প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল জরায়ুর দেয়াল সংলগ্ন একটি চ্যাপ্টা ও কিছুটা গোলাকৃতির অঙ্গ যা গর্ভাবস্থায় মায়েদের জরায়ূর ভেতরে লেগে থাকে এবং সন্তানের সাথে মায়ের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
গর্ভের শিশুর শরীর শরীরবৃত্তীয় যে সমস্ত কাজের জন্য উপযোগী হয়ে উঠে না, প্লাসেন্টা সে কাজগুলি তার হয়ে করে থাকে। এটি শিশুর নাড়ীর (আম্বিলিক্যাল কর্ড) মাধ্যমে ভ্রুনের সাথে সংযুক্ত থাকে।
অন্য কথায় বলা যায় প্লাসেন্টা (গর্ভফুল) হলো মাতৃগর্ভে শিশুর সুরক্ষা বা সাপোর্ট সিস্টেম। প্লাসেন্টা কোনো কারনে ঠিকভাবে কাজ না করলে শিশুর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
এটি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা গর্ভের সন্তানকে অক্সিজেন এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদান সরবরাহ এবং শিশুর রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। এটা জরায়ুর দেয়ালের সাথে সংলগ্ন থাকে এবং শিশুর আম্বিলিক্যাল কর্ড এর থেকেই সৃষ্টি হয়।
প্লাসেন্টা প্রিভিয়া (Placenta previa) কি?
বেশিরভাগ গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল জরায়ুর শীর্ষভাগে অথবা পাশে অবস্থান করে । কিন্তু গর্ভফুলটি যদি জরায়ুর একদম নিচের দিকে বা জরায়ুমুখে লেগে থাকে, তাহলে এই মেডিকেল কন্ডিশনকে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বা লো লায়িং প্লাসেন্টা বলে।
প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার ক্ষেত্রে গর্ভের সন্তানের মাথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপরের দিকে (ব্রীচ পজিশন) বা আড়াআড়ি (ট্রান্সভার্স লাই) থাকতে দেখা যায় ।
এ সমস্যায় সাধারণত গর্ভবতী নারীরা স্পটিং বা হালকা থেকে ভারী রক্তপাতের সম্মুখীন হয়ে থাকেন। কিন্তু এ রক্তপাতের সময় কোন ব্যথা অনুভূত হয় না এবং রক্তের রং থাকে উজ্জ্বল লাল।

যদি গর্ভফুল জরায়ুর পুরো মুখ জুড়ে থাকে তবে তাকে টোটাল বা কমপ্লিট প্রিভিয়া বলে।
যদি তা জরায়ুর মুখ আংশিক বন্ধ করে রাখে তাহলে সেটাকে বলা হয় মারজিনাল প্রিভিয়া বা পারসিয়াল প্রিভিয়া
প্লাসেন্টা যদি জরায়ুমুখের ২ সেন্টিমিটারের মধ্যে থাকে কিন্তু জরায়ুমুখকে আংশিক বা সম্পূর্ণ, কোনভাবেই ঢেকে না রাখে তবে এই কন্ডিশনকে লো লায়িং প্লাসেন্টা বলে।
মায়ের প্লাসেন্টার অবস্থান সাধারণত গর্ভধারণের ১৬ থেকে ২০ সপ্তাহের আলত্রাসাউন্ড এর সময় পরীক্ষা করা হয়।
প্লাসেন্টা প্রিভিয়া হলে কি হয়?
এটা নির্ভর করে আপনি গর্ভধারণের কোন পর্যায়ে আছেন তার উপর। যদি ১৬ থেকে ২০ সপ্তাহের আলট্রাসাউন্ডে এটি ধরা পরে তাহলে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই।
সময় বাড়ার সাথে সাথে তা জরায়ুর মুখ থেকে সরে যেতে পারে এবং আর কোন সমস্যার সৃষ্টি না ও করতে পারে।
যেহেতু প্লাসেন্টা জারায়ুর সাথে সংযুক্ত থাকে তাই তা অবস্থান পরিবর্তন করেনা। জরায়ুর আকার বাড়ার সাথে সাথে তা মুখ থেকে দূরে চলে যায়।
আর যেহেতু এটি আকারে বাড়ে তাই সম্ভাবনা বেশী যে তা জারায়ুর উপরের দিকে বাড়বে যেখানে রক্ত সরবরাহ বেশী থাকে।
যদি দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার আপনার প্লাসেন্টা প্রিভিয়া পাওয়া যায় তাহলে তৃতীয় ট্রাইমেস্টার এ আবার ফলোআপ করা হবে। যদি এ সময়ে আপনার যোনি পথে রক্তক্ষরণ হয় তবে আলট্রাসাউন্ড করে দেখার পরামর্শ দেয়া হবে।
খুব কম মায়েদের ক্ষেত্রেই শিশুর জন্মের সময় গর্ভফুল নিচে থাকে যাদের ২০ সপ্তাহের আলট্রাসাউন্ড এ মারজিনাল প্রিভিয়া পাওয়া যায়।
টোটাল বা কমপ্লিট প্রিভিয়ার ক্ষেত্রে প্রসবের সময়ও তা একই অবস্থায় থাকে। সাধারণত প্রতি ২০ জনে ১ জনের লো লায়িং প্লাসেন্টা থাকে।
যদি ফলোআপ আলট্রাসাউন্ড এ আপনার প্লাসেন্টা প্রিভিয়া পাওয়া যায় তাহলে আপনাকে বিশ্রাম এর পরামর্শ দেয়া হবে। এ সময় শারীরিক মিলন বা জার্নি করতে মানা করা হয়। এমনকি যোনি পথের কোন ধরনের পরীক্ষা ও করা হয়না। সবধরনের ভারী কাজ এ সময় নিষিদ্ধ যেগুলোর কারণে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রসবের সময় সি-সেকশন করতে হয় কারণ প্লাসেন্টা আপনার জরায়ুর মুখ সম্পূর্ণ বন্ধ করে রাখে। প্রসবের সময় মারজিনাল প্লাসেন্টা থাকলে ও সি-সেকশনের পরামর্শ দেয়া হয় কারন জরায়ুর মুখ বড় হওয়ার সাথে সাথে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে।
এ ধরনের লো লায়িং প্লাসেন্টার ক্ষেত্রে তৃতীয় ট্রাইমেস্টার এ আপনার ব্যাথাহীন রক্তপাত হতে পারে। এ অবস্থায় আপনাকে হসপিটালে ভর্তি হতে হবে।
পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করবে আপনি গর্ভধারণের কোন পর্যায়ে আছেন, রক্তপাতের পরিমান এবং আপনি ও শিশুর অবস্থার উপর। যদি আপনি গর্ভধারণের ফুল টার্ম এ থাকেন তবে তৎক্ষণাৎ সি-সেকশন এর মাধ্যমে বাচ্চা ডেলিভারির সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
যদি বাচ্চার কন্ডিশন খারাপ থাকে এবং রক্তক্ষরণ বেশী হয় এবং বন্ধ করা সম্ভব না হয় তবে বাচ্চা প্রিম্যাচিউর থাকলেও সি-সেকশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
যদি অবস্থা খুব একটা খারাপ না হয় তবে আপনার আরও কিছু দিন হসপিটাল এ রাখা হবে অবজারভেশন এর জন্য।
যদি রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায় এবং আপনার এবং শিশুর অবস্থা ভালো থাকে তাহলে হয়তোবা আপানাকে বাসায় যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। কিন্তু কোন কারণে রক্তপাত শুরু হলে অবশ্যয় অতি দ্রুত আবার হসপিটাল এ আসতে হবে।
প্লাসেন্টা প্রিভিয়া হলে আর কি কি জটিলতা দেখা দিতে পারে?
গর্ভফুল নিচে থাকলে আপনাকে রক্ত দিতে হতে পারে কারণ প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটা শুধুমাত্র গর্ভধারণের সময়ই নয়, এমনকি প্রসবের সময় ও প্রসবের পরেও হতে পারে।
এর কারণ হোল- যখন সি-সেকশন করা হয় তখন বাচ্চার সাথে সাথে প্লাসেন্টা ও বের করে ফেলা হয় এবং মাকে Pitocin দেয়া হয় যা জরায়ুকে সঙ্কুচিত করে এবং প্লাসেন্টার স্থানে রক্ত বন্ধ করতে সাহায্য করে।
কিন্তু প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার ক্ষেত্রে তা জরায়ুর নিচের দিকে থাকে যা জরায়ুর উপরের অংশের মত অতোটা সঙ্কুচিত হয়না। যার ফলে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়না।
কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে গর্ভফুল জরায়ুর অনেক ভেতরে গাঁথা থাকতে পারে যা খুব সহজে প্রসবের সময় বের করা যায়না। এর ফলে ওই স্থান থেকে অনেক রক্তখরন হয় এবং বেশ কয়েকবার রক্ত দেয়ার প্রয়োজন পরতে পারে।
এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এমনকি রক্তপাত বন্ধের জন্য hysterectomy করার প্রয়োজন হতে পারে।
এছাড়াও এসব ক্ষেত্রে প্রি-ম্যাচিউর বাচ্চার অনেক ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে যেমন- শ্বাসকষ্ট বা ওজন কম হওয়া।
সাধারণত কারা থাকেন প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার ঝুঁকিতে ?
বর্তমানে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, প্রতি ২০০ জন গর্ভবতী নারীর মধ্যে অন্তত একজন এই প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার সমস্যায় আক্রান্ত।
যদিও এটি কেন হয়, এইটার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো অজানা, কিন্তু কিছু কিছু বিষয় এ সমস্যাকে ট্রিগার করে বলে মেডিকেল সায়েন্সে বলা হয় সেগুলো হলো –
- পূর্বে সিজারিয়ান ডেলিভারি হলে।
- বয়স ৩৫ এর অধিক হলে।
- জরায়ুতে পূর্বে কোন সার্জারি করা হলে।
- পূর্বে চারবারের বেশি সন্তান জন্মদান করলে।
- ধূমপান এবং মাদকদ্রব্য সেবন করলে।
- গর্ভে দুই বা ততোধিক সন্তান একসাথে থাকলে।
প্লাসেন্টা প্রিভিয়া এমন একটি কন্ডিশন যা প্রতিরোধ করার কোন উপায় নেই। তবে একটি বিষয় গবেষণায় দেখা গেছে এ সমস্যাটি দিন দিন বাড়ছে এবং এর কারণ হিসেবে সি-সেকশন করার হার বৃদ্ধিকেই প্রধান কারণ বলা হয়েছে।
স্বস্তির বিষয় হোল আধুনিক চিকিৎসা ব্যাবস্থার কারণে যেহেতু আগেই এ রোগীটি নির্ণয় করা যাচ্ছে তাই মা ও শিশুর জন্য এ রোগের ঝুঁকি আগের চাইতে অনেক কমানো সম্ভব হয়েছে।
তাই গর্ভাবস্থায় সবসময় নিয়মিত ডাক্তারের কাছে গিয়ে চেক আপ করাতে হবে এবং তার নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে হবে।
সবার জন্য শুভ কামনা।
লো লায়িং প্লেসেন্টা হলে কি সমস্যা হতে পারে?