সন্তানের যখন একজন ফেভারিট প্যারেন্ট থাকে

Spread the love

একটি শিশুকে বড় করতে, লালন-পালন করতে মা-বাবাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। মা-বাবারা  চান তাদের সন্তানদেরকে সমানভাবে ভালোবাসা ভাগ করে দিতে, আদর-যত্ন করতে। কিন্তু প্রায়শই দেখা যায় সন্তানদের কেউ কেউ হয়তো মায়ের দিকে বেশি ঝুঁকে, আবার কেউ হয়তো বাবার দিকে। যদিও প্যারেন্টিংয়ের ক্ষেত্রে এটি খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়, কিন্তু এটি অপর প্যারেন্টের জন্য বেশ কষ্টদায়ক।

আসলে এই ধরনের আচরণের পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। আজকের আর্টিকেলে আমরা এর কারণগুলো, এরকম হলে আমাদের করণীয় কী – এই সবকিছু নিয়েই আমরা আলোচনা করবো।

বিজ্ঞাপণ

সন্তানের ফেভারিটিজম বা পক্ষপাতিত্বের কারণ

বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের খুলশীতে গুনগুন ও তার মা-বাবার বসবাস। জন্মের পর থেকে প্রথম ১-১.৫ বছর সে একদম মায়ের কোলঘেষে থাকতে চাইতো। মা তাকে ফেলে একটু দূরে গেলে বা কোনো কাজে গেলেই সে কান্নাকাটি শুরু করতো। কিন্তু একটা সময় পর সে হঠাৎই তার বাবার দিকে ঝুঁকে যাওয়া শুরু করলো।

প্রথমদিকে গুনগুনের মা বিষয়টাতে খুশিই হয়েছিলেন। কারণ তিনি নিজেও চাইতেন যে গুনগুন একটু তার বাবার সাথে সময় কাটাক। তাছাড়া তিনিও যেনো অনেকদিন পর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছিলেন।

আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টা খুবই সাধারণ মনে হয়। কিন্তু এই সাধারণ বিষয়টিই গুনগুনের মায়ের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ালো যখন তিনি দেখলেন যে গুনগুন তার বাবা ছাড়া কিছুই করতে চাইছে না। খাওয়ার সময়, ঘুমানোর সময়, বেড়াতে গেলে – সবখানেই সে বাবাকে খোঁজে। আর বাবাকে পেলে যেনো মাকে চিনেই না।

এসব কিছু নিয়ে তিনি বেশ দুঃশ্চিন্তায় ও মনঃক্ষুণ্ন ছিলেন। তার খারাপ লাগাটা একদম চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলো যখন একটি অনুষ্ঠানে গুনগুন সবার সামনে মায়ের কোল থেকে বাবার কোলে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে একাকার করে ফেললো।

যদিও একজন শিশুর এই ধরনের আচরণ খুবই সাধারণ, তবুও গুনগুনের মা এই সবকিছু নিয়ে খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন এমন কি করে ফেললেন যে যার জন্য গুনগুন তাকে ভুলে গিয়ে পুরোপুরি তার বাবা কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আসলে সন্তানের এই ধরনের আচরণের জন্য বেশ কিছু কারণ দায়ী-

চাহিদা

ব্যাপারটা এমন নয় যে বাবা-মা যে কেউই সন্তানের কোনো চাহিদা বা প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম নয়৷ অনেক ক্ষেত্রে হয় কি, ধরুন আপনার সন্তান চকলেট খেতে চাইলো বা টেলিভিশন দেখতে চাইলো। হয়তো মায়ের কাছে অনুমতি চাইলে মা তৎক্ষনাৎ সেটা দিবেন না, কিন্তু বাবার কাছে চাইলে বাবা সহজেই তাকে অনুমতি দিয়ে দিবেন। মোদ্দাকথা তারা বুঝতে পারে যে কার কাছে চাইলে সহজেই জিনিসটা পাওয়া যাবে। এজন্যই পক্ষপাতিত্ব বা ফেভারিটজম হয়ে থাকতে পারে।

সংযুক্তি

সন্তানকে সময় দেওয়া যেকোনো পিতা-মাতারই গুরুদায়িত্ব। কিন্তু অনেক সময় ব্যস্ততা বা অন্য যেকোনো কারণে মা-বাবা উভয়ই সমানভাবে সন্তানকে সময় দিতে পারেন না। ওই সময়টাতে সন্তান অপর প্যারেন্টের অভাববোধ করে এবং যে প্যারেন্ট তার সাথে থাকে, তাকে সময় দেই তার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। শিশুরা নিজেদের প্রতি মনোযোগ চায়। আর এই চাওয়া যে/যারা পূর্ণ করতে পারে তার/তাদের প্রতি তারা বেশি আকৃষ্ট হয়।

বিশ্বাস

একজন সন্তান যখন দেখে যে তার বাবা/মা তার সব চাওয়া পূরণ করছে, তাকে সময় দিচ্ছে তখন ওই সব পিতা/মাতার প্রতি তাদের এক ধরনের বিশ্বাস জন্ম নেই। তারা মনে করে যে তাদের পিতা/মাতা তাদের জন্য যে সিদ্ধান্তই নিবে তা তাদের ভালোর জন্যই নিবে। তাদের জন্য যা করবে এতে তাদের ভালোই হবে – এই আশা থেকে তাদের প্রতি বিশ্বাস জন্ম নেয়। আর তখন এই ফেভারিটজম বা পক্ষপাতিত্বের ব্যাপারটা আসতে পারে।

আচরণ বা পছন্দের মিল

ধরুন আপনার সন্তান সিনেমা দেখতে বা খেলা দেখতে বেশ পছন্দ করে। আপনি নিজেও তাই। তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই আপনার সন্তান আপনার দিকে ঝুঁকবে। কারণ তার পছন্দ, তার আগ্রহের জায়গার সাথে আপনার পছন্দ বা আগ্রহের মিল রয়েছে। সে আপনার সাথে কথা বলে তার পছন্দের বিষয় নিয়ে আরো বেশি জানতে চাইবে। এতে করে আপনাদের সম্পর্ক আরো মজবুত হবে। পাশাপাশি আপনি তার পছন্দের মানুষে পরিণত হবেন।

স্বাচ্ছন্দ্যবোধ

বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশুরা সেই পিতা/মাতার দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ে যাদের সাথে তারা ফ্রিলি বা কোনো রকম অস্বস্তিবোধ ছাড়াই কথা বলতে পারে। হয়তো মা/বাবা একটু বকাবকি করেন তাই তাকে একটু এড়িয়ে চলে। আর যার সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তার সাথেই বেশি মিশতে চায়। তিনিই তার পছন্দের পাত্রে পরিণত হন।

এছাড়াও যখন কোনো সন্তানের পিতা-মাতার ডিভোর্স হয়ে যায় বা কোনো কারণে তারা আলাদা থাকেন, তখন ওই সন্তান সেই পিতা/মাতার প্রতি আকৃষ্ট হয় যার সাথে সে থাকছে। কারণ সে সার্বক্ষণিক তাকেই দেখছে, তার সাথেই মিশছে। তাছাড়া আলাদা থাকার কারণে অপর প্যারেন্টের সাথেও তার একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। এরকম আরো বেশ কিছু কারণে ফেভারিটজম বা পক্ষপাতিত্ব হতে পারে।

[ আরও পড়ুনঃ সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের পক্ষপাতমূলক আচরণের প্রভাব | প্যারেন্টাল ফেভারিটিসম ]

সাধারণ কিছু ভুল ধারণা

সন্তান পিতা বা মাতার সাথে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেই পারে। এটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত না হয়ে প্রথমে এই ফেভারিটজম বা পক্ষপাতিত্ব কী, কেন হচ্ছে এগুলো সম্পর্কে জানার এবং বোঝার চেষ্টা করুন। সন্তান যতই আপনাকে প্রাধান্য দিক, যতই আপনার সঙ্গীর থেকে দূরে থাকতে চাক – আপনারা এগুলোতে খুব বেশি চিন্তিত না হয়ে বিষয়টা সাধারণভাবে নেওয়ার এবং এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করুন।

সন্তান তার মা বা বাবাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে মানে এটা না যে সে অপর প্যারেন্টকে ভালোবাসে না। বিষয়টা হচ্ছে সে যার সাথে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে তার সাথেই বেশি মিশছে। কিন্তু অনেক পিতা/মাতাই এটা নিয়ে খুব ভেঙে পড়েন আর ভাবেন যে তাদের সন্তান তাদেরকে ভালোবাসেনা। অনেক সময় তারা সন্তানদের প্রিয় হবার জন্য বা তাদের মন জয় করার জন্য যেকোনো পর্যায়ে যেতে প্রস্তুত থাকেন।

সন্তানের কাছে প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য অনেক সময় তারা বিভিন্নরকম পরিকল্পনা করে থাকেন যাতে সন্তানের ভালো হওয়ার বদলে খারাপই হয়। যেমন ধরা যাক আপনার সন্তান এখনো ছোট। কিন্তু আপনি তার পছন্দের মানুষ হওয়ার জন্য তাকে মোবাইল বা কম্পিউটার কিনে দিলেন। আপনি নিজেই ভেবে দেখুন তো এতে তার ভালো হচ্ছে নাকি খারাপ। আপনি নিজে ভালো হতে গিয়ে সন্তানের ভবিষ্যতটা অনিশ্চয়তায় ফেলে দিচ্ছেন না?

আপনি অবশ্যই চাইবেন আপনার সন্তানের পছন্দের বাবা/মা হতে। কিন্তু আপনি যাই করুন এটি নিশ্চিতভাবে বলা যাবেনা যে আপনি তার ফেভারিট প্যারেন্ট হবেন। আসলে ভালো লাগা জিনিসটা একান্তই ব্যক্তিগত। সে আপনার চেয়ে আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনীকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে মানে এই না যে আপনি খারাপ প্যারেন্ট বা উনি আপনার চেয়ে ভালো প্যারেন্ট। হয়তো আপনার সন্তানের চাওয়া-পাওয়া আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনীর সাথে মিলছে বা তার সাথেই সে স্বস্তিবোধ করছে – এতোটুকুই।

খ্যাতিমান লেখিকা ও মনোবিজ্ঞানী মিশেলে বর্বা পরামর্শ দেন, “এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হলে একজন আরেকজনকে হিংসা না করে নিজেদের থেকে শিখার চেষ্টা করুন। নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করুন যে কি কাজ এবং কি অনুসরণ করা উচিত যাতে করে আপনারা উভয়েই লাভবান হন এবং আপনার সন্তান তার সেরাটা করতে পারে”।

বাবা-মাদের উচিত সন্তানের ফেভারিট বা পছন্দের পিতা-মাতা হতে না চেয়ে তার শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশ যাতে ঠিক মতো হয় সেজন্য সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলা। প্যারেন্টিং সন্তানের সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হওয়া উচিত, পছন্দনীয় হওয়ার জন্য নয়।  

সন্তান পক্ষপাতিত্ব করলে কম পছন্দের অভিভাবকের জন্য পরামর্শ

এটি সহজেই অনুমেয় যে সন্তানের পক্ষপাতিত্বের স্বীকার হওয়া বেশ কষ্টকর। কিন্তু এর মানে এই নয় যে আপনি আর কখনো তার প্রিয় হতে পারবেন না৷একটু চেষ্টা করলেই হয়তো আপনি তার পছন্দের পাত্র হতে পারবেন। সন্তানরা যতই মা কিংবা বাবাকে প্রাধান্য দিক তারা উভয়েরই ভালোবাসা এবং সমর্থন চায়। গুনগুনের মায়ের মতো আনফেভার্ড প্যারেন্টদের জন্য নিচে কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো :

সন্তানের ফেভারিটজম বা পক্ষপাতিত্বকে ব্যক্তিগতভাবে নেওয়ার প্রয়োজন নেই

আপনার অভিজ্ঞতা আর আপনার সন্তানের অভিজ্ঞতা কিন্তু এক নয়। তারা পৃথিবীতে এসেছে অল্প সময়। তাই তাদের বুদ্ধির বিকাশ, চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঠিক মতো ঘটে নি। তাই তাদের কাজকে ব্যক্তিগতভাবে নেওয়ার বা হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

এই প্রসঙ্গে বর্বা বলেন, “সন্তানদেরও পরিবর্তন আসবে যেমনটা পিতা-মাতাদেরও এসেছে। আজ যারা প্রিয় কাল তারা প্রিয় নাও থাকতে পারে”। সে নিতান্তই শিশু, ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা তাই হয়ে উঠে নি। তাই তার আচরণে কষ্ট পাওয়ার দরকার নেই।

বাজে অনুভূতি বা খারাপ চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণে রাখুন

সন্তানের আচরণে কষ্ট পেলেও সেটা তার সামনে প্রকাশ করবেন না। শিশুরা নিষ্পাপ হয়, তাই তারা অনুভূতি লুকিয়ে না রেখে দেখিয়ে ফেলে বা অকপটে বলে ফেলে। এতে আহত হলেও নিজের খারাপ লাগাকে নিয়ন্ত্রণ করুন।

বরঞ্চ আপনি তাকে নিজের অনুভূতির ব্যাপারে বুঝিয়ে বলুন। যেমন তার সাথে গল্প করতে করতে তাকে বুঝিয়ে বলুন যে যখন সে আপনাকে গুরুত্ব দেয় না বা তার কাছ থেকে চলে যেতে বলে তখন আপনি কষ্ট পান। কথাগুলো নেহায়েত গল্পের ছলে বলুন, এমনভাবে বলবেন না যাতে সে অপরাধবোধে ভোগে। তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

আপনি তাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বললে সে যে শুধু আপনার অনুভূতির ব্যাপারে জানবে তা নয়। সে এটাও শিখবে যে কারো অনুভূতিতে আঘাত দিলে সে কষ্ট পায়। তাই সে সবার প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করতে শিখবে।

বিজ্ঞাপণ

সহানুভূতিশীল প্রতিক্রিয়া দেখান

এমন অনেক সময় আসবে যখন আপনার সন্তান তার পছন্দের পিতা/মাতাকে কাছে চাইলেও পাবেনা। হয়তো তিনি অফিসে বা দোকানে বা কোনো দরকারি কাজে গেছেন। সে সময় আপনার সন্তান তাকে খুঁজলে তার প্রতি সহানুভূতিশীল প্রতিক্রিয়া দেখান। ভুলেও এমন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না যাতে সে কষ্ট পায়।

তাকে এভাবে বলতে পারেন যে, “দেখো আমি জানি তুমি এখন তোমার মা/বাবাকে খুঁজছো। কিন্তু তিনি না থাকাতে আমি তোমার পাশে আছি। তোমার যা দরকার আমাকে বলতে পারো”। তার প্রতিক্রিয়া যেমনই হোক আপনি সহানুভূতির সাথে কথা বলুন।

আপনার সন্তানকে সময় দিন

আপনি যদি মনে করেন যে আপনার সন্তানের সাথে আপনার সম্পর্কে কিছুটা চিড় ধরেছে বা সে আপনার সাথে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনা – সেক্ষেত্রে আপনি তাকে বেশি বেশি সময় দিন৷ তার সাথে সবসময় কথা বলুন, তার ভালো লাগা খারাপ লাগা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন।

সে প্রথমে অস্বস্তিবোধ করলেও আস্তে ধীরে মানিয়ে নিবে। তাই চেষ্টা করতে থাকুন৷ দিনের কোনো একটা সময় তাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসতে পারেন বা টেলিভিশনে কোনো অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারেন। এতে আপনাদের সম্পর্ক আরো মজবুত হবে।

মা-বাবা উভয়েই একই নিয়মকানুন অনুসরণ করুন

বর্বা বলেন, “এটি সচরাচর হয় যে সন্তানরা সেই প্যারেন্টকেই বেশি প্রাধান্য দেয় যিনি নরম এবং শান্ত প্রকৃতির”। আপনি হয়তো বকাঝকা কম করেন আর আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনী হয়তো একটু বকে মাঝে মাঝে। সেক্ষেত্রে আপনার সন্তান আপনার দিকেই বেশি ঝুঁকবে এটাতো সাধারন ব্যাপার। পাশাপাশি তার অপর প্যারেন্টের প্রতি নেতিবাচক চিন্তাভাবনাও আসতে পারে।

তাই সন্তানের জন্য বাবা-মা উভয়েরই একি রকম শাসন, আদর-যত্ন মোদ্দকথা সমস্ত কিছুই একই রকম হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে আলাদা করে কাউকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয় আসবেনা।

নিজের ভালো দিকগুলো সম্পর্কে নিজেকে মনে করিয়ে দিন

হ্যা, আপনার সন্তান আপনার সঙ্গ পছন্দ না করলে খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এর মানে এই নয় যে আপনার জীবন থেমে গেছে বা আপনি খুব অসহায় হয়ে গেছেন। আপনি প্রতিনিয়তই আপনার সন্তানের জন্য, আপনার পরিবারের জন্য করে যাচ্ছেন। একটি অবুঝ শিশুর আপনাকে পছন্দ করা না করাতে আপনার কৃতিত্বগুলি ছোট হয়ে যাবেনা।

নিজের উপর আত্মবিশ্বাসী হন এবং  নিজেকে বোঝান যে সন্তানের এই পছন্দ না করাটা সাময়িক। আজকে আপনাকে কম গুরুত্ব দিচ্ছে, কালকে হয়তো আপনাকেই বেশি প্রাধান্য দিবে। তাই নিজেকে ছোট বা ব্যর্থ মনে না করে আপনার মতো আপনি চেষ্টা চালিয়ে যান।

সন্তান আপনার সাথে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করাতে আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনীর কোনো হাত নেই। তাই অহেতুক তার প্রতি হিংসা বা রাগ হবেন না। আর ফেভারিট প্যারেন্টেরও উচিত অপর প্যারেন্টকে সহায়তা করা। যাতে করে তাদের সন্তান দুজনকেই সমানভাবে প্রাধান্য দেয় এবং দুজনের সাথেই মিশতে পারে।

আপনার সন্তান আপনাকে বেশি প্রাধান্য দিলে সেক্ষেত্রে আপনার করণীয়

সন্তানের দ্বারা অবহেলিত হওয়া বা সন্তানের এড়িয়ে চলা সহ্য করা যেকোনো পিতা/মাতার জন্যই অনেক কঠিন। এই আনফেভার্ড বা কম পছন্দের হওয়া যেমন কষ্টকর, তেমনি ফেভার্ড প্যারেন্ট বা পছন্দের হওয়াও কম কষ্টের নয়। কারণ আপনি যখন আপনার সন্তানের পছন্দের প্যারেন্ট হবেন তখন তার সকালে ঘুম থেকে উঠা থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত সবকিছুই আপনি কেন্দ্রিক হবে। তাই আপনাকে অনেক চাপে থাকতে হবে।

এই চাপের প্রভাবে একটা সময় আপনি ক্লান্ত ও অসহায় বোধ করবেন। আপনি অসুস্থ হলেও দেখা যাচ্ছে আপনাকে ছাড়া আপনার সন্তান খেতেই চাচ্ছেনা। তখনও আপনাকে কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে। তাছাড়া আপনার ভেতর এই চিন্তা কাজ করবে যে আপনি আপনার সন্তান ও সঙ্গী/সঙ্গিনীর মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করছেন বা আপনার জন্য তারা কাছাকাছি আসতে পারছে না।

এই সমস্ত বিষয়ের সমাধানের জন্য গুনগুনের বাবার মতো একজন ফেভারিট প্যারেন্ট বা পছন্দের পিতা/মাতা হিসেবে আপনি কিছু দায়িত্ব পালন করতে পারেন। যেমন :

প্যারেন্টিংয়ের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিন

বেশিরভাগ পরিবারেরই দেখা যায় সন্তানকে খাওয়ানো, গোসল করানো, স্কুলে নেওয়া, পড়তে বসানো এরকম যাবতীয় দায়িত্ব একজন প্যারেন্টই পালন করেন যেখানে অপর প্যারেন্ট সম্পূর্ণ নিজের মতো ব্যস্ত থাকেন। এটি অনেক বড় একটি ভুল। এর জন্য আপনার সন্তান এবং সঙ্গী/সঙ্গিনী উভয়ের সাথেই আপনার একটা দূরত্ব চলে আসবে। সন্তান আপনাদের দুজনেরই, তাই দায়িত্ব গুলোও নিজেদের ভিতর ভাগাভাগি করে নেওয়া উচিত।

যেমন একজন স্কুলে নিয়ে গেলে আরেকজন নিয়ে আসলেন। এভাবে সবকিছু ঠিক করে নিন৷ পাশাপাশি ঘরের নিয়মকানুনগুলো সন্তান ঠিক মতো পালন করছে কিনা এই ব্যাপারে দুজনই সচেতন থাকা জরুরি। আর অবশ্যই এই ক্ষেত্রে কেউ কোনো রকম ছাড় দিবেন না। আর এই সবকিছু করার পাশাপাশি সন্তানদের নিয়ে উপভোগ করার জন্যও উভয়েই কিছু সময় বের করবেন। তাহলে আশা করা যায় যে সবকিছু ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে আসবে।

কম পছন্দের পিতা/মাতাকে সমর্থন দিন

সন্তান যদি আপনাকে বেশি প্রাধান্য দেয়, তাহলে তার ছোটখাটো সমস্যা বা কান্নাকাটিতে আপনি ছুটে আসবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে কিছু ক্ষেত্রে এরকম সরাসরি হস্তক্ষেপ না করাই ভালো। যেমন ধরুন আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনী আপনার সন্তানকে খাওয়াচ্ছে। কিন্তু সে চাচ্ছে আপনি তাকে খাইয়ে দিবেন, তাই সে কান্নাকাটি করছে।

এমতাবস্থায় আপনি কাছাকাছি থেকে তাকে বোঝাতে পারেন যে আজ তার অপর প্যারেন্ট খাইয়ে দিচ্ছে, কালকে আপনি খাইয়ে দিবেন। কিন্তু আবেগে পড়ে আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনীর হাত থেকে নিয়ে নিজে খাওয়ানো শুরু করবেননা।

আপনার সন্তান দ্বারা অবহেলার স্বীকার হয়ে তিনি এমনিতেই অনেক কষ্টে আছেন। তাই তার এই প্রচেষ্টাগুলোতে বাঁধা দিবেন না। উনি উনার সাধ্যমত চেষ্টা করছেন সন্তানের মন জয় করতে। উনাকে সমর্থন করুন, যাতে করে আপনাদের সন্তান উভয়কেই সমানভাবে ভালোবাসতে পারে।

সন্তানের কাছে অপর প্যারেন্ট সম্পর্কে বেশি বেশি কথা বলুন

আপনারা উভয়েই সন্তানের জন্য কষ্ট করছেন। হয়তো একেকজন একেকভাবে করছেন, কিন্তু দুজনই করছেন৷ তাই সন্তান যখন অপর প্যারেন্টের সাথে মিশতে চায় না তখন তার খারাপ লাগে। এগুলো সন্তানকে বুঝিয়ে বলুন। অবশ্যই আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনীর আড়ালে।

বিজ্ঞাপণ

সন্তানকে বোঝান যে হয়তো তার অপর প্যারেন্ট তাকে একটু বকাবকি করে, তাকে বেশি সময় দিতে পারেনা – কিন্তু এর মানে এই না যে তাকে ভালবাসেনা। তার ভালোবাসার ধরনটা ভিন্ন আপনার চেয়ে। তার ভালো গুণগুলো সম্পর্কে আপনার শিশুকে বোঝান৷ আপনাদের মধ্যে যা যা আলাদা, যা যা মিল রয়েছে সবকিছু নিয়েই কথা বলুন।

তারপর তার থেকে দুজনেরই কিছু ভালো গুণ শুনুন। এতে করে সে বুঝবে যা ভিন্নভাবে চিন্তা করলেই বা দুজনের ভাবভঙ্গি এক না হলেও দুজনই তাকে ভালোবাসে। এমনকি অন্য মানুষদের ক্ষেত্রেও সে এভাবে চিন্তা করতে শিখবে।

আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনীর অনুভূতি শুনুন

সন্তানের দেওয়া আঘাত সহ্য করা যেকোনো পিতা-মাতার জন্যই অনেক কষ্টের ব্যাপার। আপনি সন্তানের আপনাকে প্রাধান্য দেওয়া উপভোগ করলেও আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনী কিন্তু তা করছে না। তিনি হয়তো অসহায়ত্ব, অবসাদগ্রস্ত, ক্রুদ্ধ বা হিংসা বোধ করছেন। তাই তার পাশে বসে তার কথা শুনুন। শুনুন যে তিনি কেমন বোধ করছেন।

তাকে নিয়ে যাচাই-বাছাই করবেন না বা তাকে প্রশ্ন করতে যাবেন না যে তিনি এটা কেন করলেন, এটা অন্যভাবে করলে ভালো হতো ইত্যাদি ইত্যাদি। চুপচাপ শুধু তার কথা শুনুন এবং তাকে যতটা পারেন সমর্থন দিন৷

মনে রাখবেন মানুষের চাওয়া-পাওয়ার মতো ফেভারিটজমও ক্রমশই পরিবর্তনশীল। আজ শিশু আপনাকে প্রাধান্য দিচ্ছে, কালকে নাও দিতে পারে। তখন আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনীর মতো অবস্থা আপনারও হতে পারে। তাই তাকে সমর্থন দিন এবং দুজনে মিলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজুন।

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন

যদি তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসে সেক্ষেত্রে আপনি কোনো শিশু বিশেষজ্ঞ অথবা মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ নিন। তাদের কাছে সবকিছু খুলে বলুন এবং তাদের মতামত নিন। তারপর তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করুন।

ফেভারিটজম বা প্রাধান্য দেওয়া চিরকালীন কোনো বিষয় নয়, বরং খুবই সাময়িক একটি বিষয়। সময়ের সাথে সবকিছুই পরিবর্তিত হবে। আজকে গুনগুন হয়তো তার মার সাথে সময় কাটাতে চাইছেনা, আবার কালকে হয়তো তাকেই বেশি কাছে চাইবে। তাই বিষয়গুলো সম্পর্কে চিন্তার কোনোই কারণ নেই। শুধু নিজের মতো চেষ্টা চালিয়ে যান এবং অপেক্ষা করুন।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment