নবজাতকের প্রথম সপ্তাহের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমূহ- আপনার নবজাতকের প্রথম সপ্তাহ কাটে খাওয়া, ঘুমানো এবং সোহাগ-আদরে।
- আদর, কথা এবং হাসির মাধ্যমে আপনি আপনার নবজাতকের সাথে বন্ধন গড়ে তুলতে পারেন।
- যদি আপনি আপনার বাচ্চাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন তবে আপনি জেনারেল ফিজিশিয়ান, শিশু ও পারিবারিক নার্স বা শিশু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে পারেন।
নবজাতকের জীবনের প্রথম সপ্তাহ
আপনার নবজাতকের জীবনের প্রথম সপ্তাহ কাটে চারপাশের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোয়।
জরায়ুর পরিবেশ বাইরের পরিবেশ থেকে বেশ ভিন্ন হয়, সেখানের আলো ক্ষীণ থাকে, তাপমাত্র অপরিবর্তনীয় থাকে, এবং আওয়াজ চাপা থাকে। উষ্ণতা, ভালবাসা, নিরাপত্তা, মনোযোগ, অনেক আদর এবং হাসির মাধ্যমে আপনি আপনার বাচ্চাকে বাইরের পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারেন।
জীবনের প্রথম সপ্তাহে নবজাতকের আকৃতির পরিবর্তন
প্রথম সপ্তাহে আপানর বাচ্চার আকার পরিবর্তিত হতে থাকবে।জন্মনালী দিয়ে প্রসবের দরুন বা ভ্যাকুয়াম-এ্যাসিস্টের মাধ্যমে জন্মদানের কারণে যদি আপনার বাচ্চার মাথার আকৃতি কৌনিক ধরনের হয়, তবে তা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করবে।
আপনার বাচ্চার মুখে ও চোখে ফোলা ভাব থাকলে তা কয়েক দিনের মধ্যে কমে যাবে। ফোরসেপের মাধ্যমে জন্মানো শিশুর মাথায় বা মুখে কালশিটে দাগ থাকলে তা মিলিয়ে যেতে শুরু করে।
জন্মের সময় আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া শিশুদের জন্ডিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যদি আপনার বাচ্চার মুখের রং হলদেটে দেখেন এবং জন্ডিস বলে সন্দেহ হয় , তবে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
সাধারণত প্রথম দশ দিনের মধ্যে আপনার বাচ্চার নাভি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে, ক্রমে কাল বর্ণ ধারণ করবে এবং ঝরে যাবে।নবজাতকের নাভি পরিষ্কার ও শুকনো রাখুন। যদি নাভির আশ-পাশের জায়গাটা লাল বা চটচটে দেখায় তবে ডাক্তারকে জানাতে হবে।
[ আরও পড়ুনঃ নবজাতকের নাভি সংক্রান্ত কিছু জরুরী বিষয়]
জন্মের আগে বা পরে আপনার বাচ্চার শরীরে এক বা একাদিক জন্মদাগ থাকতে পারে। জন্মদাগ গুলো স্বাভাবিক জিনিস এবং তার জন্য চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু, যদি বাচ্চার জন্মদাগ আপনাকে ভাবায় বা যদি এটি পরিবর্তিত হয়, সেক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিত।
[ আরও পড়ুনঃ নবজাতকের বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ ]
জীবনের প্রথম সপ্তাহে নবজাতকের খাওয়া ও ঘুম
আপনার নবজাতক বেশীর ভাগ সময় ঘুমোয়, খাওয়ার জন্য প্রতি কয়েক ঘন্টা পর পর জেগে ওঠে। সদ্যোজাত শিশুরা সারা রাত ঘুমাতে পারেনা। তাদের পাকস্থলী খুব ছোট, তাই তাদের প্রায়শই জেগে উঠে খেতে হয়।
অধিকাংশ বাচ্চার প্রতি ২-৪ ঘন্টা পরপর খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে, এবং ২৪ ঘন্টায় ৮-১২ বার খেতে হয়। বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চাদের কখনো কখনো ঘণ্টা খানেক সময় নিয়ে খাওয়ানোর প্রয়োজন পড়তে পারে ।
আপনার বাচ্চা স্বাভাবিক ভাবে খিদে পেলে ঘুম থেকে জেগে উঠে। কিন্তু কিছু বাচ্চাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে খাওয়ানোর প্রয়োজন পড়ে, যেমন- যদি বাচ্চা অনেকটা ওজন হারিয়ে ফেলে, আকৃতি বেশী ছোট হয়, বা জন্ডিসে আক্রান্ত হয়।
নবজাতকের খাওয়া ও ঘুমের একটি নির্দিষ্ট সময়সূচী তৈরি হতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে যেতে পারে।
প্রথম কয়েক সপ্তাহ আপনার নিজের দিকে লক্ষ্য রাখা জরুরী। তা বলতে বোঝায়, ভাল ভাবে খাওয়া-দাওয়া এবং কিছু হালকা ব্যায়াম করা, এবং যখন আপনার বাচ্চা ঘুমাবে তখন কিছুটা ঘুমিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা। এসব কাজে পরিবারের অন্য সদ্যসদ্যের সাহায্য নিতে পারেন।
জীবনের প্রথম সপ্তাহে নবজাতকের বিকাশ
প্রতিদিন বাচ্চার সাথে সময় অতিবাহিত করলে, আপনার বাচ্চা অনেক কিছু শেখে। তার চারপাশের দুনিয়াকে দেখার, শোনার, গন্ধ শোকার এবং স্পর্শ করার মধ্য দিয়ে, তার মস্তিষ্ক পরিণত ও পরিবর্তিত হতে থাকে।
আপনার বাচ্চা অনিচ্ছাকৃতভাবে হাত গুটিয়ে ফেলে, এবং জোরালো কোন আওয়াজ শুনলে হঠাৎ চমকে উঠবে। এমনকি ঘুমানোর সময় সে মাঝে মাঝে হঠাৎ কেঁপে উঠতে পারে।
[ আরও পড়ুনঃ ০-৩ মাস বয়সী শিশুর বিকাশে যেভাবে সাহায্য করবেন ]
জীবনের প্রথম সপ্তাহে বন্ধন ও ভাবের আদান প্রদান
আপনার নবজাতক আপনার গলার স্বর চিনতে পারে, কারণ গত নয় মাস ধরেই জরায়ুতে থাকার সময় থেকে আপনার আওয়াজ শুনে আসছে। আপনার বাচ্চার সাথে গলার স্বর, স্পর্শ, দৃষ্টি এবং গন্ধের মাধ্যমে ভাব আদান প্রদান করতে পারেন।
আপনার বাচ্চার নিজস্ব উপায়ে আপনার সাথে ভাব বিনিময় করে যদিও সে এখনো হাসতে পর্যন্ত পারেনা। প্রথম সপ্তাহে, আপনি আপনার বাচ্চার শরীরের ভাষা বুঝতে শিখবেন।
অনেক স্পর্শ, আদর, হাঁসি এবং দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে আপনার শিশু আপনার সাথে নিরাপদ বোধ করবে। এটি বন্ধন ও ঘনিষ্টতাকে আরও দৃঢ় করে। এটি বাচ্চার মস্তিষ্কের উন্নয়নেও সাহায্য করে।
জীবনের প্রথম সপ্তাহে সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো
ওজন হারানো
এটি স্বাভাবিক যে জন্মের প্রথম পাঁচ দিনে আপনার বাচ্চার ওজন কমে যাবে, কারণ এ সময় সে তার শরীরের অতিরিক্ত তরল হারাতে থাকে। তবে ওজন কমা কোন ভাবেই জন্মের ওজনের ১০% বেশী হওয়া উচিত না, যদিও অধিকাংশ শিশু ১-২ সপ্তাহের মধ্যেই জন্মের ওজন ফিরে পায়। যদি আপনার বাচ্চা বেশী ওজন হারায়, তবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া জরুরী।
[ আরও পড়ুনঃ বয়স অনুযায়ী শিশুর ওজন ও উচ্চতা বৃদ্ধির চার্ট । ০-১২ মাস ]
আঠালো চোখ বা চোখ থেকে পিচুটি বের হওয়া
জীবনের প্রথম কয়েক সপ্তাহে আপনার বাচ্চার চোখ চটচটে থাকতে পারে বা চোখ থেকে চটচটে পদার্থ নির্গত হতে পারে। সেটা স্বাভাবিক ঘটনা। নবজাতকের অস্রুনালী বন্ধ থাকার কারণে সাধারণত এমন হয় যা আপনা-আপনিই ভাল হয়ে যায়। আলতোভাবে চোখ পরিষ্কার করে দেয়া এবং চোখ মাসাজ করলে উপকার হতে পারে। যদি আপানার বাচ্চার চোখ লাল বা চটচটে দেখায় সেক্ষত্রে ডাক্তারকে জানাতে হবে।
ফুসকুড়ি বা র্যাশ
সদ্যোজাত শিশুদের গায়ে অনেক ধরনের লাল লাল ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে, যা গুরুতর নয়। তবে র্যাশ হলে একবার চেক আপ করিয়ে নেয়া ভালো । সাধারণ ফুসকুড়ি বা র্যাশগুলো হলো ক্র্যাডেল ক্যাপ, ন্যাপী র্যাশ, হিট র্যাশ, একজিমা, মিলিয়া এবং শুকনো চামড়া।
[ আরও পড়ুনঃ নতুন জন্মানো বাচ্চা: সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং সমস্যাসমূহ]
কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে
যদি আপনার কোন কিছু ঠিক মনে না হয় এবং বাচ্চাকে নিয়ে চিন্তিত হন তবে সাহায্য নিন, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন যত দ্রুত সম্ভব:
- যদি বাচ্চা খেতে না চায়, যেমন সে যদি প্রতিবার খাওয়ার সময় তার স্বাভাবিক খাওয়ার পরিমাণের চাইতে অর্ধেক বা তার কম খায়, সে স্বাভাবিকভাবে ২৪ ঘণ্টায় যতবার খেত তার চাইতে যদি অর্ধেক বা তার কম বার খায়, যদি অনেক বেশী বমি করে।
- প্রতিদিন ৬-৮ বারের চাইতে কম প্রস্রাব করলে।
- সবসময় বিরক্ত, নিষ্ক্রিয় বা বেশি ক্লান্ত দেখালে বা খাওয়ানোর জন্য ঘুম থেকে জাগানো কঠিন হলে
- চামড়া বিবর্ণ বা হলদে হলে
জীবনের প্রথম সপ্তাহে কান্নাকাটি
নবজাতকদের জন্য কান্নাকাটি স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু ব্যাপারটা তখনি সমস্যা যদি আপনি বুঝতে না পারেন আপনার বাচ্চা কি চাইছে। কারণ, কান্নার মাধ্যমেই শিশুরা বোঝাতে চায় তাদের কি প্রয়োজন।
আপনার শিশু কান্না করতে পারে :
- ক্ষুধার্থ থাকলে
- ডায়াপার ভেজা বা অপরিষ্কার হলে
- অস্বস্তিবোধ করলে (বেশী গরম বা বেশী ঠান্ডা)
- আপনার সানিদ্ধ্য পেতে চাইলে
আপনার সদ্যোজাত যদি কান্না করে তবে আপনি তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করতে পারেন, ডায়াপার বদলে দিতে পারেন বা আদর করতে ও দোলাতে পারেন, কথা বা গান শোনাতে পারেন নরম স্বরে, কিংবা তাকে উষ্ণ গোসল দিতে পারেন। মনে রাখবেন আপনার বাচ্চা যদি বেশী কান্না করে তবে তা এই বোঝায়না যে নতুন বাবা-মা হিসাবে আপনারা ভাল করছেন না।
কান্নার জন্য কখন ডাক্তারকে জানাতে হবে
আপনি যদি ভাবেন আপনার সদ্যোজাত বেশি কান্নাকাটি করছে বা আপনি সামলাতে পারছেন না, তবে দ্রুত বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলুন।
বাচ্চার যদি নীচের লক্ষণগুলো থাকে তবে দ্রুত ডাক্তারকে জানাতে হবে, যদি-
- তীক্ষ্ণ স্বরে কাঁদতে থাকে (বেড়ালের মতো)
- দূর্বল ভাবে কাঁদে বা গোঙানোর মতন শোনায়
- লম্বা সময় ধরে কাঁদতে থাকে
[ আরও পড়ুনঃ কলিক বেবি । শিশুর অস্বাভাবিক কান্না ]
প্রথম সপ্তাহের পর বাচ্চার স্বাস্থ্য পরীক্ষা
আপনার নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বাচ্চার ফ্রী স্বাস্থ্য পরীক্ষা সেবা দেয় হয়, সাধারণত জন্মের দুই, চার এবং আট সপ্তাহ পর। এসময় নবজাতকের চেক আপ করিয়ে নিন।
আপনি যখন পরীক্ষা করানোরে জন্য যাবেন, ভাল হয় যদি লাল লাল ফুসকুড়ি থেকে বমি বা কান্নার মত যেকোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করে নেন। পরীক্ষা করানোর আগে আপনি আপনার প্রশ্নগুলো লিখে নিন, তাহলে দাক্তারতকে যা প্রশ্ন করতে চান তা ভুলবেন না।
মাস অনুযায়ী শিশুর বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে পড়ুন- শিশুর বেড়ে ওঠা । প্রথম বছর
সবার জন্য শুভকামনা।