কিভাবে আপনার লাজুক সন্তানটিকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলবেন

Spread the love

এক মানুষ থেকে আরেক মানুষে কত পার্থক্য! চারিদিকে কত বৈচিত্রময় মানুষের আনাগোণা। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতো শিশু সন্তানদের মাঝেও রয়েছে নানা রকম বৈচিত্রতা। কেউ চাপা-স্বভাবের, কেউ এক্সট্রোভার্ট, কেউ মিশুক, কেউ লাজুক ইত্যাদি।

তবে যারা অতিরিক্ত লাজুক, তাদের প্রধান সমস্যা হতে পারে কনফিডেন্স বা আত্মবিশ্বাসের অভাব। যখন কোনো শিশু লাজুক হয়, তখন সে বেশ একাকীত্বে পড়ে যায়। বাবা-মা হিসেবে আপনাদের দায়িত্ব শিশু সন্তানকে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া।

বিজ্ঞাপণ

শিশুকে তার কথা শেষ করতে দিন

অনেক বাবা-মা তাদের শিশুকে সাহায্য করার উদ্দেশে শিশুর কথার মাঝে নিজ থেকে কিছু বলে দেন। শিশুকে তার বাক্যটা শেষ করার ‍সুযোগ দেন না। শিশুর হয়ে বাবা-মা বাক্যটি পূরণ করে দেন, যা উচিত নয়।

এধরনের আচরণ আপনার সন্তানের লজ্জা ভাঙাতে বা তার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে না। সে হয়তো ভাবে, “আমি যা বলি, তা হয়তো সেরকম গুরুত্ব রাখে না।” কিংবা “আমার কথা হয়তো ইন্টারেস্টিং মনে হয় না।”

শিশুকে তার কথা বলার মাঝে না থামিয়ে বরং তাকে তার বাক্যটি শেষ করতে দিন। হয়তো বাক্যটি শেষ করতে শিশুর একটু বাড়তি সময় লাগবে। তারপরেও তাকে বাক্যটি শেষ করতে দিন। শিশুর বলা শেষ হওয়ার পর, তাকে আপনার বক্তব্য, আইডিয়া, মতামত ইত্যাদি জানান। শিশুকে নির্বিঘ্নে কথা বলতে দিন। শিশুরা কথা বললে তাদের ব্যক্তিত্ব বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়।

শিশুরা যাদেরকে বিশ্বাস করে সাধারণত তাদের কাছে নিজের বিভিন্ন কথা শোনাতে চায়, শেয়ার করতে চায়। যদি আপনার সন্তান আপনার কাছে তার কথা শেয়ার করতে চায় তাহলে বুঝতে হবে তার কাছে আপনি একজন “বিশ্বস্ত”, “নিরাপদ” সঙ্গী। শিশু ধরে নিয়েছে, আপনি তাকে কথা বলার মাঝে থামিয়ে দেবেন না বা বাগড়া দেবেন না, তার সমালোচনা করবেন না।

সমালোচনা করবেন না

আপনার সন্তান যদি বুঝতে পারে তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সমালোচিত হতে হবে, তাহলে প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সে নিজের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করবে। সে হয়তো ভাববে, “কথা বলে কী লাভ? আমাকে তো সেটা নিয়ে খোঁটা শুনতে হবে, সমালোচনা শুনতে হবে।”

যখন বাচ্চাকে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করলে জবাব দেয়, “আমি জানি না।” তখন বাবা-মায়েরা বেশ বিস্মিত হোন। কেন তাদের সন্তান মুখ খুলছে না, কেন তাদের সন্তান এত অন্তর্মুখী, লাজুক; তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করেন।

এসবের মূলে রয়েছে সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের আচরণ। তাই তার সমালোচনা করবেন না বিশেষ করে অন্যদের সামনে। তার ভালো কাজের অবশ্যই প্রশংসা করুন, ভুল হলে তা শুধরে নিন।

প্রশংসা করুন

শিশু যখন প্রশংসা-যোগ্য কিছু বলে তখন অবশ্যই তার প্রশংসা করুন। প্রশংসা শুনতে আমাদের সবারই ভাল লাগে। কোনো কাজ বা কথার মাধ্যমে যখন আমরা প্রশংসা পাই, তখন আমরা সেই কাজ বা কথার ধারা আগামীতেও বজার রাখার চেষ্টা করি। যেন সামনে আরো প্রশংসা পাই।

প্রশংসা আমাদেরকে ভাল কিছু করতে উৎসাহিত করে। তাই শিশুর ভাল কাজে, কথার বিপরীতে প্রশংসা করুন। এতে শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

[আরও পড়ুনঃ শিশুকে প্রশংসা করার সময় যে শব্দগুলোর ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে ]

নিজেকে বিচার করুন

শিশুকে লাজুক বলার আগে বাবা-মায়ের উচিত নিজেদের দিকে তাকানো। লাজুকের মানদণ্ডে আপনার স্কোর কত? ১০ হলে আপনি লাজুক নন, বরং বেশ আত্মবিশ্বাসী। ০ হলে আপনি অত্যন্ত লাজুক। এবার নিজেই বিচার করুন লাজুকের এই মানদণ্ডে আপনার অবস্থান কোথায়।

এবার ভাবুন, আপনার সন্তান কি আপনার মতোই লাজুক? আপনি কি তার রোল-মডেল হয়ে আছেন? যদি আপনি নিজেই অত্যন্ত লাজুক হয়ে থাকেন, আত্মবিশ্বাস কম থাকে, তাহলে আগে নিজেকে সংশোধন করুন। নিজের কথা ভেবে এবং নিজের সন্তানের কথা ভেবে নিজেকে সংশোধন করুন। প্রয়োজনে প্রফেশনাল কারো কাছে থেকে কাউন্সেলিং নিন।

শিশুকে নেতিবাচক তকমা দেবেন না।

ধরা যাক, আপনি আপনার সন্তানের লাজুক স্বভাব নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। আপনার সন্তান কেন যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নয়, কীভাবে তার এই সমস্যার সমাধান করা যায়; তা নিয়ে আপনার চিন্তার শেষ নেই। কিন্তু তা-ই বলে কখনো সন্তানকে যেন বলে বসবেন না, “তুমি এত চাপা স্বভাবের কেন?” বা “তুমি এত লাজুক কেন?” কিংবা “তোমার জন্য আমাকে টেনশন করতে হচ্ছে!” ইত্যাদি।

শুধু তা-ই নয়, নিজের সন্তানের ব্যাপারে যখন অন্য কারো সাথে আলোচনা করবেন, তখনও সন্তানকে হেয় করে কিছু বলা থেকে বিরত থাকুন। আপনার সন্তান যদি দেখে বা শোনে যে, আপনি তাকে অন্য কারো কাছে “লাজুক” তকমা দিয়ে উপস্থাপন করছেন, তাহলে তার নিজের ওপরে থাকা অবশিষ্ট আত্মবিশ্বাসটুকুও গায়েব হয়ে যাবে। সে নিজেকে ব্যর্থ হিসেবে ধরে নেবে। তার মগজে একটা বিষয় গেঁথে যাবে, “আমি আসলেই লাজুক। আমার আব্বু-আম্মুও সবাইকে তাই বলে।”

তাই শিশুকে কোনো নেতিবাচক তকমা দেবেন না। তকমা দেওয়াটা শিশুর জীবনে শুধু ক্ষতিই ডেকে আনবে, উন্নতি নয়।

[ আরও পড়ুনঃ চাইল্ড শেইমিং এর ক্ষতিকর দিক এবং কিভাবে তা এড়িয়ে চলবেন ]

কথাটা একটু অন্যভাবে বলুন

সন্তানের কানে যেন নেতিবাচক মন্তব্য না যায় সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখুন। সবসময় তার সাথে পজেটিভ বা ইতিবাচক কথা বলার চেষ্টা করুন। এমনকি সন্তানের দুর্বলতা নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রেও খেয়াল রাখুন যেন আপনার বক্তব্যে পজেটিভ টোন থাকে।

ধরা যাক, আপনার সন্তান তার সমবয়সী কয়েকজন শিশুর সাথে বসে খেলছে। অন্য শিশুরা খেলার পাশাপাশি প্রাণখুলে কথা বলছে কিন্তু আপনার সন্তান স্বভাবে লাজুক হওয়ায় তেমন কিছু বলছে না। শুধু শুনে যাচ্ছে। তখন আপনি সন্তানকে উৎসাহ দেওয়ার সময় কথাটা এভাবে বলতে পারেন, “আমার মেয়েটা কিছু বলার আগে একটু ভেবে বলতে পছন্দ করে। একবার বলতে শুরু করলে তখন ও খুব সহজেই সবার বন্ধু হয়ে যায়। আমার মেয়েটা অনেক লক্ষ্মী!” কিংবা এভাবে বলা যেতে পারে, “আমার ছেলেটা নিজে কিছু বলার আগে অন্যদের কথা শুনতে ভালবাসে। সবার কথা শোনার পর ও কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।”

যদি আপনার সন্তান কোন কারণে আপসেট থাকে, ভীত থাকে বা অস্বস্তিবোধ করে সেক্ষেত্রে তার সাথে এভাবে আলাপ শুরু করতে পারেন, “মনে হচ্ছে তোমার একটু নার্ভাস লাগছে। সমস্যা নেই, এমনটা হতেই পারে। দুশ্চিন্তার কিছু নেই। চাপ নিয়ো না।”

শিশুকে কনফিউজ করে দেবেন না

শিশুর সাথে আলাপ করতে গিয়ে মুখ ফসকে এমন কিছু বলে ফেলবেন না যেটা শুনে সে কনফিউজ হয়ে যায়, দ্বিধায় পড়ে যায়। “ন্যাকামো কোরো না, ছেলেরা এত লজ্জা পায় নাকি!” এধরনের কথা বলা থেকে বিরত থাকা খুবই জরুরি।

শিশুরা যখন বাবা-মায়ের কাছ থেকে এধরনের বক্তব্য শুনতে পায়, তখন তারা মনে করে তাদের আবেগ-অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। তারা ভুল পথে রয়েছে। তাদের যেমনটা হওয়া উচিত, তারা তেমনটা হতে পারছে না। এরকম আরো নানাবিধ ভাবনা তাদের মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করে এবং ফলশ্রুতিতে তারা কনফিউজ হয়ে যায়।

শিশুদেরকে আবেগ প্রকাশ করতে দিন। যেসব শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে নিজের আবেগের ব্যাপারে পজেটিভ আচরণ পায় তারা “ইমোশনালি শিক্ষিত” হয়ে ওঠে। তারা তুলনামূলকভাবে আত্মবিশ্বাসী হয় এবং নিরাপদবোধ করে।

শিশুর সন্দেহের জায়গাগুলো সহজ করে দিন

“সবাই কম-বেশি অনিশ্চয়তায় ভোগে। বুঝে উঠতে পারে না কী করবে বা কী করা উচিত।” এধরনের বাক্য দিয়ে শিশুকে তার অনিশ্চয়তা ও সন্দেহের বিষয়ে আশ্বস্ত করা যেতে পারে। তারপর আপনার নিজের জীবনের কোনো একটা ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করলে, শিশুর কাছে তা বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। “জানো, মাঝে মাঝে অফিসে আমিও এধরনের পরিস্থিতি পড়ে যাই। কী বলব বুঝতে পারি না। দুশ্চিন্তা হয়। কিন্তু আমি পিছিয়ে যাই না। সবসময় ভাল কিছু করার চেষ্টা করি এবং চেষ্টা করার মাধ্যমে পরবর্তীতে আমার অনিশ্চয়তাগুলো দূর হয়ে যায়। আমি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি।”

এছাড়া বাবা-মায়ের উচিত শিশুকে বিভিন্ন গল্পের বইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। গল্পের মাধ্যমে, গল্পে উপস্থিত চরিত্রগুলোর মাধ্যমে শিশুকে ভয়ের মুখোমুখি হতে শেখানো এবং ভয়কে জয় করার বিষয়টি পরিচিত করা।

শিশুর সামনে রোল-মডেল হোন

শিশুরা অনুকরণ প্রিয় হয়। বাবা-মাকে যা করতে দেখে, তারা সেটা অনুকরণ করতে চায়। সামাজিকভাবে মেলামেশা করার গুণটিও শিশু তার বাবা-মাকে দেখার মাধ্যমে শিখে থাকে। তাই বাবা-মায়ের উচিত শিশুর সামনে চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, যা শিশুর জন্য অনুকরণযোগ্য। যেমন : অপরিচিত লোকদের সাথে বাবা-মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, প্রয়োজন পড়লে বাবা-মা কীভাবে মানুষের কাছ থেকে কোনো বিষয়ে সাহায্য চায় তা দেখানো, কীভাবে বন্ধুদেরকে প্রশংসা করতে হয় এবং সময় দেওয়ার জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ দিতে হয় ইত্যাদি।

“আপনি নিজে যা পারেন না বা করবেন না, তা আপনার সন্তানকে করতে বলবেন না।” কথাটা ডাক্তার কারড্যাচি’র। অপরিচিত লোকদের নিয়ে গঠিত একটা গ্রুপের কাছে গিয়ে যদি আপনি নিজেই সাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে না পারেন, তাহলে কীভাবে আশা করেন যে, আপনার সন্তান তা পারবে? কীভাবে আশা করেন, আপনার সন্তান নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে তার সহপাঠীদের সাথে সহজেই পরিচিত হবে?

বিজ্ঞাপণ

তাই সন্তানের সামনে আগে নিজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। আপনার দেখাদেখি সন্তানও তা আয়ত্ত্ব করার চেষ্টা করবে বলে আশা করা যায়।

অভিনয়-অভিনয় খেলুন

সমবয়সী কারো জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গেলে আপনার লাজুক স্বভাবের সন্তান হয়তো আড়ালে আড়ালে থাকতে চায়। অনুষ্ঠানে আগত অন্যান্য শিশুদের সাথে পরিচিত হতে, খেলাধূলা করতে সংকোচবোধ করে ইত্যাদি। এধরনের সমস্যার সমাধান করার জন্য আপনি আপনার সন্তানকে নিয়ে নিজের বাসায় অভিনয়-অভিনয় খেলতে পারেন।

সন্তানের বিভিন্ন খেলনাকে বিভিন্ন চরিত্রে দাঁড় করিয়ে দিন। তারপর সন্তানকে খেলার ছলে, অভিনয়ের মাধ্যমে যার জন্মদিন তার হাতে গিফট তুলে দিতে বলুন, উপস্থিত অন্যান্য শিশুদেরকে “হ্যালো” জানাতে বলুন ইত্যাদি। এছাড়া কারো বাসায় গিয়ে কীভাবে লজ্জা ভেঙে টয়লেটের অবস্থান জেনে নিতে হয়, সেটাও শিখিয়ে দিন। অনুষ্ঠান শেষে কারো বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কীভাবে সেই বাসার মানুষদেরকে বিদায় জানাতে হয়, সেটাও শেখাতে ভুলবেন না।

এসব ছোটখাটো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যদি আপনার সন্তান শিখে নিতে পারে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তার জড়তা ও লাজুকতা কমে যাবে। সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে।

শিশুর সামর্থ্যের ওপর সন্দেহ পোষণ করবেন না

যদি দেখতে পান, কোনো একটি কাজ করতে আপনার শিশুটি বেশ ভুগছে কাজটা সম্পন্ন করতে তার বেশ বেগ পেতে হচ্ছে, তাহলে তার প্রতি সহানুভূতি ও ভরসা দুটো রেখেই মন্তব্য করুন। “মা মণি, কাজটা করতে তোমার বেশ কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু আমি জানি তুমি কাজটা ঠিকই করে ফেলবে। তোমার ওপর আমার ভরসা আছে।” এভাবে শিশুকে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে। এভাবে উৎসাহ দিলে শিশু আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে।

কোনভাবেই এমন কোনো বক্তব্য দেওয়া যাবে না যা দ্বারা তার সামর্থ্যের ওপর সন্দেহ প্রকাশ পায়। “রেখে দাও, তোমাকে দিয়ে এই কাজ হবে না।” এধরনের মন্তব্য শিশুকে লজ্জায় ফেলে দেয় এবং নিজেকে গুটিয়ে নিতে উৎসাহিত করে, শিশুর কাছ থেকে আত্মবিশ্বাস কেড়ে নেয়।

শিশুকে উৎসাহ দিন

যদি দেখেন আপনার শিশু সন্তান নতুন কিছু করার চেষ্টা করছে, তাহলে তাকে বাহবা দিন। ধরা যাক, আপনি আপনার শিশু সন্তানকে নিয়ে একটা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে ছোটদের মাঝে বালিশ খেলার আয়োজন করা হলো। কিন্তু আপনার সন্তান যথেষ্ট চাপা স্বভাব ও লাজুক হওয়া সত্ত্বেও অন্য শিশুদের দেখাদেখি সে-ও বালিশ খেলায় অংশগ্রহণ করল!

এক্ষেত্রে এই চেষ্টাটার জন্যে নিজের সন্তানকে আপনার উৎসাহ দেওয়া উচিত। খেলা শেষে ফলাফল যা-ই হোক না কেন, আপনার সন্তানকে বোঝানো উচিত- খেলার আগে বিষয়টা কঠিন মনে হলেও, খেলার পর নিশ্চয়ই আর ওরকম কঠিন মনে হচ্ছে না। কোনো কাজ চেষ্টা করে দেখলে সেটা আগের চেয়ে সহজ হয়ে যায়।

শিশুকে সমস্যার সমাধানে পাশে রাখুন

বাসায় কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা শিশুকে শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে কাজে লাগান। ধরা যাক, বেসিনের পাইপ জ্যাম হয়ে, পানি উপচে মেঝেতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাসায় মিস্ত্রি ডাকার আগে বা আপনি নিজে তা সারার আগে আপনার শিশুকে ডাকুন। তাকে সমস্যাটা বুঝিয়ে বলুন, সমস্যার ফলে মেঝেতে কী অবস্থা হয়েছে তা দেখান।

এরপর আপনার শিশুকে প্রশ্ন করুন, “বলো তো বাবা, কী করা যায়?” এভাবে আপনার শিশুকে সক্রিয় করে তুলুন। তাকে সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ করে দিন। এতে শিশুর ভেতরে আত্মবিশ্বাস বাড়বে এবং সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সে নিজের দক্ষতা ও সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পাবে।

শিশুকে “না” বলতে দিন

শিশুদেরকে দিয়ে জোর করে কিছু আদায় করে নেবেন না বা কোনো কাজ করিয়ে নেবেন না। কোনো ব্যাপারে শিশুর আপত্তি থাকলে তাকে “না” বলার সুযোগ দিন। শিশু বলে তার “না”কে অবহেলা করার কোনো কারণ নেই।

শিশুকে “না” বলার পাশাপাশি তাকে “না” বলার পরিণতি জানাতে বা দেখাতে ভুলবেন না। কোনো কিছু বলার পর তার পরিণতি বা প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলে তা শিশুর অভিজ্ঞতার খাতায় যোগ হয়ে থাকে।

ধরা যাক, বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। আপনি আপনার শিশুকে জুতো পরার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু সে “না” বলে দিলো। জানালো শীতের মাঝেও সে স্যান্ডেল পরতে চায়। আপনি শিশুর “না” মেনে নিন এবং তাকে স্যান্ডেল পরে বাইরের ঘোরার অভিজ্ঞতা অর্জনের ব্যবস্থা করে দিন।

ঠাণ্ডার বেমক্কা ধাক্কা খেয়ে জুতো পরার ব্যাপারে আপনার শিশুর শিক্ষা হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে সে নিজেই শীতের মাঝে জুতো পরার জন্য আগ্রহী হবে। স্যান্ডেল পরে বাইরে যাওয়ার একদিনের অভিজ্ঞতা তাকে সারাজীবনের জন্য শিক্ষা দিতে পারে। 

শিশুকে মাঠে বা পার্কে নিয়ে যান

শিশুকে মোবাইল বা ট্যাবে গেম খেলায় আকৃষ্ট না করে বরং তাকে নিয়ে খোলা মাঠে যান বা কোনো পার্কে যান। তাকে মাঠে খেলতে আসা অন্যান্য শিশুর সাথে পরিচিত হতে ও বন্ধুত্ব করতে উৎসাহিত করুন।

হয়তো আপনার সন্তান শুরুতে তাদের সাথে কথা বলতে ইতস্ততবোধ করবে, আটকে যাবে, লজ্জা পাবে, সংকোচবোধ করবে। কিন্তু তাই বলে আপনি নিজে তার কাজটা করে দিয়ে, ব্যাপারটাকে সহজ করে দেবেন না। আপনার শিশুকেই ব্যাপারটা সামাল দিতে দিন। এই প্রক্রিয়ায় এগোলে সে ধৈর্য ধরার বিষয়টিও আয়ত্ত্ব করে ফেলবে।

পাশেই থাকুন

শিশুকে মাঠে ঢুকে দিয়েই, তাকে একা ফেলে দূরে কোথাও গায়েব হয়ে যাবেন না। সে কীভাবে মাঠের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, তা দেখুন। নতুন পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে কিনা খেয়াল করুন।

যদি দেখতে পান, সে বেশ সহজ হয়ে গিয়েছে, সবার সাথে মজা করছে, খেলছে, তাহলে আপনি এবার তার চোখের আড়ালে যেতে পারেন। “মা মণি, তুমি তাহলে খেলো। আমি একটু বাজার করে আসছি।” এভাবে তার কাছ থেকে বিদায় নিতে পারেন।

বিজ্ঞাপণ

খেলার মাঠে বা পার্কে সন্তানকে নিজের মতো করে, স্বাধীনভাবে খেলতে দেওয়াটা জরুরি। খেলাধূলা করলে একদিকে যেমন শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে, অন্যদিকে সন্তানের সংকোচ কেটে যায়, সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।

আগেভাগে শিশুকে তৈরি করুন

দেখা যায়, বাবা-মায়ের সাথে কোনো অনুষ্ঠানে শিশু উপস্থিত হলে, শিশুটি বেশ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যায়। অচেনা, নতুন পরিবেশের ভেতরে শিশু নিজেকে স্বাভাবিকভাবে মেলে ধরতে পারে না। নিজের বাসায় যে শিশুটি বেশ চঞ্চল, প্রণবন্ত থাকে, সে অনুষ্ঠানে এসে বা কারো বাসায় এসে একেবারে চুপচাপ হয়ে যায়।

এধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য বাবা-মায়ের উচিত শিশুকে আগেভাগে উক্ত অনুষ্ঠানের ব্যাপারে পর্যাপ্ত ধারণা দেওয়া। “বাবু সোনা, জানো আগামী সপ্তাহে আমরা তোমার ছোট মামার বাসায় বেড়াতে যাব! তোমার মামাতো ভাইয়ের জন্মদিন পালন করা হবে। ওখানে আরো অনেকেই আসবে! অনেক বাবুও আসবে! তুমি তাদের সাথে খেলতে পারবে! অনেক মজা হবে!” এভাবে শিশুকে আগেভাগে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা যেতে পারে। 

তাড়াহুড়ো করবেন না

সন্তানের লজ্জা ভাঙানোর জন্য আশেপাশে থাকা ১০-১২ জন প্রতিবেশির শিশুকে একদিনে দাওয়াত দিয়ে বসবেন না যেন! এতে হিতে-বিপরীত হতে পারে। ধীরে ধীরে এগোতে হবে। প্রথমে একজন প্রতিবেশিকে তার ছোট শিশুকে নিয়ে বাসায় আসতে বলুন। এবার নিজের সন্তানের অভিব্যক্তি খেয়াল করুন।

প্রতিবেশির সন্তানের সাথে নিজের সন্তানকে পরিচয় করিয়ে দিন। তাদেরকে একসাথে খেলার সুযোগ করে দিন। এভাবে কয়েকদিন একসাথে খেলাধূলা করে যখন শিশুরা একে অন্যের সাথে পরিচিত হয়ে যাবে, তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে, তখন তাদেরকে নিয়ে কাছে-পিঠে থাকা কোনো একটা পার্কে চলে যান।

দেখুন, পার্কের নতুন পরিবেশে তারা নিজেদেরকে কীভাবে আবিষ্কার করে। খেয়াল করুন, নতুন পরিবেশের সাথে আপনার সন্তান নিজেকে কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছে। দেখুন তার মাঝে সংকোচ, ভয় ইত্যাদি কাজ করছে কিনা। কীভাবে সে ওগুলোকে কাটিয়ে উঠছে, এসব লক্ষ্য করুন। চাপা স্বভাবের লাজুক শিশুকে এভাবে পর্যায়ক্রমিকভাবে, বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।

জোর করবেন না

সবাই কিন্তু একরকম নয়। আপনি হাজার চাইলেও আপনার অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের সন্তানকে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, চনমনে, জীবনীশক্তিতে উদীপ্ত একজন এক্সট্রোভার্ট মানুষে বদলে ফেলতে পারবেন না। কারণ তা অসম্ভব। তবে হ্যাঁ, আপনি তার লজ্জা, সংকোচ কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে সহায়তা করতে পারেন।

সন্তানের ওপর অহেতুক কিছু চাপিয়ে দেবেন না। আপনার সন্তান যদি নিতান্তই চাপা স্বভাবের হয়, তাতে কোনো দোষ নেই। তবে বিষয়টা আপনার সন্তানকেও জানিয়ে দেবেন যে, তার চাপা স্বভাবের কারণে আপনারা তাকে অপরাধী ভাবছেন না বা ছোট করে দেখছেন না। সন্তানকে সাপোর্ট করুন।

সবার জন্য শুভ কামনা। 


Spread the love

Related posts

Leave a Comment