কর্মজীবী মায়েদের কাজে ফেরার অভিজ্ঞতা | সোমা সরকার

Spread the love

সকালের সব কাজ শেষ করে বাচ্চাকে বাসায় রেখে সারাদিনের জন্য বাইরে থাকাটা যে কতটা কষ্টের আর কঠিন কাজ তা কেবল একজন কর্মজীবী মা ই জানেন।

হ্যা, আমি একজন কর্মজীবী মায়েদের একজন যারা কি না বাচ্চার শৈশবের মধুময় অনেকটা সময়ের অংশ হতে পারি না। তাতে কি!! যত টাই তাকে পাই না কেন উজার করে দিতে চেষ্টা করি।

বিজ্ঞাপণ

আমার মেয়েটা পেটে আসার পর থেকে মাথায় একটা চিন্তা ঘুরতো। যে কোন ভাবে বাবু যেন সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে আমার কোলে আসে।ডাক্তার মাফিক জানতে পারি প্রেগন্যান্সির প্রথম তিন মাস আর শেষ তিন মাস সাবধানে থাকতে হয়। এটা শুনে প্রথম দিকে দুই মাস মেডিকেল ছুটি নিয়ে নিলাম। এর পর চলে আসলাম বাবার বাড়ী। বলে রাখি আমার বাবা মা দুজনই চাকরীজীবী। আমরা তিন জনই একই পেশা। সরকারী প্রাইমারী স্কুলের টিচার।।

তো আমার স্কুল পার হয়ে বাবার স্কুল। বাবা হেড টিচার। উনি মোটরসাইকেল এ যেতেন। আমিও বাবার সাথে মোটরসাইকেল এ যেতাম। হাতদিয়ে পেট টা ধরে রাখতাম।যেন ঝাকি কম লাগে। সামনে ছোট গর্ত দেখলেও বাবা কে থামাতে বলতাম। বাবা যেখানে নামিয়ে দিত সেখান থেকে ১০ মিনিটের পথ। রিকসায় ভুলেও উঠি নাই প্রথম দিকে,দরকার হলে হেটে গেছি।। এভাবে চলতে থাকে পেটে নিয়ে স্কুল করা।

পেট একটু বড় হতেই কষ্ট বাড়তে লাগলো। তিন তলা দুইটা বিল্ডিং বেয়ে ক্লাস করা।একবার এই বিল্ডিং আর ঐ বিল্ডিং করে হাপিয়ে যেতাম। মনে হত শুয়ে যদি একটু খানি রেস্ট নিতে পারতাম!!! শেষের দিকে আবার দুই মাসের ছুটি নিয়ে চলে আসলাম ঢাকায়।

ডেলিভারীর পর আবার বাবার বাসায় হাসবেন্ড কে নিয়ে চলে আসলাম। ৬ মাস ছুটি পেলাম। ছুটি যত কমতে লাগলো আমার টেনশন আরো বাড়তে লাগলো। কারন বাচ্চার সাথে ঐ ৬ মাসে যে বন্ডিং টা হয়েছে, তাকে রেখে সারাদিনের জন্য বাইরে থাকতে হবে ভেবে ভিতর থেকে আসা ভয়ের, কষ্টের কান্নাটা গলায় দলা পাকিয়ে আসতো। তবু বাস্তবতা তো মানতেই হবে।

তাই স্কুলের খুব কাছে একটা বাসা ভাড়া নিলাম।আমি, আমার হাসবেন্ড আর মেয়ে অদ্রিজাকে নিয়ে সুখের ছোট্ট সংসার শুরু হলো। সময় চলে আসলো স্কুলে জয়েন করার। আমার মা চাকরী করে আর শাশুড়ি মা ও বয়স্ক ও অসুস্থ। তাই ভাবতে লাগলাম মেয়ে কে কোথায় রাখবো? আর এই ৬ মাস নিজেদের পরিচিতদের মাঝে লোক খুজার কম চেষ্টা করি নাই। কিন্তু আজকাল বাচ্চা রাখার জন্য লোক পাওয়া সোনার হরিণ পাওয়ার চেয়ে কম কিছু না। কিন্তু কাউকে পেলাম না।

আমার ছোট একটা বোন আছে। সে অনার্সে পড়তো। তাই দায়িত্ব তার উপর পরলো। এক মাস ক্লাস অফ ছিল।তাই বাবা ওকে সকালে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যেত আর বিকালে স্কুল থেকে ফেরার পথে নিয়ে যেত। পরীক্ষা সামনে রেখেও সে সার্ভিস দিয়ে গেছে। সারাজীবন তার এই অবদানের কথা ভুলবো না।

সকালে ৯ টার মধ্যে স্কুলে যেতে হবে। সকালে সারদিনের রান্না করতাম। মেয়েকে অর্ধেক খাওয়াতে পারতাম বাকি টুকু ছোট বোন এসে খাওয়াতো।তা ও পুরোটুকু খাওয়াতে পারতো না। আর আমি না খেয়ে খাবার টা কোন মতে বগলদাবা করে দৌড় দিতাম স্কুলের দিকে। অফটাইমে কোন মতে নাকে মুখে ঢুকাতাম। মেয়ে আমার তখনও বুকের দুধই খায়। তাই স্কুলে খুব বলে টলে ১১:৩০ টার দিক একটু অফ টাইম নিয়েছিলাম।

আবার দৌড়ে আসতাম বাসায়। এসে তাড়াহুড়ো করে মেয়েকে গোসল করিয়ে খাবার দিতাম। তারপর বুকের দুধ দিতাম আর ঘড়ির দিক তাকাতাম। সময়ের ৫ মিনিট আগে কোন মতে দুধ ছাড়িয়ে আবার দৌড়। যদিও মেয়েটা আরো একটু দুধ চাইতো,তবুও উপায় নাই।

বিজ্ঞাপণ

এর পর কর্মক্ষেত্র তো কত সমস্যা আছে। আমি অফটাইমটায় বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে যেতাম সেটাও না কি সমস্যা। আমি ঠিক টাইমে যাতে স্কুলে ঢুকতে না পারি তার জন্য আগে ভাগে গেট লাগিয়ে দেয়া হতো,ম্যানেজিং কমিটি, অফিসারদের দিয়ে কথা শুনানো ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক প্রতিবন্ধকতা স্বত্বে ও আমার একটু হলেও বাসায় যেতেই হবে,তা না হলে মেয়েটার যে গোছল খাওয়া কিছু হবে না আর বুকের দুধটাও যে পাবেনা।

মেয়েটা ১২ টার দিক ঘুমাতো। দুটা / আড়াইটার দিক উঠতো। আমার টিফিন টাইম ছিল তখন। তাই এসে মেয়েকে খাইয়ে দিয়ে যেতাম। প্রথম দিকে তো বুঝতাম না,অনেক সময় বেশি খাইয়ে ফেলতাম। ফলস্রুতিতে লাস্ট চামচ দেয়ার পর কষ্ট করে যা খাওয়াইছিলাম সব বমি করে দিতো। কিন্তু তখন তো নতুন করে খাওয়ানোর টাইম নাই। তাই মেয়ের ও খালি পেটে থাকতে হতো আমার স্কুল শেষ হওয়া পর্যন্ত।

সেদিন গুলো যে কি কষ্টে কেটেছে।একদিকে স্কুলের ঝামেলা অন্য দিকে বাচ্চা আর সংসার,সব মিলিয়ে জগাখিচুরী অবস্থা।কিন্তু মেয়ের একটা রুটিন করে নিয়েছিলাম খাওয়া আর ঘুম সব মিলিয়ে।এখনও সেভাবেই চলছে।

এমনিতে নতুন মা তার উপর নতুন সংসার। এর এক মাস পর বোনের কলেজ শুরু হলো সাথে পরীক্ষা । তখন বাধ্য হয়ে আমার মা মেডিকেল ছুটি নিয়ে সার্ভিস দিতে লাগলেন। মা বাবা আর বোনের অবদানের কথা ভুলার নয়। সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তাদের কাছে।

মার ছুটি শেষ হলে আমি ছুটি নিলাম। এভাবে ৫ মাস কাটলো। কিন্তু এত ছুটি নিয়ে তো আর মেয়ে বড় করা যায় না। মেয়ের একবছর এর সময় একটা মেয়েকে পেলাম। মেয়েটা অনার্স পাশ করেছে। বাড়ীতে বসে চাকরীর চেষ্টা করছে। তাকে বলে টলে আমার বাসায় আনা হলো। তার কাজ পড়ালেখা করা আর আমি যতক্ষন থাকবো না মেয়েকে দেখে রাখা। আর আমি দৌড়ের উপর এসে অফটাইমে মেয়েকে খাওয়া ঘুম গোছল এগুলো চালিয়ে যেতে লাগলাম,হাজার বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে।চিন্তা একটাই,মেয়ে কবে একটু বড় হবে।।বিকালে সময় পেলে মেয়ে কে নিয়ে বাইরে বের হতাম।আর রাতে মেয়ের বাবা আর আমি মেয়েকে পুরো টাইম দেয়ার চেষ্টা করতাম।

আরেকজনের কাছে মেয়েকে রেখে যাওয়া কতটা যে টেনসনের তা ভুক্তভোগী ছাড়া কে বুঝবে। এমনিতে মেয়ে কম কান্নাকাটি করে। তো একদিন স্কুল থেকে এসে দেখি মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম সে গোছলে ঢুকেছিল তখন মেয়ে উঠে যায়,কাউকে না দেখে কান্না করে এই অবস্থা। কি যে কষ্ট হতো।

বিজ্ঞাপণ

এদিকে ঐ মেয়েটাকে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দিতাম। নিজের থালাটাও ধুতে দিতাম না,চায়ের কাপটাও বেডে দিতাম।যাতে মেয়েটাকে একটু দেখে রাখে। সে সারাদিনই প্রায় মেয়েকে মোবাইল দেখাতো আর মেয়ের সাথে কথাই প্রায় বলতো না। মেয়েটা আমার ১৫ মাসে হাটা শিখে। ঐ মেয়েটা প্রায় ১০/১১ মাস ছিল। এর পর লক ডাউনে বাড়ী চলে যায় গত বছর মার্চে। আর তখন থেকে এখন পর্যন্ত মেয়ের সাথে আছি। মেয়ের দুই বছর পার হওয়ার পরও বাবা মা বলেও ডাক দিতো না। Fairyland Parents এর সহযোগীতায় তা ওভারকাম করতে পেরেছি অনেকটা।। এখন তো ছুটিতে আছি, কিন্তু স্কুল খুললেই শুরু হবে যুদ্ধ।যদিও হাসবেন্ড আমার অনেক হেল্পফুল।

আমিও এক কর্মজীবী মায়ের সন্তান।কর্মজীবী মায়েরা সব কিছু সামলাতে হয়তো একটু বেগ পেতে হয়।কিন্তু দিন শেষে বা সময় শেষে সন্তান কে যদি সুসন্তান করে গড়ে তোলা যায়,তাহলেই তো সেটাই জীবনে কষ্ট করার মূল স্বার্থকতা।আমার মেয়ের এখন তিন বছর। কিন্তু এরপর আরেকটা বেবি হলে দুটোকে সামলিয়ে চাকরীটা করতে হবে,সংসার করতে হবে,সন্তান কে সুসন্তান করে গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।আমাদের পারতেই হবে কারন আমরা যে কর্মজীবী মা।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment