গর্ভাবস্থায় চেকআপ । তৃতীয় ট্রাইমেস্টার

Spread the love

সুস্থ স্বাভাবিক গর্ভধারণের জন্য গর্ভাবস্থায় পরিচর্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে শেষ তিন মাসে। গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে গর্ভের শিশুর ওজন দ্রুত বাড়তে থাকে, হাত ও পায়ের নখ গজায়, চোখের পাতা খোলা বন্ধ করা শুরু হয়। এ সময় আপনার অনেক ক্লান্ত লাগা স্বাভাবিক। এ সময় আপনি শিশুর নড়াচড়াও অনেক বেশী টের পাবেন।

আপনার গর্ভাবস্থা যদি সুস্থ স্বাভাবিক হয় তবে তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে ২৮-৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি দু সপ্তাহে একবার এবং ৩৬ থেকে প্রসবের আগ পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে একবার করে ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দেয়া হয়।

বিজ্ঞাপণ

আপনার যদি আগে থেকেই ধারনা থাকে ডাক্তারের সাথে এসব সাক্ষাতে কি কি হতে পারে এবং কি বিষয়ে আলোচনা হতে পারে তাহলে আপনার পক্ষে গর্ভকালীন সময়ে স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলো সম্পর্কে বোঝা অনেক সহজ হবে। এর ফলে উভয়পক্ষের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়। এবং কোন বিষয় ডাক্তারের চোখ এড়িয়ে গেলেও আপনি নিজ থেকেই সে সম্পর্কে ডাক্তারকে জিজ্ঞেশ করতে পারেন।

তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে সাধারণত দ্বিতীয় ত্রাইমেস্টারের মতই কিছু রুটিন চেকআপ করা হবে। এছাড়াও কিছু টেস্ট এবং এবং প্রসব পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী করনীয় বিষয়ে কিছু আলোচনা হতে পারে। নিচে এই ট্রাইমেস্টারে ডাক্তারের সাথে সাক্ষাতে কি কি হতে পারে সে সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে ডাক্তারের সাক্ষাতে কি কি হতে পারে?

আপনার সার্বিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আলোচনা

ডাক্তার আপনি কেমন বোধ করছেন সে সম্পর্কে জানতে চাইবেন বিশেষ করে আপনার আপনার মাথা ব্যাথা আছে কিনা, কোন ধরনের কন্ট্রাকশন অনুভব হচ্ছে কিনা, বা শরীরের কোথাও ফোলা ভাব আছে কিনা। দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে কোন সমস্যা থেকে থাকলে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইবেন এবং ওই সময়ে করা টেস্টগুলোর রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখবেন তাতে কোন অস্বাভাবিকতা আছে কিনা।

ডাক্তার আপনার কাছে জানতে চাক বা না চাক, আপনার যদি কোন বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকে বা কোন লক্ষন আপনার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয় তবে অবশ্যয় তা নিয়ে আলোচনা করুন।

ডাক্তারের ব্যাস্ততা দেখে চুপ করে থাকবেন না। তিনি হয়তো সারাদিনে প্রচুর রোগী দেখেন বলে ব্যস্ত থাকতে পারেন কিন্ত আপনার নিজের শরীর এবং গর্ভের সন্তান পুরো পৃথিবীতে আপনার কাছে সবচাইতে দামী।

বাচ্চার নড়াচড়া সম্পর্কে আলোচনা

এ ট্রাইমেস্টারে ডাক্তার আপনার কাছে জানতে চাইবেন গর্ভের শিশু কত ঘন ঘন এবং কতক্ষন ধরে নড়াচড়া করে। তিনি হয়তো আপনাকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে বাচ্চার নড়াচড়া রেকর্ড করার পরামর্শ দিবেন। যদি বাচ্চার নড়াচড়া আপনার কাছে স্বাভাবিক মনে না হায় তবে অতি সত্বর ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

শারীরিক পরীক্ষা

ওজন ও রক্ত পরিক্ষাঃ দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারের মত এই ট্রাইমেস্টারেও ওজন নেয়া হবে এবং রক্ত পরীক্ষা করা হবে। প্রি-এক্লাম্পশিয়া, যৌনাঙ্গের ইনফেকশনের লক্ষন আছে কিনা তা দেখার জন্য  ডাক্তার ইউরিন টেস্টের পরামর্শ দিতে পারেন। আপনার হাত, পা বা মুখে কোন ফোলা ভাব আছে কিনা সেটাও তিনি পরীক্ষা করে দেখবেন।

শিশুর হৃদ স্পন্দন এবং জরায়ুর মাপঃ ডাক্তার আপনার গর্ভের শিশুর হৃদস্পন্দন চেক করেবন এবং আপনার পেটে হাত দিয়ে ও Fundal height মেপে দেখবেন। এর সাথে তিনি আপনার গর্ভধারণের বয়স এবং পূর্বের নেয়া মাপ মিলিয়ে দেখবেন যে আপনার বাচ্চার বৃদ্ধি স্বাভাবিক কিনা। যদি কোন সমস্যা মনে হয় তবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আল্ট্রাসাউন্ড করার পরামর্শ দিবেন।

গর্ভে বাচ্চার অবস্থানঃ ডাক্তার পরীক্ষা করে বলতে পারবেন গর্ভে আপনার শিশু কি অবস্থানে আছে। তার মাথা কি নিচের দিকে নাকি উপরের দিকে (ব্রীচ পজিশন)। ৩৬ সপ্তাহের দিকে ডাক্তার যদি বুঝতে পারেন যে বাচ্চা ব্রীচ পজিশনে আছে বা নিশ্চিত হতে না পারেন তাহলে আলট্রাসাউন্ডের পরামর্শ দেয়া হবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। যদি আল্ট্রাসাউন্ডে বাচ্চার ব্রীচ পজিশন পাওয়া যায় তবে আপনাকে হয়তো external cephalic version এর পরামর্শ দেয়া হবে।

পেলভিক ও সারভিক্স পরীক্ষাঃ কোন নির্দিষ্ট কারণ না থাকলে সাধারণত এ পরীক্ষাগুলো করা হয়না। আপনার যদি প্রসবের সময় পেড়িয়ে যায় তাহলে ডাক্তার জরায়ুমুখ পরীক্ষা করে এর অবস্থা দেখবেন। এর পর তিনি আপনার প্রসবের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।

বিজ্ঞাপণ

ভ্যাজিনাল পরীক্ষাঃ যদি গর্ভের শিশুর মাথা খুব নিচের দিকে নেমে যায় অর্থাৎ শিশু যদি পেলভিক ক্যাভিটি তে চলে আসে তাহলে ডাক্তারের পক্ষে পেটে হাত দিয়ে তার অবস্থান নির্ণয় করা কঠিন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভ্যাজিনাল পরীক্ষার দরকার হতে পারে।

Rh immune globulin এর ইঞ্জেকশন

আপনি যদি Rh নেগেটিভ হন এবং বাচ্চার বাবা Rh পজিটিভ হয় তাহলে গর্ভের শিশুর Rh পজিটিভ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। সেক্ষেত্রে আপনার রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হবে আপনার রক্ত শিশুর Rh পজিটিভ রক্তের জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করছে কিনা। এ পরীক্ষাটি সাধারণত দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারের শেষের দিকে করা হয়ে থাকে।

যদি আপনি Rh নেগেটিভ হন তবে ২৮ সপ্তাহে আপনাকে Rh immune globulin এর ইঞ্জেকশন দেয়া হবে যাতে আপনার রক্ত অ্যান্টিবডি তৈরি করতে না পারে। সাধারণত এ সময়ের আগে রক্ত অ্যান্টিবডি তৈরি করেনা কিন্তু যদি রক্তে অ্যান্টিবডি সনাক্ত হয় তাহলে গর্ভাবস্থার শেষ পর্যন্ত শিশুকে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এই ইঞ্জেকশনে কোন ক্ষতি হয়না।

 Group B Strep টেস্ট

৩৫-৩৭ সপ্তাহের মধ্যে ডাক্তার আপনার যোনি ও মলদ্বার পরীক্ষা করে দেখবেন আপনার Group B Strep আছে কিনা। এটি একধরনের ইনফেকশন যা বড়দের তেমন ক্ষতি করেনা কিন্তু প্রসবের সময় তা বাচ্চার মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। যদি এ পরীক্ষার রেজাল্ট পজিটিভ হয় তাহলে প্রসবের সময় আপনাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হবে যাতে তা প্রসবের সময় বাচ্চার শরীরে সংক্রমিত হতে না পারে।

আর যেসব টেস্টের প্রয়োজন হতে পারে

উপরের পরীক্ষা গুলো ছাড়াও প্রয়োজনে আরও কিছু পরীক্ষা এ ট্রামেস্টারে করার পরামর্শ দেয়া হতে পারে-

  • আগের রক্ত পরীক্ষায় যদি গ্লুকোজ লেভেল বেশী পাওয়া যায় বা দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে যদি গ্লুকোজ পরীক্ষা করা না হয়ে থাকে তবে এই ট্রাইমেস্টারের শুরুর দিকে এই পরীক্ষা করা হবে।
  • পূর্বের পরীক্ষায় রক্তস্বল্পতার লক্ষন পাওয়া গেলে আবার রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হবে রক্তস্বল্পতা বা এনেমিয়া আছে কিনা।
  • আপনি যদি যৌন রোগের ঝুঁকিতে থাকেন তাহলে এ সময় আবার রক্ত পরীক্ষা করার পরামর্শ দেয়া হবে।
  • প্লাসেন্টার অবস্থান বোঝার জন্য আল্ট্রাসাউন্ডের পরামর্শ দেয়া হবে। বিশেষ করে যদি আগের পরীক্ষায় আপনার লো লায়িং প্লাসেন্টা বা প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার লক্ষন দেখা যায়।

আপনার গর্ভাবস্থা নিয়ে ডাক্তারের কোন সন্দেহ বা উদ্বেগ থাকলে তিনি বাচ্চার সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অতিরিক্ত আরও কিছু টেস্ট করার পরামর্শ দিতে পারেন।

আপনার যদি ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা থাকে তাহলে আপনাকে বায়োফিসিকাল প্রোফাইল ও নন স্ট্রেস টেস্ট এর পরামর্শ দেয়া হবে। যদি বাচ্চার বৃদ্ধি সম্পর্কে কোন উদ্বেগ থাকে তাহলে নিয়মিত আলট্রাসাউন্ড করে দেখা হবে।

যদি আপনার গর্ভাবস্থা স্বাভাবিক হয় কিন্তু প্রসব বিলম্বিত হয় সে ক্ষেত্রেও এসব টেস্ট করা হতে পারে। এগুলো সাধারণত দু সপ্তাহ পর পর করা হয়। এর ফলে ডাক্তার অপেক্ষা করবেন নাকি কৃত্রিমভাবে প্রসব শুরু করবেন সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

গর্ভাবস্থা সংক্রান্ত পরামর্শ

বিজ্ঞাপণ

তৃতীয় ট্রাইমেস্টারের শুরুতে আপনার ডাক্তার আপনাকে আপনার সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ধারনা দিবেন এবং ভয়ের কিছু থাকলে সে সম্পর্কে জানাবেন। তিনি আপনাকে এর পর  আর কি কি পরিবর্তন ঘটতে পারে সে সম্পর্কেও ধারনা দিবেন এবং কি কি লক্ষন দেখা দিলে দ্রুত ব্যাবস্থা নিতে হবে তা জানিয়ে রাখবেন।

তৃতীয় ট্রাইমেস্টারের প্রথম দিকের সাক্ষাতে তিনি আপনাকে গর্ভের বাচ্চার নড়াচড়ার প্রতি খেয়াল রাখতে বলবেন এবং অসময়ে প্রসব যন্ত্রণা, প্রি-এক্লাম্পশিয়া ইত্যাদির লক্ষন সম্পর্কে অবহিত করবেন।

গর্ভকালীন সময়ে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ডাক্তার এ সময় আপনার বিষণ্ণতার কোন লক্ষন আছে কিনা সেটাও খুঁটিয়ে দেখতে পারেন। তবে তিনি যদি এ ব্যাপারে জানতে না চান এবং আপনার মনে হয় যে আপনি বিষণ্ণতায় ভুগছেন তবে অবশ্যয় তা ডাক্তারের সাথে আলোচনা করুন। এ বিষয়ে তিনি আপনাকে সাহায্য করতে পারেন বা এমন কাউকে রেফার করতে পারেন যে আপনাকে সাহায্য করবে।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

2 Thoughts to “গর্ভাবস্থায় চেকআপ । তৃতীয় ট্রাইমেস্টার”

  1. […] গর্ভাবস্থায় চেকআপ । তৃতীয় ট্রাইমেস্ট… […]

Leave a Comment