শিশু রাতের বেলায় আতংকিত হয়ে বা ভয় পেয়ে জেগে ওঠা বা নাইট টেরর (Night terror) আসলে কি?
নাইট টেরর (Night terror) হল এক ধরনের ঘুম জনিত সমস্যা। এই সমস্যায় ভোগা শিশুরা হুট করে রাতের বেলায় চিৎকার করে অথবা কান্না করে জেগে উঠতে পারে। এই সময় তার চোখ পুরোপুরি খোলা থাকলেও সে পুরোপুরি জাগ্রত থাকেনা। কেননা এই সময়ে শিশু ঘুম এবং জাগরণের মাঝামাঝি এক ধরনের অবস্থার মধ্যে থাকে এবং এই সময়ে আপনি কিছু বললে শিশু সেটা একটুও বুঝবে না।
হালকা ঘুম থেকে যখন রাতে আমরা গাঢ় ঘুমের অবস্থায় যাই, অর্থাৎ ঘুমের এক ধাপ থেকে যখন অন্য ধাপে পরিবর্তন হয়, গবেষকদের মতে ঠিক সেই সময়টায় ঘুমের এই ধরনের ব্যাঘাত ঘটে থাকে। শিশুর এই আতংকিত অবস্থাটা প্রায় কয়েক মিনিট থেকে শুরু করে ঘণ্টা খানেক সময় ধরে থাকতে পারে। এরপর দেখা যায় শিশু হুট করেই আবার ঘুমিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে এই আতংকিত অবস্থার কোন স্মৃতি শিশুর মধ্যে থাকে না।
ছোট শিশু থেকে শুরু করে স্কুলে পড়ে এমন শিশুদের মধ্যে এই ধরনের সমস্যা প্রায়ই দেখা যায়। প্রায় দুই হাজার শিশুর মধ্যে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে এক থেকে ছয় বছর পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে ৪০% শিশুর মধ্যেই এই ধরনের সমস্যা দেখা যায়। তবে শিশুর বয়স ১২ বছর হতে হতেই এই ধরনের সমস্যা আর থাকে না।
ঘুমের মধ্যে এই আতঙ্ক বা ভয়, দুঃস্বপ্ন থেকে কীভাবে আলাদা?
ঘুমের মধ্যে এই আতঙ্ক বা ভয় পাওয়া এবং দুঃস্বপ্ন দেখা, দুটো কিন্তু এক ব্যাপার নয়। ঘুমের মধ্যে আতংকের অবস্থা সম্পর্কে শিশুর কখনই কিছু মনে থাকবে না, অপরদিকে দুঃস্বপ্ন শিশুকে একদম জাগিয়ে দেয় এবং সেই স্মৃতি শিশুর মধ্যে থেকে যায়। এমনকি শুধু স্বপ্নের স্মৃতিটা তার মধ্যে থেকেই যায় না বরং সেই স্বপ্ন নিয়ে মাঝে মাঝে সে কথাও বলে। এই সমস্ত সময়ে আপনার উপস্থিতি শিশুকে শান্ত থাকতে সাহায্য করে।
নাইটমেয়ার বা দুঃস্বপ্ন হল ভয়ের স্বপ্ন, অন্যদিকে, নাইট টেরর হলে বাচ্চারা হঠাৎ করে চমকে উঠে, কাঁপতে কাঁপতে জেগে ওঠে। বাচ্চারা যখন ৬ বছরের বা তার চেয়ে বড় হয়ে যায়, নাইটমেয়ার ও নাইট টেরর আস্তে আস্তে কমে যায়। কোনো কোনো বাচ্চার ক্ষেত্রে এমনটা হতে দেখা যায় ৭ বা ৮ বছর অবধি। একটি ক্লান্তিকর দিন, প্রচুর এক্টিভিটি বা কম ঘুমের জন্যেও এমনটি হতে পারে। তাই নাইটমেয়ার বা নাইট টেরর এড়াতে, বাচ্চাটির পর্যাপ্ত ঘুম দরকার।
এছাড়াও এই night terror রাতের প্রথম দিকে হয়ে থাকে যখন শিশুর ঘুম গভীর থাকে এবং যে সময়টাতে সে স্বপ্ন দেখেনা। এই ধরণের ঘুমকে Non-REM Sleep ও বলে। আর অপরদিকে দুঃস্বপ্ন রাতের শেষভাগে হয়ে থাকে যখন শিশুর REM ঘুমের পর্যায় চলতে থাকে।
ঘুম বিশেষজ্ঞ জোডি মিনডেল এর মতে, “পরের দিন সকালে কে বেশি অস্বস্তিতে থাকে?” এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে শিশুর এই রাতের আতঙ্ক এবং দুঃস্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য করা যায়। কেননা, যদি এমনটা দেখা যায় যে, পরের দিন সকালে আপনার শিশু একটু অস্বস্তিতে আছে তাহলে বুঝতে হবে সে দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। অপরিদকে, পরের দিন সকালে শিশুর কিছু মনে নেই কিন্তু আপনি বেশ অস্বস্তিতে আছেন তাহলে বুঝতে হবে সেটা ছিল night terror।
অন্যভাবে বলা যায়, এই রাতের আতংকের জন্য শিশু থেকে বাবা মাদের মধ্যেই বেশি আতঙ্ক বিরাজ করে। কেননা, শিশুর কিছুই মনে থাকে না… অপরদিকে বাবা মাকেই এই অবস্থাগুলোর মধ্য দিয়ে থাকতে হয়।
শিশু যদি এই ধরনের night terror এ ভোগে, তাহলে আপনার করনীয় কি?
এই সময়ে শিশুকে ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করবেন না। এছাড়া শিশুকে এই সময়ে শান্ত করার চেষ্টা করেও লাভ নেই, কেননা সেই চেষ্টা একদম বিফলে যাবে। night terror এর সময়ে শিশুকে আসলে শান্ত করা সম্ভব হয় না। আপনি যতই তাকে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করবেন সে ততই বেশি আতংকিত হতে থাকবে এবং আরো উত্তেজিত হয়ে উঠবে।
শিশুর এই অবস্থাটা বসে বসে শুধু দেখা আসলে একটু অস্বস্তিকর। তবে সে যাই হোক, যদি শিশু নিজেকে কোন ভাবে আঘাত করার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে শিশুকে ধরতে যাওয়ার দরকার নেই। শুধু তার সাথে শান্ত স্বরে কথা বলার চেষ্টা করুন, শিশু যাতে আঘাত না পায় সেদিকে খেয়াল রাখুন এবং এই সময়টা পার হয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করুন।
ঘুমাতে যাওয়ার আগে শিশুর জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়ে ঘুমাবেন। কেননা এই ধরনের সমস্যায় ভোগা শিশুরা প্রায়ই রাতে ঘুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতে পারে। তাই রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগেই মেঝেতে যদি কিছু পড়ে থাকে সেগুলো সরিয়ে নিন। সিঁড়ির মুখে দরজা লাগিয়ে নিন। এবং দরজা জানালা ভালোভাবে বন্ধ আছে কিনা তা পরীক্ষা করে নিন।
Night terror অর্থাৎ শিশুর ঘুমের মধ্যে এই আতংকের কারণ কি? এবং এটা কি প্রতিরোধ করা যায়?
