গর্ভপাত কি?
ডিম্বানু নিষিক্ত হওয়ার পর পরবর্তী পাঁচ মাসের (২০ সপ্তাহ) মধ্যে যে কোন সময়ে প্রসবের রাস্তা দিয়ে বের হয়ে যাওয়াকেই মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত বলে। ডাক্তারি পরিভাষায় একে স্পন্টেনিয়াস অ্যাবোরশনও বলা হয়।
গর্ভধারণ করেছেন জানতে পারা মায়দের মধ্যে ১০-১৫ ভাগ মায়েদের গর্ভপাত হতে পারে। আর বেশীরভাগ গর্ভপাত হয় প্রথম ট্রাইমেস্টারে অর্থাৎ গর্ভধারণের ১২ সপ্তাহের মধ্যে। তাই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা ১২ সপ্তাহ অবধি সময়টিকে খুব সাবধানে থাকতে বলেন। দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে শতকরা ১-৫ ভাগ মায়েদের গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটা দেখা যায় যে প্রথম তিন মাসে যে বাচ্চাগুলো নষ্ট হয় বা গর্ভপাত হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ ক্ষেত্রে ভ্রূণটিতে সমস্যা থাকে। আর হয়তো ২০ ভাগ ক্ষেত্রে মায়ের শরীরে কোনো সমস্যা থাকে।
আবার যদি ১২ সপ্তাহ থেকে ২৮ সপ্তাহ, দ্বিতীয় তিন মাসে যদি কোনো বাচ্চা নষ্ট হয়, তাহলে শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে বাচ্চার সমস্যা থাকতে পারে, অথবা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে মায়ের কোনো কারণে হয়তো বাচ্চাটি নষ্ট হচ্ছে।আবার শেষের দিকে ২৮ সপ্তাহের পরে যদি পেটে বাচ্চা মারা যায়, কিংবা অকালে গর্ভপাত হয়, তাহলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমস্যাটা মায়ের শরীরে থাকে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে অজানা গর্ভপাতের সংখ্যা এর চাইতে অনেক বেশী। গবেষণায় দেখা গেছে শতকরা ৩০-৫০ ভাগ ক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত হওয়ার সময় বা তার আগেই নষ্ট হয়ে যায়। এ ধরনের হলে গর্ভধারণ করেছেন তা বুঝে ওঠার আগেই গর্ভপাত হয়ে যায়।
[ আরও পড়ুনঃবাচ্চার হার্টবিট না আসার কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত ]
গর্ভপাতের কারণ
অনেক কারনেই গর্ভপাত হতে পারে। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এর সঠিক কারণ নির্ণয় করা যায়না। যদি প্রথম ট্রামেস্টারে গর্ভপাত হয় তবে তা সাধারনত ভ্রুনের কোন সমস্যার কারনে হয়। প্রতি চারটি গর্ভপাতের তিনটি প্রথম ট্রাইমেস্টারে হয়।
যদি দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে গর্ভপাত হয় তবে তা সাধারনত মায়ের কোন শারীরিক সমস্যার কারণে হয়। এ ধরনের গর্ভপাত সাধারনত কোন ধরনের ইনফেকশনের কারনে হতে পারে যার কারনে পানিপূর্ণ থলিটি কোন ব্যাথা বা রক্তপাত ছাড়াই ভেঙ্গে যায়। খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রে জরায়ু মুখ আগে আগে খুলে যাওয়ার কারনেও গর্ভপাত হতে পারে।
ক্রোমোসোমের সমস্যা
প্রথম ট্রাইমেস্টারে গর্ভপাত বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ভ্রুনের ক্রোমোসোমের কোন সমস্যার কারণে হয়। কখনও কখনও ভ্রুনে ক্রোমোসোমের আধিক্য বা ঘাটতি থাকতে পারে যার কারণে তা ঠিকভাবে গঠিত হতে পারেনা যার ফলে গর্ভপাত হয়ে যায়। কেন এমনটা হয় তার কারন এখনো অজানা।
প্রথম ট্রাইমেস্টারে গর্ভপাতের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ক্রোমোসোমের সমস্যার কারণে হয়। তবে এই ধরণের গর্ভপাতের পর পরবর্তী সময়ে নারীরা সাধারণভাবেই গর্ভধারণ করতে পারেন।অকাল গর্ভপাত ঘটে মূলত ভ্রুণের অস্বাভাবিকতার কারণে, এটা আগে থেকে নির্ণয় করা কঠিন আর এতে মায়ের বা বাবার কোন দোষ নেই।
গর্ভপাত হবার অন্যতম প্রধান কারণ হল খুঁতযুক্ত ডিম্বানু বা শুক্রানু। ডিম্বাণু বা শুক্রাণুর কোন একটি যদি দুর্বল হয় তবে সেই ভ্রুন ক্রুটিপুর্ন হবে। আর ভ্রূণ ক্রুটিপূর্ণ হলে গর্ভচ্যুত হবে। এছাড়াও দুর্বল শুক্রাণু ডিম্বাণু থাকলে অস্বাভাবিক ভ্রূণ তৈরি হবে, যা এক পর্যায়ে গিয়ে নিজে থেকেই মানিয়ে নিতে না পেরে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে গর্ভপাত ঘটে।
ইনফেকশন
সিফিলিস, টোপস্নাজমোসিস ধরনের সংক্রামক ব্যাধির কারণে বার বার গর্ভপাত ঘটে। টোপস্নাজমিক রোগের জীবাণু টোপস্নাজম নামক এক কোষী পরজীবী প্রাণী যা অধিকাংশ সময় বিড়ালের মলের সঙ্গে বের হয়। এ জীবাণু প্রতিকূল পরিবেশেও ছয়-সাত মাস বেঁচে থাকে। ঐ সময় খাদ্য বা পানীয়ের সাথে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে টোপস্নাজমা রোগের সৃষ্টি হয়।
এ রোগে আক্রান্ত প্রসূতিদের বার বার গর্ভপাত হবার সম্ভাবনা থাকে। জন্মাতে পারে অন্ধ বিকলাঙ্গ বা মৃত শিশু। অনেক সময় শিশুদের মাথায় পানি জমতে পারে তাদের বলা হয় হাইড্রোসেফালাস।
জরায়ুর মুখের কার্যহীনতা ও অন্যান্য সমস্যা
গর্ভধারণের পরে জরায়ু মুখের প্রধান কাজ হল ভ্রূণকে গর্ভের ভেতরে ঠিকভাবে ধরে রাখা। কোন কারণে যদি জরায়ুর মুখ বড় হয়ে যায় তাহলে ঘটে বিপত্তি। তখন ভ্রূণ বড় হয়ে সুগঠিত হতে থাকলে জরায়ুমুখের পক্ষে আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না ভ্রূণকে। ফলে গর্ভপাত হয়। একে সারভিকাল ইনকম্পিটেন্স বলে আবার অনেক সময় পূর্বে গর্ভপাত করানো হয়ে থাকলেও জরায়ুর মুখের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে হতে পারে গর্ভপাত।
আবার কারো জন্মগতভাবে যদি অস্বাভাবিক জরায়ু থেকে থাকে বা প্রজননতন্ত্রের গঠন সঠিক না হয়ে থাকে তবে গর্ভধারণে অসুবিধা দেখা দেয় বা গর্ভধারণ হলেও গর্ভপাতের সম্ভাবনা থেকে যায়। এছাড়াও নিষেকের পরে ভ্রূণ যদি জরায়ুতে সঠিকভাবে স্থাপিত না হয় তবেও হতে পারে গর্ভপাত।
গর্ভপাতের ঝুঁকি কাদের বেশী থাকে?
কিছু কিছু কারণে মায়েদের গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এগুলো হলো-
- যদি এর আগে দুই বা তার অধিকবার গর্ভপাত হয়।
- মায়ের বয়স যদি ৩৫ বা তার বেশী হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে গর্ভপাতের ঝুঁকি ও বাড়তে থাকে।
- মা যদি সিগারেট, এলকোহল বা অন্য কোনও নেশায় আসক্ত থাকেন; তাহলেও ঘটে যেতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত। একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে গেলে মাকে অবশ্যই সুস্থ ও নেশামুক্ত শরীরের অধিকারী হতে হবে।
- মা যদি গর্ভাবস্থায় কোন ক্ষতিকর ক্যামিকেলের সংস্পর্শে আসে তবে গর্ভপাতের ঘটনা ঘটতে পারে।
এছারাও কিছু কিছু শারীরিক সমস্যার কারণেও গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়তে পারে। যদি মায়ের এসব শারীরিক সমস্যা থাকে সেক্ষেত্রে গর্ভধারণের আগেই বা গর্ভধারণের সাথে সাথেই ডাক্তারকে জানাতে হবে।
অটোইমিউন ডিজিজ
মানব শরীরের ইমিউন সিস্টেম বিভিন্ন ধরনের ব্যাক্টেরিয়া,ভাইরাস এবং অন্যান্য অনুজীবকে ধ্বংস করে দেহকে সংক্রমণমুক্ত রাখে। কখনো কখনো দেহের ইমিউন সিস্টেম অনুজীবদের আক্রমণ করার স্থলে নিজদেহের কোষদের আক্রমণ করে এবং নস্ট করে ফেলে। একে বলা হয় অটোইমিউন ডিসঅর্ডার।
অটোইমিউন ডিসঅর্ডারের মধ্যে অ্যান্টিফসফোলিপিড সিন্ড্রোম এবং লুপাস গর্ভপাতের ঝুঁকি কারন। অ্যান্টিফসফোলিপিড সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে মায়ের শরীরে একধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি হয় যা রক্তনালীতে থাকা কিছু ফ্যাটকে আক্রমন করে। এর ফলে মাঝে মাঝে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। লুপাসের কারণে শরীর ফুলে যাওয়া,ব্যাথা এবং মাঝে মাঝে অঙ্গের ক্ষতি হয়। এতে মায়ের চামড়া, কিডনি, লাংস এবং রক্তনালী খতিগ্রস্থ হয়।
মায়ের স্থুলতা
মায়ের শরীরে যদি অতিরিক্ত চর্বি থাকে এবং মায়ের বডি ম্যাস ইন্ডেক্স যদি ৩০ বা তার বেশী হয় তাহলে গর্ভপাতের ঝুঁকি বেশী থাকে।
হরমোনের সমস্যা
হরমোন প্রজেস্টোরন ও এইচসিজি মায়ের জরায়ুকে ইরিটেট করা থেকে শান্ত রাখে। অর্থাৎ ক্রমাগত ধাক্কা থেকে মুক্ত রাখে। ফলে বাচ্চা মাতৃগর্ভে অক্ষত থাকে। কিন্তু এই দুই হরমোনের পরিমাণ বেড়ে গেলে বা কমে গেলে, অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে, বাচ্চা বেরিয়ে যেতে পারে।ছাড়া প্রোলাক্টিন নামে আরো এক রকম হরমোন রয়েছে মায়ের শরীরে। এই হরমোন বেশি থাকলেও বাচ্চা বেরিয়ে যেতে পারে।
এছারাও পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের কারণেও গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
মায়ের ডায়াবেটিস
মায়ের যদি গর্ভধারণের আগে থেকেই ডায়াবেটিস থাকে তাহলে গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে। ডায়াবেটিস মানে হল যখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনেক বেশী থাকে।
থাইরয়েডের সমস্যা
গর্ভধারণের প্রথম ১২ সপ্তাহে ভ্রুনের বৃদ্ধি নির্ভর করে মায়ের থাইরয়েড হরমোনের উপর। তাই মায়ের পর্যাপ্ত পরিমানে থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ হরমোনের গর্ভের শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই থাইরয়েডের সমস্যা নির্ণয় করা উচিত গর্ভধারণের আগেই বা গর্ভধারণের শুরুতেই।
যদি শুরুতেই এ সমস্যা নির্ণয় করা যায় এবং তার প্রতিকার করা হয় তবে গর্ভের শিশুর ঝুঁকির সম্ভাবনা কম থাকে। থাইরয়েডের সমস্যা দু ধরনের হয়। হাইপার এবং হাইপো – দুধরনের সমস্যার কারনেই গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
গর্ভপাতের লক্ষন
কিছু কিছু উপসর্গ আছে যেগুলো দেখে বোঝা যায় যে, গর্ভপাত হচ্ছে কিনা!
রক্তপাত
গর্ভপাতের সবচেয়ে সাধারণ চিহ্ন হলো যোনি দিয়ে হালকা বা অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া। যদিও প্রেগন্যান্সির প্রথম দিকে রক্তপাত হওয়া স্বাভাবিক। কনসিভ করার ৭-১০ দিনের মাথায় ইমপ্লান্টেসনের কারণে কিছু রক্তপাত হয়। এটা স্বাভাবিক। এই রক্তের পরিমাণ অনেক কম থাকে, এমনকি নরমাল মাসিকে যে রক্ত যায়, তার চেয়েও কম। তবে অতিরিক্ত রক্ত গেলে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করবেন।
অনেক সময় অনেকে বুঝতেই পারেনা যে, তিনি প্রেগন্যান্ট। তাই অতিরিক্ত রক্ত গেলে ভাবেন যে, হয়ত দেরিতে মাসিক হচ্ছে, আর অতিরিক্ত রক্ত যাচ্ছে যেটা স্বাভাবিক। আসলে তা নয়। প্রেগন্যান্সির প্রথম ৩ মাস রক্ত যোনি দিয়ে গেলেই ডাক্তার দেখানো উচিত। রক্তপাতের সময় নিচের ক্রাইটেরিয়া গুলো লক্ষ্য করুন,
- বাদামি বা উজ্জ্বল লাল রক্ত যাওয়া, সাথে cramping বা পেটের বা কোমড়ের পেশীর সংকোচন থাকতে পারে নাও পারে।
- অতিরিক্ত রক্ত গেলে, ঘণ্টায় ১টার বেশি প্যাড ভিজলে।
- হঠাৎ রক্তপাত হলে।
এগুলো দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরনাপন্ন হবেন।
Cramping বা পেশীর সংকোচন বা ব্যথা
হালকা পেশীর সংকোচন জনিত ব্যথা স্বাভাবিক। এটি অস্থায়ী ও অল্প সময়ের জন্য থাকে। যদি অতিরিক্ত ব্যথা হয় এবং নিচের বৈশিষ্ট্য গুলো থাকে,
- প্রথমে পিঠের বা কোমড়ের দিকে ব্যথা হয়।
- ব্যথা অনেকক্ষণ স্থায়ী হয়।
- ব্যথার সাথে রক্তপাত হয়।
এগুলো থাকলে সাথে সাথে ডাক্তার দেখাবেন।
পানি ভাংগা বা যোনি দিয়ে মিউকাস যাওয়া
যদি যোনি দিয়ে সাদা-গোলাপি রং এর মিউকাস বা পিচ্ছিল পদার্থ যায় অথবা হঠাৎ করে প্রচুর পানি গেলে অথবা সলিড টিশ্যু বের হলে, গর্ভপাত হয়। এছাড়া অন্য উপসর্গ গুলো হলো,
- ওজন কমে যাওয়া।
- প্রেগন্যান্সির চিহ্ন গুলো হঠাৎ করে হ্রাস পাওয়া।
- বাচ্চার হার্ট সাউন্ড না পাওয়া,আল্ট্রাসাউন্ডে।
গর্ভপাতের পর চিকিৎসা
চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, রক্তপাত বন্ধ করা ও ইনফেকশন প্রতিহত করা। সাধারণত গর্ভধারণের স্থায়িত্ব যত কম হয়,শরীর ততো তাড়াতাড়ি ফিটাল ম্যাটারিয়াল সব বের করে দেয়। তখন মেডিকেল প্রসিডিউর দরকার হয় না। যদি শরীর নিজে নিজে বের না করে, তখন d&c করতে হয়। এরপর বাসায় রক্তপাত মনিটর করতে হবে। যদি কাঁপুনি বা জ্বর আসে, তাহলে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করবেন।
গর্ভপাতের পর কোন টেস্ট করতে হবে?
সাধারণত একবার বা দু’বার গর্ভপাত হলে বিশেষ কোনও টেস্ট করতে হয় না। তবে মিসক্যারেজ যদি তিনবার বা তার বেশিবার হয় তবে তা সত্যি চিন্তার বিষয়। এই সমস্যাকে বলা হয় রেকারেন্ট মিসক্যারেজ। মূলত ছয় ধরনের কারণ এক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
জেনেটিক পরীক্ষা করা হয় পিতা ও মাতার যাতে বোঝা যায় তাঁদের মধ্যে কোনও ক্রোমজোমাল ত্রুটি আছে কিনা। গর্ভাবস্থায় আল্ট্রাসোনোগ্রাফির মাধ্যমে বোঝা যায় সারভিকাল ইনকম্পিটেন্স বা জরায়ু মুখের দুর্বলতা। আল্ট্রাসোনোগ্রাফি, এস আই এস অথবা এইচ এস জি পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায় জরায়ুর মধ্যে কোনও ফাইব্রয়েড আছে কি না।
তবে এটি নির্ধারণ করার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে হিস্টেরোস্কোপি নামক পরীক্ষা যাতে জরায়ুর মধ্যে একটি ক্যামেরা প্রবেশ করিয়ে দেখে নেওয়া যায় সত্যি জরায়ুতে কোনও মাংসপিন্ড আছে কিনা। হিস্টেরোস্কোপি পরীক্ষার মাধ্যমে এছাড়াও জানা যায় জরায়ুতে কোনও পর্দা বা সেপ্টাম আছে কিনা।
অ্যান্টি কার্ডিওলিপিন অ্যান্টিবডি এবং লুপাস অ্যান্টি কোয়াগুলেন্ট নামক ছোট রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় মা ও শিশুর মধ্যে রক্ত চলাচলে ব্লাড ক্লট কোনও বাধা সৃষ্টি করছে কি না। এছাড়াও অ্যান্টি থ্রম্বিন ‘থ্রি’, প্রোটিন সি এবং প্রোটিন ‘এস’ ডেফিসিয়েন্সির কারণেও ব্লাড ক্লটিং হতে পারে তাই এই রক্ত পরীক্ষাগুলিও করে নেওয়া দরকার।
হরমোনাল সমস্যাগুলি চিহ্নিত করা কিন্তু মিসক্যারেজের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তাই ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, প্রোল্যাক্টিন বিভিন্ন হরমোনগুলি সঠিক মাত্রায় শরীরে আছে কি না তা দেখে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। ইউ এস জি-তে যদি পলিসিস্টিক ওভারি ধরা পরে তাহলে কিন্তু মিসক্যারেজের সম্ভাবনা বাড়ায়। যদিও কারণটা এখনও অজানা।
অনেক সময় ল্যুটিনাইজিং হরমোন বেশি মাত্রায় থাকলে তা গর্ভপাতের কারণ ঘটায়। রুবেলা, টক্সোপ্লাসমোসিস, সাইটোমেগালোভাইরাস, লিস্টোরিয়া এবং ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনোসিস গর্ভপাত ঘটাচ্ছে কি না তা দেখে নেওয়া অবশ্যই দরকার। তবে এ সমস্ত পরীক্ষা করার পরেও আমরা ৫০% ক্ষেত্রে মিসক্যারেজের কারণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায়না।
গর্ভপাতের পর গর্ভধারণ
একবার গর্ভপাত হবার পর আবার প্রেগন্যান্ট হয়ে সুস্থ বাচ্চা জন্ম দেবার সম্ভাবনা কোনভাবেই কমে যায়না। তাই আপনার বাচ্চা সুস্থ হয়ে জন্মাবার সম্ভাবনা আর দশটা মায়ের মতোই থাকছে।
American Pregnancy ওয়েবসাইট –এর মতে একবার গর্ভপাত হবার পর দ্বিতীয়বারের চেস্টায় সুস্থ বাচ্চা জন্ম দেবার হার প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনেরও বেশি।তাই আপনার মনে যদি এই ভয় থেকে থাকে যে আপনি সুস্থ্য বাচ্চা জন্ম দিতে পারবেন কিনা, এখনই তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।
অনলাইন হেলথ ম্যাগাজিন Mayo Clinic জানাচ্ছে যে একজন মায়ের জীবনে গর্ভপাত সাধারণত একবারের বেশি হয় না। প্রতি ১০০ জন মায়ের মধ্যে মাত্র ১ জনের একাধিকবার গর্ভপাত হয়ে থাকতে পারে।
মিসক্যারেজর পর গর্ভধারণের সঠিক সময় কখন? আসলে এই ক্ষেত্রে কোন সঠিক সময় নেই। অনেকেই আছেন যারা খুব দ্রুত আর একটি বাচ্চা নিয়ে নেন আবার অনেকেই সময় নেন। অধিকাংশ ডাক্তার এক থেকে তিনটি পূর্ণ মাসিক চক্র শেষ হবার পর গর্ভধারণের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এতে করে আপনার শরীর আবার পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে আসার সময় পাবে এবং মানসিকভাবেও প্রস্তুতি নিতে পারবেন।
সম্প্রতি কিছু গবেষনায় দেখা গেছে যে,মিসক্যারেজর পর যারা ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যে গর্ভধারণ করেছেন তাদের চেয়ে যারা আরোও দেরীতে গর্ভধারণ করেছেন তাদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
তবে পুনরায় বাচ্চা নেবার চেস্টার আগে আপনাকে কিছু ব্যাপারে অবশ্যই সাবধান হওয়া উচিৎ। যেমন –
- গর্ভপাতের পর রক্ত যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হবার আগে স্বামীর সাথে মিলিত হতে পারবেন না। এতে ইনফেকশন হবার ঝুঁকি থাকে। তাই অন্তত একটি পিরিয়ড হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
- আপনার গর্ভপাত যদি মোলার অথবা এক্টপিক প্রেগন্যান্সির কারণে হয়ে থাকে তাহলে আবার বাচ্চা নেবার চেষ্টা করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
- আপনার যদি এর আগে একাধিকবার গর্ভপাত হয়ে থাকে তাহলে আবার চেস্টা করার আগে আপনার কিছু পরীক্ষা অবশ্যই করে নিতে হবে। এবং এসব পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
