মা হওয়ার গল্প | সোমা সরকার

Spread the love

ছোটবেলা থেকেই ছোটবাচ্চাদের প্রতি একটা অন্যরকম টান অনুভব করতাম। দেখলেই কোলে নিতাম। খুব অবাক লাগতো দেখে যে,বাচ্চা যতই কান্না করুক না কেন মায়ের কোলে গিয়ে ঠান্ডা হয়ে যেত।তখন তো ছিলাম মেয়ে তাই মা হওয়ার মর্ম বুঝি নাই।

আমি আজ আমার মা হয়ে ওঠার গল্প বলবো। অনেক বাধা,উৎকন্ঠা,অজানা আশঙ্কা,আর পরিতৃপ্তি মিশ্রিত অভিজ্ঞতা।

বিজ্ঞাপণ

আমার মেয়েটা পেটে আসার পর থেকেই ভাবতাম কবে একে কোলে নিবো। অপেক্ষার প্রহর যেন কাটতো না। প্রতিটা চেক আপ টাইম টু টাইম করতাম। বেবি হওয়ার ডেট ছিল ২০১৮ সালের জুলাই এর ৭ তারিখ। জুনের ১৯ তারিখ ছিল লাস্ট চেকআপের ডেট। তো তখন ঈদের সময়,হাসপাতালে ভীর ছিল।তাই ভাবলাম পরের সপ্তাহে যাব। তাই ২৬ জুন দুপুর ১ টার দিক বের হলাম আমি আর আমার হাসবেন্ড। বাইরে বের হয়েছি, মেয়েটা তো পেটে নড়েচড়ে উঠলো। বাইরে বের হলেই যেন টের পেত!

হাসপাতালে আল্ট্রা করতে রুমে ঢুকলাম। পেটে মেশিনটা ধরে মহিলা ডাক্তার তার ভ্রু কুচকে আছে। বার বার জেল পেটে ঢালছে আর মেশিনটা বিভিন্ন এঙ্গেলে ঘুরিয়ে দেখছে। অন্য সময় থেকে আধা ঘন্টা সময় বেশি রাখলো। আমি বার বার জিজ্ঞেস করলাম কোন সমস্যা? আমার বেবি ঠিক আছে তো? উনি বললো আজই রিপোর্ট ডাক্তার কে দেখিয়ে যাবেন।আর পানি এত কম কেন?

রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্ত ভয় লাগলো খুব। ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখাতে প্রথম কথা হলো- আচ্ছা আপনার বাচ্চা নড়ছে তো? আমি বললাম হ্যা নড়ছে তো। বললো পানি খুব কমে গেছে ৪ এর নিচে। এখনি সিজার করতে হবে। এদিকে হাসপাতালে আমি আর আমার হাসবেন্ড। উনাকে তো ভিতরে ঢুকতে দিবে না। আমি নিজেই একা একা ভর্তি হলাম।

হাসপাতালে পরিচিত এক বোন ছিল।কিন্তু ঐ টাইমে সে ডিউটিতে ছিল না।কিন্তু ফোনে কয়েকজন কে বললো। তাদের একজন আমার কাছে এসে বললো,দিদি আমার ডিউটি আজ সিজার রুমে। আর আধা ঘন্টা পর ডিউটি শেষ হবে। তাই এখনই চলুন,আমি থাকতে থাকতে আপনার ডেলিভারীটা হয়ে যাক।

এদিকে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বাসা থেকে মহিলা কেউ আসতে পারছে না। আমার হাসবেন্ড বাইরে বসা।ভিতরে কি হচ্ছে কিছু জানছে না।এদিকে ঐ মেয়েটাই সব কিছু করলো। এমনকি ওটি তে ঢুকার একটা ড্রেস ও কোথা থেকে এনে পরিয়ে দিল। এবার বাইরে এসে হাসবেন্ড এর সাথে দেখা করে ওটি রুমে ঢুকলাম। কোমরে সুই দিল। তারপর ও যেন বুঝছিলাম মেয়েটা কখন বের হলো। বের হয়েই কান্না । একটা ছোট ট্রে তে করে আমার সামনে ধরলো।

আমি ওকে দেখলাম। চোখ থেকে দুফোটা আনন্দ অশ্রু ঝরে পরলো। তখনও আমি কেমন যেন ঘোরের মধ্যে। মনে হচ্ছে একটু আগেই তো পেটে ছিল, এখন এত তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেল। আমি মা হলাম। এখন মাথায় চিন্তা আসলো মেয়ে কে যে নিয়ে গেল,আবার যদি ভুলে অন্য বাচ্চার সাথে পাল্টে ফেলে!! সে কি চিন্তা আমার। হবে ই বা না কেন? আমি যে এখন মেয়ে নই,একজন মা।

যা হোক আমার রক্তের গ্রুপ ছিল বি নেগেটিভ আর মেয়ে পেয়েছে তার বাবার গ্রুপ বি পজেটিভ।মেয়েকে প্রাথমিক চেক আপের পর আমার কাছে দিল।ওজন ছিল ২২০০ গ্রাম।

আমাকে যখন বেডে দিল,মেয়ে কে তো ডায়াপার চেঞ্জ করতে পারিনা। কোন দিন তো করি নি। আর আমার মা বা শাশুড়িও পারেন না। পাশে ছিল এক আয়া। উনি নিজ থেকে এগিয়ে আসলে চেন্জ করাতে,করলেন। কিন্তু এটা আমার ভুল ছিল।কারন সে পরিষ্কার আছে কি না তা না জেনেই সদ্যজাত শিশুকে তাকে দিলাম।

এরপর করলাম আরেক ভুল। পরের দিন ২৭ তারিখ আমার হাসবেন্ড অফিস থেকে এসে মেয়েকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের বারান্দা করিডোর হেটে বেড়ালেন। মেয়েটাও ছোট ছোট চোখ দিয়ে দেখছে।দুজনের ই কি আনন্দ। কখনও মনে হয়নি হাসপাতালে কত রকম জার্ম ঘোরে এগুলো তো বাচ্চার ক্ষতি করতে পারে। মনে হবেই বা কি করে!! আমি যে সবে মাত্র মেয়ে থেকে একজন মা হয়েছি। এর ফলটা হাতে হাতে পেলাম ২৭ তারিখ রাতেই।

আমার কেবিনে আমি আমার মা আর শাশুড়ি। পুরুষ মানুষ রাতে এলাউ না। তো রাত থেকে শান্ত শিষ্ঠ এক দিনের মেয়েটা খুব কান্না জুরে দিল। সে কি কান্না। প্রথমে ভাবলাম হয়তো দুধ পাচ্ছে না তাই খিদায় কাদছে। আমার সেলাই এর ব্যাথা গায়েব হয়ে গেল। গতকাল যে মেয়ে সিজার হলো একদিন পর ই সে মা হয়ে বাচ্চার কান্না সহ্য করতে না পেরে একা একা উঠে বসে বাচ্চা কে দুধ খাওয়ানো চেষ্টা করলাম।

বিজ্ঞাপণ

এদিকে তার কান্না তো কমে না। রাত তখন তিনটা আমার মা মেয়েকে কোলে নিয়ে ছুটলেন তিন তালায় ডাক্তার এর কাছে। ভাগ্যিস নিয়েছিল। দেখা গেল মেয়ের ১০১ এর উপর জ্বর। সাপোসিডার দিল। কিন্তু তাতেও জ্বর কমে না। পরের দিন সকালে হাসবেন্ড আসলো। মেয়ে কে কোলে নিয়ে আবার গেল ডাক্তারের কাছে। দেখে জ্বর আরো বেড়েছে। বলে রাখি বাচ্চা দের প্রথম ৪৫ দিনে মধ্যে জ্বর আসা খারাপ লক্ষণ। আর আমার মেয়ের তো বয়স একদিন।

ডাক্তার ইমিডিয়েট এনআইসিইউ তে ভর্তি করাতে বললো। এনআইসিইউতে ঢুকানোর সময় একদিনের বাচ্চাটা তার বাবার শার্টের কলারটা ধরে রেখেছিল। নার্স তাকে নিয়ে গেল কাচের রুমে। বাবা মেয়ের কান্নার কথা আমার মনে করলেও বুকের ভিতর মুচড়িয়ে ওঠে। এদিকে আমি তো বেডে। বিকাল ৪ টার পর মেয়েকে দেখতে পাবো। কান্না করতে করতে আমার অবস্থা খারাপ। মনে হতে লাগলো কাচের ঘরটায় আমার কলিজাটা কি করছে? কান্না করলে কেউ তো কোলেও নিবে না।

বিকালে একা একা হেটে গেলাম, সাথে হাসবেন্ড। একদিন আগে যার সিজার হয়েছে,সে সব ব্যাথা ভুলে হাটছে। কারন সে তো এখন মেয়ে নয় একজন মা। যে সন্তানের জন্য সব পারে। ভিতরে ১ নম্বর রুমে রাখা হয়ে। চোখে তার কালো কাপর বাধা। ফোটোথেরাপি চলছিল জন্ডিস ধরা পরার কারনে। তিনদিন পর কালচার টেস্ট এর রিপোর্ট দিবে। এর মধ্যে কত বার যে মেয়ে টার শরীর ফুটো করে রক্ত বের করা হয়েছে!

এদিকে মেয়ে বুকের দুধ টানে নাই বিধায় দুধ পর্যাপ্ত আসছিল না। ফরমুলা চলছিল। এদিকে ডাক্তার বলেছে এখন বুকে দুধ ওষুধের চেয়ে বেশি কাজ করে। তাই বেডে বসে বসে একটু দুধ বের করার চেষ্টা করতাম। যে একদিন আগে আমি বুকের থেকে ওড়না সরাতাম না সেই আমি আজ সবার সামনে বুক উন্মুক্ত করে একটু দুধ বের করার চেষ্টা করছি। কারন এখন তো আমি মেয়ে নই শুধু, একজন মা ও।

তিনদিন পর দুধ দিতে গেছি। দারোয়ান কে বললাম দুধ টা একটু দিয়ে আসেন। আমাকে তো ঢুকতে দিবে না আপনি একটু দেখে আসুন মেয়েটা কি করছে। শুনলেও শান্তি লাগবে। এদিকে দারোয়ান এসে বললো আপনার মেয়ে তো এক নাম্বার রুমে নেই। কথাটা শুনে যেন আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। বলে কি!! আমার মেয়ে যাবে কই!! আজ তো কালচার টেস্টের রিপোর্ট দিবে। আর রিপোর্ট ভাল আসলেই বাড়ী নিয়ে যাবো। তাহলো মেয়েকে কোথায় নিলো!!

পরে শুনলাম তাকে ৫ নম্বর রুমে ট্রান্সফার করা হয়েছে। কিন্তু কেউ বলছে না কেন? কারন ডাক্তার ছাড়া কারো কোন শিশু সম্পর্কে কিছু বলার নিয়ম নেই। কিন্তু ডাক্তার তো আমাদের সাথে কনসাল্ট করবে বিকালে।আমি এক নার্সের প্রায় পায়ে পরলাম শুধু এটা জানার জন্য কেন নেয়া হতে পারে ৫ নম্বর রুমে? পরে সে বললো হয়তো বাচ্চার খারাপ কিছু ধরা পরেছে তাই আলাদা রাখা হয়েছে। শুনে তো যেন আকাশ ভেঙে পরলো।

বিকালে গিয়ে শুনালাম মেয়ের রক্তে ক্লাবসিলা নামক খারাপ ভাইরাস ধরা পরেছে। এন্টিবায়োটিক দেয়া লাগবে। আরো কিছু দিন থাকতে হবে।

মোট ১২ দিন রাখলাম। এই কয় দিন আমি আর আমার হাসবেন্ড পাগলের মতো হয়ে গেছিলাম। মাথায় শুধু একটা জিনিস ই ঘুরতো মেয়েকে কিভাবে সুস্থ করে বুকে ফিরে পাবো।ঐ ১২ দিনের কষ্ট উদ্বেগ উৎকন্ঠার কথা মনে করতে চাই না কিন্তু র্সারাজীবন ভুলতেও পারবো না। ঈশ্বর যেন এমন কষ্ট কাউকে না দেন।

বিজ্ঞাপণ

১২ দিন পর মেয়েকে কোলে দিল এই কয়দিনে ওজন তার আরো ৩০০ গ্রাম কমে গেছে। আর হাতে পায়ে অসংখ্য ক্যানোলা করার ছিদ্র।

এক মাসের অষুধ দিল।বাসায় আসার পর নতুন আরেক যুদ্ধ।চার ধরনের অষুধ। তার মাঝে একটা ছিল এন্টিবায়োটিক। যেটা শিশুদের জন্য তৈরী হয়নি। তাই বড়দের টেবলেট টা কে ৪০ ভাগ করে ২ ভাগ ওকে দিতাম।অন্য তিন টাও খাওয়ানো ঝামেলা। সারাদিন ই যেন অষুধ তৈরী করতে করতে সময় চলে যেত।

রাতে হাসবেন্ড অফিস থেকে এসে ফ্রেস হয়ে মেয়ে কে রাখতো। রাতে মেয়ে ঘুমাতো না। বুকে পর্যাপ্ত দুধ না আসায় তখনও রাতে ফরমুলা দিতে হতো। পুরো রাত টাই প্রায় জাগা হতো আমাদের। কখনও ক্লান্ত হয়ে আমি ঘুমিয়ে পরেছি। হঠাৎ তাকিয়ে দেখতাম মেয়ের বাবা তাকে কোলে নিয়ে হেটে হেটে গল্প বলছে বা গান করছে বা কখনও দুধ বানিয়ে খাওয়াচ্ছে।

সারাদিন অফিস করে সারারাত ই প্রায় জাগতো। আর আমি বুকে একটু দুধ আনার জন্য কত কি করেছি। কলোজিরা,প্রতিদিন লাউ ডাল,ওষুধ আর প্রচুর জল। যে আমি জল খেতেই চাইতাম না সে আমি দিনে ৫ লিটার জল খেতাম। রাতে যতবার ওর মুখে দুধ দিতাম আধ লিটার জল খেয়ে ফেলতাম। সব যেন করতে পারি ওর জন্য।কোন ক্লান্তি নেই, কোন কষ্ট নেই, ওর মুখের হাসি আর ওকে সুস্থ সুন্দর রাখার জন্য সব করতে পারি কারন এখন তো আর শুধু মেয়ে নই আমি একজন মা, অদ্রিজার মা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment