মানুষ অভ্যাসের দাস। একজন সফল মানুষ গড়ে তোলার জন্যে শিশুবয়সই প্রকৃত সময়। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের এই সময়ে গড়ে তোলা অভ্যাসগুলো থেকে শিশুর মধ্যে যে গুণগুলো বিকাশ পায়, তা-ই স্থায়ীভাবে রয়ে যায় এবং এগুলোই পরবর্তীতে জীবন গঠনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহৃত হয়। এজন্য শিশু বয়স থেকেই শিশুর আচার ব্যবহার, দৈনন্দিক কাজকর্মগুলোতে অভিভাবকদের মনযোগ দেওয়া উচিত এবং সে অনুযায়ী শাসন করা উচিত।
শাসন মানেই যে শুধু খারাপ ব্যবহারের কারণে শাস্তি দেওয়া, তা কিন্তু নয়৷ আপনি ভালো আচরণের কারণে পুরষ্কৃত করুন কিংবা খারাপ ব্যাবহারের প্রতিক্রিয়া খারাপভাবে করুন বা যেভাবেই করুন না কেন, খেয়াল রাখতে হবে এর মাধ্যমে শিশুর জীবনে চলার পথে যে গুণগুলো প্রয়োজন, সেগুলো বিকাশে সহায়তা করছে কিনা।
আপনার শাসন এমন হওয়া উচিত, যার মাধ্যমে পরবর্তী বার কিভাবে আরো ভালো করা যায়, সে ব্যাপারে শিশু অবগত হবে। আর এর মাধ্যমেই শিশুর ভুলগুলো তার শিক্ষার সুযোগ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এখানে সফল মানুষের ছয়টি গুণাবলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো আপনার শিশুর মধ্যে অভ্যাসের মাধ্যমে গড়ে তোলা উচিত।
১. আত্মনির্ভরশীলতা
শিশুর বাড়ির কাজ করানোর জন্যে তার পেছনে পড়ে থাকা, তাকে বাসার কোন কাজ করতে না দেওয়া কিংবা সবসময় শিশুকে কঠিন কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখলে শিশু কখনো আত্মনির্ভরশীলতা শিখবে না। আপনার শিশুর অধিকাংশ কাজ যদি আপনিই করে দেন, তাহলে উল্টো আপনার উপর শিশুর নির্ভরশীলতা বাড়বে।
শিশুকে এটা বোঝান, তার নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে। একটা সময় পর, আপনার শিশুর আর আপনাকে প্রয়োজন হবে না৷ শিশুর স্বাধীনচেতা মনোভাবকে বিকাশের জন্যেও আত্মনির্ভরশীলতার চর্চা করা উচিত।
আপনার শিশুকে, ঘরের টুকিটাকি কাজ করতে দিন, হোমওয়ার্ক নিজে নিজে করতে বলুন, সর্বোপরি সময়ানুবর্তিতা মেনে চলছে কিনা খেয়াল রাখুন। শিশুকে আত্মসচেতনতা শেখাতে সবচেয়ে বড় উপায় হতে পারে শিশুর ভালো ব্যাবহারের কারণে পুরষ্কৃত করা এবং খারাপ ব্যাবহারের কারণে তিরষ্কার করা এবং শিশুকে নিয়মিত নজরে রেখে এই প্রক্রিয়াকে ধারাবাহিক রাখা।
২. সামাজিক দক্ষতা
ভাল সামাজিক দক্ষতা একটি দুর্লভ গুণ। শিশুর স্কুলে এমনকি যখন সে পূর্ণাঙ্গ পরিণত মানুষ হয়ে উঠবে তখনও এই গুণটি তাকে অন্যদের তুলনায় উঁচুতে স্থান দেবে। অভিভাবকদের থেকে প্রচুর সহায়তা এবং অভ্যাসই পারে শিশুর মাঝে এই অসাধারণ গুণটি গড়ে তুলতে।
অন্য কারো সাথে শেয়ার করতে পারা, ভদ্র ব্যবহার করা, নম্রভাবে কথা বলা- এই জিনিসগুলো স্কুলে পড়ুয়া বাচ্চাদের শিখিয়ে দেওয়া উচিত যাতে করে সে স্কুলে সবার সাথে ভালো বন্ধুত্ব তৈরি করতে পারে।
সামাজিক দক্ষতা ধীরে ধীরে গড়ে তোলার ব্যাপারটাও এই বয়সেই শিশুর মধ্যে তৈরি করা উচিত। কিভাবে নতুন মানুষদের সাথে কথা বলতে হয়, কিভাবে কারো কাছে সাহায্য চাইতে হয়, কেউ খারাপ ব্যবহার করলে তা কিভাবে সামলাতে হয়, এই বয়সেই শিশুকে এগুলো শিখিয়ে দেওয়া উচিত।
কোন কোন গুণগুলো শিশুর মধ্যে গড়ে তুলতে চান, প্রথমে তা ঠিক করুন। বাসায় তার সাথে অভিনয় করে দেখান কখন কেমন ব্যবহার করতে হবে। না হলে তাকে শুধরে দিন, আবার করে দেখাতে বলুন। আর যখন তাকে স্কুলে কিংবা বাইরে এমন সামাজিক দক্ষতাসম্পন্ন কাজ করতে দেখেবেন, প্রসংশা করুন।
সামাজিক দক্ষতা ব্যাপারটা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। সময়ে সময়ে বিশেষ বিশেষ ঘটনার ক্ষেত্রে শিশুকে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবহার করা শিখিয়ে দিন৷ শিখিয়ে দিন কখন প্রতিবাদ করতে হবে আর কখন বড়রা কেউ থাকলে বিনয়ের সাথে চুপ থাকতে হবে।
[ আরও পড়ুনঃ শিশুর সামনে ঠিক তেমনই আচরণ করুন যা আপনি ওর কাছ থেকে দেখতে চান]
৩. সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা
কোন একটি সমস্যা বড়রা যে দৃষ্টিতে দেখে, শিশুরা সেগুলো একই দৃষ্টিতে নাও দেখতে পারে। তাই তাদের মধ্যে কোন সমস্যা কিভাবে সমাধান করতে হয়, সে দক্ষতা থাকতে হবে এবং এজন্য নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার অনুশীলন করতে হবে।
আপনার শিশু যখন কোন সমস্যার মুখোমুখি হবে, দুজনে মিলে বসুন, তাকে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করুন৷ হয়তো জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কোন জামাটা পড়ে যাবে তা সে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, কিংবা গণিত ক্লাসের সমস্যাও সে নিজে নিজে বের করতে পারবে না, কিন্তু শিশুর মধ্যে সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা তৈরি করতে আপনার সুযোগের কিন্তু অভাব নেই।
তার সকল সিদ্ধান্ত নিজে না নিয়ে তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে দিক নির্দেশনা দিন- এভাবেই শিশুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে আপনি তাকে সহায়তা করতে পারেন। শিশুর ছোট-বড় সকল বিষয়ে কান দেবেন না আর মাঝে মাঝে সুবিধামত বাস্তবতা মোকাবেলা করারও সুযোগ করে দিন। ‘ভুল’ থেকে শিখতে শিখতেই একসময় শিশু পরিপক্ক হয়ে উঠবে।
৪. প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ
শিশু যখন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের গুণটাও তাদের বৃদ্ধি পেতে থাকে। সঠিক সময়ে সঠিকভাবে শাসন শিশুর এই গুণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
শিশুকে তার ভালো কাজের জন্য প্রশংসাও তার প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। যখন দেখবেন, শিশু যখন কোন কাজ করার আগে চিন্তা করছে, সেই চিন্তার প্রশংসা করুন। যখন দেখবেন সে আগে অন্যদের কথা শুনছে এবং নিজের কথা বলার সুযোগের অপেক্ষা করছে, সেই অপেক্ষাকে স্বাগত জানান। রেগেমেগে চিৎকার চেচামেচি না করে যদি সে হেটে চলে যায়, সে ব্যাবহারের প্রশংসা করুন।
কি হতে পারে, তা আগে থেকে আঁচ করে করে তাকে আগে থেকেই দিক নির্দেশনা দিয়ে রাখলে অনেক সমস্যা তো এড়ানো যায়-ই, পাশাপাশি শিশুও বোঝে তার এখন কি করা উচিত। যেমন, পার্কে গিয়ে অবাঞ্চিত যায়গায় দৌড়াদৌড়ি করা থেকে শিশুকে বিরত রাখতে পার্কে যেতে যেতেই তাকে বলতে পারেন, ”আমরা পার্কে গিয়ে হাতে হাত ধরে এক পাশে হাটবো, সাবধানে হাটবো যাতে গাড়ির সামনে পড়ে যেতে না হয়।” এভাবে একটার পর একটা সমস্যা ধরে শিশুর প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে কাজ করা যায়।
৫. আবেগ নিয়ন্ত্রণ
শিশুদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটিকে অনেক অভিভাবকেরাই উপেক্ষা করে থাকেন। শিশু যখন নিজের অভিব্যক্তি ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না কিংবা অপ্রস্তুত কোন পরিস্থিতিতে পড়ে যায়, তখন তারা রেগে যায় এবং আগ্রাসী (Temper Tantrum) হয়ে উঠে।
শিশু ছোটবেলা থেকেই তার আবেগ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সচেতন করা উচিত৷ গবেষনায় দেখা গেছে, জীবনে উন্নতির ক্ষেত্রে আই.কিউ(IQ) থেকেও মানসিক দক্ষতা বেশী গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
৬. আত্মবিশ্বাস
শিশুর আচরণ নিয়ন্ত্রণে অভিভাবকদের ধারাবাহিকতা মেনে চলাই পারে শিশুর মাঝে আত্মসম্মান এবং আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করতে। যখন শিশু আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে, তখন তার মধ্যে অন্যান্য আরো গুণ, যেমন – ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া, সমালোচনা মেনে নেওয়া, ভয়কে মোকাবেলা করা প্রভৃতি বিকাশ পায়।
আপনার শিশুর মাঝে আপনি যে গুণগুলো দেখতে চান, সে অনুযায়ী শিশুর কাজের তালিকা করুন। শিশুর কখন কি করা উচিত, সেটা একটা হোয়াইট বোর্ডে কিংবা কাগজে লিখে দেয়ালে ঝুলিয়ে দিন এবং এগুলো মেনে চলা হলে শিশুকে পুরস্কৃত করুন, মেনে না চললে ব্যাবস্থা নিন এবং অবশ্যই এই ব্যাপারে ধারাবাহিক থাকুন। এর মাধ্যমে আপনার শিশু জানবে এবং বুঝবে আপনি তার কাছে কি প্রত্যাশা করেন।
আপনার শিশু যখন নিরাপদ বোধ করবে, সে তার মেধাকে কাজে লাগাবে, নতুন কিছু করতে চাইবে। যত কষ্টই হোক, নিয়মিত খেয়াল রাখুন, শিশুকে আত্মবিশ্বাসী হতে সহায়তা করুন। বড় হয়ে সে পুরো পৃথিবী জয় করতে প্রস্তুত হয়ে উঠবে।
সবার জন্য শুভকামনা।