আমরা সবাই চাই আমাদের সন্তান সফল হোক। তবে একেক জনের কাছে সফলতার সংজ্ঞা একেক রকম। “সফল হওয়ার সুখানুভূতি এবং ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া”- মোটের ওপর সফলতা বলতে সবাই এটাই বোঝে। তবে একজন ব্যক্তির সফলতা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যক্তির ছেলেবেলা তার সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। সফল ব্যক্তিদের ওপর গবেষণা করে তাদের ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো পর্যালোচনা করে অনেক সাদৃশ্যও পাওয়া গেছে।
নিচে বিজ্ঞান-সম্মত পদ্ধতিতে সফল সন্তান বড় করার ৭টি পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১। সন্তানের প্রতি ভালবাসাময়, প্রতিক্রিয়াশীল এবং সহজ হোন
যে বাচ্চাটি ছোটবেলা থেকে নিরাপদবোধ করেছে, ভালবাসা পেয়ে বড় হয়েছে তার ভেতরে ইতিবাচক উন্নতির দেখা পাওয়ার পাশাপাশি অনাগত জীবনে তার ভাল করার সম্ভাবনাও বেশি থাকে।
মানুষের মস্তিষ্ক খুবই অভিজ্ঞতা-কেন্দ্রিক। জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এবং ঘটনাবলির মিথস্ক্রিয়া মস্তিষ্কের গঠনে আকৃতি প্রদান করে। যে সন্তান শুরু থেকে বাবা, মায়ের কাছ থেকে ইতিবাচক প্যারেন্টিং, পরামর্শ, সহায়তা ইত্যাদি পেয়ে বড় সে মানসিকভাবে অনেক নির্ভার থাকে। তার মানসিক স্বাস্থ্য অনেক ভাল থাকে। এতে তার ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তিও চমৎকারভাবে দাঁড়িয়ে যায়। ছোটবেলার সুখস্মৃতি মানুষকে বাকিটা জীবন এগিয়ে চলার জন্য শক্তি প্রদান করে।
তাই সন্তানকে সফল দেখতে হলে তাকে একটি চমৎকার পরিবেশে বড় করার কোনো বিকল্প নেই।
২। সন্তানকে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখান
মায়ের পেট থেকে কেউ আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার দীক্ষা নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয় না। এই গুণটি ধীরে ধীরে শিখতে হয়, আয়ত্ব করতে হয়। সাধারণত সন্তান তার বাবা, মাকে পর্যবেক্ষণ তাদের মতো করে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যদি বাবা, মা কোনো কারণে হতাশ বা রেগে সন্তানের ওপর গলা উঁচিয়ে কথা বলেন তাহলে সন্তানও একই পরিস্থিতিতে পড়লে বাবা, মায়ের মতোই চিৎকার করে কথা বলবে। তখন তাকে দোষ দেওয়া যাবে না।
যে বাবা, মা নিজেদের মেজাজ খারাপ হলে চিৎকার, চেঁচামেচি করেন, তারা কখনোই তাদের সন্তানের কাছ থেকে একই পরিস্থিতি শান্ত, ধীর স্থির আচরণ আশা করতে পারেন না। বাবা, মা সন্তানের কাছে রোড মডেল, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাই বাবা, মা সতর্ক হতে হবে এবং সন্তানকে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা শেখাতে হবে।
৩। তাদেরকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চর্চা করতে দিন
বাবা, মা হিসেবে আপনি সবসময় সন্তানকে রক্ষা করতে চান। কিন্তু তাকে খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করলে বা হেলিকপ্টার প্যারেন্টিং করলে তা বাচ্চার স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করতে পারে। বাচ্চা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে তখনই যখন সে তার চর্চা করবে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করবে।
স্বাস্থ ঝুঁকি নেই কিংবা বিপদ নেই এরকম বিষয়গুলোতে আপনার সন্তানকেই সিদ্ধান্ত নিতে দিন। এভাবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা শিখবে। তার ওপরে কোনো পরামর্শ না চাপিয়ে দিয়ে বরং তার পাশে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করুন। তবে সন্তান যদি কোনো ভুল পথে পা বাড়ায় তাহলে তাকে ভুলটা করতে দিন। তাকে সেই ভুলের মাশুল গুনতে দিন এবং কর্মফল ভোগ করতে দিন। এভাবে সে অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। পরবর্তী যখন এই বিষয়ে তাকে আবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে তখন সে আর আগের মতো ভুল করবে না। কারণ ভুল থেকে সে হাতেনাতে শিক্ষা পেয়ে গেছে।
সন্তানকে তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে না দেওয়া হলে, তারা কোনো প্রেরণা পাবে না। সন্তানকে নিজের পছন্দমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিলে সে নিজে থেকেই সেই কাজে অনুপ্রাণিত হবে এবং তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
৪। সন্তানকে যথাযথভাবে চ্যালেঞ্জ করুন
বাচ্চারা সেই কাজে অনুপ্রেরণা পায় যে কাজে সে সফলতা করতে সক্ষম হবে। কিন্তু যে কাজ খুব সহজ, বাচ্চারা সেটা করতে আগ্রহ পায় না। তাই বাচ্চাদেরকে এমন কাজে চ্যালেঞ্জ করতে হবে যেখানে সফলত হতে হলে তাকে পরিশ্রম করতে হবে ঠিকই কিন্তু বিষয়টা তার সক্ষমতার ভেতরেই আছে। বাচ্চাকে তার চ্যালেঞ্জে সফল হওয়ার জন্য আপনি চাইলে কিছু পরামর্শ দিতে পারেন, যা তার দক্ষতা, পারফরমেন্স ইত্যাদি বাড়াতে সহায়তা করবে।
৫। পুরষ্কার ও শাস্তি দেওয়া পরিহার করুন; সন্তানকে বোধ, জ্ঞানের মাধ্যমে মূল্যায়ন করুন
সব মোটিভেশন বা প্রেরণা সমানভাবে কাজ করে না। অন্যদিকে শাস্তি ও পুরষ্কার শুধু বাহ্যিকভাবে প্রেরণা দিতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে ভাল প্রভাব ফেলতে কার্যকরী নয়।
পুরষ্কার ও শাস্তির মাধ্যমে আমরা হয়তো বাচ্চাদেরকে দিয়ে তাদের স্কুলের পড়াশোনাগুলো করিয়ে নিতে পারি। কিন্তু তারা যদি স্কুল থেকে প্রকৃতঅর্থে কিছু শিখতে না পারে, জ্ঞান অর্জন করতে না পারে তাহলে একটা সময় গিয়ে তারা ঠিকই পড়াশোনা ছেড়ে দেবে বা খুবই খারাপ ফলাফল করবে।
সন্তানকে অন্তর্নিহিত প্রেরণা দিতে হলে আপনাকে নিজের ভেতরের কথা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা তার সাথে শেয়ার করতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে কেন শেখা গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলে গিয়ে ভালভাবে কোনো বিষয়ে শেখা মানে এই নয় যে এ+ পেলেই হয়ে গেল! যখনই শেখা পরিপূর্ণতা অর্জন করে যখন সেই শেখা থেকে জ্ঞান অর্জন করা হয় এবং তা ব্যক্তিকে মানুষ হিসেবে সমৃদ্ধ করে।
সন্তান যদি ভেতর থেকে অনুপ্রাণিত হয় তাহলেই তারা সফল হবে এবং জ্ঞান অর্জন করার ব্যাপারটা উপভোগ করবে। তাই সন্তানকে শিখতে আগ্রহী করার চেষ্টা করুন, শেখার ব্যাপারটা তাকে উপভোগ করতে উৎসাহিত করুন।
৬। দয়াশীলতা, দৃঢ়তা এবং সম্মানজনক শৃঙ্খলা
কর্তৃত্বপূর্ণ প্যারেন্টিঙের ক্ষেত্রে দৃঢ় এবং দয়াশীল হওয়া একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এই দুটো বৈশিষ্ট্য সফল সন্তানদের বাবা, মায়ের মাঝে সবসময় পাওয়া যায়। যেসব বাচ্চাদের বাবা, মা কর্তৃত্বপরায়ণ, তারা স্কুলে ভাল করে, তুলনামূলক বেশি প্রাণবন্ত থাকে, বিভিন্ন দক্ষতা অর্জন করতে পারে এবং স্কুল থেকে ড্রপআউট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
“কড়া” বাবা, মা প্রায় ভয় পান যে তারা যদি নরম হয়ে যান বা দয়া প্রদর্শন করেন তাহলে তাদের সন্তান বাড়ি মাথায় তুলবে ফেলবে বা বাড়িতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। কিন্তু এটা বুঝতে হবে, দয়াশীল হওয়া মানেই permissive হওয়া কিংবা অনুমতি দেওয়া নয়। দুটো আলাদা বিষয়। পারমিসিভ বাবা, মা সন্তানের প্রতি সদয় থাকেন ঠিকই কিন্তু বাড়িতে কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন প্রয়োগ করতে পারেন না। ফলে সন্তান যা খুশি তা-ই করার সুযোগ পেয়ে যায়।
দয়াশীল হওয়া বা সদয় হলে আপনি বাচ্চার প্রতি নরম, আন্তরিক থাকার পাশাপাশি তাকে তার কর্মকাণ্ডের সীমারেখা বুঝিয়ে দেবেন এবং বাড়িতে যথাযথ নিয়ম-কানুন প্রয়োগ করবেন এবং শৃঙ্খলা আনয়ন করবেন।
কর্তৃত্বপূর্ণ প্যারেন্টিঙের ক্ষেত্রে “পজেটিভ প্যারেন্টিং” একটি জনপ্রিয় পন্থা। আপনি এটা আত্মস্থ করতে পারেন। পজেটিভ প্যারেন্টিঙের মাধ্যমে ইতিবাচকভাবে সন্তানকে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয় এবং সন্তান ও বাবা, মা পরস্পরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে।
কর্তৃত্বপূর্ণ প্যারেন্টিঙের ক্ষেত্রে “সূক্ষ্ম প্যারেন্টিং” (Inductive parenting) আরেকটি বিকল্প পন্থা হিসেবে পরিচিত। ইতিবাচক নির্দেশনা এবং সম্মান প্রদর্শনের পাশাপাশি এখানে সন্তানকে গভীরভাবে চিন্তা করতে শেখানো হয় এবং তাদের যুক্তি প্রদানে দক্ষতাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হয়। এই দক্ষতার অধিকারী হওয়া আমাদের বর্তমান সমাজের জন্য খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে।
৭। বিজ্ঞানের কথা শুনুন এবং গুজব এড়িয়ে চলুন
ইন্টারনেটে প্যারেন্টিং সংক্রান্ত অনেক জনপ্রিয় কিন্তু অবৈজ্ঞানিক পরামর্শমূলক লেখা পাবেন। যেমন : “আপনার সন্তানকে দিয়ে ঘরের সব কাজকর্ম করিয়ে নিন। না করতে চাইলে জোর করে করান। তাদেরকে সবসময় নরম ভালবাসা দেবেন না, কঠোর ভালবাসার সাথেও পরিচিত করান।” এধরনের গুজব, লেখা সন্তানকে মানুষ করতে শুধু ব্যর্থই হয় না, সেই সাথে বাচ্চাদেরকে ক্ষতিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
প্যারেন্টিংকে একটা শিল্প বা আর্ট বলা যেতে পারে। সবাই এটা একটু আলাদাভাবে করতে পারেন, কারণ একেকজন শিশু একেকরকম। কিন্তু প্যারেন্টিঙের ক্ষেত্রে কিছু চিরন্তন সত্য বিষয়ও আছে। আপনার সন্তান যতই “অন্যরকম” হোক না কেন, সেগুলো তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বিজ্ঞান-ভিত্তিক প্যারেন্টিং কোনো মতবাদ নয়, কোনো মতামত নয়, কোনো ব্যক্তিগত বিশ্বাস নয়, কোনো পক্ষপাতিত্ব নয়। এগুলো ফ্যাক্টস, যা বিজ্ঞানীরা কঠোরভাবে পিয়ার-রিভিউড হওয়া গবেষণার মাধ্যমে সমাজের সামনে উপস্থাপন করেছেন। বিজ্ঞান-ভিত্তিক প্যারেন্টিং বাবা, মাকে তাদের বাচ্চাকে যথাযথভাবে বড় করতে সহায়তা করবে।
সন্তানের সাফল্য কামনা করাই শুধু মা-বাবার দায়িত্ব নয়। সেই সাফল্য লাভের জন্য সন্তানকে যোগ্যভাবে গড়ে তুলতে নিজেদেরও প্রস্তুত হতে হবে। বাদ দিতে হবে খারাপ অভ্যাস, অর্জন করতে হবে ইতিবাচক নানা গুণ। মা-বাবার এই সাধনা শুধু তাদের সন্তানকে সাফল্যের মুখ দেখাবে না, জাতিও পাবে যোগ্য উত্তরসূরি।
সবার জন্য শুভকামনা।