হামাগুড়ি হচ্ছে আপনার শিশুর শারীরিক দক্ষতার ব্যাপারে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আজকের আলোচনার মূল বিষয়গুলো হচ্ছে- বাচ্চা কখন থেকে হামাগুড়ি দেয়া শুরু করে, কিভাবে হামাগুড়ি দিতে শিখে, আপনি কতটুকু সাহায্য করতে পারেন, হামাগুড়ি না দিলে করণীয় কি, হামাগুড়ি দেয়ার পরের ধাপ কি?
হামাগুড়ি হচ্ছে আপনার শিশুর কর্মদক্ষ হয়ে ওঠার ব্যাপারে প্রথম এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। প্রথাগত রীতি অনুযায়ী, প্রথমে ও নিজের ভারসাম্য রক্ষা করতে শিখবে হাতের তালু এবং হাঁটুর উপর ভর দিয়ে।
এরপর ও বুঝতে পারবে যে হাঁটুর উপর ভর করে সামনে এবং পিছনে নড়াচড়া করা যায়। এবং একই সময়ে, বাড়ন্ত শরীরের পেশীসমূহ শক্তিশালী হয়ে উঠবে যা ওকে পরবর্তীতে হাঁটতে সাহায্য করবে।
কোন বয়স থেকে শিশু হামাগুড়ি দেয়া শুরু করে?
বেশীরভাগ বাচ্চারাই ৭ থেকে ১০ মাস বয়সের মধ্যেই হামাগুড়ি দিতে শুরু করে। অবশ্য আপনার বাচ্চা এই সময়ের মধ্যে চলাচলের মাধ্যম হিসেবে অন্য কোন পন্থাকেও বেছে নিতে পারে – যেমন বসে থেকে হাত এবং পায়ের সাহায্যে শরীরকে টেনে নিয়ে যাওয়া (Bottom shuffling), পেটের উপর দিয়ে হড়কে চলা অথবা পুরো ঘর জুড়ে গড়িয়ে বেড়ানো।
ওর স্টাইল নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই, ও যে সচল হয়েছে এইটাই সবচাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ, কিভাবে করছে সেটা কোন বড় ব্যাপার না। আবার অনেক বাচ্চা আছে যারা হামাগুড়ি না দিয়েই দাঁড়ায়, সাহায্য নিয়ে হাঁটার চেষ্টা করে এবং হাঁটতে শুরু করে দেয়।
১৯৯৪ সালে “চিৎ করে ঘুমানো” এর প্রচারাভিযানটি যখন শুরু হয়েছিল, তখন থেকে অনেক বাচ্চারাই হামাগুড়ি দেয় বেশ দেরী করে এবং এরমধ্যে আবার অল্প সংখ্যক এটাকে এড়িয়েও যায় (এই প্রচারাভিযানের লক্ষ্য ছিল শিশু মৃত্যুর প্রবণতা সম্পর্কিত (SIDS) ব্যাপারগুলোতে বাবা-মায়েদের সতর্ক করা যাতে উনারা বাচ্চাদের চিৎ করে শোয়ায়)।
আপনার সন্তান যদি শরীরের উভয় পাশের হাত এবং পা সমানতালে নাড়াতে পারে এবং সেগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় তৈরি করতে পারে, তাহলে আপনার চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
[ আরও পড়ুনঃ ঘুমানোর সময় শিশুকে কিভাবে শোয়ানো নিরাপদ ]
শিশুরা কিভাবে হামাগুড়ি দিতে শিখে
কোন কিছুর সাহায্য ছাড়াই খুব ভালোভাবে বসতে শেখার পরপরই মূলত আপনার বাচ্চা হামাগুড়ি দিতে শুরু করবে (খুব সম্ভবত ৮ মাস বয়সের মধ্যেই এটা ঘটবে)। এর পরই, ও মাথা তুলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে পারবে, এবং ওর হাত, পা এবং পিঠের মাংসপেশি যথেষ্ট শক্তিশালী হবে এবং ওর ভার রক্ষা করতেও সক্ষম হবে যখন ও হাঁটু আর হাতের উপর ভর দিয়ে উঠবে।
আর মাস দুয়েকের মধ্যেই, ধীরে ধীরে আপনার সন্তান বসার পজিশন থেকে চার হাত পায়ের উপর ভর দিয়ে উপুড় হতে পারবে। ৯ কিংবা ১০ মাসের সময়কালে, ও বুঝে যাবে যে ও যখন ওর হাঁটু দিয়ে ধাক্কা দিয়ে তখন এটা ওকে আরো বেশী শক্তি যোগায় চলাচলে। দক্ষতা বাড়ার সাথে সাথে, বসার পজিশন থেকে হামাগুড়ি দেয়া এবং হামাগুড়ির পজিশন থেকে বসার পজিশনে ফিরে আসাটা ওর রপ্ত হয়ে যাবে।
এরপর ও আরো উন্নত কৌশল রপ্ত করে ফেলবে যা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম সিয়ার্সের ভাষায়, “ক্রস-ক্রলিং” বা চলাচলের সময় একইপাশের হাত এবং পা নাড়ানোর বদলে, একটা হাত এবং হাতটার বিপরীত দিকের পা’টা একসাথে নাড়াবে। তারপর, অনুশীলনই ওকে পারফেক্ট ভাবে গড়ে তুলবে। এক বছর বয়সের মধ্যেই দেখবেন হামাগুড়িতে ও যথেষ্ট দক্ষ হয়ে উঠবে।
শিশুকে হামাগুড়ি শেখাতে আপনি কতটুকু সাহায্য করতে পারেন
টামি টাইমঃ শুরু থেকেই, এমনকি হামাগুড়ি দেয়ার আরো আগে থেকেই, আপনার সন্তানকে অনেক বেশী টামি টাইমের সুযোগ দিন। আপনার শিশুকে ওর পেটের উপর শুইয়ে দিন যখন ও জাগ্রত ও সজাগ থাকে এবং সে অবস্থাতেই প্রতিদিন কয়েক মিনিটের জন্য ওর সাথে খেলাধুলা করুন; এতে করে হামাগুড়ি দেয়ার জন্য ওর দৈহিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে। বাচ্চাকে এভাবে প্রতিদিন কিছুক্ষণ উপুড় করে শুইয়ে রাখলে বাচ্চার মাথার পেছনের দিক সমান হয়ে যাওয়ার সমস্যা ও কম হয়।
নড়াচড়ায় উৎসাহ প্রদানঃ হামাগুড়ি দেয়া শেখানোতে সবচাইতে ভালো অনুপ্রেরণা হচ্ছে – বাচ্চার হাতের নাগালের বাইরে ওর পছন্দের খেলনা (এমনকি আপনার নিজেকেও) এবং অন্যান্য বস্তু নিয়ে রাখা – যাতে ও নিজে নিজে পৌঁছাতে পারে এবং আঁকড়ে ধরতে পারে।
আমেরিকান একাডেমী অফ পেডিয়াট্রিক্স (এএপি) এর মতে, বালিশ, নরম বাক্স কিংবা সোফার কুশন দিয়ে বাধা তৈরি করা যেতে পারে যাতে সেটা অতিক্রম করার স্পৃহা জাগে। এটা ওর আত্মবিশ্বাস, গতি এবং ওকে চটপটে করে তুলতে সাহায্য করবে।
তবে কোনভাবেই ওকে একা ছেড়ে দিবেন না – কেননা একবার যদি ও বালিশের নীচে বা বাক্সের নীচে আটকা পড়ে যায়, তাহলে ও ভয় পেয়ে যাবে এবং সেটা তার জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
চাইল্ডপ্রুফ (শিশু নিরাপত্তা) – একটা হামাগুড়ি দিতে জানা বাচ্চা অনেক ধরনের দুষ্টুমি করতে পারে। সবার আগে নিশ্চিত করুন যে আপনার বাসা চাইল্ডপ্রুফ বা শিশুর জন্য নিরাপদ, এজন্যে সবার প্রথমেই বিশেষ করে আপনার বাসা যদি দ্বিতল বিশিষ্ট হয় তাহলে সিঁড়িতে দরজা ব্যবহার করুন।
সিঁড়ির ধাপগুলো কিন্তু আপনার বাচ্চার জন্য খুবই আকর্ষণীয় হবে, তবে সেগুলো কিন্তু অত্যন্ত বিপদজনক, তাই ওদেরকে চোখে চোখে রাখুন যতদিন অবধি না ওরা হাঁটাচলায় দক্ষ হয়ে যায় (সাধারণত তা ১৮ মাস বয়সের মধ্যেই হয়)। এমনকি এরপরও, ওদেরকে খুব সতর্কতার সাথে চোখে চোখে রাখতে হবে।
তবে এখনের জন্য, এএপির উপদেশ মোতাবেক অনুশীলনের জন্য এবং ভবিষ্যৎ দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ফোমের সিঁড়ি বা শক্ত কার্ডবোর্ড দিয়ে বানান সিঁড়ি দিতে পারেন তবে তা অবশ্যই কাপড় দিয়ে মোড়ান থাকবে যাতে ব্যথা না পায়।
আপনার শিশু যদি হামাগুড়ি না দেয় তাহলে কি করবেন?
একেকজন বাচ্চার বিভিন্ন দক্ষতা অর্জনের পদ্ধতি এবং সময় ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু আপনার বাচ্চা যদি কোন ধরনের নড়াচড়ায় (তা হোক ধীরে ধীরে শরীর টানা, হামাগুড়ি দেয়া, গড়ানো বা এই জাতীয় কিছু) ন্যূনতম আগ্রহ না দেখায়, যদি সে হাত পা একসাথে নাড়ানোর সময় সমন্বয় রাখতে না পারে এবং যদি এক বছর বয়সের কাছাকাছি সময়ে দু হাত এবং পায়ের ব্যাবহার রপ্ত করতে না পারে তবে আপনার ডাক্তারের সাথে এ বিষয়ে কথা বলুন।
তবে মনে রাখবেন প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এ সব মাইলস্টোনে পৌঁছাতে অন্যদের চাইতে বেশী সময় লাগতে পারে।
আপনার বাচ্চার হামাগুড়ি দেয়ার পরের ধাপ কি?
আপনার বাচ্চা হামাগুড়ি দেয়াতে দক্ষ হওয়ার পর, ওর আর ওর গতিময়তার মধ্যে কেবল একটা ব্যাপারই বাকি রয়ে যাবে আর তা হচ্ছে হাঁটা। এরই ধারাবাহিকতায়, যে কোন কিছুর কাছে গেলেই সেটা ধরে নিজেকে টেনে তুলতে চাইবে, হোক তা টেবিলের পায়া কিংবা আপনার পরিবারের কারোর পা।
পায়ের ভারসাম্যতার অনুভব যদি একবার ও বুঝতে পারে, তাহলে ও নিজে থেকেই দাঁড়ানোর জন্য একদম প্রস্তুত হয়ে যাবে এবং আসবাবপত্র ধরে হাঁটার চেষ্টা শুরু করে দিবে। তারপর এটা শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার যখন ও হাঁটবে, লাফাবে, দৌড়াবে।
শিশুর অন্যান্য মাইলস্টোনগুলো সম্পর্কে পড়ুন-
- বাচ্চা কোন বয়স থেকে উপুড় হতে বা গড়াতে শেখে?
- বাচ্চা কোন বয়স থেকে বসতে শেখে?
- বাচ্চা কোন বয়স থেকে দাঁড়াতে শেখে?
- শিশুর হাঁটতে শেখা
সবার জন্য শুভকামনা।