সন্তান জন্মদান, বিশেষ করে সিজারিয়ান ডেলিভারীর পর পেট ও কোমরের জন্য এক ধরণের বেল্ট ব্যবহার করা ভালো – এমন একটি মতবাদ আমরা প্রায় শুনতে পাই। এই ধরণের বন্ধনী বেশ চওড়া ও মজবুত হয় এবং বেশ টাইট করে পরা হয় যেন কোমর, পেট ও পিঠের নিচের অংশে সাপোর্ট দেয়। এদের কাজও ভিন্ন হতে পারে, যার উপর ভিত্তি করে এগুলোর দাম, আকার ও ম্যাটিরিয়ালও আলাদা হয়। এই ধরণের বেল্টকে পোস্ট-পার্টাম বেল্ট বা বেলী র্যাপ কিংবা সহজ বাংলায় পেটের বেল্ট বলা হয়।
অনেক নতুন মায়ের একটি কমন প্রশ্ন থাকে, ডেলিভারী বা সিযারের পর এ ধরণের বেল্ট পরে থাকলে কি পেটের শেইপ আগের অবস্থায় দ্রুত ফিরে আসে? এই বিষয়েই আলোচনা করবো আজকে আর্টিকেলে।
পোস্ট-পার্টাম–বেল্টগুলো আসলে কেনো রেকমেন্ড করা হয় বা এদের উপকারী দিকগুলো কি?
পেটের সার্জারী বা সিজারিয়ান ডেলিভারীর পর ডাক্তাররা অনেক সময় পোস্ট সার্জারী বেল্ট বা বেলী র্যাপ পরতে বলেন। এতে করে চলাচল ও অংগভঙ্গির সময় ব্যাথার জায়গাটি অনেকটা সুরক্ষিত থাকে এবং চাপে থাকার কারণে পেইন কম হয়। বেল্ট ব্যবহারের এই কারণটি যথেষ্ট যৌক্তিক।
ডেলিভারির পর বিশেষ করে সি-সেকশানের পর মায়েদের পিঠের ও কোমরের ব্যাথা খুব কমন একটি সমস্যা। তার ওপর নবজাতককে ব্রেস্টফীড করানোর জন্য হয়তো টানা অনেকক্ষন বসে থাকতে হয়, যা ব্যাকপেইন আরো বাড়িয়ে দেয়। এই সময় একটি ভালো বেল্ট মায়েদের পেলভিক এরিয়া, লোয়ার ব্যাক ও কোমরের ব্যাথায় বেশ ভালো সাপোর্ট দেয়।
এই বেল্ট অ্যাবডমিনাল মাসল অর্থাৎ পেটের পেশীগুলোকে সাপোর্ট দেয়। প্রেগন্যান্সীতে স্বাভাবিক কারণেই শিশুর আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে মায়ের জরায়ু ও পেটের পেশীগুলোর ফ্লেক্সিবিলিটি ও আয়তন বেড়ে যায়। সন্তান জন্মদানের পর এই বর্ধিত পেশীগুলো আস্তে আস্তে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে থাকে। তবে অনেকের ক্ষেত্রে, এক/দুই মাস কেটে যাওয়ার পরও পেটের পেশি ও ত্বক বাইরের দিকে আলাদাভাবে বেরিয়ে যায় বা ঝুলে পড়ে। বেল্ট পরে থেকে এ সমস্যার সম্পুর্ন সমাধান সম্ভব নয়, তবে অনেক বিশেষজ্ঞ এটি ধারণা করেন যে, ভালো মানের পোস্ট-প্রেগ্ন্যান্সী বেল্ট পেটের পেশীগুলোর সংকোচনে কিছুটা সহায়ক ভুমিকা পালন করতে পারে।
বেল্ট ব্যবহারের এই দিকটিকেই অনেকে ডেলিভারী পরবর্তী সময়ে পেটের আকার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে ধরে নিয়েছেন। এবং এই ধারণাকে পুঁজি করে কিছু মার্কেটার ‘বডি শেইপিং করে’ কিংবা ‘বেলী ফ্যাট কমায়’ এই কথাগুলো তাদের পণ্যের তথ্যের সাথে জুড়ে দিয়েছেন।
পোস্ট-পার্টাম–বেল্টগুলো কি পেটের মেদ কমাতে পারে?
যদিও বেল্ট-ব্যবহারকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ মায়েদের মত হলো, পেটের আকার বা ফ্যাট কমানোয় তাদের বেল্টের কোনো ভুমিকা ছিলো না। আবার কিছু মা খুব জোরের সাথে দাবী করেন, বেল্ট পরে তাদের পেটের আকার পুর্বের অবস্থায় ফিরে গেছে। এই ধারণা জন্মানোর পেছনে সম্ভাব্য কারন হলোঃ
আমরা জানি, প্রসবের সময় গর্ভস্থ শিশুর সাথে অ্যাম্নিওটিক ফ্লুয়িড ও প্লাসেন্টা বের হয়ে যায় এবং প্রসব-পরবর্তী ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে জরায়ু প্রায় অনেকটাই আগের অবস্থায় ফিরে আসে। আর যেসব মায়ের গর্ভাবস্থায় এডিমা বা গায়ে পানি আসে, সেগুলোও আস্তে আস্তে কমে যায়। তাই প্রসবের পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে প্রসুতির গর্ভকালীন ওজন এবং পেটের আকার দুটোই কমতে থাকে।
বেল্ট ব্যবহার করেছেন এমন কিছু মা আছেন, যাদের মেটাবলিজম প্রাকৃতিকভাবেই বেশি, কিংবা জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের কারণে খুব দ্রুত তাদের পেটের আকার কিংবা শরীরের ওজন আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়, এর জন্য বিশেষ কোনো চেষ্টা করা ছাড়াই। তাই তারা ব্যাপারটিকে হয়তো বেল্টের কল্যাণে ঘটেছে বলে বিশ্বাস করেন এবং বেল্ট পরলে পেট কমে যাবে- এই ধারণা অন্যদের কাছেও প্রচার করেন।
এ বিষয়ক এক্সপার্ট-ওপিনিওন ও নির্ভরযোগ্য বেশ কয়েকটি সোর্স খুঁজে দেখা গেছে, পেটের বেল্ট পরে পেটের আকার পরিবর্তন কিংবা পেটের মেদ কমানো সম্ভব- এই তথ্যের কোনো যুক্তিসংগত ও বিজ্ঞানসম্মত প্রমান নেই। সুস্থ শরীর ও মেদ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় নিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা।
বেল্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেসব ব্যাপার জেনে রাখা জরুরী
- যদি বেল্ট ব্যবহারের ফলে ব্যাথা বেড়ে যায়, কিংবা শারীরিক অন্য কোনো সমস্যা অনুভব করেন কিংবা অতিরিক্ত গরম লাগে, সেক্ষেত্রে বেল্ট ব্যবহার বন্ধ রাখুন।
- বিশ্রাম নেয়া বা শোওয়ার সময় যথাসম্ভব রিল্যাক্সডভাবে থাকবেন। আঁটসাঁট কাপড় বা বেল্ট পরে থাকবেন না।
- বেল্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি ভুল উপদেশ বহুল প্রচলিত, যেটি হলো অনেক বেশী টাইট করে যেন বেল্ট পরে থাকা হয়। এ কাজটি একেবারেই করবেন না। এতে রক্ত চলাচল, নার্ভ ও পেশীর কার্যকারিতার উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। কোমরের সাপোর্ট বা ব্যাথা কমানোর জন্য এই বেল্ট ব্যবহার করতে চাইলে পিঠ ও পেটে মৃদু চাপ দিয়ে বেষ্টন করে পরুন।
- সরাসরি ত্বকের উপর পরবেন না. এতে র্যাশ কিংবা ত্বকের সমস্যা হতে পারে এবং ক্ষতস্থানে জীবাণু আক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। বেল্ট জামার ওপর পরবেন।
- বেল্ট ব্যবহারের প্রয়োজন হলে বেল্ট পড়ুন। এটি ব্যবহারের সময়কাল যার যার প্রয়োজনের উপর নির্ভর করবে। তবে, দৈনিক ৮ থেকে ১০ ঘন্টার বেশি নয়। বিশেষ কোনো কাজের সময়, যেমন নিচু হয়ে কিছু তোলা, কিংবা বসে অনেকক্ষণ কাজ করা যেমন ব্রেস্টফীডিং করানো বা কম্পিউটারের কাজের সময় বেল্ট পরতে পারেন। আর বাকি সময় খুলে রাখবেন। আজকাল অনেক বিশেষজ্ঞ ডেলিভারির পর বেল্ট ব্যবহার একেবারেই না করতেও উপদেশ দিচ্ছেন।
ডেলিভারির পর যেসব বিষয় মনে রাখতে হবে
বেল্ট পরার যে বাস্তবিক কারণগুলো রয়েছে, সেসব কারণে এবং ডাক্তারের পরামর্শে অবশ্যই বেল্ট উপকারী ভুমিকা পালন করবে। কিন্তু এই কারণগুলো উপেক্ষা করে, আজকাল অনেক নতুন মা বেল্ট পরে শারিরিক গঠনের পরিবর্তন আশা করতে থাকেন, যা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে হতাশার জন্ম দেয়।
মাতৃত্ব একটি অসাধারণ ব্যাপার, যার জন্য একজন নারীকে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়। একটি শিশুকে শরীরের অভ্যন্তরে স্থান দেয়া এবং সেই শিশুর বৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য একজন মায়ের শরীর ও হরমোনের অনেক ধরণের পরিবর্তন হয়। তাই সন্তান জন্মদানের পর খুব দ্রুত আপনি পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবেন- এটি আশা করা কিছুটা বাস্তবতার পরিপন্থী।
ওজন বাড়া, স্ট্রেচ মার্ক্স কিংবা পেট ঝুলে যাওয়ার কোনোটিই আপনার মাতৃত্বের মহিমাকে কমাতে পারবে না। তাই অবাস্তব কিছুর আশা না করে, বরং নিজের যত্ন নিন। শরীরের আকৃতি বা তথাকথিত সুন্দর অবয়ব থেকে বরং সুস্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগ দেই। নিজের জন্য এবং নবাগত সন্তানকে বড় করে তোলার জন্য নিজেকে ফিট রাখাও জরুরী।
এজন্য নিয়মিত হাটা, হাল্কা ব্য্যয়াম করা এগুলো চালু রাখতে হবে। কিছু গতানুগতিক ভুল ধারনা আছে, যে প্রসুতী মাকে সারাদিন খেতে হবে, বেশি হাটা বা ব্যায়াম করা যাবে না। বিশেষ কোনো শারিরিক সমস্যা বা ডাক্তারের নিষেধ না থাকলে রেগুলার হাঁটাতে কোনো সমস্যা নেই, বরং এটি দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে। আর সি সেকশানের ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ পর থেকে নিরাপদ কিছু ব্যায়ামও শুরু করা যায়। ভারী ব্যায়াম মায়ের ফিটনেস ও অভ্যস্থতার উপর নির্ভর করে। তাই ভারী ব্যায়াম শুরু করার আগে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নেয়া ভালো।
আর খাবারের ব্যাপারে, এ যুগে সব বয়সের মানুষকেই কিছুটা সচেতন হতে হয়। একজন প্রসূতির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। পছন্দমতো সব ধরণের পুষ্টিকর খাবার সময়মত খাওয়া আর ক্ষতিকর খাবার পরিহার করাকেই ডায়েট বলে। এর জন্য না খেয়ে থাকা কিংবা খুব অল্প খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
অনেক পানি আর ফল্মুল খাওয়া, সুষম প্রোটিন, মিনারেল ও ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া এইসময় খুব দরকার৷ ফাস্ট ফুড, কোল্ড ড্রিংকস আর তেলে ভাজা খাবার বাদ রাখা উচিত। বিশেষ করে, প্রক্রিয়াজাত চিনি পরিহার করা ও কার্বোহাইড্রেট পরিমিত পরিমাণে খেলে পেটের আকার ও ওজন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
সবার জন্য শুভকামনা।