যখন আপনি একজন বাচ্চার অভিবাভক, তখন খুব কম জিনিষই আছে যা আপনাকে বাচ্চার ঢেঁকুর তোলার মত সন্তুষ্ট করতে পারে। বাচ্চাকে খাওয়ানোর কিছুক্ষন পড় বাচ্চা নিজের থেকে অথবা খাওয়ানোর পড় বাচ্চার পিঠে হাল্কা চাপড়ানোর ফলে তার মুখ থেকে ঢেঁকুর তোলার যে আওয়াজ আসে তা সব বাবা-মায়ের কাছেই খুবই মধুর মনে হয়।
বড়দের ক্ষেত্রে মুখ দিয়ে আচমকা কোন শব্দ (ঢেঁকুর তোলার শব্দ) বের হওয়া অনেকসময় লজ্জার বিষয় হয়ে দাড়ায়। তবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে নিয়মিত ঢেঁকুর তোলাটা তার প্রতিদিনের অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আপনি হয়ত অবাক হচ্ছেন, যে বাচ্চার ঢেঁকুর তোলাটা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? ও তার চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, কিভাবে আপনি তার ঢেঁকুর তুলবেন?
আমরা বেশ কয়েকজন শিশু ডাক্তার ও কিছু অভিজ্ঞ মায়েদের কাছে বাচ্চাদের ঢেঁকুর তোলার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল ও তাদের দিকনির্দেশনা জানতে চেয়েছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম যে তারা কখন ও কিভাবে তাঁদের বাচ্চার ঢেঁকুর তুলতেন এবং কত দিন বয়স হলে বাচ্চার আর ঢেঁকুর তোলার প্রয়োজন হয়না, ইত্যাদি। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক।
এই আর্টিকেলে আপনি যা পাবেন-
- কেন বাচ্চার ঢেঁকুর তোলা জরুরী।
- কিভাবে বাচ্চার ঢেঁকুর তুলতে হয়।
- বাচ্চা ঠিকমত ঢেঁকুর না উঠলে কি করা উচিত।
- বাচ্চা কখন ঢেঁকুর তোলা থামিয়ে দেয়।
কেন বাচ্চার ঢেঁকুর তোলা জরুরী?
ঢেঁকুর তোলার মাধ্যমে বাচ্চার পাকস্থলী থেকে খাবারের সাথে গ্রহন করা বাতাস বের হয়ে যায়, ফলে তা বাচ্চাকে পেট ফাঁপা, বমি করা এমন কি মেজাজ খিটখিটে হওয়া থেকে দূরে রাখে। অন্যভাবে বললে, বাচ্চার ঢেঁকুর তোলাটা তার জন্য যতটা উপকারী আপনার জন্য ঠিক ততটাই সস্তিদায়ক।
কিন্তু আপনি কিভাবে বুঝবেন যে খাওয়ার সময় আপনার বাচ্চার পেটে অতিরিক্ত বাতাস ঢুকেছে কি না বা তার ঢেঁকুর তোলার প্রয়োজন আছে কি না?
যদি দেখেন যে বাচ্চা খাওয়া বন্ধ করে অথবা খাওয়ার পর শরীর মোচর দিচ্ছে, অথবা হড়বড়ি করছে তাহলে বুঝতে হবে আপনার বাচ্চার পেটে গ্যাস হয়ে গেছে এবং তার ঢেঁকুর তোলা প্রয়োজন। তৎক্ষণাৎ বাচ্চাকে দুধ দেওয়া বন্ধ করে তার ঢেঁকুর তোলার চেষ্টা করতে হবে।
American Academy of Pediatrics এর মতে ‘’ খাওয়ানো অবস্থায় বাচ্চা মোচড়ামুচড়ি বা কান্না করলে পেটে আরও বেশি পরিমানে বাতাস যেতে পারে। যাতে বাচ্চার অস্বস্তি আরও বেড়ে যেতে পারে এবং বমি হতে পারে।
[ আরও পড়ুনঃ শিশুর পেটে গ্যাস । কারণ, লক্ষন ও করণীয় ]
কতক্ষন পর পর বাচ্চার ঢেঁকুর তোলা উচিত?
কতক্ষন পড় পড় বাচ্চার ঢেঁকুর তুলবেন তা নির্ভর করছে বাচ্চাকে খাওয়ানোর সময় কি পরিমানে বাতাস তার পেটে যেতে পারে সেটার উপর। ওয়াশিংটনের বেলিংহামের একজন অভিজ্ঞ নার্স ও স্তন্যপান প্রশিক্ষক ‘হ্যালেন এন্ডারসন’ এর মতে, ‘’কিছু কিছু বাচ্চার ক্ষেত্রে প্রতিবার খাওয়ানোর সময়ই তার ঢেঁকুর তুলতে হয়, আবার অনেকের ক্ষেত্রে এতবার ঢেঁকুর তুলতে হয়না।’’
তিনি আরও বলেন ‘’যেসব বাচ্চারা মায়ের দুধ পান করে তাদের পেটে, ফিডারের মাধ্যমে দুধ খাওয়ানো বাচ্চার তুলনায় কম গ্যাস হয়ে থাকে। বাচ্চাকে খাওয়ানোর পড় যদি দেখেন সে অস্বস্তিবোধ করছে সেক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ তার ঘন ঘন ঢেঁকুর তুলতে হবে।”
বাচ্চার প্রয়োজন অনুসারে আপনি একটা সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করতে পারেন। বাচ্চাকে খাওয়ানোর সময় ১০ মিনিট পর পর তার ঢেঁকুর তোলার চেষ্টা করুন, সেটা মায়ের দুধ অথবা ফিডারের সাহায্যে যেভাবেই খাওয়ানো হোক না কেন। এর মানে হলো বাচ্চার খাওয়ার মাঝখানে একবার এবং খাওয়া শেষে একবার ঢেকুর তুলতে হবে অথবা বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় এক স্তন শেষ হলে ঢেকুর তুলে অন্য স্তন দিতে হবে।
একজন ১০ মাস বয়সের বাচ্চার মা ভেরনিকা ডকেট তার নিজের বাচ্চার ক্ষেত্রে বলেন ‘’ আমার বাচ্চাকে কোন কিছু খাওয়ালেই তার গ্যাস হয়ে যেত। যা তার জন্য আগে এক ধরণের অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করত। তবে এখন আমি জানি যে ঠিক খাওয়ানোর পর পরই তার ঢেঁকুর তুলতে হয়। ফলে এখন আমার বাচ্চার আর এই ধরণের সমস্যা হয়না’’। ‘’বিশেষ করে তার খাওয়া হয়ে গেলেই আমি বুঝতে পারি যে তার পেটের গ্যাস বের করতে হবে, অন্যথায় তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটবে’’।
ঘুমন্ত অবস্থায় কিভাবে বাচ্চার ঢেঁকুর তুলতে হয় তা জানতে চাইলে তিনি তার কৌশল আমাদের সাথে শেয়ার করেন। তার পদ্ধতিতে তিনি প্রথমে বাচ্চাকে সোজা করে ধরে তার পিঠে আলতো করে ঘষা ঘষি করার সাথে বাচ্চাকে আস্তে আস্তে করে ঝাঁকান।
তিনি বলেন ‘’ যদিও ঘুমন্ত অবস্থায় বাচ্চার সম্পূর্ণ ভার হাতের উপর থাকাটা একটু কষ্টের তবে যখনি আমি তার ঢেঁকুর তোলার শব্দ শুনতে পাই, তখনই আমি নিশ্চিত হতে পারি যে এখন তার পর্যাপ্ত ঘুমের কোন ব্যাঘাত ঘটবেনা।
কিভাবে বাচ্চার ঢেঁকুর তুলবেন?
কিভাবে বাচ্চার ঢেঁকুর তুলবেন তা নিয়ে অবিভাবক হিসেবে আপনার কৌতূহল থাকাটাই স্বাভাবিক। ক্যালিফোর্নিয়ার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ Tanya Altmann তার বই Mommy Calls-এ বলেছেন ‘’শুধু একভাবেই বাচ্চার ঢেঁকুর তোলা যায় এমনটা ভাববেননা, বরং বেশ কিছু পদ্ধতি রয়েছে তার মধ্যে যেকোনো একটা পদ্ধতির সাহায্যে আপনার বাচ্চার ঢেঁকুর তুলতে পারেন।’’ তার বইয়ে বাচ্চার ঢেঁকুর তোলার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী ৩ টি পদ্ধতি এখানে আলোচনা করা হল।
বাচ্চাকে কোলে বসিয়েঃ বাচ্চাকে আপনার বিপরিতে মুখ করে কোলে বসিয়ে নিন। আলতো করে তার শরীর আপনার এক হাতের উপর ভর করে হেলান দিয়ে রাখুন। এবার আপনার অন্য হাত দিয়ে তার পিঠে আস্তে আস্তে চাপড়ান। বাচ্চাকে হাতের উপর হেলান দিয়ে রাখার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে তার বুক ও মাথা যথেষ্ট সাপোর্ট পায়।
![বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে ঢেঁকুর তোলা](https://myfairylandbd.com/wp-content/uploads/2019/01/1d8bd22b-2373-4485-8acb-489e299516f6-518x480.jpg)
ছবি- NHS
কাঁধে নিয়েঃ বাচ্চাকে আপনার কাঁধে হেলান দিয়ে রেখে তার পিঠে আলতো করে চাপড়ানো ও ঘষা ঘষি করে তার ঢেঁকুর তুলতে পারেন। বাচ্চাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতেও আপনি এ পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন।
![কাঁধে নিয়ে ঢেঁকুর তোলা](http://myfairylandbd.com/wp-content/uploads/2019/01/afa4bd74-a19d-4d75-be4a-e02e6394b6f0-518x480.jpg)
ছবিঃ NHS
বাচ্চাকে কোলে উপুর করে শুইয়েঃ বাচ্চার মাথা এক দিকে কাত করে বাচ্চাকে আপনার কোলে উপুর করে শুইয়ে রাখুন। এক হাতে বাচ্চাকে ধরে অন্য হাতে তার পিঠে হাল্কা ম্যাসেজ করুন চাপড়ে দিন।
![](http://myfairylandbd.com/wp-content/uploads/2019/01/d1aba2a1-74f9-4081-a4f3-845b303727bf-518x480.jpg)
ছবি NHS
এই পদ্ধতিগুলো ছাড়াও বাচ্চার শরীর ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে তার পেটের ভেতরের আটকে থাকা গ্যাস বের করতে পারেন। এক্ষেত্রে বাচ্চাকে আপনার বিপরীতদিকে ঘুরিয়ে আপনার কোলে বসান। এক হাতে তার মাথা ও অন্য হাতে পিঠে সাপোর্ট দিয়ে তার শরীর আস্তে আস্তে চক্রাকারে ঘুরাতে হবে।
এছাড়াও অনেক মা ই তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে বাচ্চার ঢেঁকুর তুলে থাকেন। তেমনই একজন ভন্যি জোন্স, ২ বছর ও ৭ বছর বয়সের ২ বাচ্চার জননী বলেন ‘’ বাচ্চার ঢেঁকুর তোলার জন্য কার্যকর পদ্ধতি হল বাচ্চকে শান্ত রাখা ও আলতো চাপ প্রয়োগ করা।
এ জন্য বাচ্চাকে কাঁধে নিয়ে ভালো মত ধরতে হবে যেন তার পেট ঠিক আপনার কাধের বিপরিতে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে তার পিঠে চাপ দিন। বাচ্চা অসন্তুষ্ট হলে তার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করুন।
প্রথম দিকে আস্তে আস্তে ঘষতে হবে, তবে তারপরেও যদি বাচ্চার ঢেঁকুর না আসে তাহলে হালকা জোড়ে চাপ প্রয়োগ করে ঘষুন যতক্ষণ পর্যন্ত না বাচ্চার ঢেঁকুর আসে।’’ তিনি বলেন, এই কৌশলটা বেশ কাজ করে।
ঢেকুর তোলার সময় আপনার হাতের পাতা একটু গুটিয়ে নিয়ে বাটির মত করে তারপর বাচ্চার পিঠে চাপড় দেবেন। এতে বাচ্চা ব্যাথা পাবেনা। বাচ্চার ঢেঁকুর তোলার আগে আপনার কোলে বা কাঁধে একটা কাপড় বিছিয়ে নিন। এতে করে বাচ্চা ঢেঁকুর তোলার সময় মুখ থেকে লালা বা বমি পড়ে তা আপনার কাপড়ের কোন ক্ষতি করবেনা।
বাচ্চার ঢেঁকুর না আসলে কি করবেন?
যদি দেখেন যে কোনভাবেই বাচ্চার ঢেঁকুর আসছেনা, সেক্ষেত্রে আপনার কৌশল বদলাতে হবে। যেমন ধরুন বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে তার পিঠে ম্যাসেজ করেও যদি তার ঢেঁকুর না আসে তাহলে অন্য কোন ভাবে চেষ্টা করতে হবে।
অন্য ভাবে ৫-৬ মিনিট চেষ্টা করার পড়েও যদি দেখেন যে বাচ্চার ঢেঁকুর আসছেনা তাহলে নিজের থেকে আর কোন কিছু করার দরকার নাই। অনেক সময় কোন কারণ ছাড়াই বাচ্চার ঢেঁকুর আসেনা। আবার এমনও হতে পারে যে তার ঢেঁকুর তোলার প্রয়োজনই নেই।
বাচ্চার বয়স কত হলে আর ঢেঁকুর তোলার দরকার নেই?
অনেকের কাছেই মনে হতে পারে বাচ্চার ঢেঁকুর তোলাটা একটা চলমান প্রক্রিয়া অর্থাৎ বাচ্চাকে খাওয়ানোর পরেই তার ঢেঁকুর তোলা বাধ্যতামূলক। তবে ব্যাপারটা আসলে তেমন না। আপনার বাচ্চা ৬ থেকে ৯ মাস বয়স হলেই অর্থাৎ বাচ্চা নিজে থেকে বসতে শিখলেই আপনি তার ঢেঁকুর তোলা বন্ধ করে দিতে পারেন
তবে বলা বাহুল্য যে, সব বাচ্চাই সমান না এমন কি, কিছু কিছু বাচ্চার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে ঢেঁকুর তুলতে হতে পারে অন্য বাচ্চাদের তুলনায়। তাই আপনার বাচ্চার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে যে খাবার গ্রহনের পর কেমন আচরণ করছে। যদি দেখেন খাবারের পর বাচ্চা অস্থির হয়ে উঠছে বা অস্বস্তিবোধ করছে , তাহলে বুঝতে হবে যে বাচ্চার পেটে যথেষ্ট পরিমাণে বাতাস আছে এবং তার ঢেঁকুর তোলা প্রয়োজন।
সবার জন্য শুভকামনা।