টাইম আউট (Time Out) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিশুকে শৃঙ্খলা শেখানোর উপায়

Spread the love

শিশুর আচার আচরণ যখন হঠাৎ করে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং মা-বাবার ধৈর্য্য পরীক্ষা করতে শুরু করে, তখন বেশীরভাগ মা-বাবা নিজেরাই ‘টাইম আউট’ (Time Out) প্রক্রিয়া আবিষ্কার করে ফেলেন।

ধরা যাক, একজন মা তার শিশুকে মানা করলেন যাতে সে তার ভাইকে না মারে। কিন্তু শিশু তো কথা শুনবেই না। সে বারবারই মারছে, সুযোগ পেলেই মারছে, মেরেই যাচ্ছে। দু-একবার চোখ রাঙানিতেও কাজ হচ্ছে না। এমনকি কোন কারণ ছাড়াই হাসতে হাসতে মারছে।

বিজ্ঞাপণ

এমতাবস্থায়, এই ব্যবহারটা যে গ্রহণযোগ্য না, এটা শিশুকে বোঝানোর জন্যে অনেক মা বাবাই শিশুকে ঘরের নির্দিষ্ট একটি যায়গায় কিছুক্ষণের জন্যে চুপচাপ বসিয়ে রাখেন এবং বলে দেন আগামী ২/৩ মিনিটের জন্যে তুমি এখানে এভাবে বসে থাকবে। আর এর মাধ্যমে ঘরেই শিশুর জন্যে ‘টাইম আউট’ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।

অবশ্য শিশুর ২ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে এই প্রক্রিয়াটি তার সাথে সিরিয়াসলি প্রয়োগ করার দরকার নেই। ২ বছর বয়সী শিশুরা কোন কিছু ঘটার কারণ এবং প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে বুঝতে শিখে। আর এর কারণেই এই বয়সে ‘টাইম আউট’ প্রক্রিয়াটি (ঠিকঠাক মতো প্রয়োগ করতে পারলে) শিশুর উপর বেশী প্রভাব ফেলে। এবং এর পাশাপাশি শিশুর মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা এবং সীদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও (উদাহরণস্বরূপ – শিশুর ‘টাইম আউট’ চলনরত অবস্থায় সে কি চুপচাপ বসে থাকবে নাকি উঠে চলে যাবে) বিকাশ পায়।

শিশুর দুই বছর বয়স হওয়ার আগে শিশুর হাত থেকে অন্য কোন বাচ্চা কিংবা ঘরের জিনিসপত্র একটু বাঁচিয়ে রাখতে উঁচু কোন চেয়ারে বা উঁচু কোন জায়গায় বসিয়ে রাখতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে শিশুর এটা বোঝার ক্ষমতা খুব একটা থাকে না যে সে আসলে কি করেছে যার শাস্তিস্বরূপ তাকে এখানে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আর বার বার প্রয়োগ করেও এ প্রক্রিয়া ঠিকঠাক কাজ না করায় অভিভাবকেরাও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন।

এখন আমরা দেখে নেব কিভাবে সঠিক উপায়ে ও পদক্ষেপের মাধ্যমে ‘টাইম আউট’ প্রক্রিয়াটি প্রয়োগ করা যায় এবং এর থেকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ফলটা বের করা যায়।

টাইম আউটের জন্য বসার জায়গাটি কেমন হবে?

বসার জায়গা নির্বাচন করা এই প্রক্রিয়াটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ন বিষয়। টাইম আউটের মূল উদ্দেশ্য নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা শেখানো, শিশুকে নিজের আবেগ এবং ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা শেখানো। এমন যায়গায়, যেখানে শিশু একা থাকবে এবং তার মনযোগ নষ্ট হবে না; এমন যায়গায়ই নির্বাচন করা উচিত।

আপনি যদি বাসার ড্রয়িং রুমে টেলিভিশনের সামনে কিংবা শিশুর খেলার রুমে যেখানে আরো ছোট ছোট বাচ্চারা খেলছে, সেখানে শিশুকে বসিয়ে রাখেন, তাহলে তার মনযোগ তো সরে যাবেই, উল্টো সে হয়তো সময়টাকে উপভোগ করা শুরু করে দিতে পারে। সে এখানে কেন বসে আছে, তা চিন্তা না করে যদি তার মাথায় যদি মটু-পাতলু ঘুরে বেড়ায়, তাহলে ‘টাইম আউট’ প্রয়োগ করে কোন লাভই নেই।

এছাড়াও এমন কোন জায়গা পছন্দ করা উচিত না যেখান থেকে শিশু আপনার কিংবা পরিবারের অন্য কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে৷ ‘টাইম আউট’এর ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা শিশুর অন্যতম চিন্তার সহায়ক হয়, তা হলো আপনার কিংবা অন্য কারো মনযোগ আকর্ষণ করতে না পারা৷ একটা নির্দিষ্ট সময় শিশু আপনার সান্যিধ্য পাচ্ছে না, এটা যেমন পুরোপুরি শাস্তিস্বরূপ হওয়া উচিত নয়, পাশাপাশি পুরোপুরি শিশুর অনুকূলেও হওয়া উচিত নয়।

এই প্রক্রিয়াটি শুধু যে শিশুর জন্যে উপকারী, তা কিন্তু নয়। এটি সাথে সাথে আপনার তথা অভিভাবকদের জন্যেও উপকারী। এই নির্দিষ্ট সময়ে শিশুর কাছ থেকে দুরত্ব আপনার ধৈর্য্য ফিরিয়ে আনবে এবং শিশুর ব্যাবহারের কারণে আপনার ভেতর জন্ম নেওয়া হতাশাগুলোও দূর করবে।

যদি শিশুর ‘সাময়িক বিরতির’ সময়টাতে আপনি শিশুর সামনে বসে থাকেন, আপনি তাকে একটু বকা দেওয়া কিংবা দু’কলম লেকচার দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারবেন না। কিন্তু এটা হতে দেওয়া যাবে না৷ এর মাধ্যমে শিশু ‘টাইম আউট’এর প্রকৃত উপকার থেকে বঞ্চিত হবে।

‘টাইম আউট’এর জন্যে স্থানটি অবশ্যই শিশুর জন্যে নিরাপদ হতে হবে এবং তার দৃষ্টি সীমানায় এমন কিছু রাখা যাবে না, যার দ্বারা তার মনযোগ ব্যাহত হতে পারে। এই সময় আপনিও শিশুর দৃষ্টিসীমানার বাইরে থাকবেন এমনভাবে যাতে আপনি তাকে দেখতে পারেন, কি করছে না করছে খেয়াল করতে পারেন। ‘টাইম আউট’এর জন্যে বসার যায়গাটা এতটা আরামদায়কও হওয়া উচিত নয়। ডাইনিং রুমের কোন কোণায় কিংবা একটু কম ব্যবহার করা হয় এমন রুমে ছোট টুল কিংবা শিশুর ছোট প্লাস্টিক চেয়ারে তাকে বসানো যায়।

কখন ‘টাইম আউট’ প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা উচিত?

শিশুকে শান্ত করার জন্যে এবং শিশুর অত্যাধিক রাগকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে মূলত মা- বাবা কিংবা অভিভাবকেরা ‘টাইম আউট’ পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। কিন্তু শুধু এসবই নয়, শিশুর অন্যান্য অনেক ব্যবহারের জন্যেও এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা যায়।

যদি ঠিকঠাক প্রয়োগ করা যায় এবং শিশুর উপর পজিটিভ প্রভাব পড়তে শুরু করে, তবে অন্যান্য অনেক ঘটনায়ও ‘টাইম আউট’ ব্যবহার করা যায়। যেমন যেসব কাজ থেকে আপনি শিশুকে বিরত রাখতে চান: কাউকে মারা, জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলা, চিৎকার করা, বইয়ের পাতা ছেঁড়া প্রভৃতি। এর পাশাপাশি ধীরে ধীরে যেসব অভ্যাস আপনি শিশুর মধ্যে গড়ে তুলতে চান যেমন খেলনা গুছিয়ে রাখা, নিজে জামাকাপড় পড়া, টয়লেট ব্যবহার শেষে সাবান দিয়ে হাত ধোঁয়া – প্রভৃতির ক্ষেত্রেও ‘টাইম আউট’ ভালো কাজ করে।

সঠিকভাবে ‘টাইম আউট’ প্রক্রিয়া প্রয়োগ করার উপায় কি?

