পেরিনিয়ামে প্রচুর ব্যাথা হচ্ছে, এর কারণ কি?
ভ্যাজাইনাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে, পেরিনিয়ামের (যোনি এবং পায়ুপথের মধ্যকার চামড়া এবং মাংসপেশি) উপর প্রচুর চাপ পড়ে। মূলত নরমাল ডেলিভারিতে শিশুর মাথা বের করার সময় পর্যাপ্ত যায়গা করে দিতেই পেরিনিয়ামের উপর এই চাপটা পড়ে।
পেরিনিয়ামে তেমন কোন প্রকার কাটাছেঁড়া ছাড়াই যদি ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি হয়ে যায় তবুও বেশ কয়েকদিন পেরিনিয়ামে প্রচুর ব্যাথা করবে এবং পুরো যায়গাটা বেশ নরম ও স্পর্শকাতর হয়ে যাবে। তবে ডেলিভারির এক সপ্তাহের মধ্যেই এটা ঠিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অনেকের ক্ষেত্রে তো দুই তিন দিনেই ভালো হয়ে যায়।
কিন্তু ডেলিভারি করার সময় আপনার পেরিনিয়াম ছিড়ে বা কেটে যেতে পারে অথবা আপনার ডাক্তার হয়তো এপিসিওটোমি করাতে বলতে পারেন৷
এপিসিওটোমি হলো একটি সার্জিকাল প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ডেলিভারির সময় শিশুর মাথা বেরিয়ে আসাটা দ্রুত করতে বেরিয়ে আসার রাস্তাটা কিছুটা কেটে বড় করা হয়। যদি আপনার এপিসিওটোমি করা হয় কিংবা কোন কারণে পেরিনিয়াম ছিড়ে কেটে যায়, তাহলে সে ঘা সারতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।
[ আরও পড়ুনঃ স্বাভাবিক প্রসবে যৌনাঙ্গ ও আশপাশ ছিঁড়ে যাওয়া বা পেরিনিয়াল টিয়ার (Perineal tears) ]
কাটাছেঁড়া সারতে কতদিন লাগতে পারে?
সেড়ে উঠার ব্যাপারটি একেক জনের একেক রকম। সাধারণভাবে বলা যায়, কাটা যত গভীর হবে, সেরে উঠতে সময়ও তত বেশি লাগবে। ছোট কোন ফার্স্ট ডিগ্রির কাটাছেঁড়া, যা শুধু পেরিনিয়ামের ত্বকেই জখম করে (মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না), তেমন কাটাছেঁড়ার ক্ষেত্রে সেলাইয়ের প্রয়োজন হয় না। এগুলো দুই তিন দিন কিছুটা ব্যাথা এবং অস্বস্তি তৈরি করে এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায়।
এপিসিওটোমি করা হলে কিংবা সেকেন্ড ডিগ্রির কাটাছেঁড়া যেখানে পেরিনিয়ামের ত্বক এবং মাংসপেশি দুই-ই ক্ষত হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে অবশ্যই সেলাইয়ের প্রয়োজন আছে যা সারতে আনুমানিক দুই তিন সপ্তাহ লেগে যায়। উল্লেখ্য, সেলাই আপনা আপনিই মিলিয়ে যাবে। কিছু কিছু মায়েদের সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও ব্যাথা হতে পারে, তবে অন্যদের ব্যাথা না থাকলেও অস্বস্তিটা ১ মাস পর্যন্ত থাকতে পারে।
থার্ড এবং ফোর্থ ডিগ্রির কাটার (অনেক গভীর কাটা যা পায়ুপথ পর্যন্তও চলে যেতে পারে) ক্ষেত্রে, ব্যাথা কিংবা অস্বস্তি থেকে সেরে উঠতে এক মাস বা এর চেয়ে বেশি সময় লেগে যেতে পারে। যে কারোরই এ জাতীয় কাটা ছেড়া হতে পারে, তবে যারা এপিসিওটোমি করান, তাদের ক্ষেত্রে এ জাতীয় কাটার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
এমতাবস্থায়, শিশু জন্মের পর প্রথম কয়েকদিন প্রস্রাব কিংবা পায়খানা করতে আপনার বেশ সমস্যাই হবে। এমনকি কয়েক মাস কিংবা বছর পর্যন্ত আপনি গ্যাস কিংবা পায়খানার চাপ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারেন।
আরও পড়ুনঃ
ব্যাথা থেকে মুক্তি পেতে এবং পুরো জায়গাটা সারিয়ে তুলতে আমি কি করতে পারি?
ব্যাথা কিংবা অস্বস্তি থেকে সেড়ে উঠতে কিভাবে নিজের যত্ন নিতে হবে সে ব্যাপারে ডাক্তার আপনাকে বিশদ ধারণা দেবেন। যার মধ্যে নিচের পয়েন্টগুলোও থাকতে পারে:
শিশুর জন্ম হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর, ঠান্ডা একটা আইসপ্যাক পাতলা কাপড়ে মুড়ে আপনার পেরিনিয়ামে চেপে রাখতে পারেন। এর ফলে ফোলা ও অস্বস্তি দুই-ই কমবে। পরবর্তী ১২ ঘন্টা পর্যন্ত কয়েক ঘন্টা পর পর নতুন আইসপ্যাক দিয়ে সেক দিতে থাকলে বেশ আরাম লাগবে।
ব্যাথা কমাতে ব্যাথানাশক ঔষধ যেমন এসিটামিনোফেন বা ইবোপ্রোফেন গ্রহণ করতে পারেন। শিশুকে বুকের দুধ পান করিয়ে থাকলে অবশ্যই এসপিরিন জাতীয় ঔষধ খাওয়া যাবে না। আপনার কাটার ক্ষত যদি অনেক গভীর হয়, তাহলে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ব্যাথানাশক ঔষধ খান।
চেতনানাশক স্প্রে ব্যাবহার করার কথা ভাবতে পারেন। অনেক নারীরাই এটা ব্যাবহার করতে চায়, অনেক হাসপাতাল থেকেও এটা লিখে দেওয়া হয়। যদিও ছোট খাটো কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, ব্যাথা নিরাময়ে এটা অত একটা উপকারে আসে না।
প্রত্যেকবার টয়লেট ব্যাবহারের পর সেনিট্যারি ন্যাপকিন পাল্টে নিন।
প্রস্রাব করার সময় একটি বোতলে উষ্ণ গরম পানি নিয়ে পেরিনিয়ামের উপর ধীরে ধীরে ঢালতে পারেন। এর ফলে প্রস্রাব যখন কাটা বা ছেঁড়া ত্বকের সংস্পর্শে আসবে, জ্বালাপোড়া কিছুটা কম অনুভব হবে। আবার প্রস্রাব শেষে একইভাবে নিম্নাংশ পরিষ্কার করে ফেলুন।
পায়ুপথ থেকে কোন জীবাণু যাতে পেরিনিয়ামের ক্ষতকে ছুতে না পারে, সেজন্যে সবসময় শরীরের নিম্নাংশ শুষ্ক রাখুন। শুকানোর সময় সবসময় সামনের দিক থেকে পেছনের দিকে মুছুন।
পেরিনিয়ামে যদি ব্যাথা থাকে তাহলে দীর্ঘসময় ধরে বসে থাকবেন না।
শিশুর জন্মের ২৪ ঘন্টা পর, পেরিনিয়ামে পর্যাপ্ত পরিমাণ উষ্ণতা দিতে হালকা গরম পানিতে পেরিনিয়াম ডুবিয়ে রাখতে পারেন। এটা করার জন্যে মোটেও বাথটাবের প্রয়োজন নেই। বিশেষ এক ধরণের বোল পাওয়া যায় যা টয়লেটে উপরে বসিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে । সেখানে গরম পানি নিয়ে টয়লেটে বসার মতো করেই সেই বোলের উপর বসুন এবং নিশ্চিত হোন যাতে আপনার পেরিনিয়াম পানির ভিতর ডুবে থাকে। এভাবে একবারে ২০ মিনিট ধরে ডুবিয়ে রাখুন এবং দিনে কমপক্ষে তিন বার এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করুন। হাসপাতালের আশেপাশের বড় ঔষধের দোকান গুলোতে এই রকম ‘সিটজ বাথ’ বোল পাওয়া যায়।
ক্ষতস্থানে যত বেশি সম্ভব বাতাস লাগার সুযোগ করে দিন, এতে ক্ষত তাড়াতাড়ি শুকাবে। কিন্তু আপনার যদি লোচিয়া (প্রসব পরবর্তী স্রাব) চলতে থাকে, তাহলে বাতাস লাগার সুযোগ করে দেওয়াটা হয়তো আপনার জন্যে কিছুটা কঠিন হতে পারে। সেক্ষেত্রে পুরনো কোন তোয়ালে বা ওয়ান টাইম ডিসপোজেবল তোয়ালের উপর শুয়ে কাজটি করতে পারেন।
শিশুর জন্মের পরের দিন থেকেই কেগ্যাল ব্যায়াম শুরু করে দিতে পারেন। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে, মাংসপেশি আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে এবং দ্রুত ক্ষত সারতে এটি বেশ সাহায্য করবে। এই ব্যায়ামের সময় আপনি যখন পেলভিক ফ্লোর মাসলগুলো কন্ট্রাক্ট করবেন তখন তা ক্ষতকে সাপোর্ট করে ধরে রাখবে যার ফলে আপনি যখন হাটাচলা করবেন, সেলাইয়ে টান লাগার অনুভূতি কম অনুভব হবে।
প্রচুর পরিমাণ বিশ্রাম নিন এবং অপ্রয়োজনীয় কাজে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। নিজে তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার জন্যে এবং ঠিকভাবে শিশুর দেখভাল করার জন্যে শক্তি সঞ্চয় করে রাখুন।
আপনার কাটা যদি এতই গভীর হয় যে, তা আপনার পায়ুপথের এনাল স্ফিংটারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে (থার্ড বা ফোর্থ ডিগ্রির কাটা), তাহলে অবশ্যই প্রচুর পরিমাণ পানি পান করতে হবে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে প্রচুর ফাইবার যুক্ত খাবার খেতে হবে। ডেলিভারির পর থেকে শুরু করে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত পায়খানা নরম রাখার ঔষধ খেতে হবে।
পায়ুপথের মাধ্যমে কিছু প্রবেশ করাতে হয়, এমন কোন চিকিৎসা ব্যাবস্থা যেমন সাপোজিটর, এনিমাস প্রভৃতি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন।
কখন চিন্তিত হওয়া উচিত এবং ডাক্তারকে জানানো উচিত?
আপনার পেরিনিয়ামের ব্যাথা কিংবা ফুলে থাকা যদি ধীরে ধীরে কমার বদলে ক্রমাগত আরো বাড়তে থাকে এবং আপনি যদি দুদন্ডও স্বস্তিতে না থাকতে পারেন তাহলে অবশ্যই ডাক্তারকে তা জানান। ডাক্তার হয়তো আপনাকে কোন ইউরোগাইনোকোলোজিস্ট অথবা পেলভিক রিহ্যাব ফিজিক্যাল থেরাপিস্টের কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দেবেন।
এছাড়া আপনার যদি জ্বর উঠে কিংবা যোনিস্রাব থেকে বা এপিসিওটোমির ক্ষত থেকে বাজে দুর্গন্ধ আসে – তাহলেও অবশ্যই সাথে সাথে ডাক্তারকে জানান। এগুলো ইনফেকশনের লক্ষণ।
প্রসবের পর কবে নাগাদ পুনরায় যৌন মিলন শুরু করতে পারবো?
ডেলিভারির সময় যদি আপনার কোন প্রকার সেলাই না লাগে, তাহলে আপনি যদি আগ্রহী হন, সেক্ষেত্রে কয়েক সপ্তাহ পরেই মিলনে আবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। তবে অবশ্যই সেটা হতে হবে যোনীস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর।
আপনি যদি এপিসিওটোমি করান অথবা ছিঁড়ে যায়, তাহলে পুরো সুস্থ হতে আপনার চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। তখন আপনার ডাক্তারের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পর, তবেই মিলনে আবদ্ধ হওয়ার কথা ভাবুন।
আবার আপনার ক্ষত যদি থার্ড অথবা ফোর্থ ডিগ্রীর হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই ডাক্তার কর্তৃক পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ করে অনুমতি পেয়ে তবেই যৌন মিলনে আবদ্ধ হওয়া উচিত।
পুনরায় যৌন মিলন শুরু করার সময় সবকিছু একদম ঠিক আগের মতো হবে না। পুনরায় যৌন মিলন করার সময়, প্রথম দিকে আপনার নিম্নাংশ বেশ কোমল এবং আটসাট মনে হতে পারে। এই অস্বস্তি কাটিয়ে উঠতে দুজনেই স্থির হোন, আপনার সঙ্গীকে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সময় দিন এবং মিলনের সময় পানিযুক্ত লুব্রিকেন্ট ব্যাবহার করুন।
শিশুকে বুকের দুধ পান করানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে এই কথাগুলো আপনার জন্যে বেশ জরুরি। শিশুকে বুকের দুধ পান করালে শরীরে এস্ট্রোজেনের পরিমাণ কমতে থাকে যার ফলে যোনীর শুষ্কভাব বেড়ে যায়। তাই শিশুকে যতদিন বুকের দুধ পান করাবেন, যৌন মিলনের সময় লুব্রিকেন্ট ব্যাবহারের কথা চিন্তা করলেই ভালো হয়। আপনার ডাক্তার হয়তো আপনাকে এস্ট্রোজেনযুক্ত ভ্যাজাইনাল প্রোডাক্ট ব্যাবহারের কথা বলতে পারেন।
এতসব কিছু বিবেচনা করার পরও যদি যৌন মিলন করার সময় অস্বস্তি লাগে, তাহলে আরো কিছুদিন সময় নিতে পারেন। এই সময়ের মধ্যে আপনার সঙ্গীর সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক গাঢ় করায় মনযোগ দিতে পারেন, ক্ষতি কি? তবে শিশু জন্ম দেওয়ার কয়েক মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও যদি ব্যাথা না কমে, তাহলে অবশ্যই এর জন্যে চিকিৎসার করাতে হবে।
ডেলিভারির পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত আপনার যৌনমিলনে আগ্রহ কমে যাওয়া কিংবা একদম না থাকাটা খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তাই এই সময়টাতে শিশুর পাশাপাশি শিশুর বাবাকেও কিছু সময় দিন, তাকে আপনার ব্যাপারটা খোলাখুলিই বলুন, আপনাকে বোঝার মতো জায়গা করে দিন। এবং অবশ্যই ধীরে ধীরে কিছুদিন পরেই যে তার এটা একদম দূর হয়ে যাবে, সেটা বলতেও ভুলবেন না।
[ আরও পড়ুনঃ প্রসব পরবর্তী সহবাস । যে বিষয়গুলো জেনে রাখা উচিত ]
সবার জন্য শুভকামনা।