গর্ভপাতের পর শরীর পুরোপুরি সুস্থ হতে কয়েক সপ্তাহ বা মাস খানেক সময় লাগতে পারে। গর্ভাবস্থার কোন সময় গর্ভপাত হয়েছে তার উপর নির্ভর করে মায়ের রক্তে ১ থেকে ২ মাস পর্যন্ত প্রেগন্যান্সি হরমোন থাকতে পারে। তাই হয়তোবা এ সময় পিরিয়ড ও বন্ধ থাকতে পারে।
তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভপাতের ৪-৬ সপ্তাহের মধ্যেই আবার মাসিক শুরু হয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে একবার মাসিক হয়ে যাওয়ার পর থেকেই আবার গর্ভধারণের চেষ্টা করা যেতে পারে।
গর্ভপাত প্রতিরোধে করণীয়
যেহেতু বেশীরভাগ গর্ভপাতের কারণ ক্রোমোসোমের সমস্যা তাই তা প্রতিরোধের কোন উপায় নেই। তবে গর্ভধারণে আগে এবং গর্ভধারণের পরে কিছু নিয়ম মেনে চলে আপনি গর্ভের বাচ্চার জন্য ঝুঁকি কমাতে পারেন।
ফলিক এসিড গ্রহন করুন। এটি একটি ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট। গর্ভধারণের ৩ মাস আগে থেকেই এটি খাওয়া শুরু করতে পারেন। এটি বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি হওয়ার প্রবণতাকে কমিয়ে দেয় এবং মিসক্যারেজর হওয়ার ঝুঁকিও অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। ফলিক এসিড, ভিটামিন ই, আয়রন ও ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহন করতে পারেন।
স্বাস্থ্যকর খাবার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে । সুস্বাস্থ্য আপনার গর্ভধারণের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। ব্রিটিশ গবেষনায় দেখা গেছে যে তাজা ফল ও সবজি মিসক্যারেজের হার ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনে। নিয়মিত হালকা ব্যায়ামও স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। এছাড়া ধূমপান, অ্যালকোহল, ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় যেমন চা, কফি বা চকলেট এবং মানসিক চাপের সাথে মিসক্যারেজর সর্ম্পক রয়েছে। তাই এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত।
পুনরায় গর্ভধারণের পূর্বে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে নিন এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিন।মিসক্যারেজর কারণ জানতে চেষ্টা করুন। পরবর্তীতে যাতে একই কারণের পূনরাবৃত্তি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
গর্ভসঞ্চারের পর শারীরিক ও মানসিকভাবে বিশ্রাম দরকার। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া কারণে-অকারণে ওষুধ খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে। হরমোনের ঘাটতি থাকলে ওষুধের মাধ্যমে তা পূরণ করা দরকার। ইনফেকশন থাকলে চিকিৎসা করা দরকার।
জন্মগতভাবে জরায়ুতে বা প্রজননতন্ত্রে ত্রুটি থাকলে অপারেশনের মাধ্যম ঠিক করে নেয়া দরকার। চিকিৎসা শাস্ত্রে সাড়া জাগানো বৈপ্লবিক পরিবর্তন হলো টেস্ট টিউব বেবি। এই চিকিৎসায় প্রায় শতকরা ত্রিশজনের জীবনে মাতৃত্ব আসে। তবে এই চিকিৎসা এখনো ব্যয়বহুল। যে সমস্ত নারীর বন্ধ্যাত্ব নেই কিন্তু বার বার গর্ভপাত হয়, তার জন্য দরকার মনোবিজ্ঞানসম্মত এক চিকিৎসা।
সবার জন্য শুভকামনা
তথ্যসূত্র
- https://www.marchofdimes.org/complications/miscarriage.aspx
- https://www.babycenter.com/0_miscarriage-signs-causes-and-treatment_252.bc?showAll=true
- https://www.nhs.uk/conditions/miscarriage/causes/
[…] গবেষণাতেই দেখা গেছে এসব অভ্যাসের ফলে গর্ভপাত, সময়ের আগেই প্রসব, বাচ্চার ওজন কম থাকা […]
[…] গবেষণাতেই দেখা গেছে এসব অভ্যাসের ফলে গর্ভপাত, সময়ের আগেই প্রসব, বাচ্চার ওজন কম থাকা […]