Night terror এর সুনির্দিষ্ট কোন প্রতিকার নেই, কেননা এর কোন সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কেও জানা যায় নি। তবে যতটুকু জানা গেছে, এই ধরনের আতংকের মানে এই না যে, শিশু কোন ধরনের মানসিক সমস্যা ভুগছে অথবা কোন কারণে সে বিপর্যস্ত।
তবে কিছু কিছু কারণে এর ঝুঁকি বাড়তে পারে, যেমন- শিশুর জ্বর বা পরিমিত ঘুম না হওয়া। আর তাই শিশু রুটিন মেনে ও পরিমাণ মত ঘুমাচ্ছে কি না এদিকে লক্ষ্য রাখলে শিশুর রাতের বেলায় এই ধরনের আতংকিত হওয়ার সমস্যা ধীরে ধীরে চলে যেতে পারে।
এছাড়াও বিশেষ ধরনের কোন ওষুধ অথবা ক্যাফেইনের জন্যও শিশু night terror এ ভুগতে পারে। এছাড়াও পরিবারের সদস্যদের মধ্য যদি অন্য কারো এই ধরনের ঘুম জনিত সমস্যা থেকে থাকে তাহলে শিশুর মধ্যেও এই ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কোন কোন ক্ষেত্রে sleep apnea রোগের জন্যও শিশুর মধ্যে night terror দেখা যেতে পারে। টনসিল অথবা এডিনয়েড বড় হয়ে যাওয়ার কারণে শিশুর শ্বাস নালীতে বাতাস প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হলে শিশুর মধ্যে এই sleep apnea রোগ দেখা যায়। এই কারণে শিশুর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং সে সারারাত ঠিকমত ঘুমাতে পারে না।
দিনের বেলা বাড়িতে, স্কুলে বা বাইরে কোনো ঝামেলা হয়ে থাকলে, কোনো ভীতি উৎপাদক ছবি দেখে থাকলে বা নতুন পরিবেশে ঘুমোলে বাচ্চাদের নাইট টেরর হতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, কোন রোগের কারণে শিশু যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম না নিতে পারে তাহলে শিশুর মধ্যে night terror দেখা যেতে পারে। যে রোগগুলোর জন্য শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিতে পারে না তার মধ্যে restless legs এবং gastroesophageal reflux অন্যতম। যদি এই ধরনের সমস্যার কারণে শিশুর মধ্যে night terror দেখা যায় তাহলে ডাক্তারের সাথে এ বিষয়ে আলাপ করতে পারেন।
Scheduled awakening কি?
এমনটা যদি দেখেন যে, প্রতিদিন ঠিক একই সময়ে শিশু night terror এ আক্রান্ত হচ্ছে, তাহলে এই scheduled awaking পদ্ধতি চেষ্টা করা যেতে পারে। যদি শিশু প্রতিদিন একই সময়ে night terror এ আক্রান্ত হয়, তাহলে ঠিক যে সময়টাতে সে night terror এ আক্রান্ত হয় তার ১৫ মিনিট আগেই আলতো করে শিশুর ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে শিশুর night terror কে প্রতিরোধ করা সম্ভব। এছাড়া এভাবে যদি বেশ কিছুদিন শিশুকে জাগিয়ে দেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে night terror এর আগে শিশু নিজ থেকেই ঘুম থেকে উঠে যাচ্ছে।
যদিও nigh terror এর ক্ষেত্রে এইভাবে ১৫ মিনিট আগে জাগিয়ে দেয়ার প্রভাব সম্পর্কে খুব একটা গবেষণা করা হয়ে উঠেনি এখন পর্যন্ত। তবে শিশুকে night terror এ আক্রান্ত অবস্থায় জাগাতে গেলে তার আতঙ্ক আরো বেড়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।
কখন ডাক্তারকে জানাতে হবে
বেশিরভাগ শিশুরই এই আতঙ্ক এক সময় কাটিয়ে ওঠে। তবে যদি এ সমস্যা একরাতে বেশ কয়েকবার বা বেশিরভাগ রাতেই হতে থাকে তবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখবেন কোন কারণে শিশুর ঘুমের খুব বেশি অসুবিধা হচ্ছে কিনা। যেমন স্লীপ অ্যাপনিয়া। কিছু কিছু শিশুর ক্ষেত্রে বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন পড়তে পারে।
সবার জন্য শুভকামনা।