ইস্ট ইনফেকশন । গর্ভাবস্থায় কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ

Spread the love

ইস্ট ইনফেকশন কি? 

ইস্ট ইনফেকশন ভ্যাজাইনার এক ধরণের ইনফেকশন এবং বিশেষত গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এই ইনফেকশন বেশি লক্ষ্য করা যায়। মূলত ক্যান্ডিডা গোত্রের এক ধরণের আণুবীক্ষণিক ছত্রাক, ক্যান্ডিডা এলবিকানসের (Candida albicans) সংক্রমণের কারণেই এই ইনফেকশন হয়ে থাকে। এই জাতীয় ইনফেকশনকে মনিলিয়াল ভ্যাজাইনিটিস অথবা (monilial vaginitis) বা ভ্যাজিনাল ক্যানডিডিয়াসিস (vaginal candidiasis) নামেও ডাকা হয়।

যোনী কিংবা পরিপাক তন্ত্রে কিছু পরিমাণ ইস্ট থাকা তেমন অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু ইস্ট তখনই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, যখন এর পরিমাণ এত দ্রুত বৃদ্ধি হতে থাকে যে, তা অন্য অণুজীবগুলিকে দখল করে ফেলে।

বিজ্ঞাপণ

গর্ভাবস্থায় শরীরে এস্ট্রোজেনের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়, যার ফলে ভ্যাজাইনা অনেক বেশি গ্লাইকোজেন উৎপাদন করা শুরু করে এবং সেখানেই ইস্টের প্রচুর পরিমাণে জন্ম নেওয়া সহজ হয়ে যায়। কিছু কিছু গবেষক মনে করেন যে ইস্টের উপর এস্ট্রোজেনের সরাসরি প্রভাব আছে, এটি ইস্টকে দ্রুত বাড়তে এবং ভ্যাজাইনার দেয়ালে সহজেই সেটে থাকতে সাহায্য করে।

এছাড়া, আপনি যদি এন্টিবায়োটিক খান, তখনও ইস্ট ইনফেকশনের সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষত তা যদি খুব নিয়মিত কিংবা দীর্ঘদিন ধরে খাওয়া হয়। কারণ, দীর্ঘদিন এন্টিবায়োটিক খাওয়ার ফলে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি এই ঔষধ যোনীর উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোকেও মেরে ফেলে, যার ফলে ইস্টের পরিমাণ বেড়ে যেতে শুরু করে।

[ আরও পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস]

ইস্ট ইনফেকশনের লক্ষণগুলো কি কি?

ইনফেকশনের লক্ষণগুলো যদি আপনার মধ্যে দেখা যায়, তাহলে এর চিকিৎসা করার আগ পর্যন্ত আপনার খুবই অস্বস্তি হবে অথবা এর চেয়ে খারাপ কিছুও হতে পারে। তবে কখনো কখনো ইস্ট ইনকফেকশন আপনা আপনিই ভালো হয়ে যায়। ইস্ট ইনফেকশনের লক্ষণগুলো নিম্নরূপ:

  • যোনী এবং ল্যাবিয়াতে চুলকানি হওয়া, লাল হয়ে যাওয়া, ব্যাথা হওয়া, জ্বালাপোড়া করা প্রভৃতি হতে পারে। কখনো কখনো ফুলে যেতে পারে।
  • গন্ধহীন যোনীস্রাব হতে পারে যা দেখতে সাদাটে, ঘন ক্রিমের মতো হতে পারে।
  • যৌনমিলনের সময় অস্বস্তি ও ব্যাথা হতে পারে
  • প্রস্রাব করার সময় জ্বালাপোড়া হতে পারে (সংক্রমিত অংশে যখন প্রস্রাব স্পর্শ করে)।

যদি মনে হয় যে, ইস্ট ইনফেকশন হয়েছে, তাহলে কি করা উচিত?

যদি মনে হয় যে ইস্ট ইনফেকশন হয়েছে, তাহলে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। তিনি আপনার যোনীস্রাবের নমুনা সংগ্রহ করবেন এবং তা পরীক্ষা করাতে বলবেন। পরীক্ষার মাধ্যমে ব্যাথা জ্বালাপোড়ার সঠিক কারণ নির্ণয়সহ অন্যান্য উপসর্গের কারণ বের করা সম্ভব হবে।

আপনার যদি ইস্ট ইনফেকশন হয়, তাহলে ডাক্তার আপনাকে কিছু ছত্রাক রোধী ভ্যাজাইনাল ক্রিম অথবা সাপোজিটর ব্যবহার করত্র বলবেন। তিনি এমন ঔষধই দেবেন যা গর্ভাবস্থায় ব্যবহার উপযোগী।

ক্রিম কিংবা সাপোজিটর একদম যোনীর ভেতরে প্রায় সাতদিন ধরে একটানা লাগাতে হবে। এই ধরণের ঔষধ রাতে শোয়ার আগে লাগানোই উচিত হবে যাতে তা বেড়িয়ে না যায় (স্বল্পমেয়াদি ঔষধ যেগুলো আপনি হয়তো পূর্বে ব্যবহার করেছেন, সেগুলো গর্ভাবস্থায় হয়তো আর কাজ নাও করতে পারে)। এছাড়া যোনীর আশেপাশের অঞ্চলেও ছত্রাকরোধী ক্রিম লাগিয়ে রাখলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

চিকিৎসা শুরু করার পর কিছুটা সুস্থ অনুভব করতে করতে আপনার কয়েকদিন লেগে যাবে। এই সময়ে চুলকানি কিংবা অস্বস্তি থেকে রক্ষা পেতে আইসপ্যাক লাগিয়ে রাখতে পারেন অথবা ঠান্ডা পানিতে ১০ মিনিট ভিজিয়ে রাখা যায়।

চিকিৎসা করানোর পরও যদি চুলকায় কিংবা ঔষধ কাজ না করে, তাহলে অবশ্যই ডাক্তারকে তা জানান। ডাক্তার তাহলে হয়তো অন্য কোন ঔষধ প্রয়োগ করার কথা বলতে পারেন। ইস্ট ইনফেকশন থেকে পুরোপুরি মুক্তি পেতে অবশ্যই চিকিৎসার পুরো কোর্স সম্পন্ন হওয়া নিশ্চিত করুন।

ইস্ট ইনফেকশন নিরাময় করতে কি ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে?

হ্যা, আপনি হয়তো বলতে পারেন যে ফাঙ্গাসরোধী বিভিন্ন ক্রিম তো বিভিন্ন ফার্মেসিতেই পাওয়া যায়, তাহলে এজন্যে ডাক্তার দেখানোর কি প্রয়োজন। কিন্তু নিজে নিজে রোগ আন্দাজ করা এবং ঔষধ ব্যাবহার করা একদমই উচিত কোন কাজ হবে না।

গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ নারীরা ইস্ট ইনফেকশন ভেবে ঔষধ নেয়া  শুরু করে দেন, অথচ তারা তাদের অস্বস্তির প্রকৃত কারণটাই জানেন না। যার ফলে তাদের আসলেই যে রোগ হয়েছে, সে রোগের সঠিক চিকিৎসা পেতে পেতে তাদের অনেক দেরি হয়ে যায়।

এই লক্ষণগুলো অন্য কোন কারণেও হতে পারে যার সাথে ইস্টের কোন সম্পর্কই নেই, যেমন- যৌনমিলন ঘটিত কোন ইনফেকশনের ক্ষেত্রেও লক্ষনগুলি কিন্তু একই থাকে।

ইস্ট ইনফেকশন কি গর্ভের শিশুর উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারে?

না, আপনার ইস্ট ইনফেকশন হলে তা শিশুর কোন ক্ষতি কিংবা তার উপর কোন খারাপ প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু আপনার ডেলিভারি অর্থাৎ প্রসবের সময় যদি ইস্ট ইনফেকশন থাকে, তাহলে শিশু যখন জড়ায়ু থেকে বেড়িয়ে আসবে, তখন তার ত্বকের সাথে সংক্রমিত অঞ্চলের স্পর্শ লাগার সম্ভাবনা রয়েছে৷ যদি তা-ই হয়, তাহলে শিশুর মুখের ভেতরে ‘থ্রাশ‘ নামক এক ধরণের ইস্ট ইনফেকশন হতে পারে।

থ্রাশ হলে, শিশুর গালের ভেতরে কিংবা উপরে সাদা আঁকাবাকা দাগ দেখা যেতে পারে, এ দাগ জিহবায়ও দেখা যেতে পারে। যদিও এই ইনফেকশন এত সিরিয়াস কিছু নয় এবং খুব সহজেই এর চিকিৎসা করানো যায়। উল্লেখ্য, আপনার যদি ইস্ট ইনফেকশন নাও থাকে, তবুও আপনার শিশুর থ্রাশ হওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু রয়েছে।

যৌন মিলনের মাধ্যমে কি আমার সঙ্গীর শরীরে ইস্ট ইনফেকশন সংক্রমিত হতে পারে?

যদিও এমনটি খুব বেশি একটা দেখা যায় না, তবুও বলে রাখা ভালো, যৌন মিলনের মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনের শরীরে ইস্ট ইনফেকশন ছড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে ইনফেকশন প্রতিরোধে আপনার পাশাপাশি আপনার সঙ্গীরও ইস্ট ইনফেকশনের চিকিৎসা নেওয়া উচিত, কিন্তু অধিকাংশ গবেষকেরাই এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে থাকেন কারন যৌনমিলনের কারণে আসলে সাধারণত ইনফেকশন হয় না।

বিজ্ঞাপণ

আবার অনেকে এটা মনে করেন যে সঙ্গীর চিকিৎসা করালে পুনরায় ইনফেকশনের ঝুঁকি কমে যায়। কিন্তু গবেষণায় এ কথাটিও ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

যা-ই হোক, যদি আপনার সঙ্গীরও ইনফেকশন হয়, তাহলে সঠিক উপদেশের জন্যে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। পুরুষদের যৌনাঙ্গে ইস্ট ইনফেকশন হওয়ার ক্ষেত্রে লাল হয়ে যাওয়া, ফুসকুড়ি হওয়া, চুলকানি, জ্বালাপোড়া হওয়া প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দেয়। যদি ইস্ট ইনফেকশন বেশি হয়ে যায়, তাহলে ডাক্তার হয়তো চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে যৌন মিলন থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেবেন।

ইস্ট ইনফেকশন প্রতিরোধে কি কি পদক্ষেপ নিতে পারি?

যৌনাঙ্গে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত রাখা এবং যৌনাঙ্গ ও এর চারপাশ শুষ্ক রাখার মাধ্যমে ইস্ট ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে আসে (কারণ উষ্ণ ও স্যাঁতসেতে অবস্থায় ইস্ট দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করে)।

নিম্নোক্ত পন্থাগুলো অবলম্বন করলে যে ইনফেকশন হবেই না এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না, তবে এই নিয়মগুলো অনুসরণ করলে যে কোন ইনফেকশন থেকে নিরাপদে থাকা সম্ভব এবং এগুলো পালন করাও বেশ সহজ।

পাতলা কটনের আন্তর্বাস পরিধান করুন৷ প্যান্টিহোস  অথবা আঁটসাট প্যান্ট পড়া থেকে বিরত থাকুন। বিশেষত, সিনথেটিকের তৈরি পোষাক এড়িয়ে চলুন।

রাতে ঘুমানোর সময় অন্তর্বাস না পড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করুন, এতে করে যৌনাঙ্গে পর্যাপ্ত বাতাস সঞ্চালন হবে এবং তা শুষ্ক থাকবে। রাতে যদি কিছু পরিধান করে ঘুমাতে চান তাহলে অন্তর্বাস ছাড়া নাইটগাউন পড়তে পারেন যা পায়জামার চেয়ে বেশি আরামদায়ক ও উপকারী হবে।

বাবল বাথ, সুগন্ধী সাবান, সুগন্ধী স্প্রে প্রভৃতি ব্যাবহার থেকে বিরত থাকা উচিত। এগুলো ব্যাবহার করলে ইস্ট ইনফেকশন হবে, এমনটা হয়তো সরাসরি বলা যাবে না, তবে এগুলো ব্যাবহারের ফলে যৌনাঙ্গে চুলকানি হয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপণ

প্রতিদিন হালকা গরম পানি দিয়ে যৌনাঙ্গ আলতোভাবে মুছে পরিষ্কার রাখুন। (গর্ভাবস্থায় কিংবা যে কোন সময়ে ড্যুশ ব্যাবহার থেকে বিরত থাকুন।

সুইম স্যুট পড়ে সাতার কাটার পর, যত দ্রুত সম্ভব ভেজা সুইম স্যুট খুলে ফেলুন। এছাড়া ব্যায়ামের সময় অনেক বেশি ঘামলে, ব্যায়ামের পরপর অন্তর্বাস পরিবর্তন করে ফেলুন।

যৌনাঙ্গ ধোয়ার সময় সবসময় সামনে থেকে পেছনে মুছুন। এতে করে পায়ুপথের ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক যোনির সংস্পর্শে আসতে পারবেনা।

জীবন্ত ল্যাক্টোব্যাসিলাস এসিডোফিলাস ব্যাকটেরিয়া যুক্ত দই খেতে পারেন, যা আপনার পেট ও যোনীতে ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করবে। যদিও ইস্ট ইনফেকশন প্রতিরোধে দই কাজ করে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে অনেক নারীরা এটার উপরই ভরসা করে থাকেন। তাছাড়া দই প্রোটিন ও ক্যালসিয়ামের বড় উৎসও বটে।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment