শিশু দুঃস্বপ্ন কেন দেখে? আপনি এ ব্যাপারে কি করতে পারেন?

Spread the love

আপনার শিশুও তার দুঃস্বপ্ন অথবা মজার স্বপ্নের কথাটি মনে রাখতে পারে। বেশীরভাগ শিশুই কিন্তু রাতের বেলায় মাঝেমধ্যেই দুঃস্বপ্ন দেখে। তবে প্রিস্কুলের সময়টাতে শিশুরা একটু বেশিই দুঃস্বপ্ন দেখে আর এই সময়টাতেই প্রায় শিশুর মধ্যেই অন্ধকারে ভয় পাওয়াটা প্রবল হয়ে ওঠে।

এই দুঃস্বপ্নকে চাইলেই বাঁধা দেয়া যায় না, এটা আসতেই পারে। তবে বাবা মা’রা যেটা করতে পারেন সেটা হল শিশুর সুন্দর ঘুমের জন্য একটা ভালো পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারেন। এভাবেই যখন দুঃস্বপ্ন শিশুর ঘুমের মধ্যে উঁকি দেয়, তখন আপনার দেয়া অল্প একটু আরাম শিশুর মনে নিয়ে আসতে পারে প্রশান্তি।

বিজ্ঞাপণ

রাতের কোন অংশে শিশু দুঃস্বপ্ন দেখে?  

বেশীরভাগ স্বপ্নের মতই ঘুমের মধ্যে যে সময় মানুষের মস্তিষ্ক যখন সবচাইতে একটিভ থাকে তখন দুঃস্বপ্ন আসতে পারে। মানুষের মস্তিষ্কে কিছু প্রাণবন্ত ছবির মত আসে, সেগুলো আবার আমাদের অনুভূতির মাধ্যমে একদম সত্যিকারের বলে মনে হয়।

ঘুমের এই অবস্থাকে বলে rapid eye movement (REM), কেননা এই সময়ে চোখের পাতা বন্ধ থাকা অবস্থাতেই চোখের মনি খুব দ্রুততার সাথে নড়াচড়া করে। দুঃস্বপ্ন বেশীরভাগ সময়ে রাতের দ্বিতীয় ভাগে আসে যখন এই REM পর্যায় দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে।

দুঃস্বপ্ন দেখে শিশুর যখন ঘুম ভেঙ্গে যায়, সেই সময়ও স্বপ্নকে তার একদম জীবন্ত ও একদম সত্যি মনে হতে থাকে। তাই সে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙার পর যখন একটু আশ্বস্ত হতে বাবা মা’কে ডাকে, সেটা একদমই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।

যদিও প্রিস্কুলের সময়টাতেই শিশুরা বুঝতে শিখে যে, স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই। এটা কখনো বাস্তব হবে না এবং এই স্বপ্ন তার কোন ক্ষতিও করতে পারবে না। তবে এটা জানার মানে এই না যে শিশু তখন ভয় পাবে না, কেননা শিশু এটা জানার এবং বুঝার পরেও ভয় পায়। এমনকি বড় শিশুরাও দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলে বেশ ভয় পায়।

[ আরও পড়ুনঃ শিশু রাতের বেলায় আতংকিত হয়ে (Night Terror) জেগে উঠে কেন? আর এই ব্যাপারে আপনার করনীয় কি? ]

শিশু দুঃস্বপ্ন কেন দেখে?

আদতে এখন পর্যন্ত কেউ জানে না মানুষ দুঃস্বপ্ন ঠিক কী কারণে দেখে। তবে স্বপ্ন এবং দুঃস্বপ্ন উভয়টাই শিশুর প্রাত্যহিক জীবনের চিন্তা ভাবনা এবং যে সমস্ত পরিস্থিতিতে সে থাকে সেগুলোর আবেগ, ভয় ও উদ্বেগেরই একটা প্রতিফলন।

আবার শিশু যে কোন ধরনের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সময় পার করলেও দুঃস্বপ্ন দেখতে পারে। এছাড়া নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়া, এক জায়গা থেকে বাসা অন্য যায়গায় পরিবর্তন হওয়া, ভাই-বোনের জন্ম হওয়া অথবা পারিবারিক যে কোন সমস্যার সময় শিশু এই ধরনের দুঃস্বপ্ন দেখতে পারে।

আপনার শিশু যখন দুর্যোগ অথবা দুর্ঘটনা জনিত কারণে মানসিক আঘাত পায়, তার ফলাফল স্বরূপও শিশু দুঃস্বপ্ন দেখে। এছাড়াও অতি মাত্রায় কল্পনাপ্রবণ শিশুরা ঘুমাতে যাওয়ার আগে যদি কোন ভয়ের বই পড়ে অথবা ভয়ের মুভি দেখে তাহলেও সে দুঃস্বপ্ন দেখতে পারে।

আবার কখনো শিশু দৈনন্দিন যে সকল ঘটনার মধ্যে দিয়ে যায়, সেগুলোই একটু ভয় মিশ্রিত হয়ে শিশুর ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্নের আকারে আসতে পারে। সাধারণত এইসব দুঃস্বপ্নের সবকিছু শিশু মনে রাখতে পারে না, তবে কিছু কিছু চরিত্র, ঘটনা এবং ভয়ের মুহূর্ত তার মনে থেকে যায়।

সুন্দর স্বপ্ন দেখার জন্য কি করতে পারেন

বাবা মা’রা চাইলেই কিন্তু শিশুর দুঃস্বপ্ন দূর করতে পারেন না, তবে তারা যেটা পারেন সেটা হল, শিশুর জন্য চমৎকার একটা ঘুমের পরিবেশ তৈরি করে দিতে। আর এভাবেই তারা শিশু যাতে সুন্দর স্বপ্ন দেখে সে ব্যাপার উৎসাহিত করতে পারেন।

খুব চমৎকার এবং আরামপ্রদ ঘুমের জন্য, শিশুর যে কাজগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে সেগুলো নিম্নে বর্ণীত হলঃ

বিজ্ঞাপণ
  • নিয়মিত একই সময়ে ঘুমানো ও ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস তৈরি করা।
  • ঘুমের জন্য একটা নিয়মিত রুটিন তৈরি করা, এর মাধ্যমে শিশু যখন ঘুমাতে যায় তখন সে বেশ নিরাপদ বোধ করে। আর এই রুটিনের মধ্যে আপনি চাইলে ঘুমানোর সময় তাকে গল্পের বই পড়া, একটু আদর করে দেয়া অথবা সারাদিনের মজার ঘটনা নিয়ে নিরিবিলিতে একটু কথা বলাকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
  • শিশুর বিছানা যাতে তার সুন্দর ঘুমের জন্য বেশ আরামপ্রদ হয়, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখুন। শিশুর ঘুমের সময় তার বিছানায় যদি তার প্রিয় খেলনা, খেলনা ভাল্লুক রাখা যায় তাহলে সেটা তার সুন্দর ঘুমের ব্যাপারে সাহায্য করবে।
  • ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভয়ের মুভি, ভয়ের বই পড়া থেকে বিরত রাখতে হবে, বিশেষ করে সেগুলো যদি দুঃস্বপ্ন হিসেবে শিশুর মনে আঘাত করে।
  • দুঃস্বপ্ন যে আসলে সত্যি নয় এবং তার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা, শিশু যাতে এটা জানে এবং বুঝতে পারে।

দুঃস্বপ্ন দেখে শিশুর ঘুম ভেঙ্গে গেলে তখন আপনি কি করবেন?

শিশু দুঃস্বপ্ন দেখার পর কীভাবে তাকে আবার শান্ত করতে হবে, সেটা নিচে বর্ণীত হলঃ

শিশুকে আশ্বস্ত করতে হবে যে আপনি সবসময় তার আশেপাশেই আছেন। শিশু দুঃস্বপ্ন দেখার পর যদি আপনার শান্ত উপস্থিতি দেখে তাহলে ভয় পেয়ে ঘুম ভাঙার পর তার কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে হবে। আপনি আশেপাশেই আছেন এবং যে কোন ব্যাপারে শিশুকে সাহায্য করবেন, এই ভাবনাটাই শিশুকে নিরাপদ এবং আশ্বস্ত করে।

আসলে কি ঘটেছে, সেটা শিশুকে বুঝানোর চেষ্টা করুন এবং তাকে বলুন সে দুঃস্বপ্ন দেখছিল আর সেটা শেষ হয়ে গেছে। “তুমি দুঃস্বপ্ন দেখছিলে আর তোমার ঘুম ভাঙার সাথে সাথে তোমার দুঃস্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে এখন সবকিছু স্বাভাবিক আছে” এমন কিছু একটা শিশুকে বলতে পারেন। শিশুকে আশ্বস্ত করুন যে, দুঃস্বপ্নের মধ্যে যেগুলো সে দেখেছে সেগুলো সত্যি নয় এবং বাস্তবে সেগুলো কখনো হয় না।

আপনার শিশুকে বুঝিয়ে দিন যে তার এই ভয় পাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক এবং এমনটা যে হতেই পারে সেটা আপনি জানেন। তাকে বলুন যে, সবাই দুঃস্বপ্ন দেখে আর মাঝেমধ্যে এগুলো খুবই ভয়ানক হয়। দুঃস্বপ্নগুলো একদম সত্যিকারের মত মনে হয় আর তাই দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।

প্রি-স্কুল এবং ছোট শিশুদের মন খুবই কল্পনাপ্রবণ হয়, তাই সে সময় আপনি যদি তাকে অনেক আদর দেন এবং তাকে নিরাপদ অনুভব করাতে পারেন তাহলে সেটা একদম ম্যাজিকের মত কাজ করে। শিশু ঘুমাতে যাওয়ার আগে এমন ভাব করুন যেন আপনি ম্যাজিক স্প্রে দিয়ে সব ভুত তাড়িয়ে দিচ্ছেন। এছাড়াও বিছানার নিচে এবং আলনার মধ্যে ভালো করে চেক করে দেখে শিশুকে আশ্বস্ত করুন যে কোথাও কিছু নেই।

শিশু যখন ঘুমাতে যাবে তখন ঘর একদম অন্ধকার না রেখে হালকা ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিতে পারেন। হালকা আলো থাকার কারণে শিশু একটু নিরাপদ বোধ করবে। এছাড়া শিশুর বিছানার পাশে একটা ফ্ল্যাশ লাইট রেখে দিতে পারেন, যাতে করে শিশু যদি দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে আলো জ্বালাতে পারে। 

শিশুকে আবার ঘুমিয়ে যেতে সাহায্য করুন। আরামদায়ক কোন কিছু দিলে শিশু হয়ত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাবে। শিশুর প্রিয় খেলনা, একটা আরামদায়ক কম্বল, কোলবালিশ অথবা ডিম লাইট শিশুকে পুনরায় ঘুমিয়ে যেতে সাহায্য করে।

এছাড়া শিশুর সাথে তার সুন্দর কোন স্বপ্ন নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। আপনি রুম থেকে বের হওয়ার আগে শিশুর সুন্দর করে একটা চুমু দিয়ে দিন, এতে করে তার ভালো লাগবে।

শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। দুঃস্বপ্ন দেখে শিশুর ঘুম ভেঙ্গে গেলে সেই অল্প সময়ের মধ্যে দুঃস্বপ্ন নিয়ে খুব বেশি কথা বলবেন না। শুধুমাত্র শিশুকে শান্ত ও নিরাপদ অনুভব করানোর জন্য তাকে আশ্বস্ত করুন যাতে সে পুনরায় ঘুমাতে চলে যায়।

পরদিন সকালে শিশু আপনাকে হয়ত তার গত রাতে দুঃস্বপ্নের কথা বলতে চাইবে, তখন তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। কেননা দিনের বেলায় রাতের দুঃস্বপ্ন শিশুকে অতটা ভয় দেখাতে পারে না, তখন আপনার শিশু দিনের বেলায় সেই দুঃস্বপ্নের শেষ অংশ নিয়ে সুন্দর কিছু ভেবে আনন্দ পেতে পারে।

বেশীরভাগ শিশুর ক্ষেত্রেই ঘুমের মধ্যে যখন তখন দুঃস্বপ্ন আসতেই পারে, এটা খুব একটা উদ্বেগের কোন বিষয় নয়। বাবা মা’রা যদি শিশুকে একটু আশ্বস্ত করেন তাহলেই হবে। তবে শিশুর এই রকম দুঃস্বপ্ন যদি প্রায় সময়েই এসে শিশুর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় এবং একই সাথে শিশুর আবেগ ও আচার আচরণে কোন পরিবর্তন আসে তাহলে শিশুর ডাক্তারের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করে নিন।  

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment