শিশুর বয়স ১৫ সপ্তাহ হওয়ার আগে এবং ৩২ সপ্তাহের মধ্যে সব ডোজ শেষ করতে হবে।

চতুর্থ মাসে শিশুর শারিরীক ও মানসিক পরিবর্তন এবং মাইলস্টোন

আপনার শিশু তিন মাস পার করার পর যখন চতুর্থ মাসে পদার্পন করে, তখন তার ভালোভাবেই হাত পা ছুঁড়ে নড়াচড়া করার কথা। সে এখন তার দু হাত একসাথে করতে পারবে এবং হাতের আঙ্গুল মুষ্টিবদ্ধ  করা ও মুঠো নিজেই খুলতে পারবে। কিছু ধরার জন্য হাত বাড়িয়েও দিতে পারে।  

এই বয়সী  শিশু তার হাত ও চোখের মধ্যে সমন্বয় (eye-hand- coordination) করতে পারে বলে তার হাতের দক্ষতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অর্থাৎ সে যেটা দেখছে সেদিকে সে হাত বাড়াতে শিখছে, যেমন- আপনি তার কাছে ধরার মত কোনো খেলনা এগিয়ে দিলে সে হয়তো হাত বাড়িয়ে সেটি ধরতে চেষ্টা করবে এবং ধরে ঝাঁকাতেও  পারবে। এসময় বেশিরভাগ শিশু তাদের হাত মুখের কাছে আনা শিখে যায়।

এসময় টামি টাইম দিলে অর্থাৎ শিশুকে উপুড় করে বুকের উপর শুইয়ে দিলে সে হাতের উপর ভর দিয়ে তার মাথা ও বুক উপরে তুলতে পারবে এবং তার মাথা তুলে ধরার দক্ষতা আগের চাইতে বেশি নিয়ন্ত্রিত থাকবে।

যেহেতু শিশুর কোমর ও হাঁটুর জয়েন্টগুলো আরো ফ্লেক্সিবল হয়ে উঠছে তাই তার পা ছোঁড়া আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আপনি যখন তাকে ধরে কোন সমতল জায়গায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করবেন সে তার পায়ের ঠেকা দিয়ে তলের উপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে।

তিন মাসের শেষের দিকে কিছু কিছু শিশুকে যখন উপুড় করে শোয়ানো হয়, তখন সে হাতের সাহায্যে নিজেকে উপরে তুলে চিৎ হয়ে যেতে পারে। সাধারণত টামি টাইমের সময় এই ধরনের ব্যাপারগুলো ঘটে থাকে যেটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশু খুব একটা নিয়ন্ত্রিতভাবে করে না। সাধারণত ৪ মাস শেষ হবার পর, শিশুরা নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী উল্টে  যেতে ও গড়াতে শেখে। তাই এই সময়  শিশুকে কখনো বিছানা বা এমন কোনো জায়গায় একা রেখে যাবেন না যেখান থেকে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এই সময় শিশু গাঢ় এবং হালকা রঙের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। তাই পৃথিবীটা তার কাছে আরো  রঙ্গিন হয়ে ওঠে। এই সময় শিশুরা আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে পছন্দ করবে। যদিও সে বুঝতে পারবেনা যে আয়নাতে তাকেই দেখা যাচ্ছে, হয়তো আয়নার শিশুর দিকে তাকিয়ে সে হাসতে থাকবে।

এসময় শিশুর মস্তিষ্কের দ্রুত উন্নতির সাথে সাথে তার শ্রবণশক্তি, ভাষা এবং দৃষ্টিশক্তি আরো  সক্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। কোনো  শব্দ শুনলে সে তার উৎস খোঁজার জন্য মাথা ঘোরাতে চেষ্টা করে। মা কিংবা পরিচিত কোনো মুখ দেখতে পেলে সে হয়তো হাত পা ছুঁড়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে। মাঝে মাঝে শিশু  হয়তো একদৃষ্টিতে আপনার চোখে চোখ রেখে তার নিজের ভাষায় কথা বলারও চেষ্টা করবে। 

এসময় শিশু যা কিছুই শোনে তার প্রত্যুত্তর দেয়ার চেষ্টা করে এবং নানা রকম শব্দ করতে থাকে। কেউ তার সাথে কথা বললে বা বিভিন্ন মুখভঙ্গি করলে, সে তাকে নকল করারও  চেষ্টা করতে পারে।

তৃতীয় মাসে কীভাবে শিশুর বিকাশে সাহায্য করবেন

গবেষণায় দেখা গেছে যেসব শিশুর বাবা মা তার সাথে প্রচুর কথা বলে সেসব শিশুর IQ এবং vocabulary অন্য শিশুদের তুলনায় অনেক সমৃদ্ধ  থাকে। তাই শিশুর সাথে কথা বলুন এবং বিভিন্ন বস্তুর নাম বলুন। সে এসব শব্দ এখন বুঝতে বা উচ্চারণ করতে না পারলেও এগুলো তার মস্তিষ্কের বিকাশে ভূমিকা রাখে।

শিশুরা গান ও ছড়া পছন্দ করে, বিশেষ করে তারা যদি সেগুলো  আপনার গলায় শুনতে পায়। আপনার কণ্ঠস্বরই শিশুর কাছে তার প্রিয় সঙ্গীত। সুতরাং তাকে গান গেয়ে শোনান এবং গল্প করার ছলে কথা বলুন। টিভি বা রেডিও চালানো থাকলে সেটা বন্ধ করে দিন যাতে শিশু আপনার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।

শিশুরা খেলাধুলার ভেতর দিয়েই সবচেয়ে ভালো শিখতে পারে, সুতরাং গান এবং ছড়াকে মজার খেলায় পরিনত করুন। আপনার গলার স্বরের ওঠানামা কিংবা কিছু অঙ্গভঙ্গী করুন, গল্প বা গান শোনানোর সময় শিশুর অথবা পরিবারের সদস্যদেরও নাম যোগ করতে পারেন।

আপনারা একসাথে যা করছেন তা নিয়ে আপনার শিশুর সঙ্গে কথা বলুন- যেমন, বাচ্চাকে গোসল করাচ্ছেন কিংবা খাওয়াচ্ছেন অথবা তার ন্যাপী বদলে দিচ্ছেন। দোকানে যাওয়ার পথে, অথবা সুপারমার্কেটে যা যা দেখছেন তাদের সম্পর্কে কথা বলুন ঠিক যেমনটি আরেকটু বড় বাচ্চারদের সাথে বলতেন।  

জন্মের সময় থেকেই আপনার শিশুর আঁকড়ে ধরার একটা সহজাত ক্ষমতা থাকে৷ প্রথম দিকে আকর্ষনীয় বা মজার কিছু দেখেই সে খুশী হয়, তবে ক্রমশ সে সেগুলো হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চায়৷ সাধারণত  ৩ মাস বয়স থেকে সে এই কৌশল ব্যবহার করতে শুরু করে ৷ আপনার শিশুকে এই কৌশলটিতে পারদর্শী করার জন্য রঙ্গিন কিছু দিলে ভাল হয়। ওর নাগালের মধ্যে সেটি দোলাতে থাকুন। দেখুন সে কীভাবে সেটি মুঠোয়  আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে!

বিজ্ঞাপণ

শিশুর বিছানায় মাথার উপর ঝুলন্ত যেসব খেলনার gym পাওয়া যায় সেসব রাখতে পারেন। এসব খেলনা ধরার জন্য যখন সে হাত পা ছুঁড়ে নড়াচড়া করে তখন তার শারীরিক দক্ষতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

মাঝে মাঝে শিশুকে উপূড় করে শুইয়ে তার সামনে একটি বল গড়িয়ে দিন বা একটি খেলনা গাড়ি চালিয়ে দিন। এটি তাকে সেগুলোর গতিপথকে অনুসরণ করতে উৎসাহ দেবে । শিশু যদি এতে উৎসাহ না দেখায় তবে তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে তার সামনে হাততালি দিন বা কিছু আওয়াজ করুন। এসব এক্টিভিটি তার ঘাড়ের পেশী মজবুত হওয়া সাথে সাথে দৃষ্টিশক্তির বিকাশে ভূমিকা রাখবে।  

শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের সাথে সাথে তার কৌতূহলও বাড়তে থাকে। কোনো খেলনা যখন শিশু হাতে আঁকড়ে ধরে কিংবা ঝাঁকায় সেসময় এই কাজটির মাধ্যমেই সে জিনিসটির রং, আকার ও মাপ সম্বন্ধে শিখতে থাকে। র‍্যাটেল বা ঝুনঝুনি  জাতীয় খেলনা থেকে যে শব্দ হয় সেই শব্দের উৎসের সাথে তার হাত ঝাঁকানোর কি সম্পর্ক তা আবিষ্কারের জন্য সে হয়তো বার বার সেটি নাড়াতে থাকবে এবং উত্তেজিত হয়ে উঠবে।

এই বয়সী শিশুর সাথে ছোট একটি খেলা খেলতে পারেন যা তার ঘাড়ের পেশী শক্ত করতে সাহায্য করবে। শিশুকে চিৎ করে শুইয়ে দিন। এরপর ধীরে ধীরে তার হাত ধরে টেনে তাকে বসিয়ে দিন। আবার একইভাবে  ধীরে ধীরে আগের  অবস্থানে শুইয়ে দিন। এভাবে কয়েকবার করতে পারেন। জোরে বা হেঁচকা টান যেন না লাগে এ বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে।

বয়স এক মাস হওয়ার পর থেকে শিশুকে সম্ভব হলে প্রায় প্রতিদিনই  ১0—১৫ মিনিট করে টামি টাইম করাতে পারেন (তবে অবশ্যই আপনার উপস্থিতিতে)। যদি দেখেন আপনার সন্তান এই ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হচ্ছে তাহলে টামি টাইমের সময় কমিয়ে দিন – এক থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

মাদুর বা নরম তোষকের উপর ছড়ানো আকর্ষণীয় খেলনাই হতে পারে আপনার শিশুর গড়াতে শেখার অন্যতম বড় অনুপ্রেরণা। শিশুর আশেপাশে বা কাছাকাছি অবস্থানে লোভনীয় কিছু রাখতে পারেন যার আকর্ষণে সে সেটির কাছে পৌঁছাতে চাইবে, ফলে শিশুর শরীর এবং মাংসপেশির দক্ষতা বাড়বে এবং এভাবেই হয়তো একসময় গড়াতে শিখে যাবে।

বিপদ চিহ্নঃ

  • চলন্ত কিছুর দিকে শিশুর দৃষ্টি না দেয়া।
  • তীব্র আলো বা শব্দে প্রতিক্রিয়া না দেখানো।
  • হাত মুখের কাছে আনতে না পারা।
  • পেটের উপর শুয়ে থাকা অবস্থায় মাথা উপরে তুলে ধরে না পারা।
  • হাত মুঠি করে ধরতে না পারা।
  • কারও দিকে তাকিয়ে না হাসা।
  • দাঁড়  করিয়ে দিলে পায়ে ভর দিতে না পারা।
  • সবসময় চোখ ট্যাঁরা করে রাখা

পরিশিষ্ট

এ সময় কি কি  মাইলস্টোন আপনার শিশু অর্জন করতে যাচ্ছে তা জানার সাথে সাথে ভুলে যাবেন না যে এটি শুধু মাত্র একটা গাইডলাইন। প্রতিটি শিশুই ইউনিক ( স্বকীয় ) এবং তার বেড়ে ওঠার গতিও ভিন্ন।

কোন বাচ্চা ‘প্রিম্যাচিওর’ হয়ে জন্মালে তার ডেভেলপমেন্ট জন্মতারিখ থেকে শুরু না করে, তার যেসময় জন্মানোর কথা ছিল সেই সময় থেকে হিসাব করা বাঞ্ছনীয়

এই টাইমলাইন সিরিজ যেন আপনার কোন রকম দুঃশ্চিন্তার কারন না হয় খেয়াল রাখবেন। প্রতিটি টাইমলাইনকে একটি গাইড হিসেবে ধরে নিতে হবে ।নবজাতক এর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন আশঙ্কা বা জিজ্ঞাসা থাকলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।

 <<শিশুর বেড়ে ওঠা – ৩ মাস

শিশুর বেড়ে ওঠা – ৫ মাস>> 


Spread the love

Related posts

Leave a Comment