খুব বেশী আয়োজন না করে সহজ কিছু ধাপ অনুসরণ করেই টাইম আউট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়:

সতর্কতা : আপনার শিশু যখন কোন খারাপ কাজ করবে, প্রথমে তাকে সতর্ক করুন। খুব বেশী কথা না বলে এভাবে বলা যায় যে, “আমি তোমাকে বইয়ের পাতা ছিঁড়তে মানা করেছিলাম যদি তুমি আবারও এই কাজটা করো, সেক্ষেত্রে তোমাকে ‘টাইম আউটে বসতে হবে”। খেয়াল রাখবেন, এটুকু বলতে গিয়ে লেকচার শুরু করে দেবেন না যেন! তাতে আপনার মূল বক্তব্যটাই হারিয়ে যেতে পারে।

ব্যখ্যা: যদি আপনার শিশু আপনার সতর্কতাকে পাত্তাই না দেয় তখন তাকে ‘টাইম আউট’এর জন্যে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যান। তাকে বসিয়ে বলুন, কেন তাকে এখানে আনা হয়েছে, ” আমি তোমাকে বইয়ের পাতা ছিঁড়তে মানা করেছি কিন্তু তুমি বারবারই একই কাজ কাজ করছো। এখানে ২ মিনিট সময় বেধে দিলাম, এর পর তুমি এখান থেকে উঠতে পারবে।”

সময় বেঁধে দিন: আপনার শিশু যখন চুপচাপ শান্ত হয়ে বসে থাকবে, তখন তাকে সময় বেধে দিন। সাধারণত শিশুর বয়স যত বছর, তত মিনিট সময় বেধে দেওয়াই উত্তম। সময় বেধে দেওয়ার পর আপনি ওই রুম ত্যাগ করুন এবং আগামী কয়েক মিনিট শিশুকে বোঝান যেন আপনি তার দিকে কোন নজর দিচ্ছেন না। যদি সে উঠে যায়,তবে কোন কথা না বলে শিশুকে আবারো ওই যায়গায় এনে বসান এবং আবারো শুরু থেকে সময় ঠিক করে দিন।

দ্বিতীয়বার ব্যখ্যা: যখন নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে যাবে, তখন আপনার শিশুর কাছে যান এবং আরেকবার পুরো ব্যাপারটা ব্যখ্যা করুন, “আমি তোমাকে বইয়ের পাতা ছিঁড়তে বারণ করেছিলাম, কিন্তু তুমি বারবার করেছো। তাই তোমাকে ‘টাইম আউট’ এ বসতে হয়েছে।

অনুতাপ: আপনার শিশুকে নিজের মুখে বলতে বলুন যে সে তার খারাপ ব্যাবহারের জন্যে দুঃখিত এবং এমনটি আর করবে না। শিশুর বলাটা যেন শান্ত ও ভদ্র হয়। যদি তা না হয়, শিশু রেগে যায়, তবে শিশুকে আবারো সতর্ক করুন এবং আবারো সময় বেঁধে দিন।

আদর করা : যখন শিশু শান্ত ও ভদ্রভাবে দুঃখ প্রকাশ করবে এবং বলবে যে সে আর এমনটি করবে না, তখন অবশ্যই আপনি তাকে আদর করবেন। সেটা হতে পারে তাকে জড়িয়ে ধরতে পারেন, চুমু খেতে পারেন, পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে পারেন বা যেভাবে আপনি তাকে আদর করতে চান৷ শিশুকে এটা বোঝাতে হবে, যত যা-ই হয়ে যাক না কেন, ভালোবাসা ও যত্ন নেওয়ার জন্যে আপনি তার পাশে সবসময়ই আছেন।

ভুলে যান: যখন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়ে যাবে, দ্রুত এই অবস্থা থেকে বের হয়ে যান এবং শিশুকেও এক্ষেত্রে সহায়তা করুন। আপনার রাগ কিংবা হতাশা থাকলে ঝেড়ে ফেলুন, শিশুকে সম্পূর্ণ অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করান৷ ‘টাইম আউট’ শেষ হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় এই বিষয়ে কথা বলা ঠিক না।

আপনার শিশু কি এই অপরাধ আবারো করবে? খুব সম্ভবতঃ হ্যা। তাকে ভুল করার সুযোগ দিন, এবং সে ভুল থেকে শিখতে দিন। তারপর একদিন দেখবেন সে আর এমন কিছু করছে না। আপনি যদি খারাপ ব্যবহার নিয়েই পড়ে থাকেন, নিশ্চিত থাকুন, সেও আপনার ব্যাতিক্রম হবে না।

কেন যত বছর বয়স, তত মিনিট সময় নির্ধারণ করে দেবেন?

শিশুর রাগ এবং হতাশা ঘড়ির সময় ধরে ঠিক করার উপায় নেই, যদি আপনি তা করতে যান তাতে হিতে বিপরীত ঘটতে পারে। তাই যখন শিশুর চিৎকার চেঁচামেচি বন্ধ করার জন্যে ‘টাইম আউট’ প্রয়োগ করবেন, তখন সময়ের দিকে তাকাবেন না। শিশুর জন্যে যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণ সময় বেধে দিন।

‘টাইম আউট’এ বসিয়ে তাকে সময় দিন নিজে নিজে চিন্তা করার এবং রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্যে রাস্তাও খোলা রাখুন কিন্তু তাকে এটাও বোঝান যে চিৎকার চেঁচামেচি করাটা গ্রহণযোগ্য কোন আচরণ নয়। ধীরে ধীরে একসময় শিশু বুঝতে শিখবে এবং তার আচরণের পরিবর্তন আসবে।

যখন আপনার শিশু ইতোমধ্যেই শান্ত, তখন শিশুর নির্দিষ্ট কিছু ব্যাবহারের উপর কাজ করার জন্যে ‘টাইম আউট’এ বয়স অনুযায়ী সময় বেঁধে দেবেন। কোন ব্যাবহারের কারণে তাকে এখানে এনে বসানো হয়েছে, তাতে ক্ষতি কি, কেন এই কাজটা করা মানা- শিশুর কাছে এটা পরিষ্কার থাকতে হবে এবং যতক্ষণ সে ‘টাইম আউট’এ বসে থাকবে, শুধুমাত্র এটা নিয়েই সে চিন্তা করবে।

আর এই বয়সের শিশুর চিন্তার পরিধি সাধারণত ২ মিনিট স্থায়ী হয়। আর যখন শিশু বড় হয়, তার চিন্তার পরিধিও বাড়ে, তার মাথায় আরো অনেক জিনিসই ঘুরপাক খায়, তখন টাইম আউটের সময়ও তাই বাড়িয়ে দিতে হয়।

বিজ্ঞাপণ

আপনার শিশু কি ‘স্যরি’ এর অর্থ আসলেই বোঝে?

অনেক অভিভাবকেরা তাদের ‘টাইম আউট’ প্রক্রিয়ায় শিশুকে দিয়ে ‘স্যরি’ বলানোর অংশটা রাখতে চান না। যদি অন্যান্য সব প্রক্রিয়া ঠিকঠাকভাবে করা হয় এবং আপনি শিশুর আচরণ ঠিক রাখার প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিক থাকেন, তাহলে এই অংশটা না থাকলেও খুব একটা সমস্যা নেই। তারা রাখতে চান না কারণ তারা ভাবেন, শিশু যেটার অর্থ ঠিকঠাক বুঝতেই পারে না সেটা সে কেন বলবে? আমি কি তাহলে শিশুকে মিথ্যে বলা শেখাচ্ছি?

খুব সম্ভবতঃ না! শিশুকে দিয়ে ‘স্যরি’ বলাতে পারা তার জন্যেই উপকারী। কৃতজ্ঞতা কিংবা দুঃখ প্রকাশ করছি কিনা তা পরের বিষয়, কিন্তু আমরা তবুও শিশুর সামনে, ‘ধন্যবাদ’ কিংবা ‘স্যরি’ বলে থাকি যাতে তার মধ্যেও অভ্যাসগুলো গড়ে উঠে।

দৈনন্দিন কাজের মাধ্যমেই আপনি ধীরে ধীরে তাকে বোঝাবেন আমরা কেন ধন্যবাদ বলি, কেন স্যরি বলি। আর এভাবেই একসময় শিশু এর ব্যবহারের পাশাপাশি এর তাৎপর্যও বুঝে যাবে৷ আপনার শিশুকে বোঝাতে হবে, অন্য কাউকে ভালো অনুভব করানোর জন্যেই ‘স্যরি’ বলা উচিত এবং এর মাধ্যমেই সম্পর্কগুলো টিকে থাকে, দীর্ঘদিন ভালো থাকে।

শিশুকে কি সবসময়ই ‘সতর্ক’ করতে হবে?

হ্যা, প্রায় সবসময়ই। একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনার কতটা কাছাকাছি, তা বোঝার ক্ষমতা শিশুদের তূলনামূলক কম থাকে। তাই কোন আচরণের কারণে যদি শিশুকে আগে ‘টাইম আউট’এ বসানো হয়ে থাকে, কাছাকাছি অন্য কোন আচরণের ক্ষেত্রেও তাকে সতর্ক করে দিতে হবে।

তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন নেই। যেমন- আপনি যদি কোন নির্দিষ্ট আচরণের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ‘টাইম আউট’ প্রয়োগ করতে থাকেন, সেক্ষেত্রে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। তাকে বলতে পারেন,”বইয়ের পাতা ছেড়ায়, এই সপ্তাহে প্রতিদিন তুমি ‘টাইম আউট’এ বসেছো, তাই তোমাকে আর কোন সতর্ক করবো না। এই কাজ যদি তুমি করো, তোমাকে সোজা ‘টাইম আউট’ এ যেতে হবে”। আবার যখন শিশু কাউকে আঘাত করার কারণে পূর্বে ঝামেলা হয়েছে, এমন কারণেও সতর্কতার প্রয়োজন নেই।

আরেকটি ঘটনা ঘটতে পারে, তবে এক্ষেত্রে আপনাকে অনেক বেশী সতর্ক থাকতে হবে। ধরুন, আপনি দেখলেন আপনার শিশু যেন ইচ্ছে করে আপনাকে দেখিয়ে দেখিয়ে এমন কোন কাজ করছে যেটা আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সে যেন অপেক্ষা করছে আপনি কিছু বলেন কিনা। এই সময়ে কোন সতর্কতাবাণীর প্রয়োজন নেই। সেই মুহুর্তে আপনাকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

শিশু আসলে আপনাকে পরখ করে দেখছে আপনি কথা রাখেন কি না৷ এর মানে হলো সে বুঝতে শিখে গিয়েছে কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল। আর এটাই ‘টাইম আউট’ প্রক্রিয়া কাজ করার সঠিক সময়। এই সময়ে শিশুকে অযথা সতর্ক করে সময় নষ্ট না করাই উচিত।

টাইম আউট চলাকালীন সময়ে কেন কথা বলা উচিত না?

শিশুরা কথার নয়, কাজের মানুষ। আপনি চাইলে তাকে অনেক্ষণ ধরে বোঝাতে পারেন সে কি করেছে, তাতে কার কি ক্ষতি হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি কিন্তু শিশুর কাছে এর আসলে তেমন কোন মূল্যই নেই। আপনি হয়তো বিশাল এক বক্তৃতার মাঝামাঝি আছেন কিন্তু আপনি প্রথমে কি বলেছেন, শিশু হয়তো ঠিকমতো সেটাই মনে করতে পারলো না।

যত বেশী কথা বলবেন, শিশুর মনযোগ তত সরে যেতে থাকবে। তার চেয়ে ভালো, নিজের মতটা প্রকাশের জন্য ঠিক যতটুকু বলা দরকার, ‘টাইম আউটের’ আগে শিশুর সাথে ততটুকুই কথা বলুন এবং নিয়মমাফিক ‘টাইম আউট’এ যে রুটিন অনুসরণ করে থাকেন, তা-ই করুন৷

‘টাইম আউট’ চলা অবস্থায় শিশু যখন রুম থেকে বের হয়ে যাবে, এবং আপনি তাকে এনে আবার বসাবেন, এই সময়টায় কোন কথা বলবেন না৷ এই সময়ে শিশুকে এটা বোঝানোই জরুরি যে আপনি তার দিকে মনযোগ দিচ্ছেন না। শুনতে অদ্ভুত হলেও সত্যি, এতে শিশুর উপকারই হবে৷

আপনি এই সময়ে তার সাথে কথা বলতে শুরু করলে ব্যাপারটা হয়তোবা রাগারাগি, মারামারি বা এরকম কোন পর্যায়ে চলে যাবে যার ফলে ‘টাইম আউট’এর প্রকৃত ফল থেকে বঞ্চিত হবে শিশু। যদি আপনার শিশু দেখে যে আপনি এমন পরিস্থিতিতে রেগে যান এবং সে এই সময়ে কান্নাকাটি করে ‘টাইম আউট’এ না বসে শুধু কিছু কথা শুনে এখান থেকে চলে যেতে পারবে, তাহলে অবধারিতভাবে শিশু সে পথই অবলম্বন করবে। তাই, এই পরিস্থিতিতে শান্ত থাকুন, নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখুন এবং চুপ থাকুন।

‘টাইম আউট’ প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মিত ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

শিশুরা দ্রুত অভ্যাসের সাথে মানিয়ে নেয় ও তারা এটাই পছন্দ করে। তারা প্রতি রাতে একই সময়ে ঘুমুতে পছন্দ করে, প্রতিদিন সকালে একই সময়ে ঘুম থেকে উঠতে পছন্দ করে এবং আপনি তাদের যে রুটিনই দেন না কেন, তারা ধীরে ধীরে তা গ্রহণ করে ফেলে। নিয়মানুবর্তিতার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এরকমই।

আপনার শিশু যখন বুঝতে পারবে কোন কাজটা করলে তার সাথে কেমন আচরন করা হবে, তখন শিশু সে অনুযায়ী নিজের একটা সীমানা নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী চলবে। হ্যা, তারা আপনার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবে, বারবারই নেবে। শিশু যত বড় হবে, ততই তা আরো বাড়তে থাকবে এবং এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু একবার যখন সে বুঝে যাবে সে কি কি করতে পারবে আর কি কি করতে পারবে না, তাহলে সে ঐ নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই থাকবে।

কিন্তু আপনি যখন ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলবেন না, তখন আপনাকে অনুমান করা শিশুর জন্যে কঠিন হয়ে পড়বে যা তার জন্যে খুবই অস্বস্তিকর এবং ভীতিকরও বটে। আপনি বলছেন একটা অথচ করছেন আরেকটা, এর মাধ্যমে আপনি শিশুকে বারবার বিচলিত তো করছেনই পাশাপাশি তার মাথায় এটাও ঢুকিয়ে দিচ্ছেন যে আপনার মুখের কথা কাজে প্রয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

আপনাকে বিশ্বাস করা তখন শিশুর জন্যে কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। যেমন – হয়তো শিশুর কোন ব্যাবহারের কারণে আপনি শিশুকে বারবার সতর্ক করছেন যে আর এমনটি হলে তাকে ‘টাইম আউট’ এ যেতে হবে কিন্তু আদৌ আপনি তাকে জোর করে হলেও টাইম আউট’ এ নিয়ে যেতে পারলেন না কিংবা আপনি তাকে ‘টাইম আউট’ এ সনয় বেঁধে দিলেন ৩ মিনিট, কিন্তু আড়াই মিনিট কিংবা পৌনে তিন মিনিটেই আপনি ‘টাইম আউট’ শেষ করে দিলেন – এসবের মাধ্যমে শিশুর কাছে যে বার্তাটা পৌঁছায়, তা হলো, আপনার মুখের কথা সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছুই নেই।

মনে রাখবেন, আপনার বর্তমান সময়ের ধারাবাহিকতার অভাবই ভবিষ্যতে শিশুর খারাপ ব্যাবহারের কারণ হয়ে দাঁড়াবে৷ যদিও ‘টাইম আউট’ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা এবং নিয়মিত এর উপর কাজ করা আপনার জন্যে প্রথমদিকে বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় যখন একদিকে আপনার ব্যস্ত জীবনের পাশাপাশি শিশুকে প্রতিদিনকার যত্নআত্তি করেই ক্লান্ত হয়ে যান।

কিন্তু এই ব্যাপারটাকে একটা রুটিন কিংবা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলতে পারলে তখন মোটামুটি সবকিছু সহজ হয়ে যায়। আর আপনি যখন দেখবেন শিশুর আচার আচরণগত কারণে ঘটা মা-শিশুর নিয়মিত যুদ্ধ অনেকটা কমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, তখন আপনা আপনিই স্বস্তি অনুভব করবেন।

বাসার বাইরে থাকলে সেক্ষেত্রে করনীয়?

আপনি কোন আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছেন, কিংবা শপিংয়ে গিয়েছেন অথবা রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছেন, তখনও কিন্তু শিশুর নিয়মানুবর্তিতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি কখনো কখনো বাসার চেয়েও বেশী। ধরুন আপনি পরিবারের সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেন এবং সেখানে আপনার শিশু চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। স্বাভাবিকভাবেই অন্য টেবিলের লোকজন আপনার দিকেই তাকাবে- আপনি কিছু করছেন না কেন? হ্যা, আপনি করবেন, অবশ্যই করবেন।

যখন আপনার শিশু দেখবে যে সে যখন বাসার বাইরে থাকে, তখন তার শৃঙ্খলার দিকে আপনি অতোটা খেয়াল করেন না এবং তাকে অনেক ক্ষেত্রেই ছাড় দিয়ে দেওয়া হয়, তখন শিশু ঠিক এটাকেই সুযোগ হিসেবে নেবে এবং সবচেয়ে খারাপ ব্যাবহারটা যেন এই সময়ের জন্যেই জমিয়ে রাখবে।

বাসায় যেভাবে ‘টাইম আউট’ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে থাকেন, বাইরেও যতটা সম্ভব সেভাবেই করার চেষ্টা করুন। যেনন- “চামচ-কাটাচামচ এভাবে ছুড়ে ফেলা ঠিক কাজ হচ্ছে না” বলে প্রথমে সতর্ক করুন। তারপর যেখানে আছেন, সেখানেই আশেপাশে কোন নীরব জায়গায় শিশুকে নিয়ে বসান এবং মোবাইলে টাইমার সেট করে দিন। খেয়াল রাখবেন, যতক্ষণ বলছেন ঠিক ততক্ষণ পূর্ণ করে এবং আপনার রাগ এবং হতাশা যথাসম্ভব লুকিয়ে খাবার টেবিলে ফিরে আসবেন৷

আপনি হয়তো আশা করতে পারেন যে শিশু আর এমনটি করবে না, কিন্তু বাস্তবতা হলো, শিশু আবারও এমনটা করতে পারে। তবে এটা ঠিক, ঘরের বাইরে ‘টাইম আউট’ এর ক্ষেত্রে প্রথমদিকে হয়তো শিশুকে অনেকটা জোর করেই করানো লাগতে পারে। তবে শিশুকে আপনার এই বার্তাটা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ যে, আপনি এখন মনে করছেন এটা করা উচিত, আপনি এটা করবেনই।

অনেক অভিভাবকেরা আছেন, যারা জনসম্মুখে শিশুর আচরণের জন্যে তাকে শাসন করতে ইতস্তত অথবা লজ্জিত বোধ করেন। এমনটা ভাবার কিছু নেই৷ অধিকাংশ মানুষই খুশি হবে এবং আপনাকে শ্রদ্ধা করবে কারণ আপনি শিশুর আচরণের ত্রুটি ঠিক করতে কাজ করছেন৷

‘মানুষ কি ভাববে’ এই ধারণা নিয়ে যদি চলে থাকেন এবং শিশুর খারাপ ব্যাবহারগুলো এড়িয়ে চলেন, সেক্ষেত্রে আপনার শিশু এটা বুঝে নিবে যে, ঘরের বাইরে বেরুলে নিয়ম-নীতি কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় যেখানে আপনি নন, বরং আপনার শিশুই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করবে। যেটা কখনোই হতে দেওয়া উচিত নয়।

সর্বশেষে, পৃথিবীতে এখনও এমন কোন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি বা হওয়া সম্ভবও না যার মাধ্যমে সকল ধরণের শিশুর শৃঙ্খলা নিয়ে কাজ করা যায়। অভিভাবকদের যত বেশী পদ্ধতি জানা থাকবে ততই ভালো।

যখন ‘টাইম আউট’ পদ্ধতি অবলম্বন করবেন, শিশুর প্রতিক্রিয়ার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখুন। যথাসম্ভব ধারাবাহিক থাকার চেষ্টা করুন, তবে যখন দেখবেন আপনি যা করছেন, শিশুর উপর তা খুব বেশী একটা প্রভাব ফেলতে পারছে না- তখন কিছুটা নমনীয় হোন। সেক্ষেত্রে শিশুর আচরণ ঠিক করার আরো অন্যান্য অনেক পদ্ধতি আছে, সেগুলোও অনুসরণ করতে পারেন।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts