সন্তান ঠিকমত খাওয়া দাওয়া না করতে চাইলে সব বাবা-মায়েরাই বেশ দুশ্চিন্তায় ভোগেন। তবে আমরা নিজেরাই শিশুর খাওয়ার প্রতি অনীহার কারণ হয়ে উঠছি কি না সেটা নিয়েও কিছুটা ভাবা প্রয়োজন। কেননা একটু সঠিক পদ্ধতিতে খাওয়ালেই হয়ত শিশু ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করবে।
শিশুর খেতে না চাওয়াকে একটি বদ অভ্যাসের কাতারে ফেলে দিয়ে, নিজেদের দোষগুলোর দিকে হয়ত অনেক বাবা মায়েরাই তেমন লক্ষ্য রাখেন না। আমরা আজ কথা বলব এমনই কিছু ভুল নিয়ে, যে ভুলগুলো শিশুকে খাওয়ানোর সময় আমরা হরহামেশাই করে থাকি।
১। স্বাধীনভাবে খেতে না দেয়া / খাবার খেতে জোর করা
এমনটা প্রায় সময়েই দেখা যায় যে শিশুর খাবার যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন শেষের অল্প কিছু খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়ার জন্য আমরা প্রায়ই জোর করে থাকি। এমনকি এই শেষ খাবারগুলো খুব দ্রুত শেষ করে ফেললে মিষ্টি খেতে দিব অথবা চকোলেট খেতে দিব, এমনটা আমরা প্রায়ই বলে থাকি।
একটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে প্রায় ৮৫ শতাংশ বাবা-মা শিশুর খাদ্যাভ্যাসকে নিজের মত করে নিয়ন্ত্রণ করতে চান। আবার এমনটাও দেখা যায় যে শারীরিক ভাবে হালকা শিশুকে বেশি খাবার গ্রহণের জন্য জোর করা হয় এবং ঠিক একই ভাবে শারীরিক গঠন যাদের একটু বড় অথবা ভারী, তাদের জোর করা হচ্ছে খাবার কম খাওয়ার জন্য!
কেন এটা ভুল?
প্রত্যেকটি শিশুই তার নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার গ্রহণের ক্ষমতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে অর্থাৎ সে তার শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ীই খায়। আর যখনই বাবা-মা শিশুর স্বাভাবিক এই ক্ষমতাকে নিজের মত করে নিয়ন্ত্রণ করতে চান, সেটা শিশুর খাবার গ্রহণের অভ্যাসের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। যখন তাকে খাবার নিয়ে জোর করা হয় তখন সে তার শরীরের প্রয়োজনটুকু বুঝতে পারেনা।
গবেষণায় দেখা গেছে খাবার নিয়ে জোর করলে কোন কোন শিশুর খাবারের প্রতি অনীহা জন্মায় আবার কেউ কেউ খিদে না থাকা সত্ত্বেও খেতে থাকে কারণ তারা বুঝতে পারেনা তাদের শরীরে খাবারের চাহিদা আছে কিনা।
করনীয় কি?
আমেরিকান একাডেমিক অফ পেডিয়াট্রিকস সহ বেশীরভাগ স্বাস্থ্য সংস্থার মতেই খাদ্য সম্পৃক্ত দায়িত্ব অভিভাবক এবং শিশু উভয়ের উপরে ভাগ করে দেয়া ভালো। পুরো বিষয়টি কিছুটা এমন হওয়া উচিৎ যে শিশু কি খাবে, কখন খাবে এবং কোথায় খাবে, এই দায়িত্বগুলো বাবা মায়ের উপরেই থাকুক। কিন্তু কতটুকু খাবে সেটা শিশুর উপরেই ছেড়ে দেয়া ভালো। ফলাফল স্বরূপ শিশুর মধ্যে স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে এবং বিভিন্ন ধরণের খাবার খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হবে।
২। খাবারের সুনির্দিষ্ট রুটিন না থাকা
সব বাবা-মায়েরাই চান যে তাদের সন্তানের ইচ্ছেগুলো যেন অপূর্ণ না থাকে। তবে কোন ইচ্ছে শিশুর জন্য আদৌ মঙ্গল আর কোনটি শিশুর জন্য খারাপ সেটা অনেকে বুঝলেও, বেশীরভাগ বাবা মায়েরাই খাবারের ব্যাপারে কিছুটা উদার হতে চেষ্টা করে থাকেন। সময় অসময় শিশুর বিভিন্ন ধরণের খাবারের প্রতি আবদার, বাবা মায়েদের বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথেই পূরণ করতে দেখা যায়।
কেন এটা ভুল?
শিশুর খাবারের সুনির্দিষ্ট কোন রুটিন না মানলে শিশু প্রতিদিন ঠিক কতটুকু খাবার খাচ্ছে সেটা আপনি জানতে পারবেন না। আর একই ভাবে আপনি কখনোই বুঝতে পারবেন না যে শিশু খাবারের সাথে পরিমিত পুষ্টিগুণ গ্রহণ করতে পারছে কি না। একই সাথে এমন অভ্যাসের কারনে শিশু প্রয়োজনীয় ও পরিমিত খাবার গ্রহণ করার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
এছাড়াও এমন অভ্যাসের কারণে শিশু বুঝতে পারেনা খিদে কি এবং কখন তার খাবার খাওয়া প্রয়োজন। বরং তার ধারণা হয় যখনই সে খেতে চাইবে এবং যা সে খেতে চাইবে, তাই পাবে। এগুলো বাচ্চার নিয়মিত এবং স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্তরায়।
করনীয় কি?
শিশুর খাদ্যাভ্যাসের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রুটিন আপনাকে তৈরি করে নিতে হবে। তিন বেলা খাবার এবং মাঝে নাশতা খেতে দেয়ার রুটিনটা খুব ভালভাবে মেনে চলতে পারলে আপনি ঠিক বুঝতে পারবেন শিশু প্রতিদিন কি পরিমাণ পুষ্টি গ্রহণ করছে। এছাড়া কোন এক বেলায় পুষ্টিকর খাবার না দিলেও পরের বেলায় পুষ্টিকর খাবার দিয়ে সেই অভাব পূরণ করে দেয়া সম্ভব হয়।
৩। মিষ্টি কিছু বা চকলেটের প্রলোভন দিয়ে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো
“তুমি যদি এই সবজী খেয়ে নাও, তাহলে আপনি তোমাকে চকোলেট খেতে দিব” শিশুকে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের জন্য আমরা প্রায়ই এই ধরণের প্রলোভন দেখিয়ে থাকি। আমরা অনেকেই হয়ত মনে করি যে, এভাবে কৌশল অবলম্বন করলেও, শিশু অন্তত পুষ্টিকর খাবার তো খাচ্ছে!
কেন এটা ভুল?
প্রকৃতপক্ষে এই ধরণের কৌশল অবলম্বন করার কারণে শিশু কখনই পুষ্টিকর খাবারের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে না। এমনকি ২০০৭ সালে শিশুদের খাদ্যাভ্যাসের উপরে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই ধরণের কৌশল অবলম্বন করার ফলে শিশুকে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে অনুৎসাহিত করা হয়। এমনকি সেই চকোলেট বরং পুষ্টিকর খাবার থেকে অনেক ভালো খাবার, এই ধরণের ধারণা শিশুর মধ্যে চলে আসে।
আর তাই এই ধরণের বিভিন্ন মিষ্টি জাতীয় অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি শিশুর আলাদা এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হয়ে যায়।
করনীয় কি?
শিশুকে চকোলেটের প্রলোভন না দেখিয়ে বরং শিশুর প্রতিদিনের রুটিনের মধ্যে পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর মিষ্টি জাতীয় খাবারও রাখুন। শিশুর দৈনন্দিন খাবারের দশ ভাগের এক ভাগ মিষ্টি জাতীয় খাবার এবং বাকি নয় ভাগ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের একটি সুষম অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করুন। তার পছন্দের খাবার খাওয়ার জন্য সবজি বা পুষ্টিকর খাবার খাওয়াকে শর্ত হিসেবে জুড়ে দেবেন না।
৪। ৬/৭ বছরের শিশুর জন্য আলাদা খাবার তৈরি করে রাখা
শান্ত নামের একটি শিশুর কথা ধরা যাক, পরিবারের সবাই যখন একসাথে খাবার খেতে বসত তখন শান্তকে দেখা যেত প্রায়ই খাবার নিয়ে নানা বাহানা করছে। আর তাই শান্ত’র মা এখন সবার জন্য রান্না করা খাবারের পাশাপাশি শান্তর জন্য আলাদা ভাবে তার পছন্দ অনুযায়ী কিছু রান্না করে রাখেন। যদি শান্ত সবার সাথে একই খাবার খেতে না চায়, তাহলে তার মা শান্ত’র পছন্দ অনুযায়ী তৈরি করে রাখা খাবারটি তাকে খেতে দেন।
কেন এটা ভুল পদক্ষেপ?
শিশু যত বড় হতে থাকে, ততই তার সব ধরণের খাবার খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হতে থাকে। কারো মধ্যে এই অভ্যাসটি তৈরি হতে কিছুটা সময় নেয় আবার কেউ দ্রুতই এই অভ্যাস রপ্ত করে ফেলে। শান্ত’র ক্ষেত্রেও হয়ত ঠিক এমনটা হয়েছে, সব ধরণের খাদ্য গ্রহণ করার অভ্যাস তৈরি হতে হয়ত তার একটু সময় লাগছে বেশি।
শান্ত’র জন্য আলাদা ভাবে খাবার তৈরি করে রাখার কারণেই কিন্তু শান্ত প্রতিনিয়ত সবার সাথে একই খাবার গ্রহণের প্রতি অনুৎসাহিত হয়ে পড়ছে। আর এভাবে কখনোই তার মধ্যে সব ধরণের খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস তৈরি হবে না।
করনীয় কি?
শিশুর পছন্দ অনুযায়ী আলাদা খাবার তৈরি না করে বরং সবার জন্য তৈরি করা খাবার থেকে তাকে বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দিন। সে যদি বলে মাংসের সাথে আলু খাবেনা তবে তাকে তাই করতে দিন। এতে তার নতুন পাওয়া স্বাধীনসত্তা খর্ব হবেনা এবং সে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে। সে যদি কিছুই খেতে না চাই তবে মাঝে মাঝে তাই করতে দিন। খিদে পেলে সে ঠিকই খাবে এবং না খাওয়ার ফল কি হতে পারে তা বুঝতে শিখবে।
৫। শাক সবজী খাওয়ার জন্য জোর করা
শিশু যদি সঠিক পরিমাণে শাক সবজী না খেতে চায়, সেটা সব বাবা মায়ের জন্যই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর সেই চিন্তা থেকেই অনেক বাবা মা শিশুকে জোর করে হলেও শাক সবজী খাওয়ানোর জন্য চেষ্টা করে থাকেন।
কেন এটা ভুল পদক্ষেপ?
প্রায় সত্তর শতাংশ শিশুকেই প্রয়োজনীয় শাক সবজী খাবার প্রতি অনীহা প্রকাশ করতে দেখা যায়। অনেকে শিশুই এর স্বাদ শুরুতে পছন্দ না করলেও ধীরে ধীরে তা কেটে যেতে থাকে। আর এমন সময়ে বাবা মা যখন সেটার প্রতি জোর করতে থাকেন তখন শাক সবজির প্রতি আগ্রহ তো তৈরি হয়ই না বরং বিতৃষ্ণা আরো বেড়ে যায়।
করনীয় কি?
একটা ব্যাপার আমরা সবসময় ভুলে যাই, সেটা হল শিশুকে কিন্তু প্রতিদিনের পুষ্টির অভাব পূরণ করার জন্য দুপুর অথবা রাতের খাবারের সময়ই যে শাক সবজী খেতে হবে তা নয়। সে যদি অন্যান্য খাবার বা ফলমূল থেকে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় তবে প্রতিদিন শাক সবজি খাওয়ার প্রয়োজন নেই।
এছাড়াও নানা উপায়ে শাক সবজী দিয়ে মজাদার নাশতা তৈরি করে দিলে, এমনকি স্মুদি সহ নানা ধরণের জ্যুস তৈরি করে দিলেও কিন্তু সেখানে থেকে শিশু সঠিক পরিমাণে পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে।
৬। বাব মায়েরা যখন শিশুর খাদ্যাভ্যাসকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে চান
শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির সাথে সাথেই নির্দিষ্ট কোন খাবারের প্রতি অনীহা অথবা নির্দিষ্ট কোন খাবার বেশি পছন্দ করতে দেখলে বাবা মায়েরা ধরেই নেন এটি একটি সমস্যা। যেহেতু এই বিষয়টাকে তারা সমস্যা মনে করছেন, তাই প্রতিনিয়ত এই সমস্যার সমাধান করার জন্যও নানা ধরণের চেষ্টা করতে থাকেন।
কেন এটা ভুল পদক্ষেপ?
আদতে ব্যাপারটি যে শুধু খাবারের ক্ষেত্রেই হয় তা নয় বরং শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে যে কোন বিষয়েই নিজের ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ পাওয়া শুরু করে এবং এমন হয়াটাই খুব স্বাভাবিক। এসব কোন খাবার নিয়ে জোর করা হলে বা ভয় ভীতি দেখিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করা হলে বরং সে খাবারের প্রতি তার স্থায়ী অনীহা চলে আসতে পারে।
তাই এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা নয় বরং এই অভ্যাসের সাথেই কীভাবে খাপ খাইয়ে শিশুকে পুষ্টিকর খাবার প্রদান করে যেতে পারে সেদিকেই বাবা মায়েদের বেশি মনোযোগ দেয়া উচিৎ।
করনীয় কি?
সাধারণত ছয় থেকে দশ মাস বয়স থেকেই শিশুর মধ্যে যে কোন খাবারের প্রতি অনীহা বা আগ্রহ প্রকাশ পেতে থাকে। আর শিশু যখন বছর দুয়েকের মত বয়সে উপনীত হয় তখন সে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীন হতে থাকে অর্থাৎ নিজের ব্যক্তিগত পছন্দ এবং অপছন্দের প্রতি জোর দিতে থাকে। এমতাবস্থায় শিশুর খাদ্যাভ্যাসের সাথেই খাপ খাইয়ে যতটা সম্ভব পুষ্টিকর খাবার প্রদান করা জরুরী।
যখন বাচ্চাকে খাবার দেবেন তখন এটা তাকে বুঝতে দিন যে কি খাবার দেয়া হবে সেটি আপনি ঠিক করবেন কিন্তু সে কোন খাবারটি খাবে এবং কতটুকু খাবে সে সিদ্ধান্ত সে নিতে পারবে। এতে সে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাববে এবং একসময় যেটা তাকে দেয়া হবে সেটাই খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে।
৭। শিশুকে খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন করার প্রবণতা
অনেক বাবা মা আছেন যারা শিশুকে একদম অল্প বয়স থেকেই খাদ্য ও পুষ্টি সম্পৃক্ত অনেক কিছু জানানোর জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। পুষ্টিকর খাবার না খেলে বিভিন্ন ধরণের অসুখ হতে পারে, আবার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সুস্থ রাখার জন্য নির্দিষ্ট পুষ্টির প্রয়োজন রয়েছে এমন জটিল তথ্য উপাত্ত অনেক বাবা মায়েরাই শিশুকে জানানোর চেষ্টা করেন।
কেন এটা ভুল পদক্ষেপ?
আদতে খাদ্য ও পুষ্টি সম্পৃক্ত জটিল কথাবার্তা ও তথ্য উপাত্ত প্রাপ্তবয়স্কদেরই মাঝেমধ্যে কনফিউজড করে দিতে পারে। আর তাই এতে করে খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে শিশু আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে।
করনীয় কি?
শিশু যখন কিছুটা বড় হবে এবং স্কুলে যাবে, তখন ধীরে ধীরে শিশুকে বিভিন্ন পুষ্টি সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে শিশু যখন নিজে থেকেই কিছু জানতে চাইবে তখন এর সঠিক উত্তর দেয়াটাই সবচাইতে কার্যকরী। আপনি যদি নিজ থেকেই তাকে হৃদরোগ সম্পর্কে বোঝাতে শুরু করেন এবং এজন্য কি খাওয়া জরুরী সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন তবে তা তার উপর খুব একটা প্রভাব ফেলেনা।
এগুলো না করে বরং শিশুকে খাবার কেনার সময় বা তৈরি করার সময় সাথে রাখুন। তাকে খাবার নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে দিন। এগুলো তার খাবারের প্রতি আগ্রহ অনেকগুনে বাড়িয়ে দিবে।
৮। ছোট শিশুর খাবারের সময় তাকে খুব বেশি পরিষ্কার রাখার প্রবণতা
নিজে থেকেই কোন কিছু খাওয়ার মত বয়স যখন শিশুর হয়ে যায়, তখনও বাবা মায়েরা শিশুকে নিজ থেকে খেতে দিতে চান না। কেননা তারা ভাবেন শিশুকে এই বয়সে নিজ থেকে খেতে দিলে সে গায়ে মাখিয়ে ফেলবে, ঠিকমত খেতে পারবে না বরং জামা কাপড়ে খাবার ফেলে নোংরা করে ফেলবে।
কেন এটা ভুল পদক্ষেপ?
শিশুর প্রতি এই নিয়ন্ত্রণের কারণে তার খাবারের প্রতি অনীহা চলে আসতে পারে। শিশু নিজের হাত দিয়ে খাবারের সময় অনেক বেশি আগ্রহী ও উৎসাহী হয়ে উঠে এবং এভাবেই বিভিন্ন ধরণের খাবার ও ফলমূলের সাথে শিশুর পরিচয় হয়।
করনীয় কি?
একটি খাবার ধরতে ও খেতে কেমন, সেটার রঙ ও গন্ধ কেমন এই ধরণের অনুভূতির সাথে শিশুর পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য মাঝেমধ্যে জামা কাপড় একটু নোংরা হলেও শিশুকে নিজ হাতে খেতে দেয়া উচিৎ। বাচ্চা প্রথম খাওয়া শুরু করলে তা কোনভাবেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ব্যাপার হবে না। না হোক, আপনার একটু কষ্ট হলেও ওকে স্বাধীনভাবে খেতে দিন। এতে খাওয়ার প্রতি ওর আগ্রহ বাড়বে ও তাড়াতাড়ি খেতেও শিখবে।
৯। একদম ছোট শিশুকে বড়দের খাবারের স্বাদ নিতে দেয়া
আমরা বড়রা যখন কফি খাই, আইসক্রিম খাই সেখান থেকে অল্প একটু নিয়ে একদম ছোট শিশুর মুখে আমরা প্রায়ই দিয়ে থাকি। ছোট শিশুটি এই নতুন স্বাদ গ্রহণ করে যখন খুব অবাক হয়, সেটা দেখতে আমাদের খুব ভালো লাগে! আমরা ভাবি এতে আর তেমন কিই বা ক্ষতি হতে পারে?
কেন এটা ভুল পদক্ষেপ?
একটি শিশু দুধ এবং মিষ্টি জাতীয় স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা ও এগুলোর প্রতি আগ্রহ নিয়েই জন্ম গ্রহণ করে। ছয় মাস বয়স থেকেই তার মধ্যে লবণের প্রতিও আগ্রহ তৈরি হয়। আর ছোট শিশুকে যত বেশি এসব খাবারের সুযোগ দেয়া হবে ততই তার এসব খাবারের প্রতি আগ্রহ প্রবল হতে থাকবে।
করনীয় কি?
বেশীরভাগ শিশু বিশেষজ্ঞের মতেই দুই বছরের আগ পর্যন্ত শিশুকে চিনি, লবণ বা ফাস্টফুড একেবারেই দেয়া যাবেনা। বাচ্চার স্বাদ এবং রুচি শুরুতেই কিন্তু বড়দের মত হয়না। তাই তার জন্য রান্না করা খাবার আমাদের একটু বিস্বাদ লাগলেও এ ক্ষতিকর উপাদান দুটো (লবণ ওচিনি) ব্যাবহার না করাই শ্রেয়। খুব সুস্বাদু করে লবণ, চিনি ব্যাবহার করে বিভিন্ন খাবার অফার করলেই বরং পরবর্তীতে খাবার নিয়ে বায়না করার সম্ভাবনা বাড়ে এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে।
১০। শিশুদের রান্নাঘর থেকে দূরে রাখা
চুলার তপ্ত আগুনে কোন কিছু রান্না হচ্ছে, আর আপনার হাতেও হয়ত একটি ধারালো ছুড়ি! হ্যাঁ! রান্নাঘরের এমন দৃশ্য তো খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। তবে এমন দৃশ্য আপনার শিশুর নিরাপত্তার জন্য কিছুটা বিপজ্জনক মনে হতেই পারে, আর তাই রান্নাঘর থেকে শিশুকে দূরে রাখতে চাওয়াটাও স্বাভাবিক।
কেন এটা ভুল পদক্ষেপ?
গবেষণায় দেখা গেছে খাবার প্রস্তুত এবং পরিবেশনের প্রক্রিয়ার মধ্যে শিশুও যদি অংশগ্রহণ করে তাহলে সেই খাবার খেতেও শিশু বেশ আগ্রহী হবে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স কলেজ, কিন্ডারগার্টেনের ৬০০ শিশুর প্রতি একটি গবেষণা করেছিল। গবেষণাটির উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে উৎসাহী করে তোলা। কর্তৃপক্ষ সেখানে একটু ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করার মাধ্যমে এই গবেষণাটি করেন।
তারা শিশুদের দিয়ে কিছু পুষ্টিকর খাবার রান্না করানোর একটি ওয়ার্কশপ আয়োজন করেন। রান্না শেষে দেখা গেল, শিশুরা সেই খাবার অনেক আগ্রহের সাথেই খাচ্ছে। এমনকি কোন কোন শিশুকে দ্বিতীয়বার খাবার নেয়ার জন্যও আগ্রহী হতে দেখা গেছে।
শিশুকে রান্না প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা একটি ভুল পদক্ষেপ, উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়য়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগের একজন অধ্যাপক ইসোবেল ঠিক এমনটাই মনে করেন। তিনি আরো বলেন, “শিশুরা যখন খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যে অংশগ্রহণ করে তখন তারা বেশ আগ্রহের সাথেই সেই খাবার খেতে চায়”।
করনীয় কি?
মজার বিষয় হল সেই গবেষণায় দেখা গেছে, যে খাবারের প্রতি শিশুর এমনিতেই অনাগ্রহ ছিল, নিজে রান্না করার পর সেই খাবারও শিশুটি বেশ আগ্রহের সাথে খেয়েছে! আর তাই আমাদের উচিৎ খাদ্য প্রস্তুতির বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে শিশুকেও অংশগ্রহণ করতে দেয়া। এতে পুষ্টিকর খাবারের প্রতি শিশুর আগ্রহ বজায় থাকবে।
১১। শিশুর সামনে কোন খাবারের প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করা অথবা ডায়েটিং করা
শিশুরা সাধারণত বাবা-মাকেই বেশি অনুসরণ করে থাকে, আর ঠিক সেটার প্রভাব পরে তার খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও। সাধারণত বাবা-মা যে খাবার খায়, শিশুও সেই খাবার খেয়ে থাকে। শিশু ও বাবা মায়ের খাদ্যাভ্যাসের উপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে বাবা-মায়ের মধ্যে যদি কোন খাবারের প্রতি অনীহা থাকে তাহলে শিশুর মধ্যেও সেই খাবারের প্রতি অনীহা প্রকাশ পায়।
এমনকি ২০০৫ সালের দিকে হেলথ সাইকোলজি জার্নালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, যে সব মায়েরা নিজেদের ওজন নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত তারা নিজেদের মেয়ের ওজনও যাতে না বৃদ্ধি হয় সেদিকে উৎসাহ প্রদান করে থাকেন।
কেন এটা ভুল পদক্ষেপ?
যেহেতু শিশু সবকিছুতেই তার বাবা-মাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে, তাই কোন মা বাবা যদি নিজেদের ওজন কমানোর জন্য শিশুর সামনে ডায়েটিং করে থাকেন, তাহলে শিশুর মধ্যেই বিভিন্ন খাবার কম খাওয়ার প্রবণতা চলে আসবে।
এছাড়া ২০০৫ সালে প্রকাশিত সেই রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায় যখন ডায়েট করার বিষয়টি বাবা মায়ের মনের মধ্যে গেঁথে যাচ্ছে তখন সেটা নিজেদের সন্তানের উপরেও প্রয়োগ করার প্রবণতা দেখা যায়। একটি নির্দিষ্ট বয়সের আগে শিশুর খাবারের প্রতি এই ধরণের নিয়ন্ত্রণ বা নিষেধাজ্ঞা শিশুকে বিভিন্ন ধরণের পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার প্রতি অনুৎসাহিত করে তোলে। এছাড়া এটা শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতেও বাধা সৃষ্টি করে থাকে।
করনীয় কি?
শিশুর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে কখনই জোর করা উচিৎ নয় এবং সেটাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করাও ঠিক নয়। শিশুকে তার খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেই স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার প্রদান করা উচিৎ। শিশুর সামনে ডায়েট করে শিশুকে অনুৎসাহিত না করে বরং শিশুর সামনে পুষ্টিকর খাবার খেয়ে শিশুকে উৎসাহিত করা উচিৎ।
সবার জন্য শুভকামনা।