শিশুর ইন্দ্রিয়ের বিকাশ | ঘ্রাণশক্তি

Spread the love

শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে তার ঘ্রাণশক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুর স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতার সাথে ঘ্রাণশক্তির জোরালো সম্পর্ক রয়েছে তাই শিশু কি খাবে আর কি খাবে না তার উপর ঘ্রাণশক্তির প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান। এছাড়া শিশুর আবেগের সাথেও তার ঘ্রাণশক্তির সম্পর্কটাও বেশ চমৎকার এবং তা তার মানসিক বন্ধন প্রক্রিয়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

শিশুর ঘ্রাণশক্তি কখন বিকশিত হতে শুরু করে?

গর্ভকালীন সময়ের প্রথম ট্রাইমেস্টারেই শিশুর নাকের গঠন শুরু হয়। এছাড়া দশ সপ্তাহের মধ্যেই রিসেপটর্স নামক যে অংশটি দিয়ে শিশু ঘ্রাণ পেয়ে থাকে সেটিও গঠিত হওয়া শুরু করে। উল্লেখ্য যে, নাকের মধ্যকার অলফ্যাকটরি রিসিপটর নামক এই অংশটি দিয়েই শিশু যে কোন ঘ্রাণ সম্পর্কে বুঝতে পারে এবং এই অংশটিই শিশুর মস্তিষ্ককে যে কোন ঘ্রাণ সম্পর্কে জানায়। ঘ্রাণশক্তি এতই দ্রুত বিকশিত হতে থাকে যে শিশু গর্ভকালীন অবস্থাতেই ঘ্রাণ পাওয়া শুরু করে।

বিজ্ঞাপণ

মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকেই শিশু ঘ্রাণশক্তি ব্যবহার করা শুরু করে। এই অবস্থায় শিশু যখন শ্বাস প্রশ্বাস এবং মুখের মাধ্যমে এমনিওটিক তরল গ্রহণ করতে থাকে তখন তারা এই তরলটির ঘ্রাণও পেয়ে থাকে।

এই এমনিওটিক তরলের ঘ্রাণের সাথে মায়ের বুকের দুধের বেশ মিল রয়েছে, যে মিল শিশুকে জন্মের পর বুকের দুধ খাওয়ার জন্য সহায়তা করে থাকে। এছাড়া আপনি যে খাবার খেয়ে থাকেন শিশু এই এমনিওটিক তরলের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সেগুলোর ঘ্রাণও পেয়ে থাকে।

নবজাতক শিশু জন্মের পর থেকেই প্রাকৃতিক ভাবেই বুকের দুধের ঘ্রাণের প্রতি বেশ আকৃষ্ট থাকে, যার ফলে সে বুকের দুধ খাওয়ার ব্যাপারেও বেশ উৎসাহী হয়। ঠিক বড়দের মতই নবজাতক শিশুরা চমৎকার এবং সুন্দর ঘ্রাণের প্রতি আকৃষ্ট থাকে এবং দুর্গন্ধ থেকে দূরে থাকতে চায়।

নবজাতকের পরিচিত ঘ্রাণ তাকে শান্ত করতে সাহায্য করে। তার প্রিয় কোন কম্বল যাতে মায়ের ঘ্রাণ বা তার শরীরে ব্যবহার করা লোশনের ঘ্রাণ থাকে এমন কিছু তাকে অশান্ত সময়ে শান্ত করতে বেশ কার্যকরী, যেমন- টিকা দেয়ার পর

মস্তিষ্কের যে অংশটি ঘ্রাণ শক্তির নিয়ে কাজ করে ঠিক সেই অংশটিই স্মৃতিশক্তি নিয়েও কাজ করে থাকে। যার ফলে শিশু ঘ্রাণের সাথে তার অভিজ্ঞতাগুলোকেও সম্পৃক্ত করে রাখে। ফলাফল স্বরূপ দেখা যায় কোন একটি নির্দিষ্ট ঘ্রাণ পেলে তার সাথে সম্পৃক্ত কোন অভিজ্ঞতাও শিশুর মনে পড়ে যেতে পারে।

