বাচ্চাকে জোর করে খাওয়ানোর কুফল

Spread the love

সব শিশুদের মধ্যে একটা সাধারণ সমস্যা দেখা যায়। সেটা হলো খাবার নিয়ে বায়নাক্কা করা! কোনো কোনো শিশু নিজের পছন্দের খাবার ছাড়া আর কিছুই খেতে চায় না। আবার কোনো শিশু সব কিছুতেই নাক সিঁটকায়। কেউ আছে খায় বটে, তবে পুরো খাবার না খেয়েই উঠে পড়ে। মোটকথা, বেশির ভাগ বাচ্চারাই খাবার নিয়ে ঝামেলা করে!

বাচ্চা কেন খেতে চায়না?

বেশির ভাগ মায়েরই অভিযোগ—বাচ্চা খেতে চায় না। কিছু কিছু রোগের কারণে শিশুদের রুচি কমে যেতে পারে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অত জটিল কিছু নয়। অনেক ক্ষেত্রেই এ বিষয়ে মা-বাবার উৎকণ্ঠা থাকে। হয়তো শিশু তার রুচি ও পরিমাণ অনুযায়ী ঠিকই খাচ্ছে, কিন্তু মা-বাবা তাতে তৃপ্ত হচ্ছেন না।

বিজ্ঞাপণ

শিশুর আসলে কোনো রোগ নেই, সমস্যাটা তার মনে। বয়স অনুযায়ী মানসিক ও শারীরিক বিকাশ অন্য বাচ্চাদের মতো হলে শিশুর খাওয়া নিয়ে মা-বাবার দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।

শিশুর প্রতি মনোযোগ কমে গেলেও সে খাওয়া কমিয়ে দিতে পারে। সে যখন দেখে যে ঠিকমতো না খেলে বা খাবার নিয়ে যন্ত্রণা করলে তাকে নিয়ে সবাই অস্থির হয়ে পড়ছে, তখন খাবার নিয়ে বায়না ধরে।

জোর করে খাওয়ানোর ফলে শিশুর মধ্যে প্রচণ্ডভাবে খাদ্য অনিহা দেখা দেয়।অনেক সময় শক্ত খাবার, অপছন্দের খাবার এবং একই খাবারের পুনরাবৃত্তি করে খাওয়ালে খাবারের প্রতি শিশুর অনীহা তৈরি হয় এবং সে খাবার দেখলে ভয় পায় বা বমি করে ফেলে।

ছোট শিশুদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় বেশ স্পর্শকাতর। খাবারের গন্ধ এবং রং যদি ভালো না হয় বাচ্চারা সে খাবার খেতে চায় না, মুখ থেকে ফেলে দেয়। অনেক সময় শরীরের জিনঘটিত কারণে কিছু কিছু খাবারের গন্ধ বা স্বাদ বাচ্চারা সহ্য করতে পারে না। এর ফলে তারা সব ধরনের খাবার খেতে চায় না, বেছে বেছে খায়।

হজম প্রক্রিয়াতে সমস্যা থাকায় অনেক বাচ্চার খিদে কম পায় এবং খাবার ইচ্ছা থাকে না। এ কারণেও অনেক বাচ্চা খাবার নিয়ে বায়না করতে পারে।যেসব শিশুদের ঘনঘন মুড পরিবর্তন হয়, তারা খাবার নিয়ে সমস্যা করে বেশি। নিজের স্বাধীন মেজাজ বোঝানোর জন্য বা বজায় রাখার জন্য অনেক শিশু খাবার নিয়ে বায়না ও জিদ করতে থাকে।

শিশুর খাবার না খেতে চাওয়ার পেছনে অনেক সময় সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার কাজ করে। যেসব বাচ্চার মা অতিরিক্ত আদর বা শাসন করে, সে বাচ্চাদের মধ্যে খাবার নিয়ে ঝামেলা করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

অনেক মা শিশুকে নিয়মমাফিক খাওয়ানোর মাঝে কান্নামাত্রই মায়ের দুধ খাওয়ান বা অন্যান্য খাবার খাওয়ান। এ অনিয়মিত খাবারের দরুন শিশুর খাবারের রুচি ও ক্ষিধা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সে খাবার খেতে অনীহা প্রকাশ করে।

কোনো কোনো বাড়িতে শিশু নিজের খাবার সময় ছাড়া অন্য সময়ও পরিবারের অন্য সদস্য বা আত্মীয়স্বজন সবার সঙ্গে খায়। আবার অনেক মা তার শিশু সাতটার সময় পেটভরে খায়নি বলে আটটার সময় তাকে আরেকবার খাবার দেন, ৯টার সময় আবার চেষ্টা করেন এবং এমনিভাবে সারা দিন ধরেই প্রচেষ্টা চলতে থাকে। এসব অভ্যাসই শিশুর খাবারের প্রতি অনিহা তৈরি করে।

তবে কিছু বাচ্চা আছে যারা, সত্যি সত্যি খায় না। বৃদ্ধিটাও ঠিকমতো হয় না। তাহলে দেখতে হবে যে বাচ্চাটি অপুষ্টির শিকার হচ্ছে কি না বা তার রক্তশূন্যতা হয়েছে কি না? না কি বাচ্চার ঘন ঘন কোনো সংক্রমণ হচ্ছে, যার জন্য খাওয়ায় রুচি কমে যাচ্ছে। যদি শিশুটির রক্তশূন্যতা থাকে, অপুষ্টি থাকে—বাচ্চাটি বসে থাকবে, খুব বেশি সচল থাকবে না। তাহলে এগুলো দেখতে হবে।

পাশাপাশি কৃমি আছে কি না দেখতে হবে। কিছু বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া, অ্যাজমা থাকতে পারে, কিংবা প্রস্রাবে সংক্রমণ আছে; তখন বাচ্চাটিকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সে যে খায় না, তার কারণ কী খুঁজতে হবে। শুধুই কি ক্ষুধামান্দ্য নাকি সঙ্গে আর কিছু রয়েছে, সেসব দেখতে হবে। দেখে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে।

বাচ্চাকে জোর করে খাওয়ানোর কুফল

গবেষণায় বলা হয়, জোর করে খাওয়ানো হলে বরং ভালোর চেয়ে মন্দটাই বেশি হতে পারে। জোর করে খাওয়ানোতে কোনো উপকার হয় না বললেই চলে।এতে শিশুর স্বাভাবিক খাওয়ার অভ্যাস বাধাগ্রস্ত হয় এবং অস্বাস্থ্যকর ওজন বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে।

বিজ্ঞাপণ

বাচ্চার নিজের যদি খাওয়ার ইচ্ছে না থাকে, সেক্ষেত্রে জোর করে লাভ নেই। বরং, জোর করে খাওয়ালে মুখের মধ্যেই অনেকসময় খাবার রেখে দেয় বাচ্চারা। সেই খাবার গলায় আটকে যাওয়ার ভয় থাকে। এমনকী, শ্বাস নিতেও অসুবিধা দেখা দিতে পারে।

জোরজবরদস্তি খাবার খাওয়ালে বাচ্চা সঠিক পুষ্টি পায় না। তাই বাচ্চা যাতে সঠিক পুষ্টি পায়, তার জন্য তাকে নিজেকে খেতে দিন ইচ্ছেমতো। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খাবার খাওয়ালে বাচ্চারা অনেকসময় বমি করে দেয়। এতে বাচ্চার শরীর খারাপ হয়ে যেতে পারে।  জোর করে খাবার খাওয়ালে বাচ্চার মনে সেই নিয়ে ভয় সৃষ্টি হতে পারে। এমনকী, এই নিয়ে কান্নাকাটি ও চিৎকার করা শুরু করতে পারে।

রোগা চেহারা মানে বাচ্চা সঠিক পুষ্টি পাচ্ছে না, গোলগাল হলে তবে তার স্বাস্থ্য ঠিকঠাক, এ ধারণা আদতে ভুল৷ বরং মোটাসোটা বাচ্চারাই ‘চাইল্ড ওবেসিটি’তে আক্রান্ত৷ ছোটবেলায় বয়সের তুলনায় অতিরিক্ত মোটা হলে বড় হয়ে হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস, স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেকটাই বেড়ে যায়৷ তাই সন্তানের যত্ন নিন ঠিকই, কিন্তু বেশি খাইয়ে মোটা করবেন না৷

প্রায়শই দেখা যায় যে বাবা মায়েরা ছেলেমেয়েদের বেশি করে খাওয়াতে চাইছেন বা ওদের জোর করছেন যাতে ওরা প্লেটে খাবার ফেলে না রাখে। বাবা মায়েরা এগুলো বাচ্চাদের ভালো চেয়েই করেন কিন্তু অসুবিধে হল এই ভাবে জোর করে খাওয়ানোর ফলে বাচ্চারা নিজেদের শরীরের প্রয়োজন এবং খিদে নিজেরাই বুঝতে পারে না।

বাচ্চারা এর ফলে খাবারকে হোমটাস্কের মত করে গিলতে শুরু করে। অথচ খুব দরকারি হচ্ছে ভালোবেসে খাবার খাওয়া, জোর করে গিলে নয়। আর এমন ভাবে জোর করে খাইয়ে গেলে ওজনও বাড়বে না আর ব্যাপারটা স্বাস্থ্যকরও নয়।

জোর করে খাবার খাওয়ালে বাচ্চার  খাবার নিয়ে ভীতি কাজ করতে পারে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে শিশুর বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশে সমস্যা হয়, কখনো বা তারা ওজন হারাতে থাকে। বারবার খাবারের জন্য তাগিদ দিলে শিশু খাবারের প্রতি অনীহা দেখাবে। খাওয়া নিয়ে একবার জোর করে খাওয়ালে পরে যখনই তাকে খাওয়াতে চাইবেন তখন সে ভয়ে আরও কম খাবে। খাওয়ার প্রতি তার কোনো উৎসাহ থাকবে না।

আরও পড়ুনঃ  শিশুর সঠিক খাদ্যাভ্যাস তৈরির ৭ টি টিপস (ছয় মাস থেকে ১৮ মাস বয়সী বাচ্চার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য)

পরিশিষ্ট

বাচ্চার খাবারের ক্ষেত্রে এসব দিক লক্ষ্য রাখার সাথে সাথে সন্তান ঠিকমতো বেড়ে উঠছে কি না, তাও নজরে রাখতে হবে। যদি দেখা যায় যে বাচ্চা সমবয়সীদের মতোই বাড়ছে, ওজনও ঠিক আছে; তাহলে বুঝতে হবে তার শরীরে পুষ্টির কোনো ঘাটতি নেই, অর্থাৎ আপনার শিশুর খাওয়াদাওয়া স্বাভাবিকই আছে।

অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যায়, বাচ্চার ওজন বয়সের তুলনায় বেশি অথচ মা-বাবার অভিযোগ—শিশুটি একদমই খায় না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মা-বাবাকে বুঝতে হবে যে শিশু যদি ঠিকঠাক না খেত, তাহলে তার ওজন বেশি হতো না। আর এরপর যদি জোর করে শিশুটিকে খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে তা শিশুটির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

যদি দেখা যায় যে বাচ্চা ঠিকঠাক বাড়ছে না, বয়সের তুলনায় ওজন অনেক কম অথবা ওজন বয়সের তুলনায় অনেক বেশি, তাহলে কোনো শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

আরও পড়ুনঃ বয়স অনুযায়ী শিশুর ওজন ও উচ্চতা বৃদ্ধির চার্ট । ০-১২ মাস

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment