প্রযুক্তির একটি অন্যতম আবিষ্কার হলো ইলেকট্রনিক ডিভাইস। নিঃসন্দেহে ইলেকট্রনিক ডিভাইস খুবই উপকারী জিনিস। মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, আইপ্যাড, ট্যাবলেট, টেলিভিশন সব কিছুই আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সারাদিনই স্ক্রিনের সামনে বসে থাকতে চায়। অনেকে তো ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহার করতে না দিলে খেতেও চায় না। কিন্তু এগুলো সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
এই আর্টিকেলে কিভাবে আপনার সন্তান স্ক্রিনের প্রতি আসক্ত হয়,কেন এটি তার জন্য ক্ষতিকর এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় সব কিছুই বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা করবো।
কীভাবে আপনার সন্তান স্ক্রিনের প্রতি আসক্ত হয় এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব
ঢাকার গুলশানের একটি বহুতল ভবনে মারিয়া ও তার বাবা মার বসবাস। ছোট থেকেই মারিয়ার ওজন একটু কম ছিলো আর খাওয়ার প্রতি খুব অনীহা কাজ করতো। মারিয়ার বাবা মা এটি নিয়ে সব সময় চিন্তিত ছিলেন। তারা এমন একটা মাধ্যম খুঁজছিলেন যার দরুন মারিয়া ঠিক মতো খাবার খাবে এবং তার কিছুটা ওজন বাড়বে। তাছাড়া সারাদিন ঘরের কাজ করার পর মারিয়ার মাও মেয়েকে খাওয়ানোর জন্য পুরা ঘর দৌড়াতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
একদিন তিনি মারিয়াকে খাওয়ার সময় কার্টুন ছেড়ে দেন। তিনি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেন যে মারিয়া কোনো রকম বায়না ছাড়াই খাচ্ছে। তাকে নিয়ে আগের মতো পুরো ঘর দৌড়াতে হচ্ছে না, তার পিছনে পিছনে ছুটতে হচ্ছে না খাওয়ানোর জন্য। এরপর থেকে মারিয়া খাওয়ার সময় কোনো রকম কান্নাকাটি ছাড়াই খেতো, সেটা কম হোক বা বেশি।
কিন্ত সমস্যাটা হয় তখন যখন ঘরে বিদ্যুত থাকেনা বা ফোনে চার্জ থাকেনা। মারিয়া এতোটাই স্ক্রিন আসক্ত হয়ে গিয়েছিলো যে খাওয়ার সময় সামনে স্ক্রিনে কার্টুন না চললে সে খেতে চাইতোনা, কান্নাকাটি করতো, জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলতো এদিক ওদিক। তার মা বাবা বুঝতে পারেন যে সে স্ক্রিনের প্রতি ভয়াবহ রকম আসক্ত হয়ে পড়েছে।
আসলে এটি শুধু মারিয়ার বাবা মা অথবা বাংলাদেশের বাবা মাদের গল্প না, পুরো পৃথিবীর বাবা মাদেরই কাহিনী। সন্তানকে খাওয়ার সময়টায় স্ক্রিনের সামনে বসিয়ে যে ভুল করছেন তারা তা প্রথমে বুঝতে পারেন না। অল্প সময়ের কষ্ট লাঘবের জন্য ভবিষ্যতে যে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে সেটি আরো ভয়ংকর।
অফকমের একটি পরিসংখ্যান অনুসারে বর্তমানে ৫ বছর বা এর চেয়ে কম বয়সী প্রায় ৩০% শিশুর নিজস্ব কম্পিউটার বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস রয়েছে। এই পরিসংখ্যান থেকে আরো জানা যায় যে, তিন থেকে চার বছরের বাচ্চারা সপ্তাহে ১৫ ঘন্টার বেশি আর পাঁচ থেকে সাত বছরের বাচ্চারা সপ্তাহে কমপক্ষে ১৩.৫ ঘন্টার স্ক্রিনে সময় দেয়, যেখানে বিশেষজ্ঞরা ৭ ঘন্টার বেশি ব্যবহার করতে নিষেধ করেন।
খাওয়ার সময় স্ক্রিন ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস
২০১৮ সালে বিএমসি পাব্লিক হেলথ এর একটি গবেষণায় দেখা যায়, শিশুদের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাসের জন্য স্ক্রিনের অতিরিক্ত ব্যবহার দায়ী। এই গবেষণা থেকে আরো জানা যায় যে পাঁচ থেকে ছয় বছরের শিশু যারা স্ক্রিনে বেশি সময় দেই তারা শাকসবজি ফলমূল কম খায়, আর চকলেট, চিপস, জাঙ্কফুড এই জাতীয় জিনিস খেতে বেশি পছন্দ করে।
যখন তারা স্ক্রিন ব্যবহারে মগ্ন থাকে তখন তারা ধীরে ধীরে আগ্রহহীন ভাবে খেতে থাকে। স্ক্রিনের দিকে অতিরিক্ত মনোযোগ থাকার কারণে তারা কি কম খাচ্ছে না বেশি খাচ্ছে সে খেয়াল তাদের থাকে না। যার ফলে তাদের শারীরিক কার্যকলাপ ও ব্যাহত হয়। এর ফলে স্থূলতা বা ক্ষুধামন্দার মতো রোগ দেখা দিতে পারে। তাছাড়া সঠিকভাবে খাবার না চিবালে বা অমনোযোগী হয়ে গিলে ফেললে খাবার হজমে সমস্যা হয়। সেই ক্ষেত্রে বদহজমের মতো সমস্যা ও হতে পারে।
অনেক বাচ্চা খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকে অথবা না চিবিয়ে সরাসরি গিলে ফেলে। এগুলোও স্ক্রীন আসক্তির ফল, কারণ সে জানেইনা কিভাবে খাবার খেতে হয় বা খাবারকে উপভোগ করতে হয়।
এই বিষয়ে সুপরিচিত লেখক ও প্যারেন্টিং বিশেষজ্ঞ ড. লরা মার্কহাম বলেন, “খাওয়ার সময় কখনোই শিশুকে স্ক্রিন ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়। কারণ এতে করে সে কি খাচ্ছে, কি চিবাচ্ছে তা সম্পর্কে অবগত থাকে না এবং তার শরীরের প্রয়োজন মিটে গেছে কিনা সেটাও তার বুঝতে পারেনা। যখন থেকেই তার নিজ হাতে খেতে সক্ষম হয়ে ওঠে তখন থেকেই তাদের নিজে খাওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়া উচিত এবং খাওয়ার জন্য কখনোই জোর করা উচিত নয়। খিদে পেলে সে নিজেই খাওয়া শিখে নেবে।“
[ আরও পড়ুনঃ শিশুকে নিজের হাতে খাওয়া শেখানো | বেবি লেড উইনিং (baby-led weaning) ]
গুরুতর আসক্তি সৃষ্টি
গবেষণায় উঠে এসেছে ৯০% শিশুরা দুই বছর হওয়ার আগেই ইলেকট্রনিক ডিভাইস এর সাথে পরিচিত হয়ে যায়। এটি একটি ভয়ংকর তথ্য কারণ এই বয়সেই শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ সবচাইতে বেশি হয়। এ সময় ডিভাইসের ব্যবহার মস্তিস্কের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে।
খাওয়ার সময় স্ক্রিন দেখাটা অভ্যাস হয়ে গেলে এটি তাদের দীর্ঘস্থায়ী অভ্যাসে পরিণত হবে। আর দীর্ঘস্থায়ী অভ্যাস হয়ে গেলে এটি সহজে ছাড়ানো সম্ভব হবে না। তাছাড়া স্ক্রিনের অতিরিক্ত ব্যবহার তাদের জন্য ভয়াবহ নেশা হয়ে যেতে পারে, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন রকম নেতিবাচক কাজের সাথেও জড়িয়ে পড়তে পারে।
পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ কমে যাওয়া
এটি একটি কঠিন সত্য যে আধুনিক পরিবার গুলোতে সবাই একসাথে খাওয়া বিষয়টা খুব কমই দেখা যায়। শিশুরাও খাওয়ার সময় টেলিভিশন বা ইউটিউবে কার্টুন বা অন্য কিছু দেখতে দেখতে খেতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু এটি খুবই খারাপ অভ্যাস। কারণ খাবার টেবিলেই পরিবারের সবাই একসাথে হওয়া হয়, পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
এটি করা না হলে সন্তানের নিজের পরিবার সম্পর্কে খারাপ ধারণা চলে আসে। নিজের পরিবারের লোকদের সাথে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। যার কারণে কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠান বা পরিবারের সবাই একসাথে কোথাও খেতে বা ঘুরতে যেতে চাইলে তারা সেখানে অংশগ্রহণ করতে চায় না। আর করলেও নিজেদের আড়াল করে রাখতে চায়। যার ফলে ভবিষ্যতে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
খাওয়ার সময় শিশুকে কীভাবে স্ক্রিন থেকে দূরে রাখবেন
ড. এমা হাইক্রাফটের অধীনে লাফবোরো বিশ্ববিদ্যালয় এর একটি গবেষণায় জানা যায় মা বাবার প্রযুক্তি ব্যবহার এবং খাদ্যাভাস সন্তানের আচরণ কে প্রভাবিত করে। এই গবেষণা হতে সরাসরিই এটা প্রমাণিত যে সন্তানের জন্য বাবা মা রোল মডেল বা আদর্শ অনুকরণীয় হতে পারেন। এজন্য আপনার সন্তান যাতে যেকোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার ছাড়াই খেতে পারে, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব ও আপনার। আপনার সন্তানকে খাওয়ার সময় স্ক্রিন থেকে দূরে রাখার জন্য আপনি নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন :
সন্তানের জন্য রোল মডেল হোন : যেমনটা আগেও বলেছি, আপনার সন্তান সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে আপনার আচরণে। আপনি চাচ্ছেন আপনার সন্তান স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুক। তাহলে সবার আগে এটা নিশ্চিত করুন যে আপনি নিজে খাওয়ার সময় টেলিভিশনের সামনে বসছেন না বা মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে কাজ করছেন না।
শুধু আপনি নন, আপনার পুরো পরিবারেই এটি নিশ্চিত করুন যে কেউ খাওয়ার সময় স্ক্রিনের সামনে বসছে না। শিশুরা অনুকরণপ্রিয় হয়। তারা যদি দেখে যে পরিবারের কেউই খাওয়ার সময় স্ক্রিনের সামনে বসে না, তাহলে আশা করা যায় যে তারাও এমন টা করবে না।
খাওয়ার সময়টা উপভোগ্য করে তুলুন : খাওয়ার সময় চেষ্টা করুন যাতে পরিবারের সবাই একসাথে খাবার খেতে পারেন। খাওয়ার সময়টা শুধুমাত্র খাওয়া এবং কিছু পারিবারিক আলাপের জন্য। এই সময় নিজেরা সারাদিন কে কি করলেন সেই গল্প শুনুন, হাসি ঠাট্টা করুন। একটা আনন্দময় এবং উপভোগ্য পরিবেশ তৈরি করুন।
আর অবশ্যই এই গল্পে আপনার সন্তানকেও যুক্ত করুন। তার কথা শুনুন, সে সারাদিন কি করেছে, তার কোনো মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে কিনা এসব শুনুন। এতে করে আপনার সন্তানের নিজ পরিবার সম্পর্কে ভালো ধারণা হবে, পাশাপাশি সে নিজেকেও পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে গণ্য করবে। সত্যি বলতে এটা নিশ্চিত করা গেলে আর স্ক্রিন ব্যবহারের চিন্তাও আসার কথা না।
রুটিন মেনে চলুন এবং পুষ্টিকর খাবার খান : প্রতিদিন অবশ্যই নিয়মমাফিক খাওয়া দাওয়া করবেন। যেমন একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিদিন সকাল এবং বিকালের নাস্তা এবং দুপুর ও রাতের খাবার খাবে। আর খাবার মেন্যুতে পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার রাখবেন। এতে করে আপনার সন্তানের সুষম খাদ্যাভ্যাস তৈরি হবে, পাশাপাশি সে একটা নিয়মের ভেতর চলে আসবে। যার কারণে খাওয়ার সময় স্ক্রিন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের চিন্তা আসবে না তার।
সন্তানের কাছে খাবারকে উপভোগ্য করে তুলুন : আপনি আজকে কি মেন্যু তৈরি করবেন, সেই পরিকল্পনাতে আপনার সন্তানকেও অন্তর্ভুক্ত করুন। তার মতামত নিন। সে কি খেতে চাই জিজ্ঞেস করুন। তার পছন্দের অন্তত একটি খাবার মেন্যুতে রাখুন। আর যখন আপনি খাবার বানাবেন তখন তাকেও সেখানে রাখুন। তাকে বলুন আপনাকে এটা সেটা এগিয়ে দিতে।
তাছাড়া যখন আপনি বাজার করতে যাবেন বা কোনো ফলমূল কিনতে যাবেন তখন আপনার সন্তানকেও সাথে নিন। এসব কিছুর কারণে আপনার সন্তানের খাবারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হবে। তখন সে খাবার কে মন থেকে উপভোগ করতে চাইবে। এতে সে কোনো রকম স্ক্রিন ব্যবহার ছাড়াই ভালো মতো খেতে পারবে।
[আরও পড়ুনঃ কিভাবে আপনার বাচ্চাকে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে আগ্রহী করে তুলবেন ? ]
খাওয়ার জন্য আপনার সন্তানকে জোর করবেন না : বেশিরভাগ মা বাবাই সন্তান খেতে না চাইলে জোর করে খেতে বাধ্য করেন। এটি সন্তানের জন্য মোটেও ভালো কিছু নয়। সন্তানকে কোনো রকম চাপ ছাড়াই খেতে দিন।
প্যারেন্টিং বিশেষজ্ঞ ড. লরা মার্কহাম সন্তানকে খাওয়ার জন্য কোনো রকম জোর জবরদস্তি না করার পরামর্শ দিয়েছেন। সে যেটুক খেতে পারে সেটুকই খাক। তার যদি পরে ক্ষুধা লাগে, সে নিজ থেকেই চেয়ে খাবে। আজ কোনোl সবজি খেতে চাচ্ছে না, জোর করার দরকার নেই। অন্য সময় দিবেন।
এতে করে সন্তানের খাবারের প্রতি কোনো রকম বিরক্তিবোধ আসবে না। মনে রাখবেন খাবারের প্রতি উৎসাহী না হওয়া এবং বিরক্তিই কিন্তু সন্তানের খেতে না চাওয়া এবং স্ক্রীন দেখে খাওয়ার অন্যতম কারণ।
[ আরও পড়ুনঃ বাচ্চাকে জোর করে খাওয়ানোর কুফল ]
যদি আপনার সন্তান ইতিমধ্যে খাওয়ার সময় স্ক্রিন ব্যবহারে আসক্ত হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে করণীয়
মারিয়ার মতো অনেক শিশুই স্ক্রিন দেখা ছাড়া খেতে চায়না। এটি নিয়ে মা বাবারা প্রায়শই চিন্তিত থাকেন যে কিভাবে এই বদভ্যাস পরিবর্তন হবে, কি করলে তারা স্ক্রিন ছাড়াই খেতে শিখবে।
এই ব্যাপারে মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. ফ্রান্সিস বলেন, “বর্তমানে বাচ্চারা সপ্তাহে প্রায় ২০ ঘন্টার বেশি স্ক্রিনের সামনে থাকে। তাই তাদের এই আসক্তি দূর করা কিছুটা কঠিন হবে। তবে অসম্ভব না। পরিবারের সদস্যরা যখন বুঝবে যে খাওয়ার সময়টা শুধুই পারিবারিক খোশগল্পের জন্য, তখন তারা সেটা যেকোনো ভাবে সম্ভব করেই ছাড়বে। এজন্য পরিবারের বড়দের আগে এই উপলব্ধি আসতে হবে”।
সিদ্ধান্ত নিন এবং বন্ধ করুন
হঠাৎ একদিন চিন্তা করলেন আজকে থেকে আর সন্তানকে খাওয়ার সময় স্ক্রিন ব্যবহার করতে দিবেন না। সেদিন থেকেই এটা শুরু করুন। আপনার সন্তান যতোই রাগারাগি করুক, কান্নাকাটি করুক, জেদ করুক আপনি কোনো ভাবেই তাকে স্ক্রিনের সামনে বসতে দিবেন না। হয়তো একদিন দুইদিন সে খুব জেদ করবে, কিন্তু আস্তে আস্তে এটার সাথেই অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তাকে কোনো রকম বকাবকি বা শাসন করার দরকার নেই, শুধু খাওয়ার সময় স্ক্রিন দিবেন না। এই ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি :
• নিজের নীতিতে অটল থাকুন : এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে নিজের নীতিতে অটল থাকা। আপনার সন্তান যা ই করুক, আপনি কোনো ভাবেই তাকে স্ক্রিনের সামনে বসে খেতে দিবেন না। আজকে করলেন, কিন্তু কালকে কান্নাকাটি বেশি করছে দেখে আবার স্ক্রিনের সামনে বসিয়ে দিলেন, তাহলে হবে না। আপনাকে ধারাবাহিক ভাবে নিজের নীতি মেনে চলতে হবে। বাচ্চা সাময়িক কষ্ট পেলেও এটি পরবর্তীতে খুবই উপকারী হবে।
• খাবারের আগে সমস্ত স্ক্রিন সরিয়ে ফেলুন : এটি খুব জরুরি বিষয়। আপনার সন্তান যদি আশে পাশে স্ক্রিন দেখে তাহলে সে আরো বেশি জেদ করবে, আরো বেশি রাগারাগি করবে। তাই খাওয়ার সময় আশেপাশে কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা স্ক্রিন রাখবেন না। যেই রুমে টেলিভিশন সেই রুমে বাচ্চাকে খাওয়াবেন না। মোদ্দকথা আপনার সন্তানের ত্রিসীমানায় যেনো কোনো রকম স্ক্রিন না থাকে।
• আপনার শিশুকে তার পছন্দের খাবার দিন: এই সময়টা আপনার সন্তানকে নতুন কোনো শাকসবজির সাথে পরিচয় করানোর সময় নয়। এই সময় তাকে তার পছন্দের খাবার গুলো দিন। এমন নয় যে জাঙ্কফুড হতে হবে। এমন কিছু মেন্যুতে রাখুন যা সে পছন্দ করে। কোনো রকম আপত্তি ছাড়া খুশি মনেই খাবে এমন খাবার রাখুন। আশা করা যায় যে এই পদ্ধতি বেশ উপকারী হবে।
• আপনার বাচ্চাকে কিছু খেলনা দিয়ে বসিয়ে দিন: সত্যি বলতে খাওয়ার সময় খেলনা দেওয়া টা উচিত নয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আপনি এটা করতে পারেন। তাকে কিছু খেলনা দিয়ে বসিয়ে দিলেন বা সে খেলছে এমন অবস্থায় তাকে খাইয়ে দিতে পারেন। বাচ্চাদের সব সময়ই খেলনার প্রতি আলাদা ঝোঁক থাকে। তাই এই পদ্ধতিটিও বিবেচনা করে দেখতে পারেন।
খাওয়ার সময় স্ক্রিন ব্যবহার ধীরে ধীরে কমিয়ে দিন
যদি এই পদ্ধতি ঠিকঠাক মতো কাজে লাগাতে পারেন তবে আশা করা যায় যে, আপনার সন্তান অতি শীঘ্রই স্ক্রিন ছাড়াই খেতে শিখবে। এই ক্ষেত্রে আপনি একদিন তাকে তার পছন্দের খাবার গুলো বানিয়ে দিন। আর তাকে বলুন যে সেটা খাবার টেবিলে বসেই খেতে।প্রিয় খাবার দেখে সে টেবিলে বসে খেতে আপত্তি করবে না। সাধারণত যে সময় সে খাবার খায়, তার কিছুক্ষণ আগেই দিন। এভাবে কয়েকদিন চেষ্টা করুন। আস্তে আস্তে এটাকেই অভ্যাস বানিয়ে ফেলুন।
স্ক্রিন ব্যবহারের সময় নির্ধারণ করে দিন
এটি শুধু আপনার শিশু সন্তানের জন্য নয়, পরিবারের সব সদস্যদের জন্যই স্ক্রিন ব্যবহারের সময় নির্ধারণ করে দিন। পরিবারের কোনো সদস্য যেন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ওই নির্ধারিত সময় ব্যতিত স্ক্রিন ব্যবহার না করে। আপনার সন্তান যদি দেখে যে পুরো পরিবার এটা অনুসরণ করছে, তাহলে সে অনিচ্ছা থাকলেও এই নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য হবে।
আপনি আরেকটা কাজ করতে পারেন যে এই পুরো ব্যাপারটা আপনার শিশু সন্তানকে দেখাশোনার দায়িত্ব দিতে পারেন। এতে করে সে নিজেও নির্ধারিত সময় ছাড়া স্ক্রিন ব্যবহার করবে না, পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করবে যে বাড়ির সবাই এই নিয়ম মেনে চলছে।
পুরস্কারের ব্যবস্থা করুন
ছোট শিশুরা সব সময়ই বিভিন্ন উপহার বা পুরস্কার পেতে পছন্দ করে। আপনি তাকে বলতে পারেন যে আজকে স্ক্রিন না দেখে খেলে তাকে কোন উপহার দেবেন বা পরের দিন কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবেন। ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে এসব ম্যাজিকের মতো কাজ করে। ধীরে ধীরে একটা সময় সে স্ক্রিন ছাড়াই খেতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
আপনার সন্তানকে নিয়মিত খেলাধূলা করতে দিন
একটা সময় ছোট বাচ্চারা ঘরের বাইরে খেলতে দিতে না দিলে কান্নাকাটি করতো। কিন্তু আজকাল প্রায় সবাই স্ক্রিন নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকে যে তাদের বাইরে খেলতে যাওয়ার সুযোগ ই হয় না। বাবা মা দের এটা নিশ্চিত করা উচিত যে তাদের সন্তান বাইরে খেলতে যাচ্ছে।
বাইরের খোলা হাওয়া, মুক্ত বাতাস আপনার সন্তানকে চাপমুক্ত এবং উৎফুল্ল রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া খেলাধূলা করলে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলাও ঠিক মতো কাজ করে। আর প্রচুর পরিশ্রমে বাচ্চারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন তাদের ক্ষুধা লেগে যায়। আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকলে তারা কোনো রকম স্ক্রিন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ছাড়া অনায়াসেই খাবে।
এই বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী আরতি রাজরত্নম বলেন, “ বাবা মা দের উচিত এটা নিশ্চিত করা যে তাদের সন্তান নিয়মিত খেলাধূলা করছে। কারণ খেলাধূলা করলে তারা ক্ষুধার্ত হবে। আর তখন কোনো রকম গ্যাজেট বা স্ক্রিন ছাড়াই খাবে তারা”। এজন্য মা বাবা দের উচিত তাদের সন্তানকে নিয়মিত খেলাধূলা করতে পাঠানো।
এসব কিছুর পাশাপাশি একটা কাজ অবশ্যই করবেন। সেটা হচ্ছে আপনার সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিন। তার কথা শুনুন, তার সাথে গল্প করুন। আপনার ছোটবেলার গল্প তার সাথে শেয়ার করুন। দেখবেন সে আর স্ক্রিনের কথা মনেই আনছে না, আপনার কথা অনুযায়ীই চলছে। এজন্য আপনার সন্তান যেন আপনার পূর্ণ মনোযোগ পায়, সেটা নিশ্চিত করুন।
মা বাবারাও মানুষ। তাদের ও বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। কখনো কখনো তাদের শরীর খারাপ থাকলে বা কোনো জরুরি কাজ থাকলে তারা হয়তো সন্তানকে দ্রুত খেয়ে নেওয়ার জন্য স্ক্রিনের সামনে বসিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এটা নিশ্চিত করবেন যে এটা শুধু ওইদিন এর জন্যই, আপনার বাচ্চা যেন এটাকে নিত্যদিনের সঙ্গী ভেবে না নেয়। আশা করছি আপনার সন্তান স্ক্রিন দেখা ছাড়াই খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলবে।
সবার জন্য শুভকামনা।