শিশুর ঘ্রাণশক্তির ক্রমবিকাশ

নবজাতক

একটি শিশু পরিপূর্ণ ঘ্রাণশক্তি নিয়েই জন্ম গ্রহণ করে থাকে। খুব দ্রুতই তারা মায়ের ঘ্রাণ চিনে ফেলে এবং স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষুধার্ত অবস্থায় বুকের দুধ খাওয়ার জন্য মায়ের দিকেই মুখ ঘুরিয়ে রাখে। এমনকি একটি নবজাতক শিশু তার মায়ের বুকের দুধ এবং অন্য বুকের দুধের মধ্যেও ঘ্রাণের পার্থক্য করতে পারে।

এক মাস বয়সী শিশু

এই বয়সী শিশুরা সব ধরনের ঘ্রাণ পাওয়ার পাশাপাশি যে কোন তীব্র ঘ্রাণের প্রতি কিছুটা সংবেদনশীল হবে। আপনি একটু খেয়াল করলেই দেখবেন যে, যদি কোন পারফিউম দেয়া অবস্থায় শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে যান তাহলে শিশু অন্য দিনের থেকে তুলনামূলক ভাবে বেশ কিছুটা কম খাচ্ছে।

তিন মাস বয়সী শিশু

এই বয়সে শিশু আশেপাশের বিভিন্ন মানুষের উপস্থিতি সম্পর্কেও জানতে পারে ঘ্রাণশক্তির মাধ্যমে। এমনকি এই ঘ্রাণশক্তি দিয়েই শিশু বুঝতে পারে যে আশেপাশে থাকা ব্যক্তি কি তার পরিচিত না কি অপরিচিত! যদি কোন মানুষের অপরিচিত ঘ্রাণের কারণে সে ভয় পায় তাহলে দেখা যাবে কাঁদছে অথবা হাত পা ছুড়ছে।

ছয় মাস বয়সী শিশু

এই বয়সে সাধারণত শিশুদেরকে মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবারও দেয়া হয়ে থাকে। আর আগেও বলা হয়েছিল যে শিশুর খাবারের স্বাদের সাথে ঘ্রাণশক্তিরও একটি প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে। এই বয়সী শিশুরা ঘ্রাণের মাধ্যমেও অনেকটা সিদ্ধান্ত নেয় যে সে খাবারটি পছন্দ করছে কি না। যদি দেখা যায় শিশুটি নির্দিষ্ট খাবারের ঘ্রাণ পছন্দ করেছে তাহলে সে হাসতে পারে, খাবারের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করতে পারে বা শব্দ করতে পারে।

আর একটু খেয়াল করেই দেখবেন যে শিশুর ঘ্রাণশক্তির পছন্দ অপছন্দের বিষয়গুলো আপনার সাথে অনেকটাই মিলে যাবে। কেননা গর্ভকালীন সময়ে আপনি যে খাবারগুলো খেতেন শিশুও গর্ভে এমনিওটিক তরলের মাধ্যমে সেই খাবারগুলোর ঘ্রাণ পেত।

বারো মাস বয়সী শিশু

দশ থেকে বারো মাস বয়সের দিকে শিশুদের বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্রতি উৎসাহ কমে যাবে। এই সময়ে তার ঘ্রাণশক্তি তাকে খাবার পছন্দ ও অপছন্দ করার ব্যাপারে সাহায্য করে। খাবারের ঘ্রাণ যদি শিশুর পছন্দ না হয় তাহলে দেখবেন শিশু সেটা জানিয়ে দিবে।

উল্লেখ্য যে, আট বছর পর্যন্ত শিশুর এই ঘ্রাণশক্তি বিকশিত হতে থাকে। 

শিশুর ঘ্রাণশক্তি বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে আপনি কি ধরনের সহযোগিতা করতে পারবেন?

জন্মগ্রহণের পূর্বেই শিশুকে বিভিন্ন ঘ্রাণের সাথে পরিচিত করে দিন

গর্ভকালীন সময়েই শিশুর স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতার মত করেই তার ঘ্রাণশক্তি বিকশিত হতে থাকে। কারণ এই সময়ে আপনি যে খাবার খাবেন শিশু এমনিওটিক তরলের মাধ্যমে সেই খাবারের ঘ্রাণ পেতে থাকবে। আর তাই এই সময়ে বিভিন্ন স্বাদ এবং ঘ্রাণের খাবার গ্রহণ করুন যাতে শিশু বিভিন্ন ধরণের স্বাদের সাথে সাথে বিভিন্ন ধরণের ঘ্রাণের সাথেও অভ্যস্ত হয়ে যায়।

শিশুকে আপনার ঘ্রাণ নিতে দিন

শিশুর কাছে যাওয়ার সময় খেয়াল রাখবেন যাতে আপনার শরীরে অতিরিক্ত কোন পারফিউমের ঘ্রাণ না থাকে এর মাধ্যমে শিশু আপনার শরীরের ঘ্রাণের সাথে পরিচিত হতে পারবে।

বিজ্ঞাপণ

শিশুকে যখন আপনি জড়িয়ে ধরে আদর করবেন তখন শিশু আপনার ঘ্রাণের সাথে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি আপনাদের দুইজনের মস্তিষ্কেই অক্সিটোসিন নামক এক ধরণের হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোনটি দুইজনের মধ্যে একটি চমৎকার ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করে দেয়।

বুকের দুধ খাওয়ার সময় শিশুকেই নিপল খুঁজে নিতে দিন

শিশুদের নাক যথেষ্ট পরিমাণ সংবেদনশীল হয়ে থাকে, যার কারণে শিশু বুকের দুধের ঘ্রাণ খুব সহজেই চিনতে নিতে পারে। আপনি যদি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে যান, তাহলে শিশুকে ঘ্রাণশক্তির মাধ্যমে নিজেকেই নিপল খুঁজে নিতে দিন।

শিশুকে বেশি বেশি পরিচিত ঘ্রাণ নিতে দিন

পরিচিত ঘ্রাণ পেলে শিশুরা বেশ শান্ত থাকে। প্রাথমিক দিকে যখন শিশুকে একা শোয়ার জন্য দিবেন তখন তার পাশে আপনার একটি টিশার্ট রেখে দিন। এতে করে শিশু বেশ শান্ত থাকবে, কেননা শিশুর আশেপাশে তখন আপনার পরিচিত সেই ঘ্রাণটিই রয়েছে। এছাড়াও শিশু তার আশেপাশের জিনিসেরও ঘ্রাণ চিনে থাকে, যেমন তার কোন খেলনা, চাদর অথবা কোলবালিশ ইত্যাদি।

এছাড়াও শিশু যখন কান্নাকাটি করে তখন বাবা মা এর ঘ্রাণ তাকে শান্ত হতে সাহায্য করে। একই ভাবে পরিচিত জায়গার ঘ্রাণও শিশুকে শান্ত রাখে।

ঘুমানোর সময় শিশুকে তার প্রিয় ঘ্রাণের সংগে রাখুন

আপনার শিশুর যদি কোন বিশেষ কম্বল অথবা খেলনার প্রতি আকর্ষণ বেশি থাকে তাহলে তাকে ঘুম পাড়ানোর সময় সেই পরিচিত জিনিসটি আশেপাশে রাখুন। পরিচিত এবং এই প্রিয় জিনিসটির ঘ্রাণ শিশুকে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যেতে সাহায্য করবে।

আর ঠিক তাই জিনিসটি ভালো করে ধুয়ে আবার শিশুকে দিলে শিশু যদি নিতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে মোটেও অবাক হবেন না। তার আশেপাশে খেলনাটি রেখে দিন, কয়েকদিনের মধ্যেই জিনিসটি আবার শিশুর প্রিয় হয়ে উঠবে।

ঘ্রাণের মাধ্যমে শিশুকে কোন কিছু মনে করিয়ে দিন

মস্তিষ্কের একই অংশ দিয়ে ঘ্রাণশক্তি এবং স্মৃতি শক্তি পরিচালিত হয়ে থাকে। আর তাই যে কোন নির্দিষ্ট ঘ্রাণ শিশুকে নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ঠিক একই রকম, আর তাই অনেক বছর পরে হলেও নির্দিষ্ট কোন ঘ্রাণ শিশুকে পুরানো কোন একটি অভিজ্ঞতার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।

নতুন কোন ঘ্রাণের সাথে পরিচিত হওয়ার সময় শিশুকে শান্ত রাখতে সচেষ্ট হন

শিশু তিন  মাসের সময় পরিচিত গন্ধ অথবা অপরিচিত গন্ধের বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন হয়ে পড়ে। আর তাই ঠিক তখন শিশুর আশেপাশে যদি কোন অপরিচিত মানুষ আসে তখন শিশু বেশ খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং কান্নাকাটি শুরু করে। এই সময়ে শিশুকে কথা বলে বলে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন।

আপনার কোন বন্ধু অথবা আত্মীয় যদি বেশ কিছুদিন আশেপাশে থাকে তাহলে তাকে বলুন শিশুর সাথে যাতে শান্ত গলায় কথা বলে এবং যাতে জড়িয়ে ধরে। এর মাধ্যমে শিশু নতুন ঘ্রাণের সাথে ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে যাবে।

খাবারের ঘ্রাণ নিতে দিন

ছয় মাস বয়সের দিকেই শিশু কোন ঘ্রাণটি পছন্দ এবং কোনটি অপছন্দ সেটা প্রকাশ করে ফেলতে পারে। আর তাই এই সময়ে শিশুকে নিত্য নতুন শাক সবজি ও ফল ফলাদির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করুন। প্রতিনিয়ত এমন খাবারের সাথে পরিচিত করিয়ে দিলে শিশু কেবল সেই ঘ্রাণের সাথেই পরিচিত হবে না বরং শিশুর একটি চমৎকার খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠবে।

যে কোন কিছুর ঘ্রাণের সাথে সাথে শিশুকে সেই জিনিসের নাম বলুন

বিজ্ঞাপণ

শিশুকে পরিচিত যে কোন কিছুর ঘ্রাণ নেয়ার সাথে সাথে সেই জিনিসের নাম বলে দিলে তার মধ্যে একইসাথে মানসিক ও ঘ্রাণশক্তি বিকশিত হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির মাইলস্টোনগুলো দ্রুত অতিক্রম করতে সাহায্য করা যেতে পারে।

ল্যাভেন্ডার অথবা সুইট আলমোন্ড জাতীয় তেল ব্যবহার করুন

যদিও শিশু জন্মগ্রহণের পর বেশ কিছুদিন ঘরের মধ্যে এয়ার ফ্রেশনার অথবা সুগন্ধি মোমবাতি ব্যবহার না করাই ভালো। তবে শিশুকে শান্ত রাখতে খুব সামান্য ও চমৎকার সুগন্ধি তেল ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন ল্যাভেন্ডার অথবা সুইট আলমন্ড এর তেল শিশুকে শান্ত রাখতে বেশ সাহায্য করে বলেই দেখা গেছে।

একটা গবেষণায় দেখা গেছে যে, কলিক বাচ্চাদের এই ধরণের তেল দিয়ে শিশুকে ম্যাসাজ করে দিলে শিশু অনেকটা শান্ত থাকে। তবে এটা এখনো জানা যায় নি যে, শিশু কি আসলে ম্যাসাজের কারণে নাকি ল্যাভেন্ডার জাতীয় তেল এর কারণে শান্ত থাকে।

তবে যে কোন ধরণের এসেনশিয়াল তেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে আপনাকে একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। খেয়াল রাখবেন যাতে করে এগুলো সরাসরি শিশুর শরীরের ত্বকে না লেগে যায়। কেননা এগুলো শিশুর ত্বকের জন্য বেশ ক্ষতিকর এবং অনেক শিশু আবার এই ধরণের এসেনশিয়াল তেল এর প্রতি বেশ সংবেদনশীলও হয়।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment