মা হওয়ার গল্প | দেবী মণ্ডল দিয়া

Spread the love

।।আরাধনার আরাধ্যা‌‌।।

প্রত্যেক মেয়ের জন্য মা হওয়া অনেক সৌভাগ্যের বিষয়। তবে যারা অনেক চাওয়ার পর কষ্ট করে মা হয় তাদের জন্য 270 দিন একটা বড় জার্নি। আজ আমি একটা ফুটফুটে লক্ষী মেয়ের মা তবে ঈশ্বর আমাকে তার অপরূপ সৃষ্টির লালন-পালনের দায়িত্ব সহজেই দেননি। তার জন্য চার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।

বিজ্ঞাপণ

আমার যখন বিয়ে হয় তখন বয়স অলরেডি তিরিশের কোঠায় বিয়ের 10 মাস পর কনসিভ করল তখন আমার মাস্টার্স পরীক্ষা চলছে চারটা পরীক্ষা দিলাম দুই ঘণ্টার বাস জার্নি করে। সেই জন্য কিনা জানিনা দেড় মাসের সময় হালকা ব্লাড যেতে শুরু করল ডাক্তার পরামর্শ দিলো bed rest এবং ঔষধ পত্র চিকিৎসা শুরু করলাম।

এক সপ্তাহ পর USG করলাম তখন ও অল্প অল্প ব্লিডিং হচ্ছে বাচ্চার হার্টবিট আসার সময় হয়নি তাই ডাক্তার দুই সপ্তাহ পর আবার আল্ট্রাসনো করতে বলল। কিন্তু আমি অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। ব্লিডিং হচ্ছিল অল্প তাই দশ দিন পর আমি USG করি তখন রিপোর্টে আসে ইনকম্পলিট এবোরশন ডাক্তার d&c করতে বলল।

ওইদিনই ভর্তি হলাম D&C করা হলো ডাক্তার বলল 6মাস বাচ্চা নেয়া যাবে না। এই ছয় মাস অপেক্ষা করে বাচ্চা নেয়ার জন্য ডাক্তারের কাছে গেলাম। চেষ্টা করছি কিন্তু কনসিভ করছেনা।মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে তখন মনে হচ্ছিল আমি বোধ হয় এ জীবনে আর মা হতে পারব না।

পাঁচ ছ জন ডাক্তার দেখানো হয়ে গেছে প্রতিমাসে ঔষধ ইনজেকসন চলছে এভাবে 17 মাস কাটলো অবশেষে প্রেগনেন্সি টেস্ট পজিটিভ।শুরু হল আমার নতুন পথচলা। এবারও ডাক্তারের পরামর্শমতো পূর্ণ বিশ্রামে থাকলাম সাথে ইঞ্জেকশন প্রলুটন,মাইক্রোজেস্ট এগুলো চলল।

তিন মাস পর USG করলাম। সেই দিনটি ছিল আমার জন্য বিভীষিকাময় একটি দিন। ভাবলে এখনো আমি শিউরে উঠি। এক মুহূর্তে তিন মাসের সব স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা আনন্দ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। ডাক্তার বলল এটা missed abortion fetal demise at 7 weeks অর্থাৎ LMP অনুযায়ী এখন আমার 12 সপ্তাহ হবার কথা কিন্তু সাত সপ্তাহের পর বাচ্চার গ্রোথ বন্ধ হয়ে গেছে অথচ আমার শারীরিক কোনো লক্ষণ নেই, পেটে ব্যথা নেই, ব্লিডিং নেই কিছু না।

আমি যদি এখন USG করতে না আসতাম জানতেই পারতাম না পাঁচ সপ্তাহ আগেই আমার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে এটা এক ধরনের সাইলেন্ট কিলার। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রনায় কেঁদে উঠলাম আর তখন আমাকে শান্তনা তো দূরের কথা ডাক্তার বলল কাঁদছেন কেন থামেন এমন অনেকেরই হয় আপনি বাইরে গিয়ে বসেন।

আমি হতবাক হয়ে গেলাম।বাইরে আমার স্বামী অপেক্ষা করছে তাকে আমি কি বলবো সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।বাইরে এসে চিত্কার করে কাঁদছি দুইবার অ্যাবরশনের ধাক্কা আমি নিতে পারছি না।দুইটা পরিবারের সদস্যদের মুখগুলো ভাসছিল চোখের সামনে যাদের আমি তিনমাস ধরে স্বপ্ন দেখিয়েছি আর ভাবছিলাম ঈশ্বরের কাছে না জানি আর কত পাপ জমা আছে আমার যার শাস্তি এভাবে পেতে হচ্ছে।

বিজ্ঞাপণ

এই রিপোর্ট আমি মানতে পারছিলাম না তাই বাড়ি এসে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করলাম কোন ব্লিডিং শুরু হয় কিনা।কোনো লক্ষণ নেই তখন আবার অন্য জায়গায় আল্ট্রাসনো করলাম। ডাক্তার বলল হার্টবিট নেই তবে চাইলে আপনি অপেক্ষা করতে পারেন। আমি আরো এক সপ্তাহ অপেক্ষা করলাম তখন একটু একটু ব্লিডিং শুরু হয়েছে মাত্র।

এক সপ্তাহ পর আবার অন্য জায়গায় USG করলাম তখন ডাক্তার বলল এটা incomplete abortion হয়ে গেছে।আপনি D&C করে ফেলেন কিন্তু আমি D&C করতে ইচ্ছুক ছিলাম না কারণ তাহলে আবার ছয় মাস আমি বাচ্চা নিতে পারবো না।তাই আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবরশন পিল খেলাম এবং ভালোভাবেই এবরশন কমপ্লিট হলো।

15 দিন পর আরেকটা আল্ট্রাসনো করে দেখলাম Uterus ঠিক আছে এবং একমাস পর রেগুলার পিরিয়ড হলো।দুই মাস পিরিয়ড হবার পর আবার চেষ্টা শুরু করলাম এবং অবিশ্বাস্যভাবে সেই মাসেই কনসিভ করল।

আবার স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছি। সাথে সাথে গেলাম ঢাকায় ডাক্তার ফরিদা ম্যাডামের কাছে তার ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ইনজেকশন, ঔষধ,পূর্ণ বিশ্রাম,টেস্ট, চেকআপ করলাম দুই মাস পর USG করতে বলল হার্টবিট আসে কিনা দেখার জন্য।

আলট্রাসনো করলাম সাত সপ্তাহ 5 দিনে। হার্টবিট প্রেজেন্ট আসলো সেদিন আনন্দে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। শুধুমাত্র বাচ্চার হার্টবিট এসেছে শুনে সে কি আনন্দ আমার। ফোনে সবাইকে খবরটা জানিয়ে ছিলাম আর কেঁদেছিলাম।

ডাক্তার আমাকে অপশন দিয়েছিল চাকরি বড় নাকি বাচ্চা বড়, আমি বলেছিলাম যে কোন উপায়ে আমি মা হতে চাই। ডাক্তার বলেছিল তাহলে এই 9 মাস আমার কাছাকাছি আপনাকে থাকতে হবে আমি সরকারি চাকরিজীবী সত্ত্বেও নয় মাস বিকল্প ব্যবস্থায় ঢাকা থেকে যাই।

প্রথম দেড় মাস পার হওয়ার পর থেকে প্রচণ্ড বমি শুরু হলো দিনে 20‌/ 22 বার বমি হয়।জল খেলে তাও বমি হয়ে যায় ঔষধ খেয়ে রাখতে পারছিলাম না।এক মাসে তিন কেজি ওজন কমে গেল।ডাক্তার এক সপ্তাহ শুধু সেলাইন দিয়ে রাখে। তখন মনে হতো আমি বোধহয় আর বাঁচবো না,শরীরে কোন শক্তি ছিলনা মাথা ঘুরত বমি আসত সমস্ত শরীর ভরে গেল এলার্জিতে প্রায় 24 ঘন্টাই শুয়ে থাকতাম।

যেদিন তিন মাস পূর্ণ হল বমি বন্ধ হয়ে গেল খেতে শুরু করলাম ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে গেলাম এরপর রেগুলার চেকআপ আর অপেক্ষা। অবশেষে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত সুন্দর দিন 27 অক্টোবর 2017 ঢাকার মনোয়ারা হাসপাতালের OT তে সিজারিয়ান সেকশন এর মাধ্যমে দুই কেজি 800 গ্রাম ওজন নিয়ে চিৎকার দিয়ে জানিয়ে দিল সে এসে গেছে, ফুটফুটে সুস্থ সুন্দর একটি কন্যা সন্তান।যার মুখের দিকে তাকিয়ে সব না পাওয়া ভুলে যাই,বাঁচার অর্থ খুঁজে পাই, যার মুখে আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডাক শুনতে পাই সে আমার অনেক আরাধনার আরাধ্যা। ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ।কৃতজ্ঞ ঈশ্বরের কাছে আমাকে শেষ পর্যন্ত মা হবার সৌভাগ্য দানের জন্য। আর প্রার্থনা জানাই পৃথিবীর সকল মেয়ে যেন মা ডাক শোনার সৌভাগ্য লাভ করে।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment