লিখেছেন- Sharmin Shamon
আমাদের অনেকের মা-বাবারই ডায়াবেটিস আছে। তারা কি যে কষ্ট করেন, ডায়েট করেন, রোজ হাঁটেন। কত কি পছন্দের খাবার যে বিসর্জন দিয়ে দুটো শুকনো রুটি খেয়ে থাকেন। আর শারীরিক সমস্যার ব্যাপারে আর কি বলবো সে তো সবাই জানেন। আমার বাবা স্ট্রোক করেছিলেন শুধুমাত্র ব্লাড সুগার টানা কিছুদিন বেড়ে থাকার কারনে। আমার সুস্থ্য স্বাভাবিক, কর্ম চঞ্চল বাবাকে কখনো এমন দেখবো ভাবিনি! কিন্তু দেখতে হয়েছে!!
ডায়াবেটিসের অনেকগুলো কারনের মধ্যে একটা অন্যতম কারন হলো অতিরিক্ত ওজন বা ওভারওয়েট। কম বেশি সবাই আমরা ডায়াবেটিসকে ভয় করে চলি কিন্তু বাচ্চার বেলায় তার উল্টোটা করি। আমরা মোটা বাচ্চা পছন্দ করি। শুকনো বাচ্চা আমরা পছন্দ করিনা, আমরা মানতেই পারিনা আমাদের বাচ্চা শুকনো হবে বা থাকবে। যে করেই হোক মরিয়া থাকি বাচ্চার ওজন বাড়ানো বা সোজা কথায় মোটা বানাতে।
এটা আমাদের একার দোষ না। সমাজব্যবস্থা, আশেপাশের লোকজন আমাদের ভেতরে এটা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে যার বাচ্চা যতো গোলাগাল, মোটাসোটা সে বাচ্চা ততো সুন্দর, ততো সুস্থ্য। আর তার মা ততো ভালো বা যত্নশীল মা। কারন বাচ্চা মোটা না হলেও মাকে শুনতে হয় যে মা খাওয়ায় না, যত্ন করেনা!!
কিন্তু এই যে মোটার পিছনে আমরা ছুটছি আমরা কি জানি আমাদের চোখের সুখের জন্য, প্রতিবেশির সুখের বা ঈর্ষার জন্য আমরা নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যত জীবনের কতোবড় ক্ষতি করছি বা ভয়ঙ্কর বীজ বপন করে রাখছি??!!
আন্ডারওয়েট বা কম ওজন যতোটা না ক্ষতিকর ওভারওয়েট ( অতিরিক্ত ওজন), স্থুলতা তার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতিকর। আমি, আপনি, আমরা সবাই নিজের হাতে আমাদের বাচ্চাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে ভয়াবহ এক ভবিষ্যত ভোগান্তির দিকে তাও আদরের নামে, সৌন্দর্য্যের নাম করে।
কোথাও একটু মোটাসোটা বাচ্চা দেখলেই আমরা অস্থির হয়ে যাই তার ওজন জানার জন্য, খাবারের রুটিন জানার জন্য। তথ্য জানতে চাওয়া খারাপ কিছু নয়, তবে এটা আমরা অনেকেই জানতে চাই নিজের বাচ্চাকে মোটা বানানোর ইচ্ছা থেকে, কৌতুহল থেকে। এটা কিন্তু আমাদের নিজেদের জন্যও অনেক মানসিক চাপের।
বাচ্চারা জন্ম থেকে কিছু ফ্যাট নিয়েই জন্মে। এগুলোকে বলে বেবি ফ্যাট। ১ বছর পূর্ণ হওয়ার পর থেকে এই ফ্যাট ক্রমান্নয়ে কিছুটা কমতে থাকে। ১.৫ বছরের দিকে আরো কমে। ২ বছরের দিকে আরো অনেক বেশি কমে যায়। বলতে গেলে প্রায় থাকেইনা। আর ৩ বছর পূর্ণ হলে এই ফ্যাট একদম মিলিয়ে যায়। এটা প্রাকৃতিকভাবেই হয়। তাই এই সময়গুলোতে হঠাৎ করেই নাদুসনুদুস বাচ্চাটাকে শুকনো দেখালে আমরা ভাবী রোগা হয়ে যাচ্ছে, খাওয়া কম হচ্ছে বুঝি, খাওয়া আরো বাড়াতে হবে।
কিন্তু এটা আমরা অনেকেই জানিনা যে এই বেবি ফ্যাট চলে যাওয়া+আমাদের বাচ্চাদের একটিভিটিস এর পিছনে আসল কারন এবং এটাই স্বাভাবিক। যদি আপনার ২, ৩, ৪……বছরের বাচ্চাকে এখনো অনেক গোলগাল, মোটাসোটা দেখতে লাগে, দয়া করে ডাক্তারের সাথে আলাপ করবেন, ওর ওয়েট চেক করে দেখতে বলবেন সে ওভারওয়েট কিনা!! অনেক বাচ্চাকে দেখামাত্রই বুঝি যে ওরা ওভারওয়েট কিন্তু তাদের মায়েদের দেখি খাওয়া নিয়ে খুব টেনশন করছে, জানতে চায় বাচ্চাকে আরো কি কি খাওয়ানো যায়।
আমি মেয়েকে নিয়ে এখানে লাইব্রেরি বা পার্কে গিয়ে যতো বাচ্চা দেখেছি বিশেষ করে ২ বছর+ বয়সী প্রায় সব বাচ্চা একদম পাতলা, টিঙটিঙে, অথচ কি শক্তিশালী, কি দূর্দান্ত সব খেলা করে বেড়ায় পার্কে। যাদের দেখলে আমাদের দেশের মানুষেরা হয়তো বলতো অপুষ্টিতে ভোগা বাচ্চা, মা মনে হয় খাওয়ায় না। আর সেই মায়েরা হয়তো ছুটতো ডাক্তারের কাছে রুচি বাড়ানোর ওষুধ আনতে!!
এখানে যখন কোন বাচ্চা ওভারওয়েট হয় তখন ডাক্তার তাকে ডায়েটিশিয়ানের কাছে রেফার করে। বাচ্চার জন্য খাদ্যতালিকা করে দিয়ে তা ধরে খাওয়াতে বলে। আর একটা খুব সহজ সূত্র হলো, ওজন তখনই বাড়ে যখন ক্যালরি বার্ন করার চেয়ে গ্রহন করা হয় বেশি। আর একটা বাচ্চা কিন্তু সারাদিনই ক্যালরী বার্ণ করতেই থাকে যেহেতু ওরা বিরামহীনভাবে ছুটাছুটি করে৷ তাহলে একবার ভেবে দেখুন আমরা প্রয়োজনের চেয়ে কতোট বেশি খাওয়ালে বাচ্চা অতিরিক্ত ওজন লাভ করে!! খাওয়া ছাড়াও কিছু মেডিকেল কন্ডিশন আছে যাতেও বাচ্চা স্থুলো হয়। আমি সেগুলো নিয়ে বলছিনা, যাদের আমরা হাতে ধরে মোটা বানাই তাদের কথাই বলছি৷ আমার মেয়ের ডাক্তার আমাকে সবসময় বলেছে যে তোমার বাচ্চা যতোটা খেতে পারবে বলে মনে করো প্লেটে তারচেয়েও কম খাবার নাও। কারন তার পাকস্থলী তোমার ধারনার চেয়েও ছোট।
সবশেষে আমার আম্মার একটা কথা দিয়ে শেষ করবো। আমার আম্মা বলেন পেট হলো রাবারের মতো, যতো খায় ততোই জায়গা বাড়ে৷ এটা কিন্তু সত্য৷ উন্নত বিশ্বে অনেকেই যখন আর ডায়েট করে আর ওজন কমাতে পারেনা, তখন অপারেশনের মাধ্যমে পাকস্থলী কেটে ছোট করে। অতিরিক্ত ওজন ১০১ টি রোগের কারন!!! আমাদের শুকনো বাচ্চা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে বরং মোটা বাচ্চা নিয়ে দুশ্চিন্তা করা দরকার।
সবার জন্য শুভকামনা।
অসাধারণ লিখেছেন ভাইয়া। আমি বরাবরই আপনার সাইট ফলো করি এবং নিত্য নতুন কিছু শিখতে পারি। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ। তবে এই লেখাটি আমাদেরই পাঠক অন্য একজনে মায